Alapon

তুরস্কের ২০২৩ নির্বাচনঃ একনায়কতন্ত্র বনাম গণতন্ত্রের অঘোষিত এক লড়াই



তুরস্কের বিগত ১০০ বছরের রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আজ ১৪ ই মে। কেবল তুরস্কই নয় সমগ্র দুনিয়া মুখিয়ে আছে নির্বাচনের ফলাফলের জন্য৷ একদিকে কামাল আতাতুর্কের পর ইতিহাসের অন্যতম ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট রেজেপ তায়্যিপ এরদোয়ান, অন্যদিকে এরদোয়ানের প্রতিপক্ষ প্রধান বিরোধীদলের নেতা কেমাল কিলিচদারওলু৷ নির্বাচনে এ দুটি নাম কেবল নামই নয়, দেশটির আগামীর ভবিষ্যত কেমন হবে সেটাও এই দুটি নামের উপরই নির্ভর করছে৷ দুটি প্রধান জোটের দু-মেরুর একপ্রান্তে রয়েছেন, একনায়ক ব্যবস্থার পিরামিডের উপর দাঁড়িয়ে থাকা এরদোয়ান, অপরদিকে গণতন্ত্র ও ন্যায়ব্যবস্থার স্লোগান দিয়ে এগিয়ে যাওয়া "তার্কিশ গান্ধী" হিসেবে খ্যাত কেমাল কিলিচদারওলু।
নির্বাচন নিয়ে অনেক জল্পনা কল্পনার অবসান হবে আজ রাতে। তবে সাম্প্রতিক জরিপের বিবেচনায় নির্বাচনে পরবর্তী রাউন্ডে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। গতকালের পূর্বেও এরদোয়ান ও কেমাল কিলিচদারওলু কারোরই ৫০% এর বেশী ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা তেমন ছিলনা বললেই চলে। তবে গতকাল ৪ প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর একজন নিজেকে প্রার্থীতা থেকে সরিয়ে নিলে নির্বাচন প্রথম রাউন্ডেই শেষ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছেন। তবে সেক্ষেত্রে এরদোয়ান এখনো এগিয়ে রয়েছেন ধর্মপ্রাণ মানুষের সহানুভুতির কারণে। যদিও তা সামান্য ব্যবধানে। বিগত কয়েক বছরে ২০২৩ এর নির্বাচন নিয়ে যে পরিমাণ জল ঘোলা হয়েছে, মেরুকরণ চরম পর্যায়ে যেভাবে উপনীত হয়েছে, তুরস্কের ইতিহাসে তার নজির কখনো পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ!

নির্বাচনের জোটসমূহঃ
দুটি প্রধান জোটই এই নির্বাচনের মুখ্য প্রতিদ্বন্দ্বী যদিও অন্য আরেকটি জোট রয়েছে, যাকে বিশ্লেষকেরা তেমন গণনায় ধরছেন না তাদের কট্টর নীতির কারণে। বিরোধীজোট সকল ক্ষেত্রে আলোচনায় কেননা তুরস্কের রাজনীতিতে এই দলসমূহের আদর্শিকভাবে তেমন মেলবন্ধন না থাকলেও শুধুমাত্র দেশকে একনায়ক শাসনব্যবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্য জোটবদ্ধ হয়েছে ৬ টি রাজনৈতিক দল। বিরোধী জোট "মিল্লেত ইত্তেফাক বা জাতীয় ঐক্য" হিসেবে পরিচিত, যেখানে রয়েছে তুরস্কের জাতির পিতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের দল সিএইচপি, জাতীয়তাবাদী দল ইয়ি পার্টি (গুড পার্টি), তুরস্কের প্রধান ইসলামপন্থী দল সাদেত পার্টি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী আদনান মেন্দেরেসের দল ডেমোক্রেট পার্টি, এরদোয়ানের এক সময়ের সহকর্মী ও সফল প্রধানমন্ত্রী আহমেদ দাউদওলুর দল গেলেজেক পার্টি (ভবিষ্যত পার্টি), এবং এরদোয়ানের অর্থনৈতিক উন্নতির প্রধান হাতিয়ার হিসেবে পরিচিত, সাবেক অর্থমন্ত্রী আলী বাবাজানের দেভা পার্টি।
অপরদিকে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানও তার জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়া দরুণ আরও ৫ টি দলের সাথে জোট করেছেন। সরকারী এই জোটে এরদোয়ানের জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একে পার্টি) সহ রয়েছে জাতীয়তাবাদী দল, বিবিপি, ইয়েনিদেন রেফাহ পার্টি, হুদা-পার পার্টি ও ছোট্ট একটি বামপন্থী দল।

২০২৩ এর এই নির্বাচন ক্ষমতাসীন দল একে পার্টি ইতিহাসের অন্যতম কঠিন এক নির্বাচন। বিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ জোটকে এভাবে কখনো মোকাবেলা করতে হয় নি এরদোয়ানের। বিরোধীরা জয়ের জন্য যুবসমাজকে কেন্দ্র করে প্রচারণা চালাচ্ছে অন্যদিকে সরকারী দল সরাসরি ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে।

নির্বাচনে যে বিষয়গুলোকে জনগণ প্রাধান্য দিবেঃ
ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত অর্থনীতি, এক ব্যক্তির শাসনব্যবস্থা, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, শাসনব্যবস্থার অবনতি এমন অনেক বিষয় রয়েছে যা নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তবে এসব মৌলিক বিষয়সমূহকে এড়িয়ে সরকারী দল সরাসরি ধর্মকে নিজেদের জয়ের একমাত্র সম্বল হিসেবে দাড় করাচ্ছে।

একব্যক্তির শাসনঃ
২০১৭ সালে তুরস্ক সংসদীয় ব্যবস্থা থেকে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়। যেখানে আমেরিকার আদলে রাষ্ট্র পরিচালিত হওয়ার কথা থাকলেও বিচারব্যবস্থা সম্পূর্ন পক্ষপাতদূষ্ট বলে অভিযোগ বিরোধীদের। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজ থেকে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারছে না। অতি ছোট্ট বিষয়েও প্রেসিডেন্টের সরাসরি নির্দেশের অপেক্ষা করতে হচ্ছে। সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে সেনাবাহিনীও অনতিবিলম্বে উদ্ধারকার্যে নামতে পারে নি। প্রায় দুদিন পর সেনাবাহিনী সম্পূর্ণরূপে উদ্ধারকার্যে নামতে সক্ষম হয়েছিল। যার দরুণ প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীনও হতে হয়েছে এবং প্রেসিডেন্ট নিজের ভুল স্বীকারও করেছেন এবং জাতির নিকট ক্ষমাও চেয়েছেন। এছাড়াও রেড ক্রস যেখানে বিনামূল্যে সাহায্য করার কথা ছিল জনগণকে সেখানে তারা ব্যবসায় নেমেছিল যার জনগণের মধ্যে অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু স্বজনহারা ব্যক্তিদের জমে থাকা ক্ষোভ যে ব্যালট বাক্সে প্রতিফলিত হবে তা নিশ্চিত। এ বিষয়টিকে খুব শক্তভাবে ধরেছে বিরোধী জোট।

অর্থনৈতিক দুরবস্থাঃ
মূল্যস্ফীতির দিক দিয়ে তুরস্ক আজ পৃথিবীর দ্বিতীয় অবস্থানে। আর্জেটিনার অবস্থান প্রথমে হলেও তুরস্কের অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের দাবী, দেশটির মূল্যস্ফীতি ৩০০% ছাড়িয়ে গিয়েছে যদিও সরকারী তথ্য অনুযায়ী তা কেবল ৮৫%। বাজার যেন এক আগুনে পরিণত হয়েছে, যে আগুনে দ্বগ্ধ নিম্ন ও মধ্যবিত্তেরা। উচ্চমধ্যবিত্তেরাও যে আগুনের প্রচন্ড উত্তাপ অনুভব করছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সাধারণত কোন দেশে যেখানে বছরে নির্দিষ্ট পরিমাণ মূল্যস্ফীতি হয়, সেখানে তুরস্কে অর্ধ-বাৎসরিক তো দূরে থাক, প্রতিদিনই দ্রব্যমূল্যের লাগাম হাতছাড়া হচ্ছে। তার উপর রয়েছে তুরস্কের বাজেটের কয়েকগুণ ঋণের বোঝা। যা প্রত্যক্ষভাবে তুরস্কের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলছে। আমদানী ও রপ্তানী মধ্যকার ফারাক প্রায় শত বিলিয়ন ছাড়িয়ে গিয়েছে।
একই সাথে জীবনযাত্রার মানের ব্যপক অবনমন জনরোষের প্রধান কারণ। যার কারণে এক সময়ের ৪৯% ভোট আদায়কারী একে পার্টি বর্তমানে ৩০% এ নেমে এসেছে।

ধর্ম তথা ইসলামঃ
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এবং ধর্ম অনেকটা সম্পূরকই বলা চলে। তার দলের সমর্থকদের নিকট তিনি সুলতান হিসেবেই বিবেচিত। এমনকি ধর্মপ্রাণ মানুষের নিকট তার এরকমই এক প্রতিচ্ছবি রয়েছে। পৃথিবীর নির্যাতিত মুসলিমদের পক্ষে কথা বলে নিজের দেশের মানুষের সহানূভূতি দুহাত ভরে আদায় করে নিয়েছেন এরদোয়ান। সাম্প্রতিক সময়ে আয়া সোফিয়া মসজিদকে জাদুঘর থেকে মসজিদে রূপান্তরিত করার ফলে ধর্মপ্রাণ মানুষের নিকট তিনি মাসীহা হয়ে উঠেছেন এবং তাকে সেভাবেই দেখা হয়।

দুই জোটের নির্বাচনী কৌশলঃ
এরদোয়ানের ২০ বছরের শাসনামলে, বিগত ১৮ টি নির্বাচনের মতোও এই নির্বাচনকেও ইসলামকে বাচানোর একমাত্র হাতিয়ার হিসেবে তুলে ধরছে তার দল। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের মতে- বিরোধীজোট ক্ষমতায় আসলে ইসলাম দেশ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এবং মদে সয়লাব হয়ে যাবে দেশ। ইসলামী শিক্ষা নিষিদ্ধ হবে, মসজিদ বন্ধ করা হবে, আযান পরিবর্তিত হয়ে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। যদিও ১৯৫০ পূর্ববর্তী এসকল ঘটনার জুজু এরদোয়ান এই প্রথম দেখাচ্ছেন না, ২০০২ পরবর্তী প্রতিটি নির্বাচনে ইসলামকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন। তুরস্কের রাজনীতিতে তা নতুন কোন ঘটনা নয়। পূর্বে আদনান মেন্দেরেস, সুলেমান দেমিরেল এবং তুরগুত ওজালরাও এই একই ভয় দেখিয়ে ধর্মভাবাপন্ন মানুষের ভোট নিজের দিকে নিয়েছেন। বলা বাহুল্য, ১৯৫০ এর পর থেকে তুরস্কের রাজনীতিতে সেক্যুলর সিএইচপি সর্বসাকুল্যে মাত্র ৫ বছর ক্ষমতায় ছিল যেখানে ১ বছর ইসলামী দল মিল্লি সালামেত পার্টির সাথে কোয়ালিশন ছিল ১৯৭৪ সালে।
অপরদিকে বিরোধীজোট জনগণের মৌলিক সমস্যাসমূহকে নিজেদের মেনিফেস্টোতে প্রাধান্য দিচ্ছে। কর্মসংস্থান, চাকুরীর ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা, জীবনমানের উন্নয়ন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয়সমূহকে নিশ্চিত করার ওয়াদা করছে। যুবসমাজের নিকট বিরোধীজোট নিজেই একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বার্তা দিচ্ছে বলে দাবী করছে বিরোধী জোট। কেননা ১৯৭৪ সালের পর এই প্রথম কট্টর ইসলামপন্থী দল সাদেত পার্টি এবং কট্টর সেক্যুলার দল হিসেবে খ্যাত প্রধান বিরোধী দল সিএইচপি জোটের অন্যতম প্রধান শরীক। এমনকি বিরোধীজোটের প্রার্থী কেমাল কিলিচদারওলুর ঘোষণা আসে ইসলামী এই দলের প্রধান কার্যালয় থেকে যেখানে বিরোধীজোটের প্রধানেরা উপস্থিত থাকেন এবং বিরোধীজটের প্রার্থী হিসেবে কেমাল কিলিচদারওলুর নাম ঘোষণা করেন সাদেত পার্টির প্রধান তেমেল কারামোল্লাওলু। বিপরীত মেরুর দুটি দল দেশের স্বার্থে যখন এক হতে পারে, তখন দেশের ভবিষ্যত নিয়ে যুবসমাজ অনেকটাই আশাবাদী।

যুবসমাজের প্রধান দাবী হচ্ছে কর্মসংস্থান। কেননা যে কোন সময়ের তুলনায় বেকারত্বের হার রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছে। যুবসমাজকে কর্মসংস্থানের বিভিন্ন ওয়াদা দুপক্ষই করছে। তবে সরকারী দলের ওয়াদাসমূহ নির্বাচনে পূর্বেই বাস্তবায়ন কেন করা হচ্ছে না সে প্রশ্ন করে আসছে যুবসমাজ।

জনগণ আজ কী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা রাত পোহালেই জানা যাবে। পুরো তুরস্ক আজ দুটি মেরুতে বিভক্ত। এক মেরুতে গণতন্ত্রের মশালবাহী তার্কিশ গান্ধী অপরপ্রান্তে রয়েছেন ইসলামকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে এক ব্যক্তির শাসনব্যবস্থাকে আরও মজবুক করার অপেক্ষায় থাকা এক প্রেসিডেন্ট।
ইতিহাসের অন্যতম কঠিন এক পরিস্থিতিতে কঠিন এক সিদ্ধান্তের মুখে তুরস্কের জনগণ। জনগণের সামনে এখন দুটি রাস্তা। একদিকে বিগত ২০ বছরের ধারাবাহিকতা ধরে রেখে এক ব্যক্তির শাসন ব্যবস্থাকে মেনে নিয়ে একনায়কতন্ত্রের সোপানকে আরও মজবুত করা। অন্যদিকে, "তার্কিশ গান্ধীর" হাত ধরে তুরস্কের প্রজাতান্ত্রিক শতবর্ষে গণতন্ত্রের রাস্তাকে সুগম করা।

সময়ই বলে দিবে তুরস্কের ভাগ্যের কাটা আজ কোন পার্শ্বে ঘুরবে !!

পঠিত : ৫৯৭ বার

মন্তব্য: ০