Alapon

তুরস্কের রাজনীতির অন্তর্দহনঃ এরদোয়ান বনাম তুরস্কের নতুন গান্ধী



ইতিহাসের এই প্রথম প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের বিরুদ্ধে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দিতে কাউকে দেখল তুরস্কের রাজনীতি। তুরস্কের ইতিহাসের অন্যতম সফল রাজনীতিবীদ এরদোয়ানের জনপ্রিয়তা, কৌশল এবং স্ট্র্যাটেজির ধারেকাছেও নেই কোন রাজনীতিক বর্তমান তুর্কি রাজনীতিতে। গতকালই প্রথম প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের একদম ঘাড়েই নিঃশ্বাস ফেলছিলেন তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কেমাল কিলিচদারওলু। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান প্রশাসন, মিডিয়া, নির্বাচন কমিশন সবকিছু ব্যবহার করে ব্যর্থ হয়েছেন ৫০% এর বেশী ভোট আদায় করতে। ২০ বছরের অধিক সময় ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থানকারী এরদোয়ানের জন্য গতকালের নির্বাচনের ফল অনেক বড় একটি ধাক্কা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কেননা এই প্রথম প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান প্রথম ধাপে জয় আনতে সক্ষম হন নি।

নির্বাচনের ফলাফলঃ
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে চারপ্রার্থীর মধ্যে ১ জন নির্বাচনের ঠিক পূর্বে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলেও ব্যালট বাক্সে চারজনেরই নাম ছিল। নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ৪৯.৫১% ভোট অর্জন করলেও তার প্রধান বিরোধীপ্রার্থী কেমাল কিলিচদারওলু পান ৪৪.৮৮%। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন সিনান ওয়ান ৫.১৭% ভোট নিয়ে।


তবে পার্লামেন্ট নির্বাচনে দল হিসেবে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের দল একে পার্টির ভোটে ব্যাপক অবনমন হয়েছে। ২০১৮ এর নির্বাচনে যেখানে তার দল পেয়েছিল ৪২% ভোট, গতকালের নির্বাচনে তা নেমে দাঁড়িয়েছে ৩৫ শতাংশে। সরকারী জোটের অন্যতম শরীক দল জাতীয়তাবাদী দল ১০% ভোট নিয়ে পূর্বের অবস্থানেই রয়েছে। তবে জোটের অন্যদল ইয়েনিদেন রেফাহ পার্টি ২.৮২% ভোট নিয়ে চমক দেখিয়েছে।
অন্যদিকে প্রধান বিরোধীদল সিএইচপি পেয়েছে ২৫.৩৩% ভোট এবং তার শরীক ইয়ি পার্টি পেয়েছে ৯.৬৯% ভোট। কুর্দিদের জনপ্রিয় দল সবুজ বাম দল পেয়েছে ৮.৮১% ভোট।
জোট হিসেবে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের জোট ৪৯.৪৬% ভোট অর্জন করেছে এবং বিরোধীজোট অর্জন করেছে ৩৫.০২% ভোট।

নির্বাচনের সমীকরণঃ
উল্লেখ্য গতকাল দুইটি নির্বাচন হয়েছে তুরস্কে একইসাথে। জনগণ দুটি ব্যালটে নিজেদের ভোট প্রদান করেছেন। একটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য অন্যটি সংসদীয় নির্বাচনের জন্য। সংসদীয় নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তন হবে না। তবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোন প্রার্থীই ৫০% এর অধিক ভোট অর্জন করতে না পারায় সর্বোচ্চ ভোট অর্জনকারী দু প্রার্থীর মধ্যে আবারও নির্বাচন হবে দ্বিতীয় ধাপে। আগামী ২৮ শে মে অনুষ্ঠিত হবে দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচন।
সেখানেই নির্ধারিত হবে কে হবেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট। সুলতান এরদোয়ান নাকি তার্কিশ গান্ধী কামাল কিলিচদারওলু।

তুরস্কের সরকার প্রেসিডেন্সিয়াল সিস্টেমের অধীন হওয়ার কারণে সংসদীয় নির্বাচনের চেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বহুগুণে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা প্রেসিডেন্ট একক ক্ষমতার অধিকারী বর্তমান সরকার ব্যবস্থা অনুযায়ী। দেশের যেকোন বিষয়ে সংসদের কোন প্রভাব নাই বললেই চলে বর্তমানে। বিগত ৫ বছরে সংসদের কোন কার্যকারীতা তুরস্কের জনগণ দেখেছে কিনা সন্দেহ।
প্রতিটি বিষয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সরাসরি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। রাতের আধারে পদের অদল বদল করেছেন, আইন পরিবর্তন করেছেন। সোজাকথায় বর্তমানে তুরস্কে একমাত্র ক্ষমতা কেবল প্রেসিডেন্টের রয়েছে। বাদবাকী সবই লোক দেখানো।

নির্বাচনের মূল বিষয় ছিল এটি। এক ব্যক্তির শাসনব্যবস্থা থেকে সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় পুনরায় ফিরে যাওয়ার লড়াই বা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াই। সেই লক্ষ্যে তুরস্কের রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে প্রধান ও সম্ভাবনাময় দলগুলো নিজেদের মধ্যে জোট করে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের এক ব্যক্তির শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য। তবে জনগণ বিরোধীদের এই দাবীকে কতটা গ্রহণ করেছে তার সম্পূর্ন চিত্র বুঝা যাবে আগামী ২৮ শে মে দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে।
অবশ্য সংসদীয় নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ও তার জোটকে প্রদান করেছে জনগণ। তবে সংসদ তেমন কার্যকরী প্রতিষ্ঠান না হওয়ার কারণে সকল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু আগামী ২৮ শে মে'র নির্বাচন।

সুলতান এরদোয়ান বনাম তার্কিশ গান্ধীর লড়াইঃ
গতকালের নির্বাচনে লড়াইটা হয়েছে মূলত তুরস্কের প্রবীন এবং যুবসমাজের মধ্যে। তুরস্কে বয়স্ক ও প্রৌঢ় ব্যক্তিদের সকলেই এরদোয়ান ভক্ত এবং তাদের চোখে তিনি ইসলামের রক্ষক, মসীহা ও সুলতান।
অন্যদিকে যুবসমাজের নিকট কামাল কিলিচদারওলু তুরস্কের নতুন গান্ধী। যার রয়েছে ভদ্র ভাষা, কোমল আচরণ, রাজনৈতিক নোংরামীর উর্ধ্বে উঠা উত্তম পরিভাষা।
প্রবীনদের নিকট যতযাই হোক না কেন সুলতানকে ক্ষমতায় বসানোর প্রবল আবেগ কাজ করছে, অন্যদিকে তরুণদের মধ্যে রয়েছে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীনতা, চাকুরীর অভাব, জীবনমানের অবনমণের আক্রোশ।



প্রবীনদের চোখে বিরোধীপ্রার্থী কামাল কিলিচদারওলু অমুসলিম। নবীনদের চোখে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান দুর্নীতির সহায়ক। প্রবীনদের চোখে কামাল কিলিচদারওলু আমেরিকার মদদপুষ্ট। যুবসমাজের চোখে এরদোয়ান একনায়ক, জনগণকে টেলিভিশনের সামনে আচ্ছামতো গালি দেয়া এক প্রেসিডেন্ট। প্রবীনদের নিকট এরদোয়ান ও ইসলাম সমার্থক। নবীনদের নিকট কামাল কিলিচদারওলু ও ভবিষ্যত গণতন্ত্র সমার্থক।

দুপক্ষের রাজনৈতিক অভিযোগ ও পালটা অভিযোগের উত্তপ্ত কড়াইয়ের ফুটন্ত তেলের উপর ঝুলে আছে ২৮ শে মে'র নির্বাচন।

সেখানেই নির্ধারিত হবে কে হবেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট। সুলতান এরদোয়ান নাকি তার্কিশ গান্ধী কামাল কিলিচদারওলু।

পঠিত : ৬০২ বার

মন্তব্য: ০