Alapon

আজ ভূমির অধিকার ফিরে পাওয়ার দিন



আজ ১৬ মে। জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির দিন।

'পূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ আইন ১৯৫০' তদানীন্তন পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত পূর্ব বাংলার নবগঠিত গণতান্ত্রিক সরকার কর্তৃক গৃহীত একটি আইন ছিল। ১৯৪৮ ইং সনের ৩১ মার্চ পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম দিকে এই বিলটির খসড়া হয়েছিল যা ১৯৫১ ইং সনের ১৬ মে পাস হয়েছিল। এটি আইন সভায় পাস হওয়ার আগে বাংলায় ভূমি রাজস্ব আইনসমূহে ১৭৯৩ ইং সনের স্থায়ী বন্দোবস্ত বিধিমালা ও ১৮৮৫ সনের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ত্ব বিধিমালা প্রযোজ্য ছিল।

বিলটি পাস হওয়ার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলার মানুষ জমিদারদের হাত থেকে রক্ষা পায় ও ভূমির ওপর তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে বাংলার বুকে জেঁকে বসেছিল জমিদারির জগদ্দল পাথর। লর্ড কর্নওয়ালিস প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালুর মাধ্যমে জমিদারী প্রথা চালু করে। এই জমিদারেরাই ছিল ইংরেজদের খাজনা আদায়ের এজেন্ট।

রাষ্ট্রের মধ্যে আরেক রাষ্ট্র হয়ে ওঠা এই জমিদার সম্প্রদায় ছিল হাতেগোনা কিছু মানুষ। আর ছিল তাদের অধীনস্হ কিছু মধ্যস্বত্বভোগী। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ আপামর জনসাধারণের বিশেষত অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বন্দি হয়ে পড়েছিল তাদের কব্জায়। একটা সময় এই জমিদারদের হাতেই পূর্ব বাংলা হয়ে ওঠে কোলকাতার কলোনি। এখানকার গণমানুষকে ভূমিদাসে পরিণত করেই গড়ে উঠেছে আজকের নগর কোলকাতা।

জাতীয় জাগরণের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন বিষয়ে আন্দোলন হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন হয়েছে জমিদারদের বিরুদ্ধেও। ত্রিশের দশকে এই আন্দোলন নতুন গতি পায়। এর প্রেক্ষিতে ১৯৩৬ সালে গঠিত হয় ‘সর্বভারতীয় কৃষক সমিতি’। ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত খাজা নাজিমুদ্দিন বঙ্গীয় সরকারের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। তাঁর বিশেষ উদ্যোগে ১৯৩৫ সালে ‘বঙ্গীয় ঋণ সালিশি বোর্ড’ বিল এবং ১৯৩৬ সালে ‘বঙ্গীয় পল্লী উন্নয়ন বিল’ পাস হয়। এসবের মধ্য দিয়ে রায়ত তথা কৃষক নিজের জমি জমিদারদের কবল থেকে বাঁচানোর সুযোগ পেত।

১৯৩৮ সালে শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক মন্ত্রীসভার উদ্যোগে স্যার ফ্রান্সিস ফ্লাউডকে চেয়ারম্যান করে একটি কমিশন গঠন করা হয়। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করা যুক্তিসঙ্গত কি না সে বিষয়ে রিপোর্ট দিতে বলা হয় তাকে। ফ্লাউড কমিশন ১৯৪০ সালে জমিদারি উচ্ছেদকে ‘আবশ্যক’ বলে মত দেয়। কৃষকদের সরাসরি সরকারের প্রজা করা এবং তাদের উৎপাদিত ফসলের তিনভাগের দুইভাগের মালিকানা প্রদান করার প্রস্তাব দেয় এই কমিশন। পরবর্তীকালে ১৯৪৫ সনের বেঙ্গল এডমিনিস্ট্রিশন এনকোয়ারী কমিটিও একই মত প্রকাশ করে।

পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালের ১০ই এপ্রিল সোহরাওয়ার্দী সরকার ‘বেঙ্গল স্টেট একুইজিশন এন্ড টেন্যান্সী বিল, ১৯৪৭’ সিলেক্ট কমিটিতে প্রেরণ করে। এর মধ্যেই পাকিস্তান গঠিত হয় এবং খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ সরকার গঠন করে। ১৯৪৮ সালের ৩১ মার্চ পুর্ব পাকিস্তানের পার্লামেন্টে ‘জমিদারি উচ্ছেদ ও প্রজাস্বত্ব আইন’ নামে বিল পেশ করা হয়। ১৯৫০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তা পাশ হয়। সর্বশেষ ১৯৫১ সালের ১৬ই মে গভর্নর জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দিন সেটিকে অ্যাক্ট হিসাবে জারি করেন।

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা পাওয়ার পর সাধারণ মানুষ ভূমির অধিকার ফিরে পাওয়ার আশা করেছিলো। সেই আশা বাস্তবায়ন করেছেন বরিশাল ও ঢাকার গণমানুষের নেতা খাজা নাজিমুদ্দিন। ১৯৫১ সালের ১৬ মে তৎকালীন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দিনের এক আদেশে পূর্ব বাংলার বুক থেকে এই জগদ্দল পাথর অপসারিত হয়। এই দিন বাঙালির মুক্তির দিন। জমিদারির করাল থাবা থেকে সাধারণ মানুষের মুক্তির দিন।

এর মধ্য দিয়ে বাংলার মধ্যস্বত্বভোগী এই শোষক শ্রেণি তথা জমিদার সমাজ বিলুপ্ত হয়। তবুও কিছু ছোট ছোট জমিদারির অস্তিত্ব তখন ছিল। যা যুক্তফ্রন্ট সরকার ১৯৫৪ সালে বিলোপ সাধন করে। ১৯৫৬ সালের ১৪ই এপ্রিল ছোটখাটো সেসব জমিদারিও বিলুপ্ত হয়ে যায়।

পঠিত : ৩৮৯ বার

মন্তব্য: ০