Alapon

সুবহে সাদিক



রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মানুষের দেহের মধ্যে এমন একটি অংশ আছে যেটি ভালো থাকলে গোটা দেহ ভালো থাকে। আর এটি খারাপ হলে গোটা দেহই খারাপ হয়ে যায়। সেই অংশের নাম হলো কলব। ভালো থাকা কিংবা খারাপ থাকা তা এর উপরই নির্ভর করে। এজন্য দেখা যায়, যুগে যুগে প্রত্যেক বিশ্বাসী মানুষ এই কলবকে ভালো রাখার চেষ্টা করে যায়। এই চেষ্টাকে বলা হয় আত্মোন্নয়ন প্রচেষ্টা।

“সুবহে সাদিক, আধ্যাত্মিক ও আত্মোন্নয়ন ভাবনা”। বইটি উপমহাদেশের ইসলামী সমাজ সংস্কারের অন্যতম প্রতিকৃত খুররম মুরাদের কতগুলো ভাষণের ইংরেজি সংকলন ‘In the Early hour's’ এর অনুবাদ। বাংলা ভাষায় গ্রন্থটির অনুবাদ করেন অধ্যাপক ড. আবু খলদুন আল-মাহমুদ এবং ড. শারমিন ইসলাম মাহমুদ। এটি মূলত ১৯৯৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ শিক্ষার্থীদের মাঝে দেয়া খুররম মুরাদের কিছু ভাষণের সারসংক্ষেপ।

→বইটি সাত অধ্যায়ে বিভক্ত।

১. আত্মোন্নয়নের প্রক্রিয়া।
২. জিকির পূর্ণ জীবন।
৩. আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্কিত হওয়া।
৪. আল্লাহর রাসূল (সঃ)এর সাথে সম্পর্কিত হওয়া।
৫. আল্লাহ তাআলার পথে ব্যয়।
৬. আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টির সাথে সম্পর্ক।
৭. আল্লাহ তাআলার সাথে সাক্ষাত।

এই সাতটি অধ্যায়ের মধ্যে আবার ৯৪টি সাব-পয়েন্ট রয়েছে। পয়েন্টগুলোর সমষ্টিই হলো “সুবহে সাদিক” বইটি।

→বইয়ের প্রথম অধ্যায়- আত্মোন্নয়নের প্রক্রিয়া।

নিজের আত্মাকে কীভাবে বর্তমান অবস্থা থেকে পরিবর্তন করে আরো উন্নতির দিকে নিয়ে যাওয়া যায় এবং এর প্রক্রিয়াটা কেমন হবে- সে সম্পর্কে তিনি ১১টি পয়েন্টে উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-

জীবনের লক্ষ্য ঠিক করা।

জীবনের লক্ষ্য হিসেবে লেখক বলেছেন, মুমিনদের জীবনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন এবং বেহেশত লাভ করা। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি কিছু পদক্ষেপের কথাও উল্লেখ করেছেন। যেমন-

১. জান্নাত অর্জনে নিজের মনকে নিবদ্ধ করা।
২. নিজের মিশন ঠিক করা। লেখক বলছেন, আপনার লক্ষ্য ঠিক করার পরে আপনার মিশন হবে, একজন মুমিন হওয়ার পাশাপাশি একজন মুজাহিদ হওয়া। এরপর আমাদের মনে হতে পারে একজন মুমিন হওয়ার পাশাপাশি একজন মুজাহিদ হওয়ার জন্য যে মানের ঈমান থাকা দরকার তা আমাদের নেই। এজন্য আমাদের তাজকিয়া তথা অন্তরের পরিশুদ্ধি দরকার হতে পারে। এই পরিশুদ্ধি অর্জনের জন্য কিছু শর্ত রয়েছে। শর্তগুলো হলো-

১. তাজকিয়া এটা নিজের ব্যক্তিগত দায়িত্ব। এটা অর্জনের জন্য নিজেকে এগিয়ে আসতে হবে।
২. তাজকিয়া অর্জনের জন্য নিখাদ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, তাজকিয়া কখনো পরিপূর্ণতা পায় না। এটা সামগ্রিক একটা বিষয়। সারা জীবন ধরে এটা অর্জনের চেষ্টা করে যেতে হবে।
৩. সুদৃঢ় ইচ্ছাশক্তি। এর জন্য দরকার দৃঢ়তা ও অবিচলতা।
৪. আল্লাহ তাআলার উপর নির্ভরতা।
৫. সময়ের সর্বোত্তম ব্যবহার।
৬. তাজকিয়া একটি সার্বিক প্রক্রিয়া। এটা অর্জন করলে এর প্রভাব জীবনের সব ক্ষেত্রে পড়তে হবে।

→দ্বিতীয় অধ্যায়- জিকিরপূর্ণ জীবন।

আল্লাহ তাআলা বলেন, হৃদয় প্রশান্ত হয় আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমে। (সূরা রা'দ-২৮) আর এই বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়টি হলো এই জিকির নিয়ে তথা “জিকিরপূর্ণ জীবন”।

লেখক এই অধ্যায়ে মোট ২৪টি পয়েন্ট নিয়ে কথা বলেছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য পয়েন্টগুলে হলো-

জিকিরের তাৎপর্য। এর মূল কথা হলো, বান্দা কর্তৃক সত্যপথ প্রদর্শনের জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনবাচক আল্লাহ তাআলার নির্ধারিত এবং পছন্দনীয় পথ। পাশাপাশি আল্লাহ তাআলার দয়া ও ক্ষমা অর্জন করার এবং জান্নাত লাভের নিশ্চিত একটি পথ।

জিকিরের অর্থ। জিকিরের মূল অর্থ হলো, মৌখিক উচ্চারণের পাশাপাশি হৃদয় ও আত্মা তার সাথে একাত্ম হয়ে যাওয়া। যা মানুষের জীবন ও কর্মকে পরিশুদ্ধ করে তোলে এবং সামগ্রিক জীবনকে আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা অনুযায়ী পরিচালিত করে।

জিকিরের পদ্ধতি। মূলত দুই ধরনের জিকির আছে।

১. এমন জিকির যেগুলো আমাদের মধ্যে নিত্যদিনে আল্লাহ তাআলার স্মরণকে জাগিয়ে রাখে।
২. এমন সব ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক পর্যায়ের কর্মসূচি- যা প্রথম ধরনের জিকিরের উন্নয়নে ব্যবহৃত হয়।

এগুলো কয়েক ধরনের। যেমন-
১. সর্বদা আল্লাহ তায়ালার স্মরণ। এর জন্য আবার চার ধরনের বোধের কথা বলেছেন। যথা।

ক. নিজেকে বলুন- আমি আল্লাহ তাআলার নিকটে, তিনি আমাকে দেখছেন।
খ. নিজেকে বলুন- আমার যা আছে তার সবই আল্লাহ তা'আলা প্রদত্ত।
গ. নিজেকে বলুন- জগতে কোন কিছুই আল্লাহ তাআলার অনুমতি ছাড়া ঘটতে পারে না।
ঘ. নিজেকে বলুন- একদিন আমাকে আল্লাহ তাআলার নিকট প্রত্যাবর্তন করতে হবে এবং সে দিনটি আজও হতে পারে!

জিকিরের সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি। এটিকেও দুইভাগে ভাগ করা যায়।
১. ব্যক্তিগত
২. সামষ্টিক

১.ব্যক্তিগত জিকিরের মধ্যে রয়েছে-
• ফরজ ইবাদত
• সুন্নাত নামাজ
• সুন্নত রোজা
• আল্লাহ তাআলার পথে সদাকা
• ওমরা হজ
• কুরআন তেলাওয়াত
• ইস্তিগফার

সালাতকে কার্যকর করার জন্য রয়েছে-

• মনস্তাত্ত্বিক ও মানসিক প্রস্তুতি
• শারীরিক প্রস্তুতি

রোজা। রোজার মাধ্যমে যেসব বিষয় আমরা অর্জন করে থাকি, তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-

• আল্লাহ তাআলার ইচ্ছাপূরণ
• ইচ্ছা শক্তি
• শয়তান থেকে আত্মরক্ষা

২. সামষ্টিক জিকিরের পন্থা সমুহ-

ক. সত্য পন্থীদের সঙ্গ অনুসন্ধান।
খ. মানবতার সামনে সত্যের সাক্ষ্য হওয়া।

→তৃতীয় অধ্যায়। আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্কিত হওয়া।

এই অধ্যায়ে দুইটি বিষয়ে কথা বলা হয়েছে।
১. আল্লাহ তাআলাকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করা এবং তার বৈশিষ্ট্য সমুহ।
২. আল্লাহ তাআলাকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সমূহ।

১. আল্লাহ তাআলাকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করার বৈশিষ্ট্য হলো-

• আল্লাহ তাআ'লার শুকর গুজার হওয়া।
• আল্লাহ তাআ'লার ইবাদ।
• আল্লাহ তাআ'লার প্রেম।
• আল্লাহ তাআ'লার পথে হানিফ হওয়া।
• আল্লাহ তাআ'লার পথে সংগ্রাম।

২. আল্লাহ তাআলাকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সমূহ।

• অহংকার
• মুনাফেকি
• হতাশাবাদ
• অনিয়ন্ত্রিত জিহ্বার অপব্যবহার
• যৌন লালসা

→চতুর্থ অধ্যায়- রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সম্পর্কিত হওয়া।

এখানে সুন্নাহর প্রকৃত অর্থ, মুমিন জীবনে সুন্নাহর গুরুত্ব, রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিশন, আমাদের মিশন এবং সুন্নাহ অধ্যয়নের কিছু নির্দেশনা দিয়ে এই অধ্যায়টি শেষ করা হয়। এখানে রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিশনে তাঁর মোট ১৬ টি দায়িত্বের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

→পঞ্চম অধ্যায়- আল্লাহর পথে ব্যয়।

আল্লাহর পথে ব্যয়টা কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে হবে ছোট্ট একটা তালিকাসহ তা আলোচনা করে এই অধ্যায়টি শেষ হয়।

→ষষ্ঠ অধ্যায়- আল্লাহ তাআলার সৃষ্টির সাথে সম্পর্ক।

আল্লাহ তাআলার সাথে শরিক করা ব্যতিত আমাদের মূলত দুই ধরনের অধিকার থাকে।

১. আল্লাহর অধিকার
২. বান্দার অধিকার

রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন, হাশরের ময়দানে উপস্থিত হওয়ার পূর্বেই তোমরা পরস্পরের অধিকারগুলো প্রদান কর অথবা ক্ষমা চেয়ে নাও। কারণ, আল্লাহ তাআলা কাউকে বান্দার অধিকারগুলো ক্ষমা করবে না। এগুলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ক্ষমা করতে হবে।

এই অধ্যায়ে বান্দার সেই সমস্ত অধিকারগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। যেমন-

• পরিবারের প্রতি দায়িত্ব
• সন্তানের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য
• পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য
• মুসলিম ভাই-বোনদের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য
• মালিক ও শ্রমিকের পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য
• প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব
• জীবজন্তুর অধিকার

এই অধ্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- কোন্ কোন্ বিষয়ে পরিবারের মতামত নিতে হবে ১০টি পয়েন্টে তার একটি তালিকা দেয়া হয়েছে এবং মুসলিম ভাই-বোনের সাথে সম্পর্কের ভিত্তি কী হবে-সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে ২৮টি পয়েন্ট উল্লেখ করেছেন।

→সপ্তম অধ্যায়- আল্লাহর সাথে সাক্ষাত।

পরকালের প্রতি আমরা যেসব বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাস রাখি তাঁর মধ্যে অন্যতম হলো- আল্লাহর সাথে সাক্ষাত। এই বইয়ের শেষ অধ্যায়টিও সে ব্যাপারে। এখানে জীবনের লক্ষ্য, পরকালের বাস্তবতা, মৃত্যু নিশ্চিত ও অনিবার্য, মানুষের পরকাল ভুলে যাওয়ার প্রবণতা, আল্লাহ তাআলার দয়া অন্বেষণ, আত্ম-মূল্যায়ন এবং মৃত্যু-ভয়কে জয় করার পরামর্শ দিয়ে অধ্যায়টি শেষ করেন।

এই বইয়ের যে বিষয়গুলো আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে তা হলো-

• প্রত্যেক পয়েন্টের আলোকে বিভিন্ন সাব পয়েন্ট দিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, যা সহজে মনে রাখা যাবে এবং আমল করতে যে কারো সহজ হবে।

• প্রতিটি পয়েন্টেই কয়েকটি করে কুরআন এবং হাদিসের রেফারেন্স নিয়ে আসা হয়েছে, যা জ্ঞান অর্জনের মূল উৎসও বটে।

• সবচেয়ে ভালো লাগা বিষয়টি হলো, এই বইয়ের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম পয়েন্টি ছিল জীবনের লক্ষ্য নিয়ে এবং শেষ অধ্যায়ের শেষ পয়েন্টি হলো, মৃত্যু ভয়কে জয় করা। অর্থাৎ আপনি আপনার জীবনের সঠিক লক্ষ্য ঠিক করতে পারলেই চিরন্তন সত্য মৃত্যুকে আপনি সহজভাবে বরণ করে নিতে পারবেন, তা যেন আমাদের স্মরণ করিয়ে দিলেন। শেষ অধ্যায়ের প্রথম পয়েন্টিও ছিল জীবনের লক্ষ্য নিয়ে।

প্রকৃতপক্ষে একজন মানুষের জন্য জীবনের লক্ষ্য ঠিক করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, কোন মানুষ জীবনের লক্ষ্য ঠিক করতে না পারলে তার জীবনটা সম্পূর্ণ এলোমেলো হয়ে যায়। বলা হয়ে থাকে, লক্ষ্যহীন জীবন মাঝি বিহীন নৌকার মতো। এজন্য সফল একটি জীবন গড়ার জন্য জীবনের লক্ষ্য ঠিক করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

আমি মনে করি দুনিয়ায় সফল একটি জীবন অতিবাহিত করার জন্য এবং দুনিয়ায় থেকে পরকালের পুঁজি জোগাড় করার ক্ষেত্রে এই বইটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করবে এবং যে কোন পাঠকই এখান থেকে উপকৃত হতে পারবে, যার মাধ্যমে নিজের জীবনে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধন করতে পারবে বলে বিশ্বাস করি।

আল্লাহ তাআলা বইয়ের লেখক-অনুবাদকসহ এই বইয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে উত্তম জাযা দান করুক।

বইয়ের নাম : সুবহে সাদিক
লেখক : খুররম মুরাদ
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ১৩৬
প্রকাশনী : বিআইআইটি প্রকাশন
বইয়ের মূল্য : ১৩০ টাকা

|| রিভিউ লেখক ||
~জাহেদুল ইসলাম

পঠিত : ৩৩৭ বার

মন্তব্য: ০