Alapon

বুক রিভিউ : সংঘাতের মূখে ইসলাম


সংঘাতের মূখে ইসলাম
লেখক : আল্লামা মুহাম্মদ আসাদ
মুহাম্মদ আসাদ- জন্মেছেন অস্ট্রিয়ার এক ইয়াহুদী পরিবারে। পেশাগত কারণে জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটিয়েছেন জাজিরাতুল আরব ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে। আফ্রিকার অনুন্নত দেশের কিছু মানুষকে যেমন পেয়েছেন খুবই অসামাজিক, হিং¯্র এবং নরখাদক হিসেবে এর কাছাকাছি পর্যবেক্ষণের সূযোগ পেয়েছেন মুসলমানদের জীবনাচারকে উপভোগ করার। মুসলমানদের জীবনাচার, পারিবারিক জীবন, তাদের অতিথি পরায়নতা এবং সামাজিক সৌজন্যবোধ তার চিন্তার জগতে তুমুল অলোড়ন তোলে। আরব দেশসমূহে অবস্থানকালে তিনি আরবী ভাষা শেখেন এবং আরবের বিভিন্ন পণ্ডিতের সংস্পর্শে এসে কুরআন হাদীসের গভীর অধ্যয়নের সূযোগ পান। পারিবারিক ইয়াহুদী ধর্ম তার মনের সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে যখন ব্যর্থ হয়েছে তখন তিনি এর জবাব পান কুরআন হাদীসের পাতায়। পশ্চিমা দুনিয়ার আধুনিকতা নামক জৌলুসের মাঝে ভোগ ও আনন্দ লিপ্সার আহŸান থাকলেও তাতে মানুষের জীবনের প্রকৃত সূখ ও সমাধান যে নেই তা তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন খুব কাছ থেকে দেখার মাধ্যমে। সিদ্ধান্ত নেন ইসলামের ছায়াতলে নিজের জীবন আলোকিত করার। এক সময়ের ইয়াহুদী রাব্বী পরিবারের সন্তান হয়ে যান ইসলামের আলোকিত সন্তান। নিজের জীবনের বাকী সময় কাটিয়ে দেন ইসলামকে জানা বোঝা, মানা এবং প্রচারের কাজে। বিংশ শতাব্দীতে যে কয়জন ধর্মান্তরিত মুসলমান দীনের দায়ী হিসেবে গোটা দুনিয়ায় বিখ্যাত হয়েছেন তার মধ্যে মুহাম্মদ আসাদ অন্যতম। তাঁর ক্ষুরধার লেখনী গোটা দুনিয়ায় বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়ে চিন্তাশীল মানুষের হৃদয়ের খোরাক মেটাতে সহায়তা করছে। পাশ্চাত্য সভ্যতার চতুর্মূখী চ্যালেঞ্জ, ক্রুসেডার ও অন্যান্য ইসলাম বিরোধী মহলের নানামূখী ষড়যন্ত্রের মোকাবিলায় মুসলমানদের ভ‚মিকা কি হওয়া উচিৎ লেখক অত্র বইয়ে অত্যন্ত সংক্ষেপে তুলে ধরেছেন। আধুনিক জাহিলিয়াতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে বইটি নতুন চিন্তার খোরাক জোগাবে ইনশাআল্লাহ।
বইটিতে মোট আটটি অধ্যায় আছে, যথাক্রমে
১. ইসলামের মুক্তপন্থা
২. পশ্চিমের ভাবধারা
৩. ক্রেেসডের প্রতিচ্ছায়া
৪. শিক্ষা ব্যবস্থা
৫. পুরনো বিষয়ে অনুরকরণ
৬. হাদীস ও সুন্নাহ
৭. সুন্নাহর প্রাণবস্তু
৮. উপসংহার
প্রথম অধ্যায়ে লেখক যে বিষয়টি আলোকপাত করেছেন তা হচ্ছে, তিনি কিভাবে ইসলামের আলোয় নিজেকে আলোকিত দেখতে পেলেন। তার এই আলোকিত জীবনে ফিরে আসা গভীর জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং বাস্তব উপলব্ধির ফলশ্রæতি। ইউরোপের আলো ঝলমল প্রাসাদ আর কৃত্রিম সূখের মাঝে আন্দ ঝলকানি যে নিরেট নিরানন্দ আর এক ধরনের অসূখ তা তিনি আবিস্কার করলেন তার বাস্তব দর্শনে। এর বিপরীতে মধ্যপ্রাচ্য এবং অফ্রিকার মুসলিম জনবসতিগুলোতে তিনি দেখতে পেলেন জীবনের প্রকৃত সূখ। যা তাঁর চিন্তার জগতকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে। এখানে তিনি লিখেছেন : ‘‘১৯২২ সালে কয়েকটি বিশিষ্ট ইউরোপীয় সংবাদপত্রের বিশেষ সংবাদদাতা হিসেবে এশিয়া ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশ সফর করার জন্য আমি আমার দেশ অস্ট্রিয়া হতে বের হই। তখণ থেকে আমার সবটা সময় কেটেছে ইসলামী প্রাচ্য দেশগুলোতে........... এখানকার জীবনের দৃষ্টিভঙ্গী ইউরেপের ব্যস্ত সমস্ত যান্ত্রিক জীবনের তুলনায় শান্ত সামহিত তথা অধিকতর মানবোচিত’’। এ সফওে তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন, যে ইসলামের শিক্ষা কতটা বাস্তব এবং মজবুত একইসাথে তিনি এ বিষয়টিও উপলব্ধি করতে পেরেছেন, যে বর্তমান দুনিয়ায় মুসলমানদের দুঃখ দুর্দশা আর জিল্লতির জীবনের কারণ এটাই যে, তারা ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা হতে দূরে সরে গেছে।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে লেখক যে বিষয়টি স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছেন, তা হচ্ছে : ধর্ম মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়। আধুনিক দুনিয়া বিভিন্ন বস্তুর সাথে মানুষের সম্পর্ক ও তা ব্যবহারের পদ্ধতি মানুষকে শিখিয়েছে। একটি বস্তু হতে আর একটি বস্তু আবিস্কারের নিত্য নতুন থিওরী আবিস্কার করেছে। মহাশূণ্য আর মাহকাশ গবেষণার থিওরী মানুষের সামনে পেশ করেছে। মহাকাশ গবেষণার নানান তত্ত¡ ও তথ্য মানুষের সামনে পেশ করেছে। একইভাবে মানুষের পার্থিব জীবনের জন্য নানা মত ও মতবাদ পেশ করেছে। এ সকল গবেষণা, মত ও মতবাদ মানুষকে কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি। মানুষের ¯্রষ্টা কে? মানুষকে কেন সৃষ্টি করা হয়েছে? মানুষ সৃষ্টির আগে তার কোনো অস্তিত্ব ছিলো কি না? এ পৃথিবীর জীবনের পর তার আর কোনো জীবন আছে কি না? পার্থিব জীবনে ভালো মন্দ কাজ করার পর তাকে কখনো কারো কাছে জবাবদিহী করতে হবে কি না? মানুষের সামনে মূলত ধর্ম এ সকল প্রশ্নের কার্যকর জবাব উপস্থাপন করেছে। পাশ্চাত্য দুনিয়ায় যে সকল ধর্ম দেখা যায়। তাতে ধর্মের আসল রূপ খুজে পাওয়া যায় না। যেখান হতে মানুষের জীবনের সকল সমস্যার সমাধান লাভ করা যেতে পারে। ইসলাম এ সকল প্রশ্নের জবাব অতি উত্তমভাবে পেশ করেছে। এ জন্য ইসলাম পাশ্চাত্য ধর্মগুলোর তুলনায় চিরন্তন ও বাস্তবসম্মত। ইউরোপীয় গির্জা কেন্দ্রীক শাসন ব্যবস্থার সামনে যখন ইসলাম আগমণ করলো তখন তাদের বিকৃত ও ক্ষয়িষ্ণু ধর্মীয় জীবনধারার ব্যর্থতাগুলো মানুষের সামনে প্রতিভাত হলো। মানুষ ইসলামের প্রবাহমান জীবনধারায় নিজেদের জীবন ও সমাজকে ইসলামের আলোকিত ধারায় প্রবাহিত করলো। পাশ্চাত্যে ইসলামের আগমণের প্রভাব ছিলো অত্যন্ত সুদুরপ্রাসারী। মুসলমানরা গোটা ইউরেপাকে নতুন আলোয় আলোকিত করলো। শিক্ষা, সাহিত্য, সংষ্কৃতি, সভ্যতা, ভব্যতা, জীবনাচার, অর্থনীতি সকল যায়গায় এক আমূল পরিবর্তন সাধিত হলো। কিন্তু পরাজিত গীর্জার অধিপতিরা বসে থাকলেন না। তারা দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে মুসলমান ও ইসলামের পতনের জন্য কাজ শুরু করলেন। মুসলমানদের আদর্শ ও নৈতিকতায় যখন ফাটল দেখা দিতে শুরু করলো তখন ক্রসেডররা একে একে ইউরোপ হতে মুসলমানদের বিতারিত করলো।
তৃতীয় অধ্যায়ে লেখক তখনকার সময়ের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ইসলামের কাছে আছে সর্বোৎকৃষ্ট জ্ঞানের আধার। তারা এটা বাদ দিয়ে পাশ্চাত্য শিক্ষাকে নিজেদের শিক্ষার সাথে একাকার করে নেবার কারণে মুসলমানদের শিক্ষা ব্যবস্থায় চরম অধঃপতন নেমে আসে।
চতুর্থ অধ্যায়ে লেখক পরানুকরণ বিষয়ে লিখেছেন, সভ্যতা, ভব্যতা, আদর্শ নৈতিকতা ইসলামই মানুষকে শিখিয়েছে। প্রকৃত মানুষ ও মানবতার শিক্ষা একমাত্র ইসলামের কাছেই আছে। কিন্তু মুসলমানগণ ক্রুসেডারদের বিজয়ের পর পোষাক, খাবার, জীবন যাপন, অতিথি আপ্যায়ন, প্রত্যহিক চলাফেরা সব কিছুতে পাশ্চাত্যের অনুকরণ শুরু করে। যা মুসলমানদের পতনের অন্যতম কারণ।
পঞ্চম অধ্যায়ে লেখক সুন্নাহর প্রাণবস্তু নিয়ে লিখেছেন। যার মূলকথা হচ্ছে, আমাদের কাছে ওহীর জ্ঞান এসেছে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. এর মাধ্যমে। মুহাম্মদ সা. ই ওহীর জ্ঞানের একমাত্র উৎস। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘তিনি(নবী) যা নিয়ে এসেছেন তা গ্রহণ করো আর যা থেকে দূরে থাকতে বলেছেন, তা হতে দূরে থাকো’। মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ঘোষণা ‘তিনি নিজের খুশি মোতাবেক কোনো কথা বলেন না’। মুহাম্মদ সা. তার গোটা জীবন ব্যবস্থায় যা কিছু করেছেন, যা বলেছেন, যার অনুমোদন দিয়েছেন তা সবই সুন্নাহ। বর্তমান সময়ে সুন্নাহ বা হাদীসকে নিয়ে নানান প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়ে থাকে। যে সকল আপত্তি উত্থাপন করা হয়, যুক্তিবাদের কাছে তার কোনো স্থান নেই। মুহাম্মদ সা. এর জীবন এবং কর্ম যে সূত্রধারায় আমাদের কাছে এসেছে তা ইতিহাসের নিরিখে তার চেয়ে বৈজ্ঞানিক এবং শুদ্ধ পন্থা আর কিছু হতে পারে না। হাদীসকে সঠিকতার মানদÐে যাচাই করার জন্য হাদীস সংগ্রহকারগণ বিশাল এক শাস্ত্র মানুষের সামনে পেশ করেছেন, যাকে বলা রেজাল শাস্ত্র। পৃথিবীর আর কোনো গবেষণায় এমন অথেন্টিক, গ্রহণযোগ্য তথ্যমালার আবিস্কার কেউ দেখাতে পারবে না। তাই সুন্নাহর অনুসরণই উম্মাহর মুক্তির পথ। আজ দুনিয়াব্যাপী যতো সমস্যা তা সমাধানের একমাত্র পথ সুন্নাহরকে যথার্থমানে অনুসরণ ও অনুকরণ।
উপসংহারে লেখক লিখেছেন, পাশ্চাত্য সভ্যতা নিজের মধ্যে আত্মস্থ করে মুসলিম উম্মাহ সামনে অগ্রসর হতে পারে না। বরং পাশ্চাত্য সভ্যতার চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করেই মুসলমানদের সামনে অগ্রসর হতে হবে।
আজ মুসলিম উম্মাহর প্রধান সমস্যা পাশ্চাত্য সভ্যতার বহুমূখী আগ্রাসান। এ আগ্রাসান ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন, অর্থনৈতিক জীবন, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল, রাজনীতি, প্রশাসন সর্বত্র। খাদ্য, পোষাক, অতিথি আপ্যায়ন সকল ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যকে অনুসরণের যে রসম মুসলিম সমাজ আত্মস্থ করেছে তা মুক্তির পথ নয় বরং ধ্বংসের পথ। পাশ্চাত্য সরাসরি মুসলিম উম্মাহর সামনে সম্মূখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে না। তার আদর্শিক, নৈতিক, শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতিতে নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে উপস্থাপন করে মুসলিম সমাজে ঘুন ধরাবার কাজে ব্যস্ত। এ সকল চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় ইসলামের শ্বাশ্বত বিধানকে অক্ষুন্ন রেখে সামনে এগুতে হবে, নচেৎ পাশ্চাত্য সভ্যতার সংঘাত মোকাবিলা করা যাবে না।
বইটি অনুবাদ করেছেন : সৈয়দ আবদুল মান্নান
প্রকাশক : আধুনিক প্রকাশনী
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ১০৬
মুদ্রিত মূল্য : ৯৫.০০ টাকা
রিভিউ : মুহাম্মদ হাফিজুর রহমান

পঠিত : ২৪০ বার

মন্তব্য: ০