Alapon

সেক্যুলারিজম এবং হিন্দু সংস্কৃতি




১. সংস্কৃতির শিকড়

প্রাচীন রোমের বাগ্মী সিসেরো দার্শনিক আত্মার উন্নয়নে কৃষিভিত্তিক রূপক হিসেবে কালচার শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। যেখানে পরমকারণবাদে আত্মার চর্চার মাধ্যমে মানুষের উন্নয়ন পদ্ধতি দেখানো হয়েছে। পরবর্তী সময়ে কালচার শব্দটি তার অর্থ আরও বিস্তৃত করে। আধুনিক সেক্যুলার অর্থে কালচার বলতে বোঝায় মানুষের উৎসগত বর্বরতা কাটিয়ে ওঠার জীবনচর্চা।

বাংলায় কালচার শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে সংস্কৃতি শব্দটি ব্যবহৃত হয়। আভিধানিক অর্থে কালচার বা সংস্কৃতির সঙ্গে জমি চাষ করা বা কর্ষণের সম্পর্ক রয়েছে। ফলত যদি আমরা জমি চাষের পদ্ধতির দিকে তাকাই তাহলে দেখব জমির মধ্যে ফসলের সুপ্ত সম্ভাবনা থাকে। একখণ্ড জমি যদি বীজ এবং পরিচর্যা পায় তাহলে সেখানে ফসল উৎপন্ন হবে। সেক্যুলার আকিদায় মানুষ ছিল বর্বর, অসভ্য। খাদ্য এবং যৌনতার পরবর্তী স্তরে মানুষ যখন পদার্পণ করেছে, জন্ম নিয়েছে সংস্কৃতির। মানুষ সভ্য হয়েছে, বর্বরতা থেকে মুক্ত হয়েছে। কিন্তু কীভাবে মানুষ সংস্কৃতির জন্ম দিল?

কালচার শব্দের আভিধানিক অর্থে আবার লক্ষ করা যাক। একটি সম্ভাবনাময় জমিতে ফসল উৎপাদনের মূল হলো বীজ। বীজ রোপণ এবং তার পরিচর্যার মাধ্যমে ফসলের উৎপত্তি। মানুষের সংস্কৃতি যেন জমির সেই ফসল। যার মূলে থাকে আকিদা নামক বীজ। পশুর মতো মানুষের মৌলিক চাহিদা আছে। কিন্তু মানুষ তার মৌলিক চাহিদার ঊর্ধ্বে উঠে এ জীবন এবং জগত সম্পর্কে চিন্তা করে এবং সে অনুযায়ী নিজেদের জীবন পদ্ধতি সাজায়। কেন মানুষের সৃষ্টি হল? কে তাকে সৃষ্টি করলো? কোন উদ্দেশ্যে সৃষ্টিজগতের শুরু, কোথায়-ই বা এর শেষ? এরকম কিছু বুনিয়াদি প্রশ্ন মানুষকে আজীবন ভাবিয়েছে। মানুষ এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে। প্রত্যেক সমাজ এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে চিন্তা করেছে, সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং তাদের সিদ্ধান্তের উপরে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে নিজস্ব আকিদা তথা সংস্কৃতির বুনিয়াদ। যাদের সিদ্ধান্ত যত গভীর ও যৌক্তিক হয়েছে, তাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি হয়েছে তত বৃহৎ এবং শক্তিশালী।

ভারতবর্ষের কথাই ধরা যাক। হিন্দু-সেক্যুলার-মুসলিম, এই হলো বর্তমান ভারতবর্ষের বৃহৎ তিনটি সাংস্কৃতিক সমাজ। এই তিন সমাজের সংস্কৃতির শিকড়ে লক্ষ করলে দেখা যায় তিন সমাজের জ্ঞানের উৎস এবং মৌলিক আকিদা একেবারে ভিন্ন। যে কারণে এদের মধ্যে তৈরি হয়েছে সাংস্কৃতিক ভিন্নতা। নিছক প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাব যদি বিভিন্ন সমাজের সংস্কৃতির শিকড় হত, এক‌ই প্রাকৃতিক পরিবেশে অবস্থিত বাঙালি সমাজে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির তিন সমাজের উপস্থিতি কখনোই পরিলক্ষিত হত না। প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাব সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ, এটা অনস্বীকার্য। কিন্তু পরিবেশ কখনোই সংস্কৃতির শিকড় বা নিয়ন্ত্রক নয়, সংস্কৃতির শিকড় আকিদা।

২. সেক্যুলারিজম এবং হিন্দু সংস্কৃতি যে বিন্দুতে এসে মিশেছে

মূলত ঊনিশ শতক থেকে বাঙালি হিন্দু সমাজ ধর্ম ছেড়ে সেক্যুলারিজমের দিকে ব্যাপকভাবে ঝুঁকে পড়তে থাকে। অথচ দুশো বছর পরে এসেও আমরা দেখছি সেকুলার বাঙালির সংস্কৃতি চর্চায় হিন্দু প্রথার মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি। এমনকি সেকুলার-মুসলিমদের মধ্যে‌ও এই চর্চা ইসলামি সংস্কৃতির চেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। আপাত স্ববিরোধী এই বিষয়টা বিশ্লেষণ করা যাক। সেক্যুলারিজমের জ্ঞানের উৎস ইদ্রিয়; হিন্দু ধর্মীয় জ্ঞান অন্তরিন্দ্রিয় তথা আধ্যাত্মিক, অর্থাৎ মন তথা আত্মা; মুসলমানদের জ্ঞানের উৎস ওহী।

স্বাভাবিকভাবেই এই তিন সমাজের আকিদার বুনিয়াদ গড়ে উঠেছে তাদের এই ভিন্নভিন্ন জ্ঞানের উৎসের উপরে ভিত্তি করে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তাদের সিদ্ধান্তের উপরে। যে সিদ্ধান্তগুলো জন্ম দিয়েছে তিনটি আলাদা আলাদা সংস্কৃতির। যদিও সেক্যুলারিজমের বুনিয়াদ 'অস্বীকার', কিন্তু ধর্মীয় সংস্কৃতির দীর্ঘ চর্চার ঐতিহ্য ও অভ্যাস একজন মানুষকে মুহূর্তে সেক্যুলার হয়ে উঠতে বাঁধা দেয়। এই বাঁধা একদিনে কাটিয়ে ওঠার শক্তি সেক্যুলারিজমের নেই। তাছাড়া বাঙালি সমাজে দীর্ঘ হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা সভ্যতা-সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, ঐতিহ্য, অর্জন ও ইতিহাস পরিত্যাগ বা সংস্কারের জন্য বিকল্প যা প্রয়োজন ছিল, যেমনটা কুরআন ও সুন্নাহর অবয়বে মক্কার সদ্য মুসলমানরা পেয়েছিলেন, সেক্যুলারিজম সেটা দিতে সক্ষম ছিল না। সেজন্য ইউরোপীয়দের অনুকরণে বাঙালি হিন্দু‌ও তার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতা, যুক্তি, প্রবৃত্তি এবং বৈজ্ঞানিক দর্শনের সাহায্যে সমাজে বিদ্যমান প্রথা ও চর্চার বিশ্লেষণ, সংশোধন, গ্রহণ ও বর্জনে মনোনিবেশ করে। যে প্রক্রিয়া গত দুশো বছর ধরে চলছে।

চলমান এ প্রক্রিয়ার অর্জনে যদি আমরা লক্ষ করি, দেখা যাবে বাঙালি সংস্কৃতির বিশ্বাসগত কাঠামো মোটের ওপর সেক্যুলার হলেও ব্যবহারিক কাঠামো এখনও হিন্দু ধর্মীয় প্রভাবে আবিষ্ট। সাক্ষাতে নমস্কার, প্রদীপ জ্বালিয়ে উৎসবের শুরু, জন্ম-মৃত্যু-বিয়েতে হিন্দুরীতির পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ থেকে শুরু করে স্কুলের সরস্বতী পূজা আর শিল্পসাহিত্যে বেদ-পুরান-রামায়ণ-মহাভারতের প্রভাব বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে ফিরে ফিরে আসার মতো হিন্দুরীতি ও ঐতিহ্য বাঙালি সমাজ তথা মানুষের সামগ্রিক জীবনাচরণে এখনও প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক। কিন্তু এই প্রাসঙ্গিকতায় মধ্যযুগের বাঙালি মানসের সঙ্গে আধুনিক সেক্যুলার মানসের ব্যবধান যোজন যোজন। একজন সেক্যুলার যখন দুর্গাপ্রতিমার সামনে হাতজোড় করে দাঁড়ায়, সেখানে তখন খাঁটি ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিবর্তে ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে কুরআনে বর্ণিত 'বাপদাদার অন্ধ-অনুসরণ' এর এক আধুনিক সেক্যুলার ভার্সন, যেখানে অভ্যাস আর বিনোদনের চেতনা বিশুদ্ধ ধর্মীয় বিশ্বাসের উপরে প্রাধান্য পায়।

একদিকে সেক্যুলারিজমের নিজস্ব সংস্কৃতির অভাব, অন্যদিকে অন্তরিন্দ্রিয় তথা আধ্যাত্মিকতা থেকে প্রাপ্ত এবং প্রবৃত্তি দ্বারা ক্রম-সংস্কৃত ঐতিহ্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার যোগ্যতা বা প্রয়োজন সেকুলার মানসে কখনো ছিল না। সেজন্য সাক্ষাতে সৌজন্যতা হিসেবে হিন্দুয়ানী নমস্কার বা পাশ্চাত্যের করমর্দনের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন বাঙালির প্রয়োজন পড়েনি। রামায়ণ বা মহাভারত থেকে ধর্মীয় চাদরটা সরিয়ে দিলেই সেটা হয়ে উঠেছে উচ্চমানের সাহিত্য, ঐতিহাসিক দলীল। দুর্গাপূজা বা সরস্বতী পূজার মধ্যে পাওয়া গিয়েছে বিনোদনের আকর্ষনীয় কাঠামো, যেটা ক্রিসমাসে থাকলেও ঈদে থেকেছে অনুপস্থিত। সেজন্য বাঙালি সমাজে ক্রিসমাস গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে, ঈদ পায়নি।
আসলে সেকুলার সমাজে মুসলিম সংস্কৃতি গ্রহণযোগ্যতা না পাওয়ার মূলে আছে ইসলামি শিয়ারের প্রতি তাদের স্বাভাবিক ঘৃণা এবং ইন্দ্রিয়-সুখ প্রাপ্ত হয় এমন বিনোদনের অভাব। বিপরীত দিকে পৌত্তলিকতার প্রতি মানুষের আদিম ঝোঁক এবং হিন্দুয়ানী সংস্কৃতিতে বিনোদনের ব্যাপক উপস্থিতি সেকুলার মানস উপেক্ষা করতে সক্ষম হয়নি। সেজন্য সেক্যুলারিজম এবং হিন্দু দর্শনের জ্ঞানের উৎস ভিন্ন হলেও সেক্যুলার মানস এবং হিন্দু সংস্কৃতি একটি বিন্দুতে এসে মিশে গিয়েছে।

৩. বাঙালি সংস্কৃতির গন্তব্য

পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সেক্যুলার মানসের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হলো 'অস্বীকার'। কিন্তু সেক্যুলার চর্চা মূলত ঐতিহ্য ও প্রথার সমালোচনা, সংস্কার এবং গ্রহণের মধ্যে আটকে থেকেছে। তবে এই চর্চা যে দীর্ঘদিন চলতে পারে না, সে লক্ষণ গত চার পাঁচ দশকে বেশ প্রকট হয়ে উঠেছে। একদিকে যেমন দক্ষিণপন্থী রাজনীতি ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে, অন্যদিকে উত্তরাধুনিকতার জমিও দ্রুত শক্ত হচ্ছে। মূল্যবোধ, পাপ-পূণ্য, অপরাধ, শাস্তির মতো পরিভাষাগুলো থেকে ধর্মীয় প্রভাব মুক্ত করে সেক্যুলার সমাজ আজ‌ও মৌলিক কোনো অর্থ প্রদান করতে পারেনি। ঠিক-ভুল, সত্যাসত্যের ধারণাও আজ প্রবলভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। ধর্মের বিপরীতে আধুনিক সেক্যুলার মানস জীবন ও সৃষ্টি সংক্রান্ত প্রশ্নের যে উত্তর এতকাল দিয়ে এসেছে, বর্তমানে তার অসারতা ক্রমশ স্পষ্ট। পাশাপাশি পৌত্তলিকতার নতুন উত্থান এবং ইসলামি সংস্কৃতির ক্রমাগত জনপ্রিয়তা বাঙালি সেক্যুলার সমাজকে গভীর সংকটে ফেলে দিয়েছে। ফলত তারা বাধ্য হচ্ছে পুনর্মূল্যায়নের। মানুষ সৃষ্ট যেকোনো মতাদর্শ তথা সভ্যতা ও সংস্কৃতি একসময় ধ্বংস হয়ে যায়। ধ্বংসস্তূপ থেকে জন্ম নেয় নতুন এক আকিদা তথা সংস্কৃতির বীজের। বাঙালি সমাজ আজ যেন এমন‌ই এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। ত্রিমুখী এই লড়াইয়ের ফলাফলের উপরে নির্ভর করছে ভবিষ্যতের নতুন সাংস্কৃতিক চেহারা।

| গ্রন্থপঞ্জি |
১. আলী নদভী, সাইয়েদ আবুল হাসান। ধর্ম ও কৃষ্টি। কাসেমিয়া লাইব্রেরী। ১৯৯৫ মে।
২. মওদুদী, সাইয়েদ আবুল আলা। ইসলামী সংস্কৃতির মর্মকথা। আধুনিক প্রকাশনী। ১৯৯৮ অক্টোবর।
৩. সরকার, পবিত্র। প্রধান সম্পাদক। বঙ্গদর্পণ প্রথম খণ্ড। সমাজ-রূপান্তর সন্ধানী তৃতীয় সহস্রাব্দ। ২০০১ অক্টোবর।

পঠিত : ২৫০ বার

মন্তব্য: ০