Alapon

বুক রিভিউ : সালজুক রাজত্বের ইতিহাস


সালজুক বংশের রাজত্বের ইতিহাস ইসলামের মহত্ত¡ ও গৌরবের এক অমর কৃতিগাথা। আব্বাসীয় রাজত্বের রাজনৈতিক পতনের পর সালজুক সালতানাতই পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলিম জনপদ এবং ইসলামী খেলাফতকে ধরে রেখেছিল। ১০৪৩ খৃষ্টাব্দ থেকে ১৩০০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চল শাসন করেছে সালজুকরা। আব্বাসীয় এবং উমাইয়া খিলাফতের পর সালজুকরা ইসলামের প্রকৃত চরিত্র নিয়ে বিশ্ব ইতিহাসে আবির্ভূত হয়েছিল- যা ইতঃপূর্বেকার এই সকল রাজতন্ত্রের মধ্যে অনুপস্থিত ছিল। বদান্যতা, উদারতা, হৃদয়ের প্রসস্ততা, সাহসীকতা, বীর্যবত্তা, ক্ষমা, ন্যায়পরায়ণতা, ক্ষমতার প্রতি লোভহীনতা এবং অনারম্বরতা ও গর্বহীন জীবন যাপনের মাধ্যমে তারা এক অনন্য আদর্শিক শাসন ব্যবস্থা বিশ্ব বাসীকে উপহার দিয়েছিল। অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতামত হচ্ছে তারা যদি শুধু শাসন কর্তৃত্বকে প্রাধান্য না দিয়ে দীনি দাওয়াতকে সর্বাগ্রগণ্য কার্য হিসেবে গ্রহণ করতো তবে গোটা দুনিয়া ইসলামী একক খিলাফতের অধীনে করায়ত্ব করা সম্ভবপর হতো। তারা তাদের রাজ্যসমূহে দীনি শিক্ষা বিস্তার, আলেমদের কদর করা, মাদারসা, ও মসজিদ স্থাপন করে প্রকৃত ইসলামী চরিত্রকে ধারণ করেছিলো। সালজুক শাসনামলেই আমীদুল মুলক, নিজামুল মুলক, ইমাম গাজালী, আবু ইসহাক সিরাজী, ইমামুল হারামাইন আবুল মাআ‘লী আল জুয়াইনী, আবদুল করীম শাহরিস্তানী, আবুল হোসেন ফারগানী, আবু বকর শাশী, সাইফুদ্দীন আমেদী, ইলমুদ্দিন সাখাবী, আসমুদ্দিন আবুহুরী, উমার খাইয়াম, ইবনে জাওযী, আবু বকর সামআনী, যামাখশারী, রাগেব ইস্পাহানী, আবদুল কাহের জুরজানী, আবু যাকারিয়া তাবরীযি, শায়খ আবদুল কাদের জিলানী, খাযা ইউসুফ চিশতী, খাযা কুতুবুদ্দীন মওদুদ চিশতী, আবুল কাশেম কুরাইশী, শেখ ফরিদুদ্দীন আত্তাবের মতো বড় বড় মনীসীর জন্ম হয়েছে। এ সময় ইসলামের ফুল বাগানে জগদ্বিখ্যাত সব ফুল প্রস্ফুটিত হয়েছে। এ সকল বড় বড় মনীসীর উত্থানের পেছনে তৎকালীন পরিবেশ এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা সহায়ক ভ‚মিকা পালন করেছে। ইসলামী যুগে আব্বাসীয় এবং উমাইয়া শাসকগণ বেশ কিছু দোষে দোষী ছিলেন, কিন্তু সালজুকগণ এ সকল দোষ থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিলো। সালজুক শাসনের তিনশ বছরের শাসনামলের প্রথম ২৭৫ বছর তারা পারস্পারিক হিংসা, বিদ্বেষ, লোভ, ক্ষমতার মোহ এবং ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত থেকে মুক্ত ছিলো। পরবর্তী ২৫ বছরে যখন তাদের মধ্যে কিছু দূর্বলতা এবং ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত জন্ম হয় তখন এ শাসন ব্যবস্থার ওপর মঙ্গল ও ক্রুসেডারদের আক্রমণ তাদেরকে নিঃশেষ করে দেয়। সালজুকদের যখন উত্থান শুরু হয় তখন মধ্য এশিয়ায় সুলতান মাহমুদ গজনবীর শাসন ব্যবস্থা চলছিল। এ সময় সালজুক রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ‘আরসালান’ মাহমুদ গজনবীর সাথে সাক্ষাতের জন্য যান। মাহমুদ গজনবী আরসালানের কাছে জানতে চান, যে যদি আমার কখনো সাহায্যের প্রয়োজন হয়, আপনি কি পরিমাণ সৈন্য দিয়ে আমাকে সাহায্য করতে পারবেন।
আরসালান তখন তার বাহু হতে একটি তীর বের করে বললেন, ‘প্রয়োজনের মুহুর্তে একটি তীর আমার সেনাবহিনীর কাছে পাঠিয়ে দিবেন, আপনার খেদমতে এক লক্ষ সৈন্য এসে হাজির হবে।
মাহমুদ বললেন, আরো বেশি সংখ্যক সৈন্য প্রয়োজন হলে?
আরসালান দ্বিতীয় তিরটি বের করে বললেন, এটি ‘বাগানকোহ’ এলাকায় পাঠিয়ে দিবেন, আরো পঞ্চাশ হাজার সৈন্য আপনার খেদমতে হাজির হবে।
মাহমুদ বললেন, আরো বেশি প্রয়োজন হলে ?
আরাসালান ধনুকটি বের করে বললেন, এটি তুর্কিস্তান পাঠিয়ে দিবেন, আপনার খেদমতে দুই লক্ষ সৈন্য এসে হাজির হবে।
এ আলোচনায় মাহমুদ সালজুকদের সৈন্য সংখ্যা এবং তাদের রাজনৈতিক শক্তি টের পেয়ে তাকে বন্দী করলেন।
তিনি সাত বছর বন্দী থাকার পর তাঁর সেনাবাহিনীর দুইজন সৈনিকের সহায়তায় কারাগার থেকে পালালেন, কিন্তু পথিমধ্যে আবার গ্রেফতার হলেন। এবারে একটি আবদ্ধ কক্ষে রেখে তাকে হত্যা করা হয়। গ্রেফতারের পূর্ব মুহুর্তে তিনি তার সন্তানকে অসিয়ত করে যান, যে তুমি অবশ্যই সালজুকদের জন্য একটি রাষ্ট্র কায়েম করবে। পরবর্তীতে সালজুকরা একটি রাষ্ট্র কায়েম করতে সমর্থ হয়। যার বিস্তুৃতি ভারতীয় উপমহাদেশ হতে শুরু করে মিশর, আরব, আফ্রিকা সহ মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং আফ্রিকা অধিকাংশ অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিলো। সালজুকদের এ সকল ঘটনা এবং উত্থান পতন নিয়ে ইতিহাসের নির্যাস থেকে সঠিক তত্ব ও তথ্যের আলোকে মাওলানা মওদূদী লিখেছেন সালজুক রাজত্বের ইতিহাস। সালজুকদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য মাওলানা মওদূদী মরহুম যে সকল ঐতিহাসিক গ্রন্থ থেকে তথ্য নিয়েছেন তা হচ্ছে :
১. তারীখে বায়হাকী
২. যায়নুল আখবার
৩. যুবদাতুন নুসরা
৪. রাহাতুস সুদুর
৫. তারীখুল কামেল
৬. ওয়াফাইয়াতুল আইয়ান
৭. আল মুখতাসার ফী আখবারিল বাশার
৮. তারীখে গুজীদাহ
৯. রওজাতুস সাফাহ
১০. হাবিবুস সিয়ার
১১. মুখতাসারে সালজুকনামা
১২. তারীখে সালাজুকায়ে কিরমান
১৩. তবকাতে নাসেরী
তবে মাওলানা এ সকল গ্রন্থ হতে সেই সকল তথ্যই গ্রহণ করেছেন, যা ইতিহাসের নির্যাসে সঠিক ও সত্য বলে বিবেচিত হয়।
ইতিহাস সচেতনতা ব্যতীত একটি জাতি তার অস্তিত্ব ধরে রাখতে পাওে না এবং আগামী দিনের পথ চলার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে না। তাই ইতিহাস সচেতন প্রতিটি মানুষের অবশ্যই বইটি পাঠ করা অতি আবশ্যক। ১৭৫ পৃষ্ঠার বোর্ড বাঁধাই বইটির মুদ্রিত মূল্য ১২০ টাকা। বইটি প্রকাশ করেছে আধুনিক প্রকাশনী।

পঠিত : ২১৯ বার

মন্তব্য: ০