Alapon

তাজকিয়ায়ে নফস


তাজকিয়ায়ে নফস তথা প্রশান্ত পবিত্র আত্মা গঠন এবং সংরক্ষণের জন্য করনীয়..............
লিখেছেন - উস্তাদ আব্দুল্লাহ আল মাসুদ

কাপড় ধুয়ে নিলে ঝকঝকে তকতকে হয়ে যায়। আবার কিছুদিন তাকে অযত্ন-অবহেলায় রাখলে ধুলোবালি জমে মলিন হয়ে যায়। আগের চকচকে ভাবটা মিইয়ে যায়। তখন এটি আকর্ষণ তৈরি করে না। একে গায়ে চাপাতে ভাল লাগে না।

আমাদের অন্তরটাও কাপড়ের মত। এটি গুনাহের বালু আর গাফলতির ধুলোতে মাঝেমাঝে অপরিচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। তখন এতে চকচকে নূরান্নিত ভাবটা থাকে না। ভাল কাজের প্রতি কোন আকর্ষণবোধ হয় তৈরি হয় না তাতে।

কাপড় যেমন ধুয়ে নিলে নতুন হয়ে উঠে, তেমনি অন্তরকে তওবার পানি দিয়ে মাঝেমাঝে ধুতে হয়। যিকির ও ইস্তিগফারের তোয়ালে দিয়ে মুছতে হয়। নেককার লোকদের মজলিসে ও সোহবতে গিয়ে মরা অন্তরে পানি সিঞ্চন করতে হয়। এগুলোর ভেতর দিয়ে অন্তর আবার ঝকঝকে ও তরতাজা হয়ে উঠে। এতে নূর তৈরি হয় এবং ভাল কাজের প্রতি আকর্ষণবোধ জন্মায়।

হৃদয়ের এই আদল-বদল অবস্থা সদা চলমান থাকে। নদীর মত বেলায় বেলায় এতে জোয়ার-ভাটা আসে। এই ভাল তো এই খারাপ। এখন আখিরাতের খুব স্মরণ হলেও পরক্ষণে আবার দুনিয়ার মোহজালে ফেঁসে যাই। হৃদয়ের এই উথাল-পাতাল অবস্থা আপনি চাইলে পরখ করতে পারেন। যেভাবে থার্মমিটার দিয়ে সহজে জ্বর পরিমাপ করে নেন সেভাবে। সেটা কীভাবে?

এই প্রশ্নের উত্তর আছে হযরত উসমান বিন আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর ছোট্ট একটি কথার মধ্যে। এটি প্রত্যেক ব্যক্তির নিজের অবস্থা যাচাইয়ের জন্য এক ধরনের থার্মমিটার বলা যায়। তিনি বলেছেন,
‘যদি তোমাদের অন্তরগুলো পরিচ্ছন্ন-পবিত্র হয়ে থাকে, তবে তোমরা আল্লাহর কালাম (পঠন-পাঠনে) কখনো তৃপ্ত হয়ে যাবে না।’ (মুসনাদ আহমাদ)

আল্লাহর কালাম পবিত্র কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করতে গিয়ে যদি দেখেন ভাল লাগছে না, মন বসছে না কিংবা আরও বেশি তিলাওয়াত করার তৃষ্ণা মনের মধ্যে জাগ্রত হচ্ছে না এর মানে আপনার অন্তর যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন নয়। এতে নানান রকম ধুলো ও জং ধরেছে। আর যদি এর উল্টো চিত্র দেখতে পান- যতোই তিলাওয়াত করছেন ততোই যেন আপনার ক্ষুধা বেড়ে চলছে, মনে চাচ্ছে শুধু পড়তেই থাকি… পড়তেই থাকি… এমন হলে বুঝে নিবেন আপনার অন্তর পরিচ্ছন্ন আছে। এখন তিলাওয়াতের মাত্রা বাড়িয়ে এর চাকচিক্যকে আরও শাণিত করে নিতে পারেন।

মূলত কুরআন অন্তরের ভাল-মন্দ অবস্থা বুঝার জন্য যেমন থার্মমিটার, তেমনি এটি অন্তরের জন্য পরিশোধনকারীও। আপনি যত তিলাওয়াত করবেন, অন্তর তত আলোকিত হবে। এর ভেতর থেকে অন্ধকার দূরীভূত হবে। গাফলতি ও দুনিয়ার বুকে পদচারণা করতে গিয়ে যেসব ধুলো জমে, সেগুলোকে সরে যাবে।

জনৈক আবেদ বলেছেন, হৃদয়ের আরোগ্য আছে ৫টি জিনিসের মধ্যে। তা হলো-
১. চিন্তা-ভাবনার সাথে কুরআন তিলাওয়াত করা।
২. রোজার মাধ্যমে পেট খালি রাখা।
৩. তাহাজ্জুদের নামাজ পড়া।
৪. শেষ রাতে আল্লাহর কাছে রোনাজারি করা।
৫. নেককার লোকদের সাথে চলাফেরা করা।

কাছাকাছি ধরনের কথা বর্ণিত হয়েছে ইমাম ইবনুল কাইয়িম রাহ. থেকে। তিনি বলেছেন, ‘তাদাব্বুর ও চিন্তা-ভাবনার সাথে কুরআন তিলাওয়াত করার মত অন্তরের জন্য উপকারী আর কিছু নেই। কুরআনের তিলাওয়াত মানুষের অন্তরে যেসব বিষয় সৃষ্টি করে তা হলো- আল্লাহর প্রতি ভালবাসা, জাহান্নামের ভয়, জান্নাতের প্রত্যাশা, তাওবা করার প্রতি আগ্রহ, আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল, আল্লাহর সিদ্ধান্তের প্রতি সন্তুষ্টি, সব ব্যাপারে নিজেকে আল্লাহর কাছে সপে দেওয়ার মানসিকতা, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা, ধৈর্য ধারণ, অন্তরকে সজীবতা ও পূর্ণাঙ্গতা দানকারী গুণাবলী ইত্যাদী। এমনিভাবে কুরআনের তিলাওয়াত অন্তর থেকে মন্দ এবং হৃদয়-বিনষ্টকারী বিষয়াবলীও দূরিভূত করে। মানুষ যদি সঠিকভাবে জানত যে, চিন্তা-ভাবনার সাথে কুরআন তিলাওয়াতের মধ্যে কী ধরনের ফায়দা আছে, তাহলে অন্য সকল কিছু বাদ দিয়ে এটি নিয়েই তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ত।

সুতরাং কেউ চিন্তা-ভাবনার সাথে কুরআন তিলাওয়াত করার সময় যদি এমন কোন আয়াত তার সামনে এসে পড়ে, যার মধ্যে তার জন্য অন্তরের আরোগ্য রয়েছে, তার কর্তব্য ঐ আয়াতটাকে বারবার তিলাওয়াত করা। দরকার হয় একশবার সেই আয়াতটি পুনরাবৃত্তি করবে। যদি সময়টা রাত্রিবেলা হয়ে থাকে তবুও। কারণ হলো, চিন্তা-ভাবনার সাথে ও অর্থ বুঝার চেষ্টা করে এক আয়াত তিলাওয়াত করা সাধারণভাবে এক খতম কুরআন তিলাওয়াত করার চেয়েও উত্তম।’ [মিফতাহু দারিস সাআদাহ, ইবনুল কাইয়িম : ১/৫৩৫]

কোন এক জায়গায় পড়েছিলাম, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হলে আপনার ঘর যেমন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়, তেমনি অন্তর যখন কুরআন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তখন অন্তরের অবস্থাও সেরকম হয়।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কুরআনের মাধ্যমে নিজেদের অন্তরের অবস্থা যাচাই করা ও কুরআনের আলোয় অন্তরকে আলোকিত করার তাওফীক দান করুন। আমিন।

কপি - M Zaman Shamim

পঠিত : ২১৪ বার

মন্তব্য: ০