Alapon

মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাম রাজনীতির সূচনা

(বাম রাজনীতি পর্ব -০২)

মুক্তিযুদ্ধের সময় বামপন্থীদের কিছু অংশ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় অংশ নেয়ার পাশাপাশি আরেকটি বড় অংশ মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধীতা করে থাকে। মূলত মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে বামপন্থীদের মাঝে বিভ্রান্তি এবং সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার ক্ষেত্রে দোদুল্যমান পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। আরেকটা অংশ পাকিস্তান বাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের উভয়কেই ঢালাওভাবে জনগণের দুশমন হিসেবে অবহিত করে।

এ সম্পর্কে উপমহাদেশের বাম রাজনীতির গুরু ও কুখ্যাত নকশালপন্থী বলে খ্যাত চারু মজুমদার বলেন, "১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান অন্যায় যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সম্প্রসারণবাদী ভারত সরকার, সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সহায়তায় পাকিস্তান আক্রমণ করে, ১৬ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান দখল করে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সেখানে এক নয়া ঐপনিবেশিক শাসন কায়েম করলে পূ্র্ব বাংলার গণতান্ত্রিক সংগ্রাম একই শত্রুর বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিন্ন সংগ্রামের অংশ হয়ে পরে (১)।

ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গের বাম সংগঠন গুলোর তৎপরতা মুক্তিযুদ্ধের পরের সময়েও স্বাধীন বাংলাদেশে খুব শক্তভাবেই দেখা যায় ।

"শ্রেণিশত্রু খতম করো, শ্রমিক রাজ কায়েম করো
"বন্দুকের নলই সকল ক্ষমতার উৎস "
"সংসদ হলো শুয়োরের খোঁয়ার"
"হারামজাদা জনগণ থাকলো তোদের নির্বাচন আমরা চললাম সুন্দরবন"।
ইত্যাদি উগ্রবাদী শ্লোগানের মাধ্যমে নয়া বাংলাদেশে বামপন্থীদের কন্ঠ দাপটের সাথে উচ্চারিত হতে থাকে।

বাংলাদেশে প্রায় ২৫ টির মত প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য বিভিন্ন বাম রাজনীতির সংগঠন এখন কাজ করে যাচ্ছে (২)। এদের মাঝে কেও সাংসদীয় রাজনীতি আবার কেও গোপন কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে জানা যায়। এসব বামপন্থী দলগুলোর বিভিন্নমূখী তীর্থস্থান বা ব্যক্তি রয়েছে। মস্কো এবং পিংকিং থেকে বিচ্যুতির পর এরা বিভিন্ন দেশ,দল,ব্যক্তির লেজুড়বৃত্তি করে আসছে। কার্ল মার্কস,লেনিন,স্ট্যালিং, মাও সেতুং,কিউবার কাস্ট্রো, আলবেনিয়ার আনোয়ার হোজ্জাকে তাত্ত্বিক নেতা মেনে টিকে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছে তারা এবং এখনো যাচ্ছে ।

বামপন্থীদের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের লড়াকু সৈনিক বলে বহুল প্রচারণা চালানো হলেও ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকে 'দুই কুকুরের লড়াই' বলে বামদের বড় একটা অংশ ই তাচ্ছিল্য করেছিল।রাজনৈতিক বিরোধীতার পাশাপাশি বামদের একটা অংশ বহু মুক্তিযোদ্ধা দের হত্যা করেছে। বৃহত্তর পাবনা অঞ্চলে বামপন্থীদের হাতে মুক্তিযুদ্ধা হত্যার ঘটনা ও জানা যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ও কোন বামপন্থী গ্রুপ তাদের নামের আগে পূর্ব পাকিস্তান ব্যাবহার করতো। এর অন্যতম ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কস-লেনিন)।

অমর ভট্টাচার্য তার 'লাল তমসুক' গ্রন্থে এম-এল থেকে কাজী জাফর আহমেদ, হায়দার আকবর খান রনো ও রাশেদ খান মেনন প্রমুখ বের হয়ে এক উপদল তৈরি করেন এই দলের নেতারা চরম উগ্রবাদী নকশালপন্থী হিসেবে নিজেদের তুলে ধরেন।
বিভিন্ন লিফলেটের মাধ্যমে জনগণ ও প্রশাসনের মাঝে বামপন্থীরা সে সময় ছড়িয়ে দেয় উত্তেজনা ও ভয়।

বামপন্থী তথা সমাজতন্ত্রীদের ডেফিনেশন অনুযায়ী, তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ হলো বুর্জোয়া, ধনিকশ্রেণি, মৎসুদ্দী, মহাজন ইত্যাদি। এদের কে কেও কেও শ্রেণিশত্রু হিসেবে অবহিত করতেন এবং সমাজতন্ত্রের চরমপন্থীদের মতে শেণিশত্রুকে খতম করাই সংগ্রামের মূল হাতিয়ার বলে মনে করা হয়।

আর এই সংগ্রামের জন্য গেরিলা যুদ্ধের বিষয়ে তারা একমত ছিল। 'চারু মজুমদারে'র বিভিন্ন কথায় এটা বারবার প্রতিয়মান হয়।
চারু মজুমদারের মতে"একমাত্র ক্ষমতা দখলের রাজনীতিই পারে দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে তীব্র শ্রেণিঘৃণা জাগিয়ে তুলতে এবং এই রাজনীতি কে অধিনায়ক করেই খতম অভিযান কে উচ্চতর স্তরে তোলা যায় "(৩)

এবার আসি মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বামপন্থীদের কার্যক্রম নিয়ে কিছু তুলে ধরতে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন খান আহমেদ উল্লেখ করেন ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি সর্বহারা পার্টির নেতৃত্বাধীন পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিবাহিনীর নাম বদলে পূর্ব বাংলার সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনী রাখা হয়। অনুরুপভাবে জন্মকালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল(জাসদ) নিজেকে একটা সমাজতান্ত্রিক গণসংগঠন হিসেবে ঘোষনা দিয়েছিল। তৃতীয় বছরে তারা একটি বিপ্লবী পার্টি গড়ার প্রক্রিয়া শুরু করে৷ যদিও সেটার নামকরণ হয় নি।
এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ১৯৭৪ সালের জুনে গঠন করা হয় বিপ্লবী গণবাহিনী। সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টির অধীনে 'পূর্ব বাংলার সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনী' এবং জাসদের বিপ্লবী গণবাহিনী'র লক্ষ্য ছিল অভিন্ন -ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কে উৎখাত করা। (৪)

সর্বহারা নামধারী সমাজতান্ত্রিক দের সশস্ত্র এই সংগঠনের বিষয়ে মহিউদ্দিন আহমেদের লেখায় আরও বিস্তারিত জানা যায়।

তারা নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী গড়ার কাজ খুব গতিশীলতার সাথে শুরু করে। এর কাঠামো অনেকটা সামরিক বাহিনীর মতো। এদের সবার নিচে হলো গেরিলা গ্রুপ। একটি গ্রুপে ৫-৯ জন করে সদস্য। তাদের হাতে থাকবে কমপক্ষে তিনটি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল। তিনটি গেরিলা গ্রুপ নিয়ে একটি প্লাটুন।
৩ টি প্লাটুন নিয়ে একটি কোম্পানি। কমপক্ষে একটি অটো রাইফেল থাকতো প্রতিটি কোম্পানির কাছে। সেক্টর কমান্ডারের অধিনে কাজ করতো কোম্পানিগুলো। রাজনৈতিক অফিসার থাকবে যাকে বলা হতো রাজনৈতিক কমিসার । সামরিক সকল দলিল সহ অভিযানের কৌশলসহ সব কিছু শিখিয়ে দিতেন সেক্টর কমান্ডাররা।

উক্ত বিবরণগুলো কে কেও মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ঘটনা বলে ভুল করতেই পারে কিন্তু এগুলো ১৯৭৩ এর সমাজতান্ত্রিক দের সশস্ত্র বাহিনীর কার্যক্রম কাঠামো।

আগামী পর্বে এই সশস্ত্র বাহিনীর ভয়ানক ইতিহাস তুলে ধরব যা শুনে অনেকের বধ্যমূল ধারণা বদলে যাবে। মনে পড়ে যাবে এখনকার সমাজতান্ত্রিক দের তথাকথিত শান্তির পক্ষে ফাকাবুলি যা আমরা বিভিন্ন মিডিয়ায় তাদের বক্তব্যের মাঝে শুনতে পাই। ব্রিটিশ শাসন থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমল এমনকি বাংলাদেশে ও নিষ্ঠুরতার এক গভীর কালিমাময় ইতিহাসের দায়ে অভিযুক্ত এই বাম রাজনীতি।

পুলিশ হত্যা,গুপ্তহত্যা, লুট,রাহাজানি, নিজেদের খেয়ালখুশির আদালতের মাধ্যমে নিজেদের লোকদের প্রকাশ্য খুন ইত্যাদির তথ্যমূলক ইতিহাস নিয়ে সামনের পর্বে কথা হবে ইনশাআল্লাহ....

তথ্যসুত্র-
১) চারু মজুমদার সমগ্র(ভূমিকা),আবু সালেক সম্পাদিত, ঘাস ফুল নদী, ঢাকা ১৯৯৭।।

২)জগলুল আলম :বাংলাদেশে বামপন্থী রাজনীতির গতিধারা :প্রতিক প্রকাশনা সংস্থা:ঢাকা।

৩) চারু মজুমদার সমগ্র(ভূমিকা),আবু সালেক সম্পাদিত, ঘাস ফুল নদী, ঢাকা ১৯৯৭।

৪) মহিউদ্দিন আহমেদ:লাল সন্ত্রাস : সিরাজ শিকদার ও সর্বহারা রাজনীতি, বাতিঘর ঢাকা ২০২১। পৃষ্ঠা নং ১৩৯।

পঠিত : ২৪৩ বার

মন্তব্য: ০