Alapon

ফিলিস্তিন ক্রাইসিসঃ প্রেক্ষিতে জাতিসংঘ ও মুসলিম বিশ্ব

ফিলিস্তিন ক্রাইসিসঃ প্রেক্ষিতে জাতিসংঘ ও মুসলিম বিশ্ব


জেরুজালেম সুন্দর সুশোভিত প্রাচীন নগরী। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুর শাসনামলে মুসলিমরা জেরুজালেম জয় করেন। পালাক্রমে পুরো ফিলিস্তিন শহর বিজিত হয়। এর বহুকাল পর খ্রিস্টান বাহিনী কর্তৃক ফিলিস্তিন আক্রান্ত হয়। ক্রুসেডারদের নির্মম নির্যাতনের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিন মুসলিমদের হাতছাড়া হয়ে যায়। সে যাত্রায় সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ফিলিস্তিন মুক্ত করেন। তারও অনেকদিন পর আবার জেরুজালেম খ্রিস্টানদের দখলে চলে গেলে নাজিমুদ্দিন আইয়ুব রাহিমাহুল্লাহ জেরুজালেম মুক্ত করেন। তৎপরবর্তীকালে কুখ্যাত রক্ত খেকুর দল মোঙ্গল বাহিনী কর্তৃক ফিলিস্তিন আক্রান্ত হলে সাইফুদ্দিন কুতুজ ও রুকনুদ্দীন বাইবার্স (র.) ফিলিস্তিন হেফাজত করলেও তা পুনরায় খ্রিস্টানদের দখলে চলে যায়।

সর্বশেষ ১৯১৭ সালে বেলফোর ঘোষণার মধ্য দিয়ে খ্রিস্টান বাহিনী কর্তৃক ফিলিস্তিন ইহুদিদের দখলে চলে যায়। এরপর ত্রিশ বছর পর্যন্ত মুসলিমরা ইহুদিদের অস্তিত্বকেই স্বীকার করেনি বরং ইহুদিদেরকে চোরের দল বলে বিশেষায়িত করা হয়েছে। এর আরো কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর আরবের পূর্ববর্তী অস্বীকারকারীরাই দখলকৃত ভূমির ৭৮% এর ওপর ইসরায়েলের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়। এটা ছিল গাজা ও পশ্চিম তীর ব্যতীত ফিলিস্তিনের সম্পূর্ণ ভূমি। অতঃপর মূল দখলদারির ৭৮% ছাড়াও ইহুদিরা পশ্চিম তীর ও গাজার ৬০% ভূমির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। বর্তমানে চলছে নতুন ধাপ। ইহুদিরা ফিলিস্তিন থেকে মুসলিমদের অস্তিত্ব বিলীন করে দিতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনের আজকের পরিস্থিতি যেন আন্দালুসিয়ার বাস্তব প্রতিচ্ছবি।

সম্প্রতি আমেরিকার জো বাইডেন প্রশাসন আরব বিশ্বের সাথে ইজরায়েলের বন্ধুত্বপূর্ণ তৈরিতে অনেকদূর এগিয়েছেন। তলে তলে প্রায় সব চুক্তিই সম্পন্ন। বাকি রইলো সম্পর্কের আলাপ প্রকাশ্যে আসা। আরব বিশ্ব ইজরায়েলের সাথে দৃঢ় সম্পর্ক তৈরি করা মানে ইজরায়েলকে চূড়ান্ত ভাবে স্বীকৃতি দিয়ে চিরতরে ফিলিস্তিনকে দূল্যিসাৎ করা। এছাড়াও সদ্য গত হওয়া জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তেল আবিবের সর্বোচ্চ অভিভাবক বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনকে নিশ্চিহ্ন করে মধ্য প্রাচ্যের নতুন মানচিত্র উপস্থাপন করলে তেমন কোনো ভূমিকা রাখেনি মুসলিম রাষ্ট্র সমূহ। অথচ সমগ্র মুসলিম রাষ্ট্র সেদিন জোর গলায় প্রতিবাদসহ ইজরায়েল আগ্রাসনের চিত্র তুলে ধরার কথা ছিলো। মুসলিম বিশ্বের এই নিশ্চুপ ভূমিকা পরোক্ষ ভাবে ইজরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়ার নামান্তর। যাহার ফলে ফিলিস্তিনের সার্বভৌমত্ব রক্ষার আন্দোলন দেয়ালে পিঠ ঠেকার মত হয়ে দাঁড়িয়েছে। হামাস কর্তৃক ইজরায়েল আক্রমণ নিঃসন্দেহে এক যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে ফিলিস্তিনের ইতিহাসের পাতায় স্থান পাবে।


বর্তমান বিশ্বে ব্রিটিশ-ফ্রান্স-ওয়াশিংটন বনাম চীন-রাশিয়া স্নায়ু যুদ্ধের সবচেয়ে বড় তাসের তুরুক ইরান। ফিলিস্তিন ইস্যুতে একাট্টা তেহরান। ফলশ্রুতিতে লেবাননের হিজবুল্লাহ হামাসের হয়ে মাঠে নামতে বদ্ধপরিকর। এই দফায় ফিলিস্তিন সংকট বাড়তে থাকলে ইরান পরোক্ষ থেকে প্রত্যক্ষ মাঠে চলে আসতে পারে। তখন মসজিদুল আল-আকসা ইস্যুতে সৌদিসহ আরব বিশ্ব এবং তুরস্ক একত্রে না হলেও ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ফিলিস্তিনের জন্য লড়াইয়ে নামবে। এছাড়াও বিশ্ব ব্যাপী শোর তুলবে মুসলিম জনতা। ওয়াশিংটনের আধিপত্য ঠেকাতে মস্কো-বেইজিং ইরানকে হাতছাড়া করবে না। ফলতঃ রাশিয়া-চীন ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলবেই। পাশাপাশি পিয়ং ইয়াং আমেরিকা ঠেকাও নীতিতে সর্বদা যুক্তরাষ্ট্র মিত্রের বিরুদ্ধে একাট্টা। এই নীতির ফল হিসেবেই উত্তর কোরিয়া ফিলিস্তিনকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।


বিপরীতে ইজরায়েলের হয়ে ওয়াশিংটন-লন্ডন অগ্রণী ভূমিকা রাখবে এটাই স্বাভাবিক। বৈশ্বিক পরিমন্ডলে ভারত বড় কিছু না হলেও জায়নবাদের বড় মিত্র হিন্দুত্ববাদ হিসেবে এবং লন্ডন-ওয়াশিংটন মিত্র বিধায় হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র ইজরায়েলের পক্ষেই থাকবে। আজকের ইজরায়েল লন্ডনের হাতে গড়া রাষ্ট্র। অন্যদিকে আরব বিশ্বকে পঙ্গু করতে ওয়াশিংটন ইজরায়েলকে দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করে যাচ্ছে। ইজরায়েল আমেরিকার জন্য দাবার গুটি হলেও হোয়াইট হাউস তেল আবিবের তাসের তুরুক। ইউরোপীয় বড় শক্তি প্যারিস এখন আর ওয়াশিংটনের উপর আশ্বস্ত নয় বিধায় চোখ বন্ধ করে ইজরায়েলকে সাপোর্ট দিবে না। আমেরিকা কখনোই চাইবে না ইরানকে তাদের প্রত্যক্ষ প্রতিপক্ষ বানিয়ে যুদ্ধ করতে। যাহার ফলেই মূলত আমেরিকা তেলআবিবে রসদ পাঠালেও সৈন্য পাঠাবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। কারণ আমেরিকা সৈন্য পাঠালে ইরান তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবে, যা ওয়াশিংটনের জন্য বড় হুমকি।

কুটনীতির জাঁতাকলে বড় ধাক্কায় ইজরায়েল। কোনো ভাবেই হেরে যাবার পাত্র নয় তারা। প্রযুক্তি ও কুটনীতিতে সেরা রাষ্ট্রের অন্যতম। গাজা ও জেরুজালেম গুড়িয়ে দেবার সামর্থ্য থাকলেও নিজেদের অস্তিত্বের কথা ভেবে সামনে অগ্রসর হতে আতঙ্কগ্রস্ত। তেলআবিবের অতি বাড়াবাড়ি মহা যুদ্ধ পর্যন্ত গড়াতে পারে, যা ইজরায়েলকে পূর্বের অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে। হোয়াইট হাউসের অতি রাজনীতির ধাক্কা ইজরায়েল পর্যন্ত ঠেকেছে।


এই পর্যন্ত আশার বাণী থাকলেও পর্দার আড়ালের গল্প মারাত্মক ভয়ংকর। মুসলিম বিশ্বের কালেমার ভিত্তিতে ঐক্য গঠন ব্যতিত ফিলিস্তিনের ভাগ্য ফিরবে না। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো, মুসলিম বিশ্ব কখনোই এক হয়ে লড়াইয়ে নামতে পারবে না। জাতিসংঘ সে পথ রোধ করে দিয়েছে। আমেরিকা বড় ভাই টাইপের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে নাড়ছে সেই কলকাঠি। এদিকে মুসলিম বিশ্ব বুঝতেই নারাজ যে, ওয়াশিংটন যার বন্ধু তার শত্রুর প্রয়োজন হয় না। কারণ ওয়াশিংটন বাইবেলের প্রকৃত আদর্শ থেকে বিপরীত মেরুতে গিয়ে তানাখ আদর্শের জায়নবাদ দ্বারা পরিচালিত। জায়নবাদ সবচেয়ে বড় বাঁধা হিসেবে মনে করে মুসলমান জাতিকে। সুতরাং সেই জায়নবাদ পরিচালিত হোয়াইট হাউসের কলকাঠি মুসলিম উম্মাহর জন্য কতবড় অস্ত্র তা আর বলার বা ব্যাখ্যার তাগিদ রাখে না।

মার্কিনী রুজভেল্টের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘের অন্তর্নিহিত মূলমন্ত্র হলো ২য় বিশ্বযুদ্ধের মিত্র শক্তির আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত করা। আদতে হয়েছেও তাই। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত নুরেমবার্গ ট্রায়াল ও টোকিও ট্রায়ালের মাধ্যমে শুরু হয়ে আজ পর্যন্ত জাতিসংঘের একপাক্ষিক দৃষ্টি বিশ্বময় সুউচ্চ। নাৎসি বাহিনী ও জাপান নেতাদের বিচারকে তথাকথিত জুডিশিয়াল কিলিং হিসেবেই মনে করে বৈশ্বিক সুধীজন। ওয়াশিংটন সুকৌশলে মস্কো, বেইজিং, প্যারিস ও লন্ডনকে দুর্বল করে জাতিসংঘে মহা আধিপত্য বিস্তার করেছে। নিরাপত্তা পরিষদ মানেই যেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো পদ্ধতি না থাকলে আজকে বিশ্ব পরিস্থিতি কত বেশি নাজুক হতো তা ভাবলেও গা শিউরে ওঠে। অবশ্য সে পর্যন্ত না গড়িয়ে জাতিসংঘের অবসান হতো অবশ্যম্ভাবী। জাতিসংঘ বর্তমান সময়ে আমেরিকার হয়ে কাজ করলেও ভেটো ক্ষমতার দরুন বৈশ্বিক শান্তি নূন্যতম হলেও বজায় রয়েছে।


১. শান্তি ভঙের হুমকি ও আক্রমণাত্মক প্রবণতা ও কার্যকলাপ দূর করে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ২. সব মানুষের সমান অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে বিভিন্ন জাতির মধ্যে সহযোগিতা ও বন্ধুত্ব জোরদার করা, ৩. অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পুরো জাতির মধ্যে সহযোগিতা গড়ে তোলা, ৪. জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধবোধ গড়ে তোলা, ৫. আন্তর্জাতিক আইনের সাহায্যে আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান নিশ্চিত করা, ৬. প্রত্যেক জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের স্বীকৃতি এবং তা সমুন্নত রাখা, ৭. উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়নের জন্য জাতিসংঘের কার্যধারা অনুসরণ করা।

এতদ মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ সনদ স্বাক্ষরিত হলেও বাস্তবে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কার্যকর ফলাফল দেখেনি বিশ্ববাসী। ম্যানহাটন থেকে পরিচালিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই সংস্থাটি মানবতার বুলি আউড়িয়ে মানবতাকে বিলুণ্ঠিত করে যাচ্ছে। যার অন্যতম উদাহরণ সম্প্রতি ফিলিস্তিন-ইজরায়েল যুদ্ধে পশ্চিমাদের ভূমিকা। ইজরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনে গণহত্যা চালানো হলে পশ্চিমা মানবাধিকারের বর্গাচাষীদের মুখে হাসি ছিলো বেশ। সম্প্রতি হামাসের হাতে ইজরাইলী যুদ্ধ বন্দী শ'খানেক থেকে হাজার খানেক হতে পারে। ইজরায়েল কর্তৃক গাজায় হামলা চালানো হলে যুদ্ধবন্দী হত্যার হুমকি দেয় হামাস। হামাসের এই হুমকিকে মানবাধিকার লংঘন বলে নিন্দা জানায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আদতে এই নিন্দাবাদকেই একুশ শতকের মানবাধিকার বলা হয়। জাতিসংঘ অন্য সবার অধিকার রক্ষায় একাট্টা হলেও মুসলিম বিশ্বের সকল সংকটে অনীহা দেখিয়ে চলছে। উপরন্তু মুসলিম উম্মাহর সংকট গুলোকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘায়িত করেছে।


১৯৯২-১৯৯৫ সাল পর্যন্ত সার্ব খ্রিস্টানদের নির্যাতনে বসনিয়ার দুই লক্ষ মুসলমান প্রাণ হারিয়েছে। এক্ষেত্রে ও জাতিসংঘ সার্বদের বর্বরতার হাত থেকে বসনিয়ার নিরপরাধ মুসলমানদেরকে রক্ষা করেনি। হাজার হাজার মুসলিম নর-নারীকে নির্মমভাবে হত্যা ও অগণিত মুসলিম নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। বসনিয়া হার্জেগোভিনা যুদ্ধে প্রথম দিকে জাতিসংঘের বক্তব্য ছিলো ইহা কেবলই রাষ্ট্রের অন্তর্নিহিত ব্যাপার। অবশ্য পরবর্তীতে গনহত্যা সংঘটিত হলে এবং ইউরোপীয় রাষ্ট্র সমূহের ভূমিকার ফলে জাতিসংঘ নামমাত্র হলেও গা দেখিয়েছে। তবে স্থায়ী সমাধান আজো হয় নাই।

১৯৪৮ সালে জাতিসংঘে কাশ্মীরের গণভোট অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়েছিল এবং গণভোটের ফলাফলের ভিত্তিতে কাশ্মীরের ভাগ্য নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। অথচ জাতিসংঘের সেই সিদ্ধান্ত আজো বাস্তবায়িত হয়নি। ভারত সেখানে দশ লক্ষ সৈন্য মোতায়েন করে রেখেছে। ভূলুণ্ঠিত কাশ্মীরের স্বাধীনতা ও জনগনের মানবিক অধিকার।


ককেশাস পর্বতমালার চেচনিয়া এবং ফিলিপাইনের মিন্দানাওয়ের মুসলমানরা পারেনি স্বাধীনতা অর্জন করতে। অথচ জাতিসংঘ ঠিকই পূর্বতিমুরের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করেছে। সেখানে গণভোটের রায় অনুযায়ী পূর্বতিমুরকে স্বাধীন করেছে। পূর্বতিমুর যেহেতু একটি খ্রিস্টান অধ্যুষিত এলাকা এবং এটি যেহেতু মুসলিম প্রধান ইন্দোনেশিয়ার অন্তুর্ভুক্ত, তাই মুসলমানদের কাছ থেকে খ্রিস্টানদের স্বাধীন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা জাতিসংঘের মাধ্যমে সেটিকে স্বাধীনের ব্যবস্থা করেছে। একই ঘটনা সুদানের ক্ষেত্রেও বাস্তবায়িত হয়েছে। সুদানকে ভেঙ্গে দক্ষিণ সুদান নামে আলাদা খ্রিস্টান রাষ্ট্র বানিয়েছে। অথচ চেচনিয়া, মিন্দানাও, কাশ্মীর, চীনের জিনজিয়াং, রাশিয়ার দাগেস্তান, শ্রীলঙ্কার মান্নার দ্বীপের ব্যাপারে জাতিসংঘের ভূমিকা সম্পূর্ণ উল্টো ও বধির টাইপের।

২৫ আগস্ট ২০১৭ সালে মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর দ্বারা শুরু হওয়া গণহত্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বিগত তিন দশক ধরে মায়ানমার সরকারের সহিংস নির্যাতন থেকে ৩ লাখের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে অবস্থান করছে। এ মুহূর্তে কক্সবাজারে সব মিলিয়ে অন্তত ১১ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে কতশত আলোচনা হলো কিন্তু আদতে মায়ানমার ইস্যুতে জাতিসংঘের ভুমিকা শূন্যের কোঠায়।

লিবিয়া ও ইরাকে বেসামরিক মানুষকে রক্ষা ও গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র ধ্বংসের নামে যুদ্ধের আয়োজন জুড়ে দিয়েছে জাতিসংঘ। ন্যাটো জোটকে বিশ্বের যত্রতত্র যুদ্ধের বৈধতাও দিয়েছে জাতিসংঘ। আফগানিস্তানে লাদেনকে ধরার নামে ওয়াশিংটন এবং ইংল্যান্ড দেশটিকে তছনছ করলো অথচ জাতিসংঘ ছিল নীরব দর্শক।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ২য় বিশ্বযুদ্ধের পাঁচ মিত্র শক্তি স্থায়ী সদস্য হিসেবে স্থান পেয়েছে। তন্মধ্যে একটিও মুসলিম রাষ্ট্র নয়। ফলতঃ মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় ভূমিকা রাখার কেউ নাই। চীন-রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র-ফ্রান্স-যুক্তরাজ্যের মধ্যকার আধিপত্যের খেলা না চললে জাতিসংঘ প্রত্যক্ষ ভাবে মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে কাজ করতো।

বর্তমান বিশ্বের কুটনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করলে ফিলিস্তিনের জন্য মহা সংকট মনে না হলেও পরিস্থিতির উন্নতি আদৌ ঘটবে না। দিনশেষে ফিলিস্তিনবাসী পূর্বের ন্যায় ধারাবাহিক ট্রাজেডি ভোগ করতেই থাকবে। আজকের ইউক্রেনে যা ঘটছে ফিলিস্তিনেও তাই ঘটবে। ইরান কর্তৃক হামাসকে সহায়তা প্রদান হলো ভূরাজনৈতিক পদক্ষেপ। সৌদি, তুরস্ক, মিশরসহ যেসব মুসলিম রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলছে সেসব আদতে তাদের মুখের বুলি। কার্যকর ফলাফল প্রতিষ্ঠিত করার মত দৃঢ় চেতা শক্তিধর একটি মুসলিম রাষ্ট্রও নেই। জর্ডান, সিরিয়া, লেবানন ও মিশর ফিলিস্তিন-ইজরায়েলের বর্ডার ঘেরা রাষ্ট্র না হলে তাদের ভূমিকা বাংলাদেশের চেয়ে বেশি হতো না। কুটনৈতিক দৌড় প্রতিযোগিতা না থাকলে হয়তো কোনো কোনো মুসলিম রাষ্ট্র হামাসকে সন্ত্রাসী বলতেও দ্বিধা করতো না। মুসলিম বিশ্বের ঐক্য আজ কাজীর গোয়ালের গরুর মত।

১৯৬৭ সালের ছয়দিনের যুদ্ধের পর ১৯৬৯ সালের ২১ আগস্ট ইসরাইল জেরুজালেমের মসজিদুল আকসায় অগ্নিসংযোগ করে। এর ফলে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে প্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়ায় ২৫ আগস্ট ১৪টি আরব দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীগণ মিশরের রাজধানী কায়রোতে এক বৈঠকে মিলিত হয়। পরবর্তীতে ২৫ সেপ্টেম্বর ওআইসি প্রতিষ্ঠিত হয়। মসজিদুল আল-আকসাকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটি নামমাত্র ভূমিকা রেখেই ক্ষান্ত। বর্তমান ওআইসি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ছায়া সংস্থা হিসেবে শোভা পেয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের কার্যের বৈধতা দেয়াই সংস্থাটির মূল কর্ম।

মুতামার আলম আল-ইসলামী, রাবেতা আলম আল-ইসলামী, আরব লীগ সহ মুসলিম সম্প্রদায়ের সংগঠন গুলোর ভূমিকাও যথাযথ নয়। এদের দাবি ছিল, তারা মুসলমানদের ঐক্য ও উন্নয়নের জন্য নিবেদিত। এরা গায়ে জুব্বা ও মাথায় আরবীয় গামছা পড়ে দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়াত আর মসজিদ, মাদ্রাসা, ব্যাংক, হাসপাতাল আর ক্লিনিক বানানোর নামে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করত। এখন এরা কোথায়?

মুসলমানদের এ কঠিন মহাদুর্যোগের সময় এদের ভূমিকা কী? রোহিঙ্গাদের ফেরৎ পাঠানোর বিষয় এরা মুসলিম দেশগুলোকে কেন একত্র করতে পারছে না? সিরিয়াকে পশ্চিমাদের খপ্পর থেকে বাঁচানোর জন্য এরা কেন সচেষ্ট নয়? ইরানকে মার্কিনী ও ইসরাঈলী আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য এরা আগাম ব্যবস্থা কেন গ্রহণ করছে না? কাতারের বিরুদ্ধে মার্কিনী-সৌদি আগ্রাসনের সময় এরা কোথায় ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর একটাই। এ প্রতিষ্ঠানগুলো সৌদি তথা মার্কিনীদের আজ্ঞাবহ ভূত্য। এই যখন মুসলিম সংস্থা সমূহের অবস্থান তখন দিনশেষে ফিলিস্তিনের ভাগ্য ফেরার সম্ভাবনা কতটুকু?

মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্র সমূহের দিকে তাকালে হতাশ ইসলামি চিন্তাবিদের দল। মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র মুসলিম চেতনাহীন ব্যক্তিদের দখলে। ইসলামি খেলাফতের আদর্শ টিকিয়ে রাখতে পদক্ষেপ নেই কাহারো। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে ওয়াশিংটনকে বানিয়েছে শালিস খানা। যত দর কষাকষি সবের শেষ সমাধান খোঁজে হাউট হাউজে। এই যখন মুসলিম রাষ্ট্র সমূহের অবস্থা তখন ফিলিস্তিনের ভাগ্য ফিরবে কিসে?


একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হচ্ছে শরীরের উপরের অংশের। এখন আর দেহের প্রায়োগিক যুদ্ধ নেই বললেই চলে। মেধার যুদ্ধই সবচেয়ে বড়। ইরান সে যুদ্ধে অনেক এগিয়েছে। মুসলিম বিশ্বের অন্যতম তেহরানের আত্মবিশ্বাসী চরিত্রে পশ্চিমা বিশ্ব হোঁচট খাচ্ছে। ইরান মাত্র একটি রাষ্ট্র। তাদের তত্বাবধানে পরিচালিত গোষ্ঠীও তেমন সংখ্যায় নয়। হাতেগোনা দুয়েকটার মধ্যে হিজবুল্লাহ অন্যতম। এতেই কুপেকাত আমেরিকা। ক'দিন আগে আফগানিস্তানে নাস্তানাবুদ হয়েছিলো আমেরিকা। টুইনটাওয়ার ঘটনায় লাদেন ইস্যুতে কতই না আগ্রাসন চালিয়েছিলো। তালেবানদের ইমানের কাছে হেরে গিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন। সামান্য মোল্লাদের কাছেই যাদের এতো নির্মম পরাজয় তাদের দৌঁড় যে খুব বেশি দূর নয় তা সহজে অনুমেয়। আফগান ও ইরানের ন্যায় সমগ্র বিশ্ব মুসলিম যদি হোয়াইট হাউস ও তথাকথিত জাতিসংঘকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখাতে পারতো তবে সারা পৃথিবী মুসলমানদের করের মধ্যে চলে আসতো। মুসলিম বিশ্ব জায়নবাদের পরিকল্পনার জালে আবদ্ধ। নারী, ক্ষমতা ও অর্থলিপ্সা মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বকে ভঙ্গুর করে তুলেছে।

মুসলিম বিশ্বকে জাতিসংঘ যেন গোনার বাহিরে রেখেছে। অথচ বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাবান মুসলিম বিশ্ব। বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ২৫ শতাংশ মুসলমান। ওআইসিভুক্ত ৫৭টি মুসলিম দেশ পৃথিবীর ২৩ শতাংশ ভূমির অধিকারী। পৃথিবীর মোট তেল ও গ্যাসের ৮০ ভাগ, স্বর্ণের ৬৫ ভাগ, রাবার ও পাটের ৭৫ ভাগ ও খেজুরের ১০০ ভাগই মুসলিম দেশগুলোর। বর্তমানে অমুসলিম বিশ্বের ৮৭ ভাগ বাণিজ্যই মুসলিম দেশগুলোর সাথে। তারপরও মুসলিমবিশ্ব আজ অবহেলিত এবং মুসলমানরা চরমভাবে নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত।

মুসলিম বিশ্ব এতো বেশি শক্তি সম্পন্ন হওয়ার পরও এতো দুর্দশার হেতু কি? আমাদের চিন্তা করা দরকার, যে মুসলিম উম্মাহ সর্বদা নেতৃত্ব দিতে অভ্যস্ত ছিল, আজ তাদের এই অধঃপতন কেন? কেনইবা বৈশ্বিক জনসংখ্যার মাত্র ০.২৫ শতাংশ ইহুদী বিশ্ব জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ মুসলমানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে বায়তুল মুকাদ্দাসে আধিপত্য বিস্তার করছে? কেনইবা প্রাচ্য-প্রাশ্চাত্যের নেতারা মুসলমানদের সংখ্যাধিক্যের ও সম্পদের ভ্রুক্ষেপ করছে না? কেনইবা মুসলিম নারীদের ধর্ষণ করা সত্ত্বেও আমাদের রক্ত জেগে ওঠে না? নিশ্চয়ই মুসলিম উম্মাহ গুরুতর পাপে জড়িয়ে আছে, যা এমন অধঃপতনের পথকে সুগম করছে। কেননা মুসলিম উম্মাহ কখনো কাফেরদের শক্তির দ্বারা পরাজিত হয় না বরং নিজেদের দূর্বলতার কারণেই পরাজিত হয়। যার স্পষ্ট উদাহরণ বদর ও উহুদ যুদ্ধ। বদরের প্রান্তরে মুসলমানদের দৃঢ়তার বলয়ে অনায়াসেই বিজয় লাভ করে কিন্তু উহুদ প্রান্তরে সামান্য আনুগত্যহীনতার কারণে মুসলমানদের সাময়িক পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। উম্মাহর প্রতিটি মানুষের অন্তরে আজ ব্যাধির আবাস। দুনিয়ার লোভ ও মৃত্যুকে অপছন্দ করাই হলো সেই গুরুতর ব্যাধি। সাহাবায়ে কেরাম জান্নাত লাভের আশায় মৃত্যুকে ভালোবাসতেন কিন্তু আমরা দুনিয়ার লোভে মৃত্যুকে অপছন্দ করছি। মুসলিম বিশ্বের দুর্যোগটা মূলত মুসলমানদের অন্তরে দুনিয়ার ভালোবাসা বেড়ে যাওয়া এবং মৃত্যুকে অপছন্দ করা।


মুসলমানদের ভূমি আন্দালুসিয়া দীর্ঘদিন যাবৎ মুসলমানদের শাসনামলে থাকার পর সর্বশেষ দুর্গ গ্রানাডা অঞ্চলে সংঘটিত প্রতিরোধ আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে মুসলিমরা আন্দালুসিয়া হারায়। কালক্রমে সেই আন্দালুসিয়া মুসলমানদের স্মৃতিপট থেকেই যেন হারিয়ে গেছে। মুসলমানগণ বর্তমানে স্পেন থেকে পর্যটন ভিসা নিয়ে আন্দালুসিয়ার কর্ডোভা মসজিদে ভ্রমণে যায়। ফিলিস্তিনের ব্যাপারটাও আজ সেদিকেই যাচ্ছে। ফিলিস্তিনরা প্রতিনিয়ত নির্মম নির্যাতনের স্বীকার হলেও বিশ্ব মুসলমানের টনক নড়ছে না। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় আমাদেরকে ইসরায়েলের ভিসা নিয়ে আল-আকসা ভ্রমণে যেতে হবে। ফিলিস্তিনের সমস্যাটা মুসলিম উম্মাহর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। এই সংকট মুসলিম উম্মাহর আত্মমর্যাদার বিষয়। এই সংকট উত্তরণে মুসলিম উম্মাহর কিছু করণীয় দিক রয়েছে।

১. ফিলিস্তিন জাগরণ সৃষ্টি করা : ফিলিস্তিন ইস্যুটা যেন কখনোই স্তিমিত না হয় সেজন্য ফিলিস্তিন ইস্যুটাকে সঠিকভাবে বুঝতে হবে। এ ব্যাপারে মুসলমানদের মাঝে চেতনা ও জাগরণ সৃষ্টি করতে হবে। ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনে সংঘটিত হামলার দৃশ্য বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে হবে। এ লক্ষ্যে নিজেদের আলাপনে, মসজিদের খুতবায়, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে, সোশ্যাল মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়ায় সরব থাকতে হবে। মুসলমানদের জাগিয়ে তুলতে নতুন নতুন মাধ্যম আবিষ্কার করতে হবে। যেমন, গল্প তৈরি, বাচ্চাদের মাঝে ফিলিস্তিন মুক্তি চেতনা সৃষ্টির জন্য ভিডিও গেম, ফিলিস্তিনের ইতিহাসের ওপর রচনা প্রতিযোগিতা আয়োজন করা যেতে পারে।

২. দৃঢ় প্রত্যয়ী হওয়া : মুসলমানদের অন্তর আজ মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে মুসলিম উম্মাহকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য দৃঢ় প্রত্যয়ী হতে হবে। মুসলমানরা কখনো শক্তি সামর্থ্যের কাছে পরাজয় বরণ করেনি বরং পরাজয় বরণ করেছে নিজেদের দুর্বলতার কাছে। তাই ফিলিস্তিন বিজয়ের জন্য মুসলমানদেরকে সব দুর্বলতা কাটিয়ে সত্য ও ন্যায়ের পথে দৃঢ় থাকতে হবে।

৩. অর্থের যোগান দেওয়া : বর্তমানে ফিলিস্তিনের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আর্থিক সহায়তা। ভয়ংকর অর্থনৈতিক অবরোধ, কর্মহারা, ক্রসিং বন্ধ হওয়া, কৃষি জমি উজাড়, ঘরবাড়ি ধ্বংস, খাদ্য-বস্ত্র-অস্ত্রশস্ত্রের ঘাটতি, যুবকদের শাহাদাত বরণ, অসংখ্য নারী বিধবা হওয়ার ফলে তারা আজ দিশেহারা। সব মুসলমান চাইলেই স্বশরীরে জিহাদে অংশগ্রহণ করা সম্ভব না হলেও আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে জিহাদে অংশগ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে। আমাদেরকে আর্থিক সহায়তার নজির স্থাপনের মধ্য দিয়ে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও আন্তরিকতার প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর রাহে জিহাদকারী কোনো যোদ্ধাকে যুদ্ধসাজে সজ্জিত করে দিল, সেও যেন জিহাদ করলো।’ (বুখারি, হাদিস নং-২৮৪৩) ফিলিস্তিনের জন্য আজ এক টাকা দান আল্লাহর কাছে সাতশ টাকা দানের চেয়েও অধিক মূল্যবান হবে। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, হজ্ব ও জিহাদের ক্ষেত্রে এক দিরহামকে সাতশগুণ বাড়িয়ে প্রতিদান দেওয়া হবে।

৪. ইহুদিদের বয়কট করা : ফিলিস্তিন ইস্যুকে দাঁড় করিয়ে মুসলিম উম্মাহ ইহুদি সমপ্রদায় এবং তাদেরকে সাহায্যকারী পশ্চিমাদেরকে বয়কট করতে হবে। বয়কটের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষা বিষয়ক অনেক প্রভাব রয়েছে। পশ্চিমাদের উৎপাদিত পণ্যের সবচেয়ে বড় ভোক্তা হলো মুসলিম সমপ্রদায়। মুসলমানগণ সম্মিলিতভাবে কাফেরদেরকে বয়কট করতে পারলে তাদের টনক নড়বে। বিশ্ব ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদের প্রায় ৭০ শতাংশ মুসলমানদের দখলে। তাই কাফেরদেরকে বয়কট করার মধ্য দিয়ে মুসলিম উম্মাহ নিজেদের সম্পদের যথার্থ ব্যবহার উপযোগী করে তুলতে হবে।

৫. উম্মাহর বৃহত্তর ঐক্য সাধন : মুসলমানগণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কারণে আজ দ্বিধাবিভক্ত। ফলে ফিলিস্তিনসহ সারা বিশ্বে মুসলমানগণ মার খাচ্ছে। ফিলিস্তিন ইস্যুকে কেন্দ্র করে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো নিজেদের মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য স্থাপন করতে হবে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে একটি দেহের ন্যায় তুলনা করেছেন। হজরত নুমান ইবনে বশির (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘মুমিনদের পরস্পরের ভালোবাসা, অনুগ্রহ, হূদ্যতা ও আন্তরিকতার উদাহরণ হচ্ছে একটি দেহ বা শরীরের মতো। যখন দেহের কোনো একটি অঙ্গ আহত বা আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তখন সারা দেহের সবগুলো অঙ্গই নিদ্রাহীন হয়ে পড়ে এবং কষ্ট-যন্ত্রণায় জরাগ্রস্ত ও কাতর হয়ে পড়ে।’ (সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম) দেহের এক অঙ্গে আঘাত পেলে যেমনিভাবে পুরো দেহ আঘাতপ্রাপ্ত হয় তেমনিভাবে মুসলমানদের যে কোনো সংকটেই পুরো উম্মাহকে জেগে উঠতে হবে।

৬. সম্মিলিত জিহাদ ঘোষণা : ইহুদি সমপ্রদায়কে আজ পুরো কাফের বাহিনী সহায়তা করে যাচ্ছে। জাতিসংঘ নিজেদেরকে মানবাধিকার রক্ষাকবচ বলে ঘোষণা দিলেও তারা শুধুমাত্র খ্রিস্টান ও স্বজাতির পক্ষেই কাজ করছে। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী। আজ ইহুদি সমপ্রদায়ের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া মানে পুরো কাফের সমপ্রদায়ের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া। তাই মুসলিম উম্মাহকে আজ সম্মিলিতভাবে জিহাদ ঘোষণা করতে হবে। আমরা অনেকে মনে করি, ফিলিস্তিনে জিহাদের দরজা খুলে গেলেই সবাই জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়বে এবং বিজয় ছিনিয়ে আনবে। বাস্তবে বিষয়টা অতো সহজ নয়। তাই প্রথমে মুসলিম উম্মাহকে বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজেদেরকে প্রস্তুত করত: সম্মিলিত জিহাদ ঘোষণা করতে হবে।

৭. মাবুদের সাহায্য কামনা : কাফেরদের সাথে লড়াইয়ে মুসলমানদের একটি শক্তিশালী অস্ত্র হলো মাবুদের দরবারে দোয়া করা। আল কোরআন ও হাদিসে বিপদাপদ ও কঠিন পরিস্থিতিতে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য অনেক দোয়া শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে। সুরা ইউনুসের ৮৫-৮৬ নাম্বার আয়াতে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে আমাদের রব, আপনি আমাদেরকে জালিম কওমের ফিতনার পাত্র বানাবেন না। আর আমাদেরকে আপনার অনুগ্রহে কাফির সমপ্রদায় থেকে নাজাত দিন।’ সুরা কাসাসের ২১ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘হে আমার রব, আপনি জালেম সমপ্রদায় থেকে আমাদেরকে রক্ষা করুন।’ হজরত আনাস থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘হে আল্লাহ, আপনিই আমার শক্তির উৎস ও সাহায্যকারী। আপনার সাহায্যেই আমি কৌশল অবলম্বন করি। আপনার সাহায্যেই বিজয়ী হই এবং আপনার সাহায্যেই যুদ্ধ করি।’ (আবু দাউদ,হাদিস নং-২৬৩২) দোয়ার মধ্যে বরকত রয়েছে। তাই সর্বত্র আল্লাহর নিকট দোয়া করতে হবে। বিশেষ করে সব ফরজ নামাজ এবং রাত্রিকালীন নামাজে।

সবিশেষে উল্লেখ্য যে, বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ফিলিস্তিন অনেক বড় ব্যাপার। জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদ মুসলমানদের প্রথম কিবলা। আল-আকসা আমাদের আবেগের জায়গা। তাই মসজিদে আল-আকসাকে কেন্দ্র করে ফিলিস্তিন জয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্ব জয়ের সীদ্ধান্ত নিতে হবে। এজন্য প্রতিটি মুহূর্তেই আমাদেরকে সরব ও সচেতন থাকতে হবে। মহান আল্লাহ মুসলিম উম্মাহর জয় সুনিশ্চিত করুন। আমিন।

লেখক,
মুহাম্মদ ইয়াসিন আরাফাত ত্বোহা
কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক।
ইমেইল[email protected]

পঠিত : ১৫৯ বার

মন্তব্য: ০