Alapon

কোটাবিরোধী আন্দোলন দমাতে পুলিশ কেন মরিয়া?

বেকার তরুণের সংখ্যা দিন দিন যে হারে বাড়ছে তা সত্যিই আতঙ্কের ব্যাপার। শিক্ষিত এই বিপুল জনগণকে জনশক্তিতে পরিণত করতে না পারলে তা বোঝা হয়ে দাঁড়াবে পুরো জাতির ওপর। দাঁড়াবে কি? দাঁড়িয়েছে ইতোমধ্যেই। আর এরমধ্যে চাকরির বাজারে কোটাপদ্ধতি আবার মরার উপর খরার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চাকুরিপ্রার্থী তরুণ সমাজের কাছে এই কোটাপদ্ধতি রীতিমত মূর্তিমান আতঙ্কের নাম।
নিয়োগে বিদ্যমান কোটাব্যবস্থাকে নিয়োগের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা উল্লেখ করে আকবর আলি খান বলেন, কোটাব্যবস্থা পুরোপুরি তুলে দেওয়া উচিত। কোনো দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য কোটাব্যবস্থা চলতে পারে না।

বিশিষ্ট সাংবাদিক, কলামিস্ট ও লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ এর মতে- ‘শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ও দেশের পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ছাড়া কোনো কোটা রাখা উচিত নয়। তাদের (প্রতিবন্ধী ও ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী) কোটার মধ্যে রাখলেও এক শতাংশের বেশি রাখা উচিত হবে না। এর মাধ্যমে এক শ্রেণীর লোকজন সুবিধা ভোগ করে আসছে। এর ফলে দেশের সঠিক মেধাবীরা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চাকরি পাচ্ছে না। দেশের সার্বিক উন্নয়ন মেধাবীদের সঠিক সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।’

কোটা পৃথিবীর সব দেশেই বিদ্যমান, তবে কোথাও এটা চিরস্থায়ী নয়। কোটা সাধারণত হয় ১০–১৫ বছরের জন্য সমাজে পিছিয়ে পড়া বিশেষ কোনো জনগোষ্ঠীর জন্য, যেমন ভারতে ১৫ বছরের জন্য দলিত সম্প্রদায়ের কোটা এখন বিদ্যমান, যুক্তরাষ্ট্রে মোট ১০ বছর রেড ইন্ডিয়ানদের জন্য ২ শতাংশ কোটা বিদ্যমান ছিল। সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো দেশেই ১৫ শতাংশের ওপর কোটা বিদ্যমান নেই, যেখানে আমাদের দেশে ৫৬ শতাংশই কোটায় চলে যায়, যা ৪৮ বছর ধরে চলমান! ভাবা যায়?

অনুসন্ধান বলছে, বর্তমানে দেশে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরি বিশেষ করে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশ কোটা ব্যবস্থা প্রচলিত। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী কোটায় ১০, জেলা কোটা ১০, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য পাঁচ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে এক শতাংশ কোটা। বাদবাকি ৪৪ শতাংশ আসনের জন্য ফাইট দিচ্ছে সংখ্যাগুরু বিপুল সংখ্যক মেধাবী। সংখ্যাগুরু সাধারণ চাকরিপ্রার্থী এবং সংখ্যালঘূ কোটাধারীদের মধ্যে এত বড় বৈষম্য সম্ভবত পৃথিবীর আর কোনো দেশে নেই।

যাইহোক, পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হতো যে, তারা সকল ক্ষেত্রে আমাদের সাথে বৈষম্য করছে। আমাদের প্রাপ্য বুঝিয়ে না দিয়ে তারা বেশি বেশি সুযোগ সুবিধা নিচ্ছে। কিন্তু একি! স্বাধীন বাংলাদেশে সরকারি উদ্যোগে যে বৈষম্যের চাষাবাদ করা হচ্ছে তা তো পাকিস্তানের চেয়েও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে!


কোটা ব্যবস্থা সংস্কার করে ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নিয়ে আসা, কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধা থেকে শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়া, কোটায় কোনো ধরনের বিশেষ পরীক্ষা না নেওয়া, সরকারি চাকরিতে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা এবং চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার না করার মত যৌক্তিক দাবি নিয়ে শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমেছে। কিন্তু এতে তাদের অপরাধ কোথায়? এসব দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে কোন প্রকার সন্দেহ বা প্রশ্ন থাকলে প্রশাসন তা জেনে নিতে পারে। কিংবা কোন অসৎ উদ্দেশ্য খুঁজে পেলে তা জাতির সামনে স্পষ্ট করতে পারে। কিন্তু সেসব কিছু না করে পুলিশ নিজ থেকেই কেন সহিংস হয়ে উঠলো? কেন ক্ষুধার্ত হায়েনার মত হামলে পড়লো আন্দোলনকারীদের ওপর? কেন শারীরিকভাবে নাজেহাল করলো আন্দোলনরত ছাত্রীদের? কেন অসভ্যতার চূড়ায় নিজেদের উপস্থাপন করলো? কেন আমার বাবার ট্যাক্সের টাকায় কেনা টিয়ারশেল আর রবার বুলেট আমারই ভাইয়ের গায়ে ছুড়লো? পুলিশের এখানে কি স্বার্থ??

শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশের এই অযাচিত হস্তক্ষেপ কতটুকু গ্রহনযোগ্য? গত রোববার ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের’ ব্যানারে মিছিল বের করে স্মারকলিপি প্রদানের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় অভিমুখে যাত্রা করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ সময় মিছিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহস্রাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেন।


শিক্ষার্থীরা ‘দাবি মোদের একটাই, কোটার সংস্কার চাই’, ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই, ‘কোটা সংরক্ষণ বন্ধ করো, মেধাবীদের সুযোগ দাও’ লেখাসংবলিত প্ল্যাকার্ড বহন করেন। এতে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন বিক্ষোভকারীরা। এ সময় টিয়ারশেলের ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়া কয়েকজনসহ ৬৩ জনকে আটক করে পুলিশ। পরে শাহবাগে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে রাতে তাদের ছেড়ে দেয় শাহবাগ থানা পুলিশ। কিন্তু এখানেই পুলিশ ক্ষান্ত থাকেনি। বাহাদুরি শতভাগ প্রদর্শণের লক্ষ্যে ৮০০ অজ্ঞাত আসামী দেখিয়ে একটি মামলা ঠুকে দেয় তারা। পুলিশের পক্ষ থেকে এসআই মির্জা বদরুল হাসান বাদী হয়ে বুধবার রাতেই ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ দেখিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলাটি করেন। পুলিশের অভিযোগ-পুলিশের ওপর আক্রমণ এবং রাস্তা অবরোধ করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি ও যানবাহন ভাঙচুর করে সম্পদের ক্ষতি সাধন করেছে আন্দোলনকারীরা! 

অথচ দেশের মিডিয়াগুলোতে লাইভ দেখানো হয়েছে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশের অন্যায়ভাবে হামলার দৃশ্য। কিন্তু ওসব দলীল প্রমাণ আসলে দেখবে কে? সরকার বাহাদুর তো কোটা রাখতে পারলেই সুবিধা। ওসবের সুযোগ নিয়ে দুর্নীতি করার সুযোগ কেন তারা হাতছাড়া করবে? তাই পুলিশকে দলীয় পেটোয়া বাহিনীর মত ব্যবহার করে দমানোর চেষ্টা করছে আপামর শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলন। কিন্তু এভাবে কি দমিয়ে দেয়া যাবে ছাত্রজনতার আন্দোলন? পুলিশ যদি রক্তখেকো হয়ে ওঠে তবে ছাত্রজনতা কি পিশাচের কাছে নিজেদের বিলিয়ে দিতে হাতে চুড়ি পরে অপেক্ষা করবে? তা কি করে হয়! প্রয়োজনে অনেক বড় ত্যাগের দৃষ্টান্ত তৈরী হবে। কিন্তু বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তুলতে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করবে এদেশের ছাত্রসমাজ।

পঠিত : ৭৭৪ বার

মন্তব্য: ০