Alapon

সাভার ট্রাজেডি


সাভারের রানা টাওয়ার এখন এক ধ্বংসস্তুপ। মানুষের লাশ এবং কংক্রিটের মিলিত এক ধ্বংসস্তুপের নাম রানা টাওয়ার, জীবনের তাগিদে প্রতিদিন আর সেখানে শ্রমিকের পদচারণা নেই। প্রতিটি গার্মেন্টস মেশিনারিজের শব্দ, বিদ্যুতের পাখার ঘুর্ণন, সাড়ি সাড়ি কাপড়ের রোল, কাপড় কাটা, সেলাই করা,শিপমেন্টের জন্য প্রস্তুতকৃত মালামাল প্যাকেটজাত করা-সব ব্যস্ততা বন্ধ হয়ে গিয়ে এখন সেখানে চলছে প্রিয়জন হাড়ানো মানুষের আর্তনাদ। একদিকে বিল্ডিং এর ধ্বংসস্তুপ অন্য দিকে পঁচা, গলিত লাশের গন্ধ অন্যদিকে শোকার্ত মানুষের আহাজারি আর কান্নার রোনাজারি। বিভিষিকাময় পরিবেশে এখনো চলছ স্বজনদের খুঁজে ফেরা। এখনো ছবি হাতে ভাইয়ের জন্য, পিতার জন্য, স্বামীর জন্য, স্ত্রীর জন্য, মায়ের জন্য, বোনের জন্য অসংখ্য মানুষের সকাল-সন্ধ্যা অপেক্ষা। এ অপেক্ষার পালাও এক সময় শেষ হবে। মানুষের কান্না এক সময় থেমে যাবে। নিহত পরিবারগুলির পরিচয় আমাদের কাছ থেকে হাড়িয়ে যাবে। মাতা-পিতা হাড়ানো সন্তানদের হৃদয়ের গুমরে মরা কান্নায় তার অন্তর ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকবে। স্বামী হারা নারী ‘বিধবা’ পরিচয় নিয়ে অন্তর্দহনে ক্ষত-বিক্ষত হবে। সন্তানহারা পিতা সন্তানের শোকে নিজের দুঃখগুলো নিজের কাছেই জমা করে হা-পিত্যেশ করবে। প্রিয়জন হাড়ানোর বেদনা নিয়ে মানুষগুলো আবার ফিরে যাবে যার যার ব্যস্ততায়। স্ত্রীকে হাড়িয়ে অনেক স্বামী সন্তান নিয়ে জীবনের নতুন যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে। দুঃখী মানুষগুলোকে নিয়ে পত্রিকায় এই লেখা এক সময় থেমে যাবে। টি.ভি.র টক শো বন্ধ হয়ে যাবে। আলোচনা-সমালোচনা, তদন্ত, দোষীদের বিচারের দাবীতে আন্দোলন সবই এক সময় থেমে যাবে। আমরা হয়তো এক সময় ভুলেই যাবো সাভারে রানা টাওয়ার নামে একটি টাওয়ার ছিল। নিহত মানুষগুলির পরিবারকে তাদের হাড়ানো মানুষগুলি আর ফিরে আসবে না। আহত মানুষগুলো যাদের কারো হাত নেই, কারো পা নেই, কারো চোখ নেই যারা দুর্ঘটনার এক ঘন্টা আগেও সুস্থ ছিল পঙ্গুত্বের জীবন নিয়ে তারা দুঃখের জীবন পাড়ি দিবে। যারা কখনো কারো কাছে হাত পাতে নি, ভিক্ষা চায়নি এদের অনেকেই হয়তো জীবনের তাগিদে দু মুঠো অন্যের জন্য রাস্তার পাশে কাতর কন্ঠে মিনতি জানাবে। হয়তো তাদের ভাষা এমন হবে আমার হাত ছিলো, পা ছিলো,চোখ ছিলো, আজ আমি এক অসহায় ব্যক্তি আপনাদের সাহায্য চাচ্ছি। এভাবে ই অসহায় জীবনগুলো দুনিয়ার মানুষের সমানে নিজেদের অসহায় জীবনের উপাখ্যানগুলো তুলে ধরবে। কিন্তু অবাক পৃথিবী তাদের জীবন কখনোই ফিরিয়ে দিতে পারবে না। কিন্তু কেন? এভাবে বার বার খেটে খাওয়া দুঃখী মানুষগুলোর জীবনের উপর দিয়েই সব ঝড় ঝঞ্জা বয়ে যাবে। কেন সকল বিপদ, দুর্ঘটনার নিরব শিকার হবে? এর কি কোন প্রতিকার নেই। অতি দরিদ্র পরিবারের অসহায় মানুষগুলো যারা দু’মুঠো অন্যের জন্য, একটু মাথা গোজার ঠাই পাবার জন্য, সন্তানের মুখে দু বেলা খাবার তুলে দেবার জন্য,কেউবা অসহায় পিতার ঔষধ কিনে দেবার জন্য নিজের সমস্ত শ্রমকে ঢেলে দিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকাকে করছে মজবুত শুধু তারাই সকল দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে? যে সমস্ত মানুষগুলোর ঘামের বিনিময়ে শহরের উচ্চবিত্তদের সম্পদের পাহাড় রচিত হচ্ছে তারাই সব সময় দুর্ঘটনার নির্মম শিকার হচ্ছে। দেখে মনে হয় যেন ওদের জীবনের কোন মূল্য নেই। ওরা মানুষ নয়। ওদের প্রাণ নেই। ওরা কোন নির্জীব পদার্থ অথবা ধনীদের আরাম আয়েশ এবং সম্পদের পাহাড় রচনার জন্য ওদের সৃষ্টি করা হয়েছে। অসহায় জীবনগুলোর ঘামের উপর দিয়ে যারা অট্টালিকার আর সম্পদের মালিক হন প্রতিটি দুর্ঘটনার পর তাদের আর খুজে পাওয়া যায় না। ঘটনা-দুর্ঘটনার নির্মম শিকার মানুষগুলোর এ বোবা কান্না আকাশ বাতাস ভারী করলেও আমাদের সমাজপতিদের এবং সরকারের বোধোদয় ঘটছে না। সাভারের রানা ভবনের দুর্ঘটনার সামান্য পর্যালোচনা করলেই আমাদের কাছে এ বিষয় গুলো ধরা পড়বে।
ভয়াবহ দুর্ঘটনার পূর্বেই সংকেত দেয়া হয়েছিল : ৮তলা এই ভবনটিতে আগের দিনই ফাটল দেখা দেয়। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক এবং সংবাদ সংস্থার খবর প্রকাশ করে যে ঘটনার আগের দিন দেখা যায় ভবনটির তিনটি পিলার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এ কারণে ওই দিন ভবনের সব গার্মেন্টস ও ব্যাংক ছুটি দেয়া হয়। দোকানগুলোও বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়া হয়। স্থানীয় প্রশাসনের লোকজন গিয়ে ভবনটি খালি করারও নির্দেশ দেয়। কিন্তু মঙ্গলবার রাতে সবাইকে ফোনে জানানো হয় ভবনটিতে কোনো অসুবিধা নেই। সকালে সব গার্মেন্টস শ্রমিককে কাজে যোগ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। এ কারণে সকালে গার্মেন্টস শ্রমিকরা কাজে যোগ দেন। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে হঠাৎ ভবনটি কেঁপে ওঠে। এ সময় ভেতরে তারা তীব্র আর্তচিৎকার শুনতে পান। ভবনের সামনেই তখন যুবলীগের সভা চলছিল।
ভবন মালিক সাভার থানা যুবলীগের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক রানা ওই সভার নেতৃত্বে ছিলেন। আওয়ামীলীগ ও যুবলীগের বেশ কিছু নেতাকর্মী ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে রানার অফিসে অবস্থান করছিলেন। হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে রানা নিজেও ভবনের নিচতলায় গিয়ে আশ্রয় নেন। সেখানে তিনিও আহত হন। ৩-৪ মিনিটের মধ্যেই ভবনটি গুঁড়ো হয়ে মাটিতে পড়তে থাকে। প্রত্যক্ষদর্শীরাএ সময় কিছু লোককে দৌড়ে ভবন থেকে বের হয়ে যেতে দেখেন। বেশির ভাগ লোকই ভবনের মধ্যে আটকা পড়েন বলে সংবাদ মাধ্যমে জানা যায়। ভবনটি যখন মাটিতে পড়ে যায় তখন পাশের ভবনগুলোর ওপর খন্ডিত অংশ ছিটকে পড়ে। এতে ওই সব ভবনও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এ ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটার আগের দিন ভবনে ফটল দেখা দেয়ার পর যখন সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। এমনকি শিল্প পুলিশ যেখানে ভবন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় এরপর কার নির্দেশে এবং কার অনুমতিতে ভবনে আবার শ্রমিকদের ডেকে এনে কাজ শুরু করা হলো? এটা কি এ জন্য যে ভবনের মালিক রানা প্রভাবশালী এবং সরকার দলীয় এম পি মুরাদ জংয়ের ক্যাডার হওয়ায় তার দাপটের কাছে প্রশাসনসহ সবাই অসহায়। এই প্রভাবশালীদের দাপটে এবং ক্ষমতার অপব্যবহারে আর কত মানুষের জীবন কেড়ে নেয়া হবে? এ প্রশ্নের জবাব দিবে কে?
সংখ্যালঘুর দখল করা অবৈধ জমিতে অবৈধ ভবন : কলুর ছেলে সোহেল রানা। সাভারের এক সময়ে যুবলীগ নেতা। ক্ষমতার দাপটে হয়েছেন কোটি কোটি টাকার মালিক। তার দখলবাজির হাত থেকে রেহাই পাননি সংখ্যালঘুরাও। যে ভবনটি ধসে পড়ে, তার মধ্যেও এক সংখ্যালঘুর সম্পত্তি রয়েছে। এক সময়ে এই সোহেল রানা তার বাবার তেলের ঘানিতে কাজ করতো। বোতলে ভরে সরিষার তেল বিক্রি করতো হেঁটে হেঁটে। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, সোহেল রানার বাবার নাম আবদুল খালেক। সবাই তাকে খালেক কলু বলেই চিনতেন। বাড়ি সাভারের বাজার রোডে। বাড়িতে গরুর ঘানিতে তেল বানাতেন আবদুল খালেক। স্থানীয় অধরচন্দ্র হাইস্কুল থেকে নবম শ্রেণী পাস করেছে রানা। এরপর অভাবের তাড়নায় তার আর লেখাপড়া হয়নি। তাদের বাড়িটিকে এখনো কলুর বাড়ি হিসেবেই জানেন স্থানীয়রা।
এই সোহেল রানাই রাজনীতি করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে। প্রথমে একটি তেল তৈরির মেশিন বসায়। গরুর ঘানি থেকে উন্নতি হয় মেশিনে। নাম দেয়া হয় রানা অয়েল মিল। গোলাপ ফুল মার্কা নামের সেই সরিষার তেল সরবরাহ করা হয় রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায়। সেই রানা আজ পৌঁছেছে সমাজের উচ্চপর্যায়ে। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত থাকায় তিনি থোড়াই কেয়ার করতেন স্থানীয় প্রশাসনকে। ১৯৯৮ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দলীয় মাস্তান বাহিনী নিয়ে স্থানীয় রবীন্দ্রনাথ সাহার জমি খল করে রানা। সেখানে ডোবার ওপরে রানা প্লাজা নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয় ওই বছরই। রবীন্দ্রনাথ সাহা আদালতে মামলা করলেও সে মামলা বেশিদূর এগোয়নি। একপর্যায়ে পাগল হয়ে যান রবীন্দ্রনাথ সাহা। ২০০৬ সালে পৌরসভা থেকে ছয় তলা ভবনের অনুমোদন নেয়া হয়। অনুমোদন নিলেও কোন নকশা অনুমোদ করানো হয়নি। আর সেই ছয়তলা ভবনের উপরেই গড়ে উঠেছে আট তলা ভবন। সোহেল রানা এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। সাভারের অসংখ্য মানুষের জমি সে দখল করেছে বলে জানা যায়। স্থানীয় প্রশাসন ছিল তার কাছে জিম্মি। তার ইশারায় সাভারে অনেক কিছুই ঘটত। রানার ক্ষমতা এবং অর্থের লোভের বলি হলো অসহায় মানুষগুলো।
ইউ এন ও বললেন সমস্যা নেই ঃ দুর্ঘটনার পূর্বের দিন ফাটল দেখা দেয়ার পর যখন স্থানীয় শিল্প পুলিশ এবং সাভার পৌরসভার মেয়রের পক্ষ থেকে ভবন খালি করার নির্দেশ দেয়া হলো, তখন ইউ এন ও বললেন, সমস্যা নেই। যেখানে স্থানীয় একজন প্রকৌশলী মোঃ মিজানুর রহমান ভবনটি দেখে বললেন, বুয়েটের প্রকৌশলী এনে পরীক্ষা করে রিপোর্ট পাওয়ার পর বোঝা যাবে এ ভবন ব্যবহার করা যাবে কি না, সেখানে তিনি কিভাবে বললেন যে কোনো সমস্যা নেই? আজ বড় প্রশ্ন তিনি কেন এমন কথা বললেন? রানার অবৈধ ভবন এবং ব্যবসার সাথে তার ভাগ এবং অংশীদারিত্ব কত পার্সেন্ট? সরকার এই- টি.এন. ও কে এখনো গ্রেফতার করে নি। বরং প্রকাশিত খবর অনুযায়ী তিনি এখনো বহাল তবিয়তে আছেন। এতবড় দুর্ঘটনার পর এই ধরণের অযোগ্য, দায়িত্বজআনহীন এবং দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা দায়িত্বে থাকেন কিভাবে?
পিটিয়ে বাধ্য করা হয় কাজে যোগ দিতে : ফাটল দেখা দেয়ার পর রানা প্লাজায় অবস্থিত গার্মেন্টসগুলোতে কাজে যোগ দিতে চাননি শ্রমিকরা। শ্রমিকদের পিটিয়ে বাধ্য করা হয়েছে কাজে যোগ দিতে। এমনই অভিযোগ করেছেন বেঁচে যাওয়া শ্রমিকেরা। আহতাবস্থায় হাসপাতালে তারা এ অভিযোগ করেন।মঙ্গলবার ওই ভবনের দেয়ালে ফাটল দেখা দিলে শ্রমিকরা ভবন থেকে নেমে পড়েন। তাদের আশঙ্কা ছিল ভবনটিতে যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ওই দিন তাদের গার্মেন্ট মালিকও গার্মেন্ট ছুটি দিয়ে দেন। কিন্তু রাতে শ্রমিকদের মোবাইলে ফোন করে জানানো হয় কাজে যোগ দিতে। সকালে তারা ওই ভবনের সামনে আসেন। কিন্তু অনেকেই কাজে যোগ দিতে নারাজ ছিলেন। তাদের পিটিয়ে বাধ্য করা হয়। শ্রমিকদের কেউ কেউ অভিযোগ করেন, ভবন মালিক রানা নিজেই তাদের বলেন কাজে যোগ না দিলে পিটিয়ে হাড় গুঁড়ো করে দেয়া হবে। রানা এ সময় শ্রমিকদের হুমকি দেন, ‘যারা কাজে যোগ না দেবে মনে করব তারা বিএনপি-জামায়াতের লোক’। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও হুমকি দেয়া হয়। ভয়ে শ্রমিকেরা বাধ্য হন ওই ভবনে ঢোকেন। রানা কথাও বলেন, ‘হায়াত কমে আসলে কেউ কি বাঁচাতে পারবে’ এক নারীশ্রমিক জানান, তাদের ভয় দেখিয়ে ভবনে তোলা হয়েছে।
ফাটল দেখে তাদের ইচ্ছে ছিল না কাজ করার। তিনি বলেন, শ্রমিকদের পিটিয়ে বাধ্য করা না হলে এ ভয়াবহ পরিস্থিতি হতো না। জীবন দিতে হতো না অসহায় শ্রমিকদের।
মাদক, নারী ব্যবসা এবং টর্সার সেল : রানা প্লাজার মালিক সাভার পৌর যুবলীগের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সোহেল রানার অপকর্মের আস্তানা ছিল ধসে পড়া ভবনটি। একাধিক হত্যা মামলার আসামি এই যুবলীগ ক্যাডার ছিল স্থানীয়দের কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্ক। এই ভবনের নিচতলায় সে গড়ে তুলেছিল টর্চার সেল। এখানে বিরোধী জোটের কর্মী এবং প্রতিপক্ষ লোকজনকে ধরে এনে হাত-পা বেঁধে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হতো। এছাড়াও এখানে গড়ে তোলা হয় মাদক ও নারী ব্যবসার আখড়া। সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাই এলাকায় রয়েছে যুবলীগ ক্যাডার রানার বিশাল বাহিনী। এই বাহিনী দিয়ে সে পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণ করত। তার দাপটে ওই এলাকার সাধারণ মানুষ ও নিরীহ ব্যবসায়ীরা ছিলেন আতঙ্কে। প্রকাশ্যে অপকর্ম করলেও এর প্রতিবাদ করার সাহস পেত না কেউ। যুবলীগ নেতা সোহেল রানার প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন তার আপন বোনের স্বামীও। জমিজমা নিয়ে বিরোধের কারণে রানা বোনের স্বামী জাকির হোসেনকে ধামরাইয়ের ধুলিভিটা এলাকায় বাসস্ট্যান্ডের কাছে নিয়ে হত্যা করে লাশ ফেলে রাখে। এছাড়াও ২০০৪ সালে এক বন্ধুকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে রানা। খুন, হত্যা,গুম, নির্যাতন মাদক ব্যবসার অভায়রণ্য হওয়ার পরেও কোন এক অজানা কারণে এ ভবনের সাথে প্রশাসনের অনেক কর্তা ব্যক্তির ছিল দহরম মহরম সম্পর্ক। আজ স্বাভিবিকভাইে দাবী উঠেছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে।
লাশের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে : এই লেখাটি যখন লিখছি তখন একটি অনলাইন নিউজে দেখানো হচ্ছে এখন পর্যন্ত ৩১৮ লাশ উদ্ধার, জীবিত উদ্ধার হয়েছে ২৩৯৭ জন। নিখোজ কয়েক হাজার। সাভারের বাতাসে শুধুই লাশের গন্ধ। এত লাশ সাভারের বাতাসও সহ্য করতে পারছে না। রানা ভবনের ধ্বংস্তুপ থেকে উদ্ধারকৃত ও ভেতরে এখনো পড়ে থাকা শত শত লাশের গন্ধে এবং স্বজনদের আহাজারিতে ক্রমশ ভারী হচ্ছে সাভারের বাতাস। স্মরণকালের ভয়াবহ ভবনধসে দেয়াল ও ছাদের কংক্রিটের সাথে মিশে আছে চাপা পড়া মানুষের লাশ। উদ্ধারকাজে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করা ও সমন্বয় না থাকায় লাশের সংখ্যা বেড়েইে চলেছে। ধ্বংসস্তুপর মধ্যে আটকে পড়া মানুষগুলো জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।তারা জানে না তাদের জীবনের ভবিষ্যৎ কি। কিন্তু এই সংখ্যাও দীর্ঘ হচ্ছে। স্বজনদের খোঁজে ধ্বংস্তুপ থেকে এনাম মেডিক্যাল। আবার এনাম মেডিক্যাল থেকে অধর্চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। কিন্তু কোথাও জীবনের খোঁজ পাচ্ছেন না অনেক স্বজনেরা। স্বজনদের খুঁজতে তারা পাগলপ্রায়। তারা শুধুই তাদের স্বজনকে ফিরে পেতে চাচ্ছেন। তাদের অভিযোগ উদ্ধারকাজ ঠিক মতো হচ্ছে না। উদ্ধারকাজের ঢিলেমির কারণে অনেককেই লাশ হয়ে বের হতে হচ্ছে।
বুদ্ধি প্রতিবন্ধী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : এতবড় দুর্ঘটনার পর দোষীদের খুজে বের করার পরিবর্তে গণহত্যার নায়ক হিসেবে পরিচিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হাজির করলেন নাড়াচাড়া তত্ব। তিনি বি.বি.সিতে এক সাক্ষাৎকারে বললেন মৌলবাদী এবং হরতালকারীদের নাড়াচাড়ার কারণে বিল্ডিংটি ধ্বসে পড়তে পারে। এমনকি পরের দিন সাংবাদিকরা তাকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি এর উপর আরো বেশী জোর দেন। তার এ কথার সমালোচনা হয় তার দলের মধ্য থেকেই। আওয়ামীলীগ দলীয় সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রণি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন ‘ আওয়ামীলীগকে রক্ষা করতে হলে তাকে এখই ক্ষমতা থেকে সড়াতে হবে.. উনি যদি মন্ত্রী হন তবে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী কে?’ মাহবুবুল আলম হানিফ বলেছেন ‘উল্টাপাল্টা কথা বন্ধ করে দোষীদের গ্রেফতার করুন’ সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম একই ভাষায় কথা বলেছেন, রাশেদ খান মেনন বলেছেন দুর্ভাগ্যজনক ও কান্ডজ্ঞানহীন, ডঃ কামাল বলেছেন কান্ডজ্ঞানহীন। দলের মধ্য থেকে সমালোচনার পর তিনি এখন বলছেন আমার কথা মিডিয়ায় ঠিকভাবে আসে নি। বাংলাদেশর ইতহাসে বিল্ডিং ধ্বসের মাধ্যমে এত মানুষের জীবনহানি এবং এত বেশী পরিমাণ মানুষের আহত হওয়ার ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেনি। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যেন মানুষের জীবন নিয়ে উপহাস করতেই বেশী ভালবাসেন। ইতিপূর্বে গত ২৭ ও২৮ মার্চ সরকারি বাহিনী কর্তৃক গণহত্যা চালানোর পর তিনি বলেছিলেন পুলিশ কি আঙ্গুল চুষবে? মানুষের জীবন নিয়ে যিনি এভাবে তামাসা করেন তিনি আর যাই হোন কোনো দায়িত্বশীল মন্ত্রীর পদে বেমানান।
মানুষ মানুষের জন্য : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মানুষের জীবন নিয়ে তামাসা করলেও মানবিকতায় যাদের জীবন গড়া সেই মানুষগুলো ছুটে এসেেছ প্রকৃত মানব সেবার ব্রত নিয়ে। যে যা পেরেছে তাই নিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ঘটনার সাথে সাথেই এনাম মেডিকেল কলেজ, ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ এবং ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল আহতদের জন্য ফ্রী চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। প্রধান বিরোধী দল বি.এন.পি, হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী ছাত্র শিবির ফ্রী রক্ত দান, মেডিকেল টিম গঠনসহ নানাবিধ কার্যক্রম হাতে নেয়। নাম না জানা অসংখ্য মানুষ রক্তদানসহ আহতদের চিকিৎসা এবং উদ্ধারকাজে ঝাপিয়ে পড়ে সবটুকু সামর্থ নিয়ে। কেউ লাশ সরাচ্ছেন, কেউ আহতদের কাধে করে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন, কেউ পনি পান করাচ্ছেন, কেউ টিস্যু পেপার বিতরণ করছেন, কেউ বাতাস দিচ্ছেন। মানুষের প্রতি মানুষের দায়িত্ববোধ আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় ভুপেন হাজারিকার আবেদনময়ী সেই গাণ ‘মানুষ মানুষের জন্য-একটু সহানুভূতি কি দেখাতে পারে না-ও বন্ধু’...
ক্ষোভে ফুসে উঠেছে শ্রমিকরা : সাভারের রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার ফাঁসি, সব কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং কারখানা বন্ধের দাবিতে রাজধানীজুড়ে বিক্ষোভ করেছেন হাজার হাজার গার্মেন্ট শ্রমিক।
তাদের বিক্ষোভে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। রাস্তা অবরোধ করে দুই শতাধিক যানবাহন ভাঙচুর করা হয়। প্রতিটি গার্মেন্টে ইট নিক্ষেপ করে ভাংচুর চালায় শ্রমিকেরা। এ সময় পুলিশ মিছিলে গুলি ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করলে শুরু হয় দফায় দফায় সংঘর্ষ। পুলিশের সাথে শ্রমিকলীগের নেতাকর্মীরাও শ্রমিকদের ওপর হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে দু’জন পুলিশসহ কমপক্ষে অর্ধশত শ্রমিক ও পথচারী আহত হয়েছে। রামপুরা, বাড্ডা, মালিবাগ এলাকার সব গার্মেন্টস থেকে শ্রমিকেরা মিছিল বের করে রাস্তায় নেমে পড়ে। শ্রমিকদের এ বিক্ষোভে এখন উত্তাল রাজপথ। শ্রমিক বিক্ষোভ দমাতে সরকার পুলিশ এবং সরকার দলীয় ক্যাডার বাহিনীকে নামিয়েছে। যা আগুনে ঘৃতাহুতি দেয়ার শামিল। তাদের দাবী শ্রমিকদের জীবন নিয়ে এমন মড়ন খেলা বন্ধ করতে হবে। যাদের ঘামের বিনিময়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল হয় তারাই সবচেয়ে বেশী অবহেলার শিকার। তাদের জীবনের যেন কোন মূল্য নেই। তারা এই নির্মমতার বিচার চায়। অসহায় শ্রমিকদের জীবন নিয়ে নির্মমতা এবং নিষ্ঠুরতা তারা আর দেখতে চায় না। কিন্তু সরকার সম্ভবত তাদের দাবী মানার পরিবর্তে বাকা পথ অনুসরণ শুরু করেছে। যা কারো জন্যই মঙ্গল হবে না।
মানবতার সাথে চরম উপহাস : যে দিন সাভারে দুর্ঘটনা ঘটলো সেদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাড়িয়ে বললেন, ফাটল দেখা দেয়ার পর সব লোক সড়িয়ে নেয়া হয়েছে, এখন যারা আছে তারা হয় মালামাল সড়াতে গেছে অথবা চুরি করতে গেছে। যে মানষগুলো দু মুঠো অন্যের জন্য প্রতিদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে দেশের অর্থনীতি সচল রাখে এবং শেষ পর্যন্ত নিজেদের জীবন পর্যন্ত দিয়ে দিল তাদেরকে প্রধানমন্ত্রী চোর আখ্যা দিয়ে জাতির কাছে কি ম্যাসেজ দিলেন? যদি সব লোক সড়িয়ে নেয়া হয়ে থাকে তবে আহত-নিহত লোকগুলো আসলো কোত্থেকে? তিনি আর কি একটি কথা বলেছেন, দায় এড়ানোর জন্য ‘রানা যুবলীগের কেউ নয়।’ জনগণের প্রশ্ন হচ্ছে.. রানা যুবলীগের কেউ যদি না-ই হয়ে থাকে তবে সে পৌর যুবলীগের আহ্বায়ক হিসেবে পোষ্টার ফেষ্টুন লাগায় কিভাবে। স্থানীয় সংসদ সদস্য তাকে সেল্টার দেন কেন? ঘটনার দিন সংসদ সদস্য মুরাদ জং তাকে উদ্ধার করে কোথায় নিয়ে গেছেন? স্বাভাবিকভাবেই জনগণ এ প্রশ্নের জবাব চাইবে।
সরকারের চেয়ে সাধারণ জনগণের ভূমিকা বেশী : রড কাটা, মানুষ উদ্ধার করা, পানি পান করানো, আহতদের চিকিৎসা দেয়া, রক্ত দেয়া লাশ উদ্ধার করা সব কাজেই সাধারণ মানুষ সবটুকু সামর্থ নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছে। যে যার মতো উদ্ধারকাজ পরিচালনা করছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাধারণ মানুষ ভবনের বড় বড় ভগ্নাংশ অপসারণের চেষ্টা করছেন। সাধারণ রশি দিয়ে টেনে নামানোর চেষ্টা করছেন বড় বড় অংশ। প্রয়োজনীয় মেশিন ও যন্ত্রের অভাবে উদ্ধারকাজে কোনো গতি নেই। হাতুড়ি বাঁটাল দিয়ে তারা নয় তলা ভবন ভাঙার চেষ্টা করছেন। উদ্ধারকারীদের অনেককে দেখা যায় হ্যাকসো বেøডের ওপর ভর করে কাজ চালিয়ে যেতে। সেনাবাহিনীর তত্ত¡াবধানে উদ্ধারকাজ পরিচালিত হলেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাধারণ মানুষকে দেখা যায় সুড়ঙ্গ খুঁড়ে খুঁড়ে ভেঙে পড়া ভবনের এক তলা থেকে অন্য তলায় যেতে এ কাজে সরকারের সমন্নয়হীনতা আহত নিহত মানুষের দূর্ভোগকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। সরকার কাছে বিল্ডিং কাটার এবং আহতদের উদ্ধারের জন্য অধুনিক এবং উন্নত কোন যন্ত্রপাতি-ই ব্যবহার করে নি। বরং বিক্ষুব্দ জনতার উপর উল্টো পুলিশী হামলার ঘটনা ঘটেছে।
সরকারি সহায়তা অপ্রতুল : আহতদের চিকিৎসা, কাটার যন্ত্র, গ্যাস সিলিন্ডার, ঔষধ, স্যালাইন ইত্যাদির জন্য উদ্ধারকারীদের পক্ষ থেকে বার বার আকুতি জানালেও সরকারের তরফে তার সহায়তা ছিল নামমাত্র াপর দিকে সাধারণ জনগণ এ বিষয়ে বেশী এগিয়ে এসেছে। তবে সবচেয়ে বেশি সমস্য রড কাটার যন্ত্র এবং গ্যাস সিলিন্ডারের অভাবে। যা সাধারণ জনগণের অনেকেরই নাগালের বাইরে কিন্তু সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রচুর পরিমাণ থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু চাহিদা আনুযায়ী তা পাওয়া যায়নি।
শেষ মুহুর্তের বাঁচার আকুতি : শাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, অক্সিজেন নাই খাবার নাই, চোখে অন্ধকার এর মধ্যেও বার বার বাঁচার আকুতি জানচ্ছে আটকে পড়া মানুষগুলো। ফোনে ভাই,বাবা,মা আত্মীয়-স্বজনকে আকুতি জানিয়ে একসময়ে কন্ঠটি নিথর হয়ে যাচ্ছে। এরপর আর ও প্রান্ত থেকে কথা আসছে না। এমন অসংখ্য মানুষের বোবা কান্নায় ভারী হয়ে আছে সাভারের আকাশ বাতাস। শেষ মুহুর্তের বাঁচার আকুতি জানিয়ে পিলারের নীচে আটেক পড়া এক নারী আর্তনাদ করে বলেছেন ভাই আমার পা আটকে আছে আমার পা দরকার নেই। আমাকে উদ্ধার করেন। অন্য এক নারী আর্তনাদ এবং চিৎকার করে বলেছেন ভাই আমার দু’বছরের সন্তনাটির জন্য আমাকে বাঁচান। এ ধরণের হাজারো আর্তনাদে সাভার আজ ভারাক্রান্ত। দুঃখের ভার বইতে পারছে না সাধারণ মানুষ।
হৃদয় গহীনের অব্যক্ত বেদনা : ফেসবুকে এক তরুণের স্ট্যাটাসে এক নিহত তরুনীর শেষ মুহুর্তের না বলা বেদনা গুলো লিপিবদ্ধ করেছে ‘ সাভার ট্রাজেডির দ্বিতীয় দিন এক হতভাগ্য তরুণীর একটি লাশ বের করে আনা হলো লাশের মুঠোর মধ্যে একটি চিরকুট তাতে লেখা- মা,বাবা তোমরা আমাকে ক্ষমা করো, আমি আর তোমাদের ঔষধ কিনে দিতে পারবো না, তোমরা আমাকে ক্ষমা করো, ভাইয়েরা আপনারা আমার লাশটা দয়া করে আমার বাড়িতে পৌছে দিবেন।’
সুস্পষ্ট গণহত্যা : ফাটল ধরা ভবনে শ্রমিকদের ডেকে এনে কাজে বাধ্য করে সুস্পষ্ট গণহত্যা চালিয়েছে। দেশের বিশিষ্ট জনেরাসহ প্রতিটি সাধারণ মানুষ এ প্রতিক্রিয়াই ব্যক্ত করেছন। কারণ প্রথমে শ্রমিকরা কাজ করতে চায়নি। কিন্তু তাদের ডেকে এনে জোর করে কাজ করানো হয়েছে।
চাকুরী হাড়ানোর ভয়ে অসহায় শ্রমিকেরা ববনে ঢোকার কারণে এ ঘটনা ঘটেছে। এতেই বোঝা যায় এটি সুষ্পষ্ট গণহত্যা।
বিদেশে তৈরী পোষাক শিল্পের বাজারে ধ্বস : গার্মেন্টস ভবনে ফাটল, শ্রমিক গণহত্যা, শ্রমিক অসন্তোষ, শ্রমিকদের কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকা, হঠাৎ করে সব গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে তৈরী পোষাক শিল্পের বাজোরে ব্যাপক ধ্বস নামবে এতে কোন সেন্দহ নেই।
১০০ দিনের হরতালের চেয়ে বেশী ক্ষতি : বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক কর্মসূচী এবং হরতালের কারণে অর্থনীতির ক্ষতি নিয়ে অনেক সেমিনার হয়। বি.জে.এম.ই বি.কে.এম.ই সহ ব্যবসায়ীসংগঠনগুলো প্রায়ই এ বিষয়ে তাদের ক্ষোভের কথা জানান যে রাজনৈতিক কর্মসূচী এবং হরতালের কারণে ব্যবসায় বাণিজ্য এবং শিল্পের ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু সাভার ট্রাজেডির কারণে যে ক্ষতি হলো তা একশ দিনের হরতালের ক্ষতির চেয়েও মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনবে। এ ঘটনায় দেশী-বিদেশী বায়াররা মুখ ফিরিয়ে নিবে এবং তারা অন্য কোথাও তাদের পণ্যের বাজার খুজবে। বায়ারদের একটি অন্যতম শর্ত থাকে শ্রমিকদের নিরাপত্তা। এভাবে ঝুকিপূর্ণ ভবনে গার্মেন্টস শিল্প স্থাপন করে ব্যবসা করা নিয়ে বি.জে.এম.ই বি.কে.এম.ই সহ ব্যবসায়ীসংগঠনগুলোর কোন নজরদারী নেই। তাদের যত ক্ষোভ রাজনীতিবিদদের উপর। কিন্ত তাদের উদাসীনতা, শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা না দেয়া ইত্যাদি নিয়ে বি.জে.এম.ই বি.কে.এম.ই সহ ব্যবসায়ীসংগঠনগুলোর কোন তৎপরতা দেখা যায় না। আজ তাদের অতি লোভের কারণে ১০০ দিনের হরতালের চেয়েও বেশী ক্ষতি হয়েছে বলে অভিজ্ঞজনেরা বলছেন।
অর্থনীতি হুমকির মূখে পড়বে : আমাদের প্রধান রফতানী আয়ের শিংহভাগ আসে গার্মেন্টস পণ্য থেকে। সাভার ট্রাজেডির কারণে এ শিল্প এখন হুমকির মূখে। এ শিল্পে ধ্বস মানে গোটা অর্থনীতি হুমকির মূখে পড়া। দুর্ঘটনা ঘটার পরের দিনই কোরিয়ান এক কোম্পানী তাদের বাংলাদেশ অফিসের মাধ্যমে উৎপদনকারীদের বলে দিয়েছেন তারা আর বাংলাদেশে ব্যবসা করবেন না। এ অবস্থায় বাংলাদেশের অবস্থা হতে পারে শ্রীলংকার মতো। শ্রীলংকায় এক সময় প্রধান রফতানী আয় ছিল তৈরী পোষাক শিল্প। কিন্ত যুদ্ধ বিগ্রহের কারণে তারা তাদের বাজরা হারায়। আজ বাংলাদেশও সে পথে হাটছে।
প্রথম আলোর নর্তন কুর্দন : সাভারের ভয়াবহ নির্মম ট্রাজেডির ২ দিন পর গোট জাতি যখন শোকে স্তব্ধ তখন প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয় নতুন শিল্পীদের নর্তন কুর্দনের। এ অনুষ্ঠান আয়োজনের পূর্বে এর সম্পাদক সাবেক কমিউনিষ্ট নেতা মতিউর রহমান যারা সব সময় শ্রমিক অধিকারের কথা বলেন সেই নেতাই জাতির শোকের দিনে, শ্রমিকদের দুঃখ-বেদনার দিনে তাদের আর্তনাদ-আর্তচিৎকারকে তুচ্ছ জ্ঞান করে আযোজন করলেন নট-নটীদের নর্তন কুর্দনের। যার শ্লোগান বদলে যাও বদলে দাও - ধিক এই বদলে যাওয়াকে। তার আর একটি শ্লোগান মাদককে না বলুন। কিন্তু সকালে দেখলাম এক তরুণ তার ফেইস বুক ষ্ট্যাটাসে লিখেছে ‘প্রথম আলোকে না বলুন।’
ধরনী তুমি দিধা হও : পৃথিবীর মানুষের নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতা দেখে কবি বলেছিলেন ‘ধরনী তুমি দিধা হও’ নারী অধিকার নিয়ে নিয়মিত আন্দোলন হয় এবং হচ্ছে। আজ যখন এই লেখাটি লিখছি আজো গার্মেন্টস এর নারী শ্রমিকদের জড়ো করে মতিঝিলে ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে নারী সমাবেশ করার কথা ছিল। কিন্ত সাভার ট্রাজেডির পর সরকারের সে সাহস উবে গেছে তারা জানেন এখন এই মূহুর্তে সরকারের পক্ষে গার্মেন্টস শ্রমিকদের রাস্তায় নামানো সম্ভব নয়। কিন্তু যেই নারীদেরকে নারী অধিকারের জন্য ব্যবহার করা হয় তাদের অধিকার কতটুকু? তাদের জবিনের নিরাপত্তা নেই। এমনকি কোন কোন সময় ইজ্জতের নিরাপত্তা নেই। ঠিকমত বেতন ভাতা দেয়া হয় না। এরপরও অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়। যে আমানবিক বিষয়টি আজ সবার নজরে এসেছে তা হচ্ছে সাভারে ধ্বসে যাওয়া ভবনের মধ্যে দুইজন মা সন্তান প্রসব করেছেন। যেখানে সরকারিভাবে ঘোষিত নারীদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস, সেখানে সন্তান প্রসবের আগের দিন ও একজন নারীকে গার্মেন্টস এ কাজে আসতে হয়েছে। এর চেয়ে নির্মমমতা এর চেয়ে শৈাচিকতা আর কি হতে পারে? আজ তাই বলতে হচ্ছে ‘ধরণী তুমি দিধা হও’।
দরিদ্রের রক্তে ধনীদের কোমল পাণীয় পাণ : অসহায় দরিদ্র মানুষগুলোর রক্ত আর ঘামের বিনিময়ে ধনীরা কোমল পাণীয় পান করেন আর তাদের শোষন করেন। বাংলাদেশর পোশাক শিল্প এ দেশের মানুষের দরিদ্রতার সুযোগ নিয়ে গড়ে উঠেছে। এখানে খেটে খাওয়া মানুষেরা প্রতারিত হচ্ছেন। শুধু রক্ত আর ঘাম শুষে নিয়ে মালিকেরা টাকার পাহাড় গড়ছেন আর এখন তারা প্রাণটাও কেড়ে নিচ্ছেন। শিল্প মালিকদের লোভের অগ্নিশিখায় সব জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে গার্মেন্টস মালিকদের সম্মিলিত ফোরাম থাকলেও দুর্ঘটনা ঘটলে সম্মিিিলত উদ্দারের কোন ব্যবস্থা তাদের হাতে নেই। তারা সংগঠন গড়ে তুলেছে শুধু দরিদ্রের রক্ত শোষণ করে ধনী হওয়ার জন্য।
নয় তলা ভবনটির বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে বাঁচার আকুতি ভেসে আসছে; কিন্তু উদ্ধারকর্মীরা তাদের লক্ষ করে এগিয়ে যেতে পারছেন না। উদ্ধার-সরঞ্জামের অভাবের কথাও বারবার উচ্চারিত হয়েছে। পর্যাপ্ত সার্চলাইট পাওয়া যায়নি, যদিও অনেক সাধারণ মানুষ নিজেদের তরফ থেকে এ ধরনের লাইট সরবরাহ করেছেন। আটকে পড়া শ্রমিকেরা অক্সিজেন সঙ্কটে পড়েছেন। তাৎক্ষণিক উদ্ধার করতে না পারলেও অক্সিজেন সরবরাহ করার মাধ্যমে জীবন বাঁচানো সম্ভব হয়।
দেখা গেল পর্যাপ্তসংখ্যক অক্সিজেন মাস্ক পাওয়া যায়নি। সরবরাহকৃত যন্ত্রগুলো ছিল ত্রুটিযুক্ত। একটি দক্ষ অভিজ্ঞ উদ্ধার বাহিনীর সাথে সাথে প্রয়োজনীয় পরিমাণ উদ্ধার-সরঞ্জাম সরবরাহ করা গেলে প্রাণহানি কমানো যেত, উদ্ধার-তৎপরতাও আরো গতি পেত। পোশাক শিল্প মালিকরা নিজেদের স্বার্থের বেলায় কোন ছাড় দিতে রাজী নয়। অন্য দিকে শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাদের মানসিকতা সব সময় নেতিবাচক মনোভাব আমরা সব সময় দেখেছি। এখন দেখা যাচ্ছে, এ খাতটিকে সম্ভাব্য দুর্যোগ থেকে বাঁচানোর জন্য তাদের কোনো প্রস্তুতিও নেই। অথচ এ খাতের ব্যবসায়ীরা সম্মিলিতভাবে উদ্দার তৎপরতা চালানোর জন্য একটি ফোর্স গড়ে তুলতে পারতো। কিন্ত তারা তা করেন নি।
সরকার দায় এড়াতে পারে না : সরকারের পক্ষ থেকে গার্মেন্টস সেক্টরের অন্যায়, দুর্নীতি, অসাধুতা প্রতিরোধে যে ধরণের তদারকী দরকার ছিল তার কিছুই ছিল না এখানে। উল্টো ভবন মালিক সরকার দলীয় ক্যাডার হওয়ায় তিনি প্রশাসনের লোকজনকে থোরাই কেয়ার করতেন। শিল্প পুলিশের নিষেধ উপেক্ষা করে গার্মেন্টস চালু করাই তার প্রমাণ। সরকারের ছত্রছায়ায় এভাবেই প্রতিটি যায়গায় অন্যায় হচ্ছে। দুর্ঘটনা ঘটার পরেও সরকারি উদ্ধার তৎপরতায় আন্তারিকতা, নিষ্ঠা, প্রয়োজনীয় সামগ্রীর জোগান সবকিছুতে ছিল প্রচন্ড রকম অভাব। সব মিলিয়ে এ দূর্ঘটনায় সরকার কোনভাবেই দায় এড়াতে পারে না।
সরকারের পদত্যাগেই সমাধান ঃ অর্থনীতি, রাজনীতিসহ সকল সেক্টরে সরকারের অন্যায় অ্গণতান্ত্রিক আচরণ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর দলীয় করণের কারণে একর পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে। ব্যর্থ দুর্নীতিবাজ সরকারের দেশ পরিচালনার চেয়ে দলবাজি এবং ক্ষমতাবাজিই এখন প্রধান লক্ষ্য। তাদের অবৈধ বাসনার বলি হচ্ছে অসহায় বণি আদম। আজ সর্বত্র দুঃখক্লিস্ট, নির্যাতিত অসহায় মানবতার আহাজারি। তাদের আর্তনাদে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে আছে। সরকারের অন্যায় এবং দুর্নিতির বলি হচেছ দরিদ্র অসহায় মানুষগুলো... দিনে দিনে বাড়িয়াছে দেনা শোধিতে হইবে ঋণ.... এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের পদত্যাগই একমাত্র সমাধান। ঢাকা, ২৭ এপ্রিল, ২০১৩।
( ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রাজধানী ঢাকার অদূরে সাভারে রানা প্লাজা ধ্বসে ১ হাজার ১৩৫ জন শ্রমিক নির্মমভাবে নিহত হয়। এ বিষয়ে ২০১৩ সালের ২৭ ও ২৮ এপ্রিল আমার লেখা নিম্মোক্ত কলাটি দুই কিস্তিতে দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত হয়েছিলো। রানা প্লাজার সেই নির্মম ঘটনার বিচার আজো হয়নি। এই নির্মম ঘটনার বিচার দ্রুত নিস্পত্তির জন্য আজ ১৫ জানুয়ারী-২০২৪ হাইকোর্ট অর্ডার দিয়েছে, সেই প্রেক্ষিতে পাঠকদের স্মৃতি রোমন্থনের জন্য কলামটি আবার নিম্মে তুলে ধরা হলো )
লেখক : মুহাম্মদ হাফিজুর রহমান


পঠিত : ১৬৫ বার

মন্তব্য: ০