Alapon

জলরঙের স্মরণ তিথি - পারভেজ শিশির-এর প্রথম একক কাব্যগ্রন্থ



কবি সারা জীবনে’ও নিজের কাছে সত্যিই ‘কবি’ হয়ে উঠতে পারে…! সামান্য একটা মটরশুঁটি লতায়’ও সে মুগ্ধ হতে চায়, হয়তো ক্ষণিক আগেই কোনো গ্রাম্য কিশোরীর আঙুলের ছোঁয়ায় সে কাঁপছিল তখন’ও…! মনে মনে কখন যে একজন মানুষ কবি হয়ে ওঠে সে ব্যাখ্যা কোনো নিবন্ধে বোধ করি আজও কেউ লেখেনি, কেননা লিখতে ব’সে কেউ কবি হতে পারে না, একটা তরঙ্গায়িত বাতাস, কিছু অস্থির বিকেল, কোনো গাঢ় খয়েরি সন্ধ্যে হয়তো তাকে লিখতে বসিয়েছে… ​

কবি হয়তো কখনও আকাশের পাখি’কে, আর কখনও মাটি’র ফুল’কে চেয়ে তাঁর প্রাণকুসুম ভাবতে চেয়েছে – “সুপ্রিয় অন্তরলোকদর্শিনী, আমার কথা আর শব্দের ঘ্রাণে যে মধুপিয়াসী প্রাণপ্রতিমা এমন সুরের গুঞ্জনে মুখরিত হ'তে পারে, এত বহু সুদূরের আত্মীয়তায় তাকে আমি যেন খুব কাছ থেকে দেখেছি, আত্মার কাছে পেয়েছি…! যে কোমল ‘পারিজাত হিয়া’ কৃষ্ণ-মৃত্তিকার অবগুন্ঠনে সূর্যকরোজ্জ্বল হিরণ্ময়ী’র সন্ধান পেয়েছে, শুধু সে’ই ‘প্রাণপ্রতিমা’ এমন স্বপন গহন অতল শব্দের ঘ্রাণে…সর্ব্বহারা সামান্য’কে হৃদয় অলিন্দে মহাকালের জন্যে আপন ক’রে নিতে পারবে… শাশ্বতই, এই নৈবদ্য এই শ্রদ্ধার্ঘ্য যেন অতলস্পর্শী মমতা’র, বড় মনোরম অতি সাধনার… এ যেন বহু শতাব্দীর সঞ্চিত প্রেমকিঞ্জল যা’র স্পর্শে বিকশিত হবে স্বতঃ আকাঙ্খিত অদৃষ্টপূর্ব স্বর্গোদ্যান… প্রিয় হে ‘পারিজাত কুসুমকুমারী’, সকল তোমার ছন্দিত পল্লব সুরভিতে ধরিত্রীর নিযুত করুণ প্রাণের এই ক্ষণিকের জনম ও মুহূর্তের জীবন-স্পন্দন পুতপবিত্র হোক… … …” ​

এই কাব্যগ্রন্থের স্বপ্নবীজ আজকের নয়, যেন বহুযুগের বিবিধ কালান্তিক অনুষঙ্গ এসে একে প্রাণিত করেছে। ​ মাঝে মাঝে আমি কবিতা’র মন্তব্যে লিখেছি, “কবিতার প্রতি প্রেম হোক, কবি’র প্রতি প্রেম হোক”… জানেন, আমি এটা খুব চেয়েছি, মানুষ তার প্রিয় কবি’কে তাঁর জীবদ্দশায় ভালোবাসুক, কিন্তু এটা’ও ঠিক, কবি অত্যন্ত অভিমানী আবেগী সম্প্রদায়ের মানুষ, সে তুচ্ছ ঘটনায়’ও প্রবলভাবে আলোড়িত হতে পারে… কিভাবে যেন কবি’ই এই পৃথিবীতে সবচেয়ে দুঃখী মানুষ… ​ ​

কবি যেন উজ্জ্বল হাসিমুখে আত্মাভিমানী এক কিশোর, সে যা চেয়েছে তা এখনো পায়নি, না পাওয়ার আক্ষেপে সে অস্থিরমতি হয় অথচ সুদূর সে এখনও দেখেনি, সে জানে না বরফখচিত নিরিবিলি মেরুতে কত অর্বুদযুগের কান্না স্মিত-স্ফটিক-শিলা হয়ে জমে রয়েছে, যেখানে স্থান রয়েছে অথচ স্থানিকের উপযোগী জলবায়ূ অনুপস্থিত…! কোথায় কোথায় কিভাবে কবি’র প্রাণ-কিঞ্জল বাতাসে বিষাদিত সুগন্ধি ছড়ায়, তার সুরভি কেবল সমগোত্রীয় কোনো কবি’র স্নায়ূতন্ত্রীতেই আড়োলিত হতে পারে… এই যেমনটা এখানে কোন এক মেঘ-কিশোর কইছে…

“কোনো এক কৃষ্ণপক্ষ রাতে একাকী নদীর জলে
কেউ যদি একটা দীর্ঘ ডুব সাঁতার দিয়ে
নদীটার অন্যপারের অন্ধকারে কুয়াশায় মিলিয়ে যায়?
তখন যদি নির্জন শান্ত নদী ছলাৎ ছলাৎ,
ক'টা বালি হাঁস হঠাৎ করে জলে উত্তাল শব্দ করে
অন্ধকারে এদিক সেদিক চলে যায়?

কোনো হেমন্তের লাল হলুদ ম্যাপল্ পাতার বনে
কেউ যদি "এই আসছি, বেঞ্চের ওপরে আমার হ্যান্ডব্যাগটা দেখো"
বলে ঝরা পাতার স্তুপে
তার মেরুন সুগন্ধি কার্ডিগান উড়িয়ে
আকাশের নক্ষত্র হয়ে যায়?

ধু ধু তেপান্তরের প্রান্তরে চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে
কেউ যদি হাত নাড়তে নাড়তে অনেক অনেক দূর চলে যায়
যেখান থেকে আর তাঁকে দেখা যায় না?

কোনো একটা বিমান বন্দরের রানওয়ে থেকে
গর্জন করে "টেক অফ" করা জেটের পেটের ভেতর থেকে
কেউ যদি আকাশের ওপারে আকাশে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়?

দুর্দান্ত রোদ ভরা ঝিল মিল একটা দুপুরে যদি কেউ
আর কোনোদিন না আসে শিরীষ তলায়?

তখন কি কারো সমগ্র অতীত, তার বর্তমান, তার ভবিষ্যৎ
গলিত হিজল ফুল, বিল ঝিল নাম সর্বনাম, নীলাকার জামবন
এক মুহূর্তে আকাশ চেরা বিদ্যুৎ নিঃশব্দ গর্জিত বজ্রপাতে
অর্থহীন পৃথিবীটা ভেঙে জ্বলে চুরমার ভস্ম হয়ে যায়?

নির্বিকার নিরাকার প্রগাঢ় অভিমান? হাতের এক ভরাট বুনো ডেইজি গুচ্ছ ধূলিসাৎ,
সে কি আর কোনোদিন অন্য কারো নিবিড় খোঁপা খোঁজে নি, খুঁজবেও না?
সারাটা জীবন?
নিরাশ শ্রাবণ মেঘ মল্লার ঝর ঝর উইলোর চিরল পাতায়
ইতিহাস থাকবে কি লেখা? "একদিন একজনা এইখানে পাশে
বসেছিলো, এক শাড়ি স্বপ্ন ছড়িয়ে, তার নিঃশ্বাস
এখনও বাতাসে ভাসে --- সবুজাভ ঘাসে?
ভাসে বুকের ভেতরে?"

​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ [ কোনো এক কৃষ্ণপক্ষ রাতে / শাহনূর ]

কাব্য, সাহিত্যিকতা এবং ভাষার সংগতির সমন্বয়ে নির্মিত একটি সৌধ, যা একটি সমাজের, সমাজচেতনার এবং মানসিক দৃষ্টিকোণের বিকাশ ও প্রগতির প্রতীক। একটি কাব্যগ্রন্থ তৈরি, কবির সম্মানকে সার্থক করে এবং তার সাহিত্যিক দক্ষতা ও শিল্পের প্রদর্শনী হয়। এটি সাহিত্যিক পরিশ্রম, আবিষ্কার এবং সৃজনশীলতার সাক্ষাৎ যা একটি কাব্যে প্রকাশ পায়।
একটি প্রথম একক কাব্যগ্রন্থে কবি’র চরিত্র, অনুভূতি উৎপাদনের উপকরণ, ঘটনা, স্থান এবং সময়ের বিবরণ গুলি সঠিকভাবে উপস্থাপন করা প্রয়োজন। এই বিবরণগুলি কাব্যের প্রস্তাবনা, বিকাশ এবং সংকলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া, কাব্যের শৈলী, ছন্দ, রস, উৎপ্রেক্ষা, অলংকরণ এবং ব্যক্তিগত দৃষ্টি-স্বত্বও গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রপঞ্চসমূহ স্মরণে রেখে ‘জলরঙের স্মরণ তিথি’কে সাজানো হয়েছে।

প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেমের মধুরস, দ্রোহে কম্পিত দগ্ধ হৃদয়, বিরহের অসহ অগ্নিকণিকা, জীবনের প্রাত্যহিক অনুষঙ্গ সমস্তই নানা বর্ণে আমার কবিতায় বার বার এসেছে। এই গ্রন্থে বেশ কিছু কবিতায় উত্তরীয় কিংবা পূর্বিতা ব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলো কবিতার সারমর্ম ও পূর্বাভাস হিসেবে লিখিত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই সেটা অনিবার্যভাবে এসেছে।
আমার এই কাব্যগ্রন্থটি বই আকারে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে শ্রদ্ধেয় ভাতৃপ্রতিম কবিবন্ধু লেখক মেসবাহ আহমেদের নিকট আামি চিরকৃতজ্ঞ যিনি শাহনূর কবিনামে সুপরিচিত। তাঁর অনুক্ষণ উৎসাহ, প্রেরণা এটি প্রকাশনার ক্ষেত্রে প্রভূত ভূমিকা পালন করেছে। এছাড়া বিভিন্ন সময় দেশে ও বিদেশে আমার কবি ও লেখকবন্ধুদের মূল্যবান পরামর্শ ও আলাপন গ্রন্থটির সুচারু প্রকাশনায় সহায়তা করেছে। ​

প্রথম একক গ্রন্থ হিসেবে অনেক যত্ন নিয়ে এর সংকলনের কাজটি সম্পাদন করা হলে’ও হয়তোবা কাব্যের ভিতরে কিছু অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি থেকে যেতে পারে। অনুগ্রহ ক’রে আমার সুন্দর মনের পাঠকবন্ধু সেটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। কারন কোনো মানুষ ভুলের উর্ধে নয়। সকলের প্রতি আমার হৃদয়োৎসারিত ভালবাসা, শুভেচ্ছা এবং প্রীতিমুগ্ধতা রইলো।
এটি আমার প্রথম একক কাব্যগ্রন্থ। এই গ্রন্থে একত্রীকৃত কবিতাগুলির অধিকাংশই বাংলা কবিতা’র আসরে, কখনো বা কোনো বিশেষ ঋতু, জীবনের আকস্মিক কোনো দূর্ঘটনা বা সমস্যাখচিত কোনো বিশেষ দিনরাত্রি অথবা উৎসবভিক্তিক দেশীয় বা বিদেশি সংস্কৃতির প্রতিক্রিয়া অনুপ্রাণন হিসেবে রচিত হয়েছে। এই জন্যে হয়তো বা এর বিশেষ কোনো ধারাবাহিকতা’র ঔজ্জ্বল্যতা এর নেই, এমন হয়েছে কিছু কবিতায় হয়তো একটি বিশেষ শব্দ কিংবা উৎপ্রেক্ষা বার বার উপস্থাপিত হয়েছে। অনেক সময়ই এই কবিতাগুলির কোনো কোনোটির পাঠে আমার অগ্রজ অনুজ কবিবন্ধুগণ যে সমস্ত বিমুগ্ধ মন্তব্য করেছেন, সেটির প্রতিমন্তব্যে হয়তো পরবর্তী কোনো কবিতার জন্ম হয়েছে, কোনো কবিতার বিষবস্তু নিয়ে দীর্ঘ আলাপচারিতা হয়েছে আমার অনেক কবি সাহিত্যিক বন্ধুদের সাথে। এই সব কবিতার প্রসঙ্গে নানা সময়ে আমার সাধ্যানুযায়ী কবিবন্ধুদের বর্ণিল অনুভূতি ও মুগ্ধতার যে প্রণয়-প্রতিবিম্ব আমার মনে সৃষ্টি হয়েছে সেটা অনিবার্য প্রকাশ হয়েছে আমার বিভিন্ন পর্যায়ের কবিতায়।

আমার যে সব সাহিত্যানুরাগী কবি ও পাঠকবন্ধু আমার কবিতার সহযাত্রী রয়েছেন এবং বিভিন্ন সময়ে আমাকে তাদের অতি মূল্যবান মতামত ও পরামর্শ দিয়ে আমাকে উৎসাহিত ও প্রাণিত করেছেন তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা শেষ নেই। গ্রন্থটির প্রকাশনা ও সম্পাদনার জন্যে কবিতার যাত্রায় এই ক্ষুদ্র জীবনে এত এত ভালোবাসা’র প্রাপ্তি আমার কাছে অনেক বড়, অনেক বিশেষ। এই গ্রন্থের মূল্যায়ন ভার আমার কবি সাহিত্যিক ও পাঠকবন্ধুদের উপর দিলাম। তাদের ঐকান্তিক বিচারের উপরেই নির্ভর করছে আমার প্রথম একক গ্রন্থটির সাফল্য ও ব্যর্থতা।

পারভেজ শিশির
একুশে বইমেলা ২০২৪
স্টল নম্বর ৪৭৩, ৪৭৪ ও ৪৭৫
হাওলাদার প্রকাশনী
ঢাকা, বাংলাদেশ

পঠিত : ৫০২ বার

মন্তব্য: ০