Alapon

আহলান সাহলান মাহে রমজান



বছর ঘুরে আবারো এলো পবিত্র মাহে রমজান। হাজার দুঃখ বেদনা আর হাহাকারের মধ্যে রহমতের দরিয়া নিয়ে হাজির হলো পবিত্র মাহে রমজান। বছরের আবর্তনে অনেকেই আমাদের সাথে নেই। হয়তো দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন, নয়তো দূর পরবাসে অবস্থান করছেন। রমজান আবারো এলো। এলো সুসংবাদ নিয়ে। প্রতি বছরই আসে। এবারও এসেছে।

জাহান্নামের দড়জা বন্ধ হয়ে গেলো, জান্নাতের দড়জা উন্মুক্ত হয়ে গেলো। নফল ইবাদাতের সওয়াব ফরযের সমান হলো, ফরজ ইবাদাতের মর্যাদা ৭০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এটাই মাহে রমজান। এ মাসে আল্লাহ পাক স্বয়ং তার বান্দাকে মার্কিং করেন। স্বয়ং খালিক তাঁর বান্দাকে নেকি দিবেন, যার আরেক নাম গণি মানে মহা ধনি, যিনি দাতা তিনি কি আর কম দিয়ে পারেন। সবচেয়ে বেশিই তো দিবেন। অতুলনীয় ভাবেই তো দিবেন।

তিনি তাঁর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করছেন। আমাদেরও তো সংযম থাকা লাগবে। শুধু কি পানাহার বন্ধ করলে হবে? চোখের সংযম, হাতের সংযম যতটা সম্ভব করা যায়।

এ মাসের কতটা মর্যাদা আমরা কি জানি?

পবিত্র কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে- "রমযান মাসই হল সে মাস যাতে নাযিল করা হয়েছে কুরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়াত এবং সত্যপথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ।" -সূরা বাকারা ১৮৫

হাদীসে এ মাসের ফযীলত বর্ণিত হয়েছে যে, ‘রমযান মাসের শুভাগমন উপলক্ষে জান্নাতের দরজাসমুহ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর শয়তানকে শৃংখলাবদ্ধ করা হয়।’ -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৮৯৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৭৯/১

রমযানের করণীয়
(পয়েন্ট গুলো সংগ্রিহীত)

* রোযা : রমযান মাসে রোযা রাখা ফরয। এটা এ মাসের বিশেষ আমল। সকল আদব রক্ষা করে পুরো মাস রোযা রাখা প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য।

* তারাবীহ : রমযানের রাতের বিশেষ আমল হল কিয়ামে রমযান তথা বিশ রাকাত তারাবীহ। এ মাসের অফুরন্ত রহমত ও মাগফিরাত লাভ করার জন্য এবং প্রতিশ্রুত ছওয়াব ও পুরস্কার পাওয়ার জন্য তারাবী নামাযের প্রভাব অপরিসীম।

* দান করা : দান-সদকা সর্বাবস্থাতেই উৎকৃষ্ট আমল, কিন্তু রমযানে তার গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। হাদীস শরীফে এসেছে- ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়ার সকল মানুষ অপেক্ষা অধিক দানশীল ছিলেন। রমযান মাসে তাঁর দানের হস্ত আরো প্রসারিত হত।’ -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯০২

* কুরআন মজীদ তেলাওয়াত : এ মাস কুরআন অবতরণের মাস। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিবরীল আ.-এর সাথে রমযানের প্রত্যেক রাতে কুরআন মজীদ দাওর করতেন। হাদীস শরীফে এসেছে- ‘হযরত জিবরীল আ. রমযানের শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সাক্ষাত করতেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে কুরআন মজীদ শোনাতেন।’-সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯০২

অতএব আমাদের প্রত্যেকের উচিত রমযানে অধিক পরিমাণে কুরআন তেলাওয়াত করা। অন্তত একবার হলেও কুরআন মজীদ খতম করা। সালাফে সালেহীনের জীবনী আলোচনা করলে দেখা যায় যে, তাঁরা এবং পরিবারের সদস্যগণ প্রত্যেকে রমযানে বহুবার কুরআন মজীদ খতম করতেন।

* নফল ইবাদত : এ মাসে শয়তান শৃংখলাবদ্ধ থাকে। এই সুযোগে অধিক পরিমাণে নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জন করা যায়। এ মাসে যে কোনো ইবাদত নিয়মিত করতে তেমন কোনো বেগ পেতে হয় না এবং পরবর্তীতে তা সহজেই অভ্যাসে পরিণত হয়। সুতরাং যিকির-আযকারের সঙ্গে অধিক পরিমাণে নফল নামায আদায় করা উচিত। অন্তত বিভিন্ন সময়ের নফল নামাযগুলো আদায় করা যেমন-ইশরাক, চাশত ও তাহাজ্জুদ ইত্যাদি।

আফসোসের বিষয় এই যে, রমযানে সাহরীতে উঠলেই দু’চার রাকাত তাহাজ্জুদ নামায সহজেই পড়া যায়। বছরের অন্য দিনের মতো কষ্ট করার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু অমনোযোগী হওয়ার ফলে কিংবা সাহরীতে অতি ভোজনের কারণে তাহাজ্জুদ আদায়ের সুযোগ হয়ে ওঠে না।

* দুআ করা : এ মাস রহমত, বরকত, মাগফিরাত ও জান্নাত লাভের মাস। তাই বেশি বেশি আল্লাহ তাআলার শরণাপন্ন হয়ে কান্না-কাটি করে দুআ করা একান্ত কাম্য।

* মাগফিরাত কামনা করা : যে ব্যক্তি রমযান পেয়েও স্বীয় গুনাহসমূহ ক্ষমা করাতে পারল না তার উপর জিবরীল আ. ও দয়ার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিসম্পাত করেছেন। তাই জীবনের কৃত গুনাহের কথা স্মরণ করে বেশি বেশি তওবা ইস্তেগফার করা এবং আল্লাহ তাআলার দরবারে ক্ষমা মঞ্জুর করিয়ে নেওয়ার এটিই উত্তম সময়। বিশেষ করে ইফতার ও তাহাজ্জুদের সময় আল্লাহ তাআলার দরবারে ক্ষমা চাওয়া এবং দুআ করা উচিত।

* ই’তিকাফ : শেষ দশকের মাসনূন ই’তিকাফ অত্যন্ত ফযীলতের আমল। হাদীস শরীফে এসেছে- ‘নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করতেন।’ -সহীহ বুখারী, হাদীস ২০২১; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৭১ ঁ

* শবে কদর অন্বেষণ : ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে রাত্রি জাগরণ করে সহস্র রজনী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও উত্তম রাত-লাইলাতুল কদর তালাশ করা কর্তব্য। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে-

‘নিঃসন্দেহে কদরের রাতে আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি। আর আপনি কি জানেন শবে কদর কী? শবে কদর হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এ রাতে ফেরেশতা ও রুহুল কুদ্স (জিবরাঈল আ.) তাদের পালনকর্তার আদেশক্রমে প্রত্যেক মঙ্গলময় বস্ত্ত নিয়ে (পৃথিবীতে) অবতরণ করে। (এ রাতের) আগাগোড়া শান্তি যা ফজর হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।’ -সূরা কদর

রোযার হাকীকত

ইসলামের মূল স্তম্ভসমূহের মধ্যে ঈমান, নামায ও যাকাতের পরই রোযার স্থান। হাদীস শরীফে এসেছে-

‘পাঁচটি স্তম্ভের উপর ইসলামের ভিত্তি স্থাপিত : আল্লাহ তাআলা এক বলে স্বীকার করা, নামায কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা, রমযানের রোযা রাখা ও হজ্জ পালন করা।’ সহীহ মুসলিম ১/৩২

সুতরাং রমযানের পূর্ণ মাস রোযা রাখা ফরয। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- (তরজমা) ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর (রমযানের) রোযা ফরয করা হয়েছে, যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতের উপর ফরয করা হয়েছিল। যেন তোমরা মুত্তাকী হতে পার।’- সূরা বাকারা ১৮৩

শরয়ী ওযর ছাড়া যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত একটি রোযাও পরিত্যাগ করে সে নিকৃষ্ট পাপী। দ্বীনের মৌলিক ফরয লংঘনকারী এবং ঈমান ও ইসলামের ভিত্তি বিনষ্টকারীরূপে সে পরিগণিত হবে। আর এ কাজ সে রোযার যে মঙ্গল ও বরকত থেকে বঞ্চিত হবে তা কস্মিণকালেও পাবে না। এমনকি এ রোযার কাযা করে নিলেও তা ফিরে পাবে না। হাদীস শরীফে এসেছে ‘যে ব্যক্তি কোনো ওযর বা অসুস্থতা ব্যতিরেকে রমযানের একটি রোযা পরিত্যাগ করবে সে যদি ঐ রোযার পরিবর্তে আজীবন রোযা রাখে তবুও ঐ এক রোযার ক্ষতি পূরণ হবে না।’ -জামে তিরমিযী, হাদীস ৭২৩

অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় এই যে, আমাদের সমাজে অনেক সবল-সুঠাম দেহের অধিকারী ব্যক্তিও অকারণে, সামান্য ছুতায় অসুস্থ হওয়ার অমূলক আশংকায় রোযা পরিত্যাগ করে। এতে তারা আখেরাতের কত বড় ক্ষতি নিজের উপর টেনে নিচ্ছে তা একটু ভেবেও দেখে না।

রোযার অর্থ : রোযা একটি ফারসী শব্দ। এর আরবী হল ‘ছওম’। ছওম এর আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। শরীয়তের পরিভাষায় ‘জ্ঞানবুদ্ধি সম্পন্ন মুসলমানের উপর সুবহে সাদিক তথা দিনের একেবারে শুরু ভাগ থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোযার নিয়তে পানাহার, স্ত্রী সহবাস ও রোযাভঙ্গকারী অন্যান্য কার্যাদি থেকে বিরত থাকার নামই হল ‘সওম’ বা ‘রোযা’।’

মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে চলুন আমরা সঠিক ভাবে সিয়াম পালন করি।

পঠিত : ৬৫০ বার

মন্তব্য: ০