Alapon

আমার স্ত্রীর মৃত্যু

আজ সকাল থেকেই গরম। একেবারে ভ্যাপসা গরম।
বাড়িতে পাখার তলা ছাড়া থাকা যাচ্ছে না। এক সেকেন্ড যদি পাখার তলা থেকে সরে আসি ঘেমে পুরো ভিজে যাচ্ছি।

ঘড়িতে দেখলাম সকাল ন'টা বাজে। তেল মেখে স্নান করতে গেলাম। গিন্নি যথাসময়ে ভাত বেড়ে দিল। বাড়ি থেকে বেরোবার সময় তাকে বলে এলাম ঝড় বৃষ্টি হলে সাবধানে থেকো আর আকাশে বিদ্যুৎ চমকালে বাড়ির বাইরে একদম বেরিয়ো না।

আমি বাড়ি থেকে কিছু দূরে একটি স্কুলে চাকরি করি। আজ সকালে খবরের কাগজে দেখেছি লেখা আছে "বিকেল থেকেই শুরু হতে পারে বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টি"। আসলে দুর্যোগের সময় ঘরের বাইরে কেউ থাকলে ঘরে যে আছে তার খুব চিন্তা হয় ঘরের বাইরে যে আছে তার জন্য, ঠিক উল্টো ভাবে ঘরের বাইরে যে আছে তারও খুব চিন্তা হয় ঘরে যে আছে তার জন্য। তাই ভাবছিলাম আমি সেই সময় বাড়ি থাকলে আর কোনো চিন্তা হতো না। যদিও জানি সে তো বাচ্চা মেয়ে নয় তবু স্বামী হিসেবে এটা বলা আমার কর্তব্য।

বাড়ি থেকে স্কুল যেতে আধ ঘন্টা মতো লাগে যদি হেঁটে যাওয়া যায়। আমি অবশ্য হেঁটে যাই হেঁটে আসি।
যথাসময়ে স্কুলে পৌঁছে গেলাম। টিফিনের সময় দেখলাম আকাশে বেশ ঘন কালো মেঘ জমছে। তার মানে বুঝতে পারছি যেটা খবরে জানিয়ে দিয়েছে সেটা হবেই। স্ত্রীকে একবার ফোন করে জেনে নিলাম খেয়েছো কিনা, শুয়েছো কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। আর একটা কথা জানতে চাইলাম ওদিকে মেঘ করেছে কিনা। জবাব পেলাম ---- হ্যাঁ।

স্কুল ছুটি হয় বিকাল সাড়ে চারটেয়। ছুটি হওয়ার আগে থেকেই ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। তবে জোরে জোরে হচ্ছে না। ঐ হালকা ঝড় হালকা বৃষ্টি এমনই হচ্ছে। সেই সাথে আকাশে মাঝেমধ্যেই বিদ্যুৎও চমকাচ্ছে। একে একে স্কুল ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে দেখলাম। ছাত্রছাত্রীরা, আমার সহকারী কয়েকজন শিক্ষক বন্ধুগণ একে একে চলে যাচ্ছে দেখলাম। কিন্তু আরো কয়েকজন থেকে গেলেন কারণ সবার বাড়ি তো এক জায়গায় নয়, কারোর বাড়ি দূরে কারোর কাছে। যাদের বাড়ি দূরে তারাই আগে চলে গেলেন। ওদিকে আকাশ আরো অন্ধকার হয়ে আসছে। কাজেই তাদের থেকে আর লাভ নেই। যেতে যখন হবে তখন ঠাকুরের নাম নিয়ে বেরিয়ে পড়াই ভালো।

আরো আধঘন্টা কেটে গেল। ঘড়িতে দেখলাম সময় বিকাল পাঁচটা। ঝড় বৃষ্টির পরিমাণ আরো বেড়ে গেছে এর মধ্যে। বাড়িতে ফোন করতে পারছি না কারণ অনেকেই বলে থাকে যে ঝড় বৃষ্টির সময় মোবাইল ব্যাবহার করা উচিত নয়।

আমার সঙ্গে যে কয়েকজন শিক্ষক বন্ধু ছিলেন তারা একটু আগেই বেরিয়ে গেছেন। এবার আমি রওনা দিলাম। আর থেকে লাভ নেই। এরপরেও যদি ঝড় বৃষ্টি আরো জোরে হয় তখন আরোই যেতে পারব না। আর এ ঝড় বৃষ্টি কখন থামবে তা আমি নিজেও জানি না। বেরোনোর পর ভাবছিলাম এই দুর্যোগের সময় স্কুল থেকে না বেরোলেই ভালো হতো। স্কুল তো একটা ভালো আস্তানা। কিন্তু বাড়িতে তার জন্য আমার মন কেমন করছিল। তাই বেরিয়ে পড়েছিলাম।

আমার বাড়ির পিছনের দিকে একটা আম গাছ আছে। সময়টা যেহেতু এখন গ্রীষ্মকাল সে গাছে তাই ভালোই আম ফলেছে। যদিও সে গাছ আমাদের নয়। বলা ভালো আমার বাড়ির পিছন থেকে একটা বাগান শুরু। বাগানটি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। আম গাছটি সেই বাগানের গাছ।
আম গাছটি পাঁচিলের ওপারে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যে তার অধিকাংশ ডালপালা আমাদের ছাদের দিকে। তবে এতে আমাদের বাড়ির কোনো ক্ষতি হয় না। ঐ একটু পাতা-টাতা ছোটো-ফোটো ডালপালা পড়ে ঝড়েতে। এতে আমাদের কোনো আপত্তি ছিল না কারণ, আমরা তো আম ঠিক পেয়ে যাই, ছাদে পড়ার দরুণ। তবে সব আম কি ছাদে পড়ে? বাগানেও পড়ে। সেগুলো আর নেওয়া সম্ভব হয় না।
আর বাগনের যিনি মালিক তিনি বছরে একদিনও আসেন না দেখতে এসব। কাজেই বলা যায় গাছটি আমাদের না হয়েও যেন আমাদেরই।

বাড়ি যখন এলাম তখন প্রায় সন্ধের মুখ। বৃষ্টিটা কমে গেছে। কিন্তু ঝড় আগের মতোই হচ্ছে জোরে জোরে। যদিও আকাশে বিদ্যুৎ চমকানো এখন অনেকটাই কমেছে। মেঘের গুরগুরানিও আর নেই।
স্ত্রীকে ডাক দিলাম। উত্তর পেলাম ছাদ থেকে ---- উপরে আছি হাতমুখ ধুয়ে চলে এসো।
আমি ভাবলাম সারাদিন খাটাখাটনি করে এলাম, কোথায় একটু খেতে দেবে, তা না সে এখন ছাদে আছে। নিশ্চয়ই আম কুড়াচ্ছে। আচ্ছা তোমার আম কি অন্য কেউ নিয়ে নেবে? ছাদ তো তোমার। বড্ড ছেলেমানুষী চিন্তাভাবনা। তবে ঝড় বৃষ্টিতে আম কুড়ানোর কিন্তু একটা দারুণ মজা আছে এটা স্বীকার করতেই হয়।

যাইহোক আমি হাতমুখ ধুয়ে একটু রেস্ট নিয়ে ছাদে গেলাম। দেখলাম ছাদে লাইট জ্বলছে অন্ধকার হয়ে গেছে তো তাই। দেখলাম গিন্নি ছাদের এক কোনায় অন্তত গোটা দশ বারো আম জোগাড় করে রেখে দিয়েছে।
সারা ছাদে এদিকে ওদিকে ভেজা ডাল পাতা পড়ে আছে। ছাদও ভেজা। বৃষ্টি হয়ে গেছে তো। আমি ছাদের দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে আছি স্ত্রী আছে সেই ছাদের কোনায় যেখানে আমগুলো জড়ো করে রেখেছে সেখানে।
আমি বললাম ----- এবার চলো নিচে। অনেক হয়েছে।
স্ত্রী বলল ---- হ্যাঁ চলো।আসলে ছোটোবেলাকার অভ্যাস তো ঝড় জলে আম কুড়ানো তাই সে অভ্যাস আর যাই নি। তুমি জানো না আমার বাপের বাড়ির পিছনেও একটা আম গাছ আছে।
আমি বললাম ---- সব জানি। এবার চলো।

ঝড় এখনো কমেনি। স্ত্রী এগিয়ে আসতে লাগল। হঠাৎ দেখলাম নিজের চোখের সামনেই আম গাছের এক মোটা ডাল ঝড়ের দাপটে পুরো ভেঙে পড়ল আমার স্ত্রীর মাথায়। শুধু সেই সময় শুনলাম তার একটাই শব্দ, আ!
আমার চোখের সামনেই আমার স্ত্রীর মৃত্যু হল।

পঠিত : ১৮৫ বার

মন্তব্য: ০