Alapon

ইসলামের দৃষ্টিতে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক



আজকের পৃথিবীতে যা কিছু অবস্থিত তার সবকিছুই শ্রম দ্বারা তৈরি। এসব তৈরিতে প্রয়োজন হয়েছে শারীরিক শ্রম এবং মানসিক শ্রম। শ্রম দিয়ে যারা নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করে তাদেরকে আমরা শ্রমজীবী হিসেবে সাব্যস্ত করি।

সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে কোন মানুষই শ্রমজীবীর বাইরে নয়। প্রত্যকেই শ্রমিক, প্রতেকেই শ্রমজীবী। একেকজন একেক স্তরে শ্রম দিয়ে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।
আল্লাহ তাআলা মানুষকে তৈরি করেছেন শ্রমজীবী হিসেবে। মানুষ কাজ করে নিজেদের জন্য হালাল জীবিকা নির্বাহ করবে এটাই স্বাভাবিক। আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজিদে ঘোষণা করেন,

فَاِذَا قُضِیَتِ الصَّلٰوۃُ فَانۡتَشِرُوۡا فِی الۡاَرۡضِ وَ ابۡتَغُوۡا مِنۡ فَضۡلِ اللّٰہِ وَ اذۡکُرُوا اللّٰہَ کَثِیۡرًا لَّعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ ﴿۱۰
যখন সালাত শেষ হবে তখন তোমরা জীবিকা নির্বাহের জন্য পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো আর আল্লাহর অনুগ্রহ অনুসন্ধান করো এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো। (সুরা জুমুআ, আয়াত-১০)

অত্র আয়াতে আল্লাহ তাআলা ফরজ নামাজ আদায়ের পরে রিজিকের সন্ধানে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়ছেন। তাই যে যেভাবে পারে সেভাবে রিজিক অন্বেষণ করে।
রিজিক অন্বেষণের জন্য যে যেখানে কাজ করে সে সেখানের জন্য শ্রমিক হিসেবে সাব্যস্থ হয়। আর যার অধীনে কাজ করে সে হয় মালিক। এই মালিক এবং শ্রমিকের মধ্যে কেমন সম্পর্ক হওয়া উচিত, সেটাই মূল আলোচ্য বিষয়।
আমাদের মনে রাখতে হবে শ্রমিক এবং মালিক দুজনেই মানুষ। দুজনেই একই সত্তার অধিকারী। আল্লাহ তাআলা বলেন,

یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ اتَّقُوۡا رَبَّکُمُ الَّذِیۡ خَلَقَکُمۡ مِّنۡ نَّفۡسٍ وَّاحِدَۃٍ وَّ خَلَقَ مِنۡہَا زَوۡجَہَا وَ بَثَّ مِنۡہُمَا رِجَالًا کَثِیۡرًا وَّ نِسَآءً ۚ

হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় করো, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক আত্মা থেকে। আর তা থেকে সৃষ্টি করেছেন তার স্ত্রীকে এবং তাদের থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী। (সূরা নিসা, আয়াত-১)

এখানেই স্পষ্ট যে, সূচনার দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখি সব মানুষ একই মা-বাবার সন্তান। সেই দিক দিয়ে সমস্ত মানুষ পরস্পর ভাই ভাই। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

عن ابن عمر رضي الله عنهما أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «المُسْلِمُ أَخُو المُسْلِمِ

এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। (সহিহ বুখারী, ই.ফা-৬৪৮১)

আল্লাহ তাআলা বলেন,
اِنَّمَا الۡمُؤۡمِنُوۡنَ اِخۡوَۃٌ
নিশ্চয় মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। (সূরা হুজুরাত, আয়াত-১০)

সুতরাং মালিক এবং শ্রমিক যা-ই হোক, আমরা যদি ইসলামের উপরোক্ত নির্দেশনার দিকে তাকায়, তাহলে মালিক শ্রমিকের সম্পর্ক হবে আপন ভাইয়ের মতো। বড় ভাই ছোট ভাইয়ের যে সম্পর্ক হয় সেটাই হবে মালিক শ্রমিকের সম্পর্ক। একজনের উপর আরেকজনকে প্রাধান্য দিয়ে আল্লাহ তাআলা অনুগ্রহ করেছেন মাত্র। তিনি বলেন,

اللّٰہُ فَضَّلَ بَعۡضَکُمۡ عَلٰی بَعۡضٍ فِی الرِّزۡقِ
আর আল্লাহ্‌ জীবনোপকরণে তোমাদের মধ্যে কাউকে কারো উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। (সূরা নাহল, আয়াত -৭১)

সুতরাং সেই বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে শ্রমিকের সাথে সুন্দর আচরণ করতে হবে। তার জন্য তা-ই পছন্দ করতে হবে যা নিজের জন্য পছন্দ করি। তাকে তা খেতে দিতে হবে যা নিজেরা খেতে পছন্দ করি। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

শ্রমিক/ তোমাদের অধীনস্থরা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদের তোমাদের অধীন করেছেন। সুতরাং যার ভাইকে তার অধীন করেছেন সে যেন তাকে তা-ই খাওয়ায় যা সে খায়। সেই কাপড় পরিধান করায়, যা সে পরিধান করে এবং তাকে সামর্থ্যরে অধিক কোনো কাজের দায়িত্ব দেবে না, যদি এমনটা করতে হয় তাহলে সে যেন তাকে সাহায্য করে (সহিহ বুখারি-৫৬১৭)।

আনাস রদিয়াল্লাহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যত্র বলেন,

"‏ لا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ

তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য তা-ই পছন্দ করবে, যা নিজের জন্য পছন্দ করে। (সহিহ বুখারী, কিতাবুল ঈমান, ই.ফা-১২)

সুতরাং, মালিক শ্রমিকের ব্যাপারে এই দৃষ্টিভঙ্গি লালন করলে তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে। কাজের সুন্দর পরিবেশ তৈরি হবে। শ্রমিককেও তার কাজের ব্যাপারে আন্তরিক হতে হবে। মালিকের অবর্তমানে শ্রমিকের উপর তার সমস্ত সম্পদ আমানত স্বরূপ। তাকে আমানতের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। কাজে ফাঁকি দেয়া বন্ধ করতে হবে। মালিকের কাজকে নিজের কাজ মনে করে করতে হবে।

হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. দীর্ঘ দশ বছর রাসুলের খেদমত করেছিলেন। এই দীর্ঘ সময়ে রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে হয় নাই, আনাস! এই কাজটি কেন করেছো কিংবা এই কাজটি কেন করো নাই।
এজন্য শ্রমিকদেরও ভালোভাবে নিজের কাজ সম্পন্ন করতে হবে।

মালিকরাও শ্রমিকদের সামর্থ্যের বাইরে কোন কাজ চাপিয়ে দিতে পারবে না।
আল্লাহ তাআলা নিজেই কোন ব্যক্তিকে তার সামর্থ্যের বাইরে দায়িত্ব দেন না। তিনি বলেন- لَا یُکَلِّفُ اللّٰہُ نَفۡسًا اِلَّا ووُسۡعَہَا
(সূরা বাকারাহ, আয়াত-২৮৬)

তাই, শ্রমিকদের উপর এমন কাজের বোঝা দেওয়া যাবে না যা করতে সে অক্ষম। এমন কাজ দিলে তাকে সহযোগিতা করতে হবে। সময় বাড়িয়ে দিতে হবে। মজুরি বাড়িয়ে দিতে হবে। মালিক শ্রেণিকে সবসময় মনে রাখতে হবে, আল্লাহ তাআলা চাইলে আমাকেই শ্রমিক বানিয়ে তাকে আমার মালিক বানাতে পারতেন। আল্লাহ তাআলার এই অনুগ্রহকে স্মরণ করতে হবে। সুতরাং, নিজের পক্ষে যা অসম্ভব, তা শুধু শ্রমিক হওয়ার কারণে তার উপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। সামর্থ্য থাকার পরও শ্রমিকের প্রাপ্য ও অধিকার প্রদানে টালবাহানা করা যাবে না। আর ছোটখাটো অজুহাতে বেতন-ভাতা ও প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। নবি (সা.) বলেন, যে কাউকে শ্রমিক নিয়োগ দেওয়ার পর তার থেকে কাজ বুঝে নিয়েছে অথচ তার প্রাপ্য দেয়নি। কিয়ামতের দিন আমি তার বিপক্ষে সাক্ষ্য দিবো। (সহিহ বুখারি- ২২২৭)

শ্রমিককে তার যথাযথ প্রাপ্য না দেয়া এবং তার সাথে সুন্দর আচরণ না করার ফলেই মালিক শ্রমিকের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তাই, মালিক শ্রমিক স্ব স্ব জায়গা থেকে নিজেদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলে মালিক শ্রমিকের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে। ফলে উভয় উপকৃত হবে। মালিক শ্রমিক বৈষম্যও দূরীভূত হবে ইনশা আল্লাহ।

|| হাফেজ জাহেদুল ইসলাম ||

পঠিত : ৮৩৩ বার

মন্তব্য: ০