Alapon

কোটা সংস্কার আন্দোলন সঙ্ঘাতে রূপ নিল কেন ?


লমান কোটা সংস্কার আন্দোলন এক ভিন্ন রূপে আবির্ভূত হয়েছে। একে একে ঝরে গেছে ৭ টি তাজা প্রাণ। আহত হয়েছে কয়েকশত সাধারণ শিক্ষার্থী। এই যে ৭ জন মায়ের বুক খালি হলো, কোন অপরাধে ? তাদের অপরাধ তাদের সন্তানেরা তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবি করেছিল রাষ্ট্রের কাছে। রাষ্ট্রের অন্যায় সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনটি সঙ্ঘাতে রূপ নিল কেন ? তারা তো শুরু থেকে খালি হাতেই আন্দোলনে নেমেছিল। তাদের দাবি ছিল কোটা নয়, মেধার ভিত্তিতে চাকুরীতে নিয়োগ হবে। প্রতিবন্ধী ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য সর্বোচ্চ ৫% কোটা রেখে বাকিগুলো বাদ দেওয়ার দাবি করেছিল। মেধার মূল্যায়ণ করার দাবি জানিয়েছিল। বৈষম্য দূর করার কথা বলেছিল। তবে কেন সরকার তাদের উপর খকড়্গহস্ত হলো ? তাও আবার সন্ত্রাসী লেলিয়ে দিয়ে ?

কোটা সংস্কারের দাবী এই প্রথম নয়। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত কোটা সংস্কার হয়েছে মোট ৮ বার; ১৯৭৬, ১৯৮৫, ১৯৯৭, ২০২২, ২০০৯, ২০১১, ২০১২ ও ২০১৮ সালে। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশে কোটা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন পূর্ববর্তী পাকিস্তান সরকারের আদলে। ২০% মেধা কোটা ও ৮০% জেলা কোটা দিয়ে। তবে জেলা কোটার একটা বড় অংশ তথা ৩০% বরাদ্দ রাখেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালে থেকে মুক্তিযোদ্ধারা সরকারি চাকুরিতে আবেদনের বয়সসীমা না থাকায় তারা দাবী করেন তাদের সন্তানদের যেন এই সুযোগ দেওয়া হয়। ১৯৯৭ সালে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য কোটার সুযোগ রেখে কোটাব্যবস্থা সংস্কার করেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম ১৯৯৬ সালে কোটাসংস্কার দাবি উত্থাপন করেছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। যেহেতু মুক্তিযোদ্ধা কোটায় অংশ নেওয়ার মতো কোনো প্রার্থী ছিল না, তাই ছাত্রশিবির ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে তা মেধা কোটায় যুক্ত করার প্রস্তাব করেছিল। ২০০২ সালে ছাত্রশিবিরের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকার কোটা প্রথা কিছুটা সংস্কার করে। ২০০৮ সালেও বিভিন্ন ক্যাম্পাসে কোটা সংস্কারের দাবি উত্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে ২০১১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের তৃতীয় প্রজন্ম তথা নাতি-নাতনী ও পোষ্যদের জন্য কোটা বরাদ্দ দিলে ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বে কোটা সংস্কার আন্দোলন আবারও জোরদার হয়। কিন্তু অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে কোটা সংস্কার আন্দোলন ২০১৩ সালে বন্ধ হয়ে যায়।

২০১৮ সালে কোটা সংস্কারের দাবি সাধারণ শিক্ষার্থীদের গণদাবীতে পরিণত হয়। তুমুল আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১১ এপ্রিল জাতীয় সংসদে সকল কোটা বাতিল করা হবে বলে ঘোষণা দেন এবং কয়েক মাস পরে অক্টোবর মাসে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তা কার্যকর করা হয়। নবম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত অর্থাৎ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। ১৪তম থেকে ২০তম অর্থাৎ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর পদগুলোতে কোটায় প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধা থেকেই নিয়োগের কথাও জানানো হয়।

২০১৮ সালের পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। সেই আবেদনের চূড়ান্ত শেষে বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাই কোর্ট বেঞ্চ কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছিল গত ৫ জুন। হাই কোর্টের আংশিক প্রকাশিত রায়ে বলা হয়েছে, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে সব কোটা বাতিল করে যে ২০১৮ সালে যে পরিপত্র সরকার জারি করেছিল, তা ‘অবৈধ এবং আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত’। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান এবং তাদের নাতি-নাতনিদের জন্য যে কোটা সরকার বাতিল করেছিল, তা পুনর্বহালের নির্দেশ দেওয়া হয় রায়ে। সেই সঙ্গে জেলা কোটা, নারী কোটা, প্রতিবন্ধী কোটা এবং উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও জাতিগোষ্ঠীর জন্যও কোটা বহাল করতে হবে। এই রায় পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে কোটা পুনর্বহালে আদেশ বাস্তবায়ন করতে সরকারকে নির্দেশ দেয় আদালত। সেই সঙ্গে হাই কোর্ট বলেছে, সরকার যদি ওইসব কোটার শতকরা হার বা অনুপাত বাড়াতে, কমাতে বা পরিবর্তন করতে চায়, এই রায় সেক্ষেত্রে কোনো বাধা হবে না।

হাই কোর্টের রায়ের পর থেকেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন করে আন্দোলনে নামেন চাকরিপ্রত্যাশী তরুণরা। প্রথম কয়েক দিন মিছিল, মানববন্ধনের মত কর্মসূচি থাকলেও গত সপ্তাহ থেকে শুরু হয় তাদের অবরোধ কর্মসূচি, যার নাম তারা দিয়েছে ‘বাংলা ব্লকেড’। আন্দোলনের অংশ হিসেবে গত ১৪ জুলাই গণপদযাত্রা কর্মসূচি পালন ও রাষ্ট্রপতিকে স্মারকলিপি দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। পরে তারা জাতীয় সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে কোটা সংস্কারের দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেন। ওইদিনই এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাফ জানিয়ে দেন, সরকারি চাকরিতে কোটার বিষয়টি আদালতেই ফয়সালা করতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’, ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে সম্বোধন করায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে তারা। আন্দোলন পায় এক নতুন মাত্রা। ওইদিন মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে প্রতিবাদ মিছিল বের করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ‘তুমি কে, আমি কে? রাজাকার, রাজাকার’ স্লোগানে মুখরিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আশেপাশের এলাকা। মধ্যরাতেই তারা মিছিল নিয়ে শাহবাগসহ বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। তারা দাবি জানায় প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য প্রত্যাহার এবং সর্বোচ্চ ৫% কোটা রেখে কোটাব্যবস্থা সংস্কার করার জন্য। ওই রাত থেকেই ছাত্রলীগ আন্দলনকারী শিক্ষার্থীদের উপর আক্রমণের চেষ্টা চালায়।

পরদিন ২ দফা দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, শাবিপ্রবি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। কর্মসূচি চলাকালে ছাত্রলীগ পুলিশের উপস্থিতিতে আন্দোলনরত প্রায় সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হমালা চালায়। এতে কয়েকশ শিক্ষার্থী আহত হয়। হাসপাতালে প্রবেশ করেও শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল ১৬ জুলাই দেশের গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে আসে। এতে খড়্গহস্ত হয় সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ছাত্রলীগ ও অস্ত্রধারী পুলিশের ন্যাক্কারজঙ্ক হামলায় ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরে ৭ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়। আহত হয় কয়েকশত শিক্ষার্থী।

এখন কথা হলো সাধারণ ছাত্রদের এই যৌক্তিক আন্দোলনে দেশের এত বড় একটি ছাত্র সংগঠন তাদের দাবির প্রতি সমর্থন না জানিয়ে এই মারমুখী ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো কেন ? কেন সরকার এটাকে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান না করে ছাত্রলীগকে অস্ত্র হাতে লেলিয়ে দিয়েছে ? সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একজন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কেন বললেন, ‘কোটা আন্দোলন নিয়ে কোনো কথা বলবো না, জবাব যা দেওয়ার ছাত্রলীগ দিবে।’-এই জবাব দেওয়ার অর্থ কী পিটিয়ে মানুষ মেরে ফেলা ? সরকার তো চাইলেই আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে পারতো। যেহেতু তারা রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে, তার পরে প্রধানমন্ত্রীর এহেন উস্কানীমূলক বক্তব্যের উদ্দেশ্য কী থাকতে পারে। এটা কী ভারতের সাথে দেশবিরোধী চুক্তি, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি সহ সরকারের অপকর্ম থেকে জনগণের মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা ? সরকারের দৃষ্টিতে এটা যদি অযৌক্তিক আন্দোলনও হয়ে থাকে, তবুও প্রশাসনিক ব্যবস্থা না নিয়ে সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিলো কেন ? স্যাংশনের ভয়ে নাকি অন্য কিছু ? একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণ তাদের অধিকার চাইবে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে, মিছিল, মিটিং, বক্তব্য দিবে এটা তাদের নাগরিক অধিকার। এই নাকরিক অধিকারকে সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে দমন করে সরকার কি এটাই প্রমাণ করে দেয়নি যে তারা স্বৈরাচার ?

*তথ্যসূত্রঃ
১. কোটা, কোটা আন্দোলন ও এর ইতিহাস; আহমেদ আফগানী
২. বিডিনিউজ২৪.কম
৩. জাতীয় দৈনিক পত্রিকা ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া

পঠিত : ৪৯৯ বার

মন্তব্য: ০