Alapon

বিপদ শুধু আল্লাহর পক্ষ থেকে পরিক্ষা নয়, ব্যক্তি জীবনে শিক্ষা ও সতর্কতা



নিচের ভাঙ্গা দরজা আমার বাসার একটা দরোজার ছবি এটা।

ঘটনাটা খুলে বলি। আমার বাসায় রুমের দরোজাগুলোতে দুটো করে ছিটকিনি। একটা ছিটকিনি একেবারে নিচে, মাটি থেকে একহাত মাত্র উপরে। অন্যটা দরোজার একদম উপরের অংশে। উপরের ছিটকিনিটা বাচ্চারা ধরতে পারার কথা নয় কোনোভাবে। কিন্তু যেটা নিচে আছে, সেটা তাদের হাতের নাগালে।

আমার খালি মনে হতো—‘ছোট মেয়েটা একদিন রুমে ঢুকে ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দেবে’।

দরোজার ছিটকিনি হাতের কাছে, বাসায় একটা পিচ্চিও আছে। সুতরাং, এ ধরণের বিপদের আঁচ যেকারোই করতে পারার কথা। কতোবার যে ভেবেছি দরোজার এই ছিটকিনিটা খুলে রেখে দেবো। অথবা, ছিটকিনি আটকানোর হুকটা খুলে রেখে দিলেও হয়। ভেবেছি অনেকবার, কিন্তু কাজটা আর করে উঠা হয়নি। করছি, করবো করে করে দিন পার হয়ে গেল।

আমার ছোট মেয়েটার তখন এক বছর মাত্র বয়স। আলতো আলতো পায়ে হাঁটে। বড় মেয়েটার সাথে খেলাধুলায় মোটামুটিভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে। একদিনের ঘটনা। যোহরের পর পর আমার একটা কাউন্সেলিং সেশান ছিল। সেশানে উপস্থিত থাকতে হলে আমাকে রওনা করতে হবে ঠিক সকাল এগারোটায়।

আমি সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম সকাল থেকে। সাড়ে দশটার দিকে যে-ই না আমি রিডিং রুম থেকে বেরুতে যাবো, হঠাৎ বড় মেয়েটার বিদীর্ণ চিৎকারে আমার অন্তরাত্মাটাই যেন কেঁপে উঠল। দৌঁড়ে রুমের বাইরে এসে দেখি, বড় মেয়েটা কাঁদছে আর বলছে, ‘আব্বু, মারইয়াম ভেতরে আটকে গেছে’।

দরোজার কাছে গিয়ে দেখলাম সেটা ভেতর থেকে আটকানো এবং মারইয়াম ভেতরে গলা ফাটিয়ে কাঁদছে। এরমধ্যে মেয়ের মা-ও এসে গেছেন হাতের কাজ ফেলে। তারা তিনজনেই ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। রুমের ভেতরে আটকা পড়ে মারইয়াম কাঁদছে, রুমের বাইরে কাঁদছে বড় মেয়েটা আর ওর মা।

আমার সেশানের জন্য বের হওয়ার সময় একেবারে কাছাকাছি, এদিকে এই বিপদ! কী করি?

বাইরে থেকে মারইয়ামকে অনেক ডাকাডাকি করলাম। দরোজাকে নিজের দিকে টেনেও ধরলাম, যাতে ছিটকিনিটা সে সামান্য নড়াচড়া করলেই খুলে যায়। কিছুতেই কাজ হলো না। ওদিকে ওর কান্না বাড়ছে তো বাড়ছেই। আমিও ভয় পেয়ে গেলাম খানিকটা—বেচারি যদি সেন্সলেস হয়ে যায়!

আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইলাম মনে মনে। একটু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে বাইরে আসলাম। বাসার খুব কাছেই একটা ফার্নিচারের দোকান। তাদেরকে সমস্তটা খুলে বলতেই, একজন মিস্ত্রী কিছু যন্ত্রপাতি সমেত চলে এলেন আমার সাথে। দরোজার যে জায়গায় ছিটকিনিটা ছিল, ঠিক তার উল্টোপাশ বরাবর তিনি কাটতে শুরু করলেন। খুবই সাবধানে কাটছিলেন, কারণ বিপরীত পাশে দরোজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে আমার ছোট্ট মেয়েটা।

প্রায় ১০ থেকে ১৫ মিনিট পরে দরোজায় এই ছিদ্রটা করা সম্ভব হয়। হাত ঢুকিয়ে ছিটকিনি খুলে আমরা মেয়েটাকে বের করি সেদিন। আলহামদুলিল্লাহ।

এই ঘটনা থেকে আমি কয়েকটা জিনিস শিখেছি সেদিন। প্রথমটা হলো—যেকোনো কাজ, হোক সেটা যতো ছোট অথবা বড়—সেটা যদি আজকে করে ফেলার সুযোগ আর সময় থাকে, তাহলে অন্যকোনো দিনের জন্য সেটা তুলে না রাখা।

হতে পারে, অন্যদিন সেই ফেলে রাখা কাজটা একটা বিপদের কারণ হয়ে উঠবে। ছিটকিনিটা যদি আমি খুলে রাখতাম আগে, হয়তো এই ঘটনাটা সেদিন ঘটতো না।

দ্বিতীয় বিষয়টা হলো, এই ধরণের পরিস্থিতি ধৈর্য ধরে সামলানো। একে তো আমার সেশানের সময় খুব আসন্ন ছিল। তখন বের হয়ে না পড়লেই নয়। অন্যদিকে কলিজার টুকরো মেয়েটা আটকা পড়ে গেল। অধিকাংশ মানুষ এমন পরিস্থিতিতে রাগ সামলাতে পারে না। ঘরের অন্য সদস্যদের দোষারোপ করে বা চিৎকার চেঁচামেচি করে।

কিন্তু, আমরা যদি একটু মাথা খাটিয়ে ভাবি—ঘরের অন্যদের দোষারোপ করাটাও সমাধান এনে দেয় না, চিৎকার চেঁচামেচি করে ঘর মাথায় তোলাটাও কোনোকিছুর সমাধান করে না। সমাধান চাইতে হয় আল্লাহর কাছে। তারপর ধীরেসুস্থে ভাবতে হয় উদ্ভুত পরিস্থিতিকে কীভাবে সমাধান করা যায়। আমি যদি সেদিন অন্যদের দোষ দিতে গিয়ে আর চেঁচামেচি করতে গিয়ে বাড়তি দশটা মিনিটও নষ্ট করতাম, হয়তো ওই বাড়তি দশমিনিটের ব্যবধানে আমার ছোট মেয়েটা শক থেকে অজ্ঞান হয়ে যেত। হতে পারতো—সারাজীবন এটা তার জীবনে একটা ট্রমা হিশেবে থেকে যেত। একটা ভুল সিদ্ধান্ত, অনেক ঘটনার দিকে মোড় নেওয়ায় জীবনকে।

সেদিন আমি সেশানের জন্য বেরিয়ে পড়বার পর যদি এই ঘটনা ঘটতো, আমাকে যে একটা ফোন দিবে বাসা থেকে, সেই সুযোগটাও অবশিষ্ট থাকতো না। কারণ, মারইয়াম যে রুমের ছিটকিনিটা আটকে দিয়েছিল, সেই রুমে তার আম্মুর ফোনও আটকা পড়া ছিল।

আমি বুঝলাম—আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা শুধু বিপদ দিয়ে মানুষকে পরীক্ষাই করেন না, সেই বিপদের মাঝে এমন অনেক উপাদান রেখে দেন যা দেখে বান্দার মনে হবে—‘আমার বিপদটা তো আরো কঠিন হতে পারতো। এটাও ঘটতে পারতো, ওটাও ঘটতে পারতো। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা হিফাযত করেছেন’।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলাই যে হিফাযত করেন—এই বোধটুকু হৃদয়ে পোক্ত করার জন্যই তো জীবনে বিপদ আসে। হাসবুনাল্লাহু ওয়া নি’মাল ওয়াকীল। আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট। তিনি কতোই না উত্তম কর্মসম্পাদনকারী।

লেখকঃ আরিফ আজাদ

পঠিত : ৬০ বার

মন্তব্য: ০