আন্দোলন, গণহত্যা, গণঅভ্যুত্থান - পর্ব ১
তারিখঃ ২৯ নভেম্বর, ২০২৪, ০৮:৪১
.
জুলাই ২০২৪, বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহ অবিস্মরণীয় ইতিহাস হিসেবে লিখা হচ্ছে, লিখা থাকবে। সরকারি চাকরিতে সাধারণ ছাত্র সমাজের কোটাবিরোধী, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন হিসেবে শুরু; এরপর ভারতের পাপেট জালিম-ত|গু'ত শেখ হাসিনার গণ-হ-ত্যা ও ক্র্যাকডাউনের কারণে সপ্তাহের ব্যবধানে তা এক গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশে অবস্থানরত এবং কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করা আমরা ঘটনাপ্রবাহ মোটামোটি জানি। তাই আমাদের আজকের আলাপ এখনও আলো-আঁধারে থাকা এমনকিছু বিষয়ে যেগুলোকে একজন জি/হা-দপন্থী মুসলিম দাঈর পর্যবেক্ষণ, মন্তব্য, নাসীহা, করণীয় ইত্যাদির বিক্ষিপ্ত (কিন্তু প্রয়োজনীয়) প্রবন্ধ বলা যেতে পারে।
.
[১] ভারতীয় আধিপত্যবাদের থাবা?
.
শুরুতে সাধারণ অধিকার আদায়ের নিরীহ এক আন্দোলন হওয়া সত্ত্বেও তা দমনের নামে ত|গু'ত হাসিনা প্রকৃতপক্ষে ভারতের র-এর সহায়তায় ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য এই গণ-হ-ত্যা ও ক্র্যাকডাউন চালিয়েছে।
স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকার যে ভারতের মদদেই টিকে আছে এবং ভারতের স্বার্থরক্ষাকারী পাপেট হিসেবেই কাজ করছে এ কথা তো স্বতঃসিদ্ধ এবং অকাট্যভাবে প্রমাণিত। আর ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সময়ে সময়ে হাসিনা যেসব গণ-হ-ত্যা চালিয়েছে সেসবে ভারতের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সম্পৃক্ততার কথাও জনপরিসরে বারবার আলোচনায় এসেছে।
ঘটনাবহের অস্থিরতা এখনও চলমান থাকা, কারফিউ-সেনাবাহিনী ইত্যাদি জারি করে এখনও র নির্দেশিত হাসিনা বাহিনীই শাসনে থাকা – ইত্যাদি কারণে উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণসহ এখনই ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা 'র' এর (সরাসরি) সম্পৃক্ততা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। তাছাড়া আরেক দেশে হস্তক্ষেপের সময় ইন্টেলিজেন্স বাহিনী স্বাভাবিকভাবেই তাদের রেকর্ড যতো সম্ভব মুছে দেওয়ার চেষ্টা করে।
.
কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও আল্লাহর ইচ্ছায় কিছু কিছু আলামত ইতোমধ্যেই বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, যা বাংলাদেশে ২০২৪-এর জুলাইয়ের গণ-হ-ত্যায় হাসিনার সহায়তাকারী হিসেবে উপমহাদেশীয় হিন্দুত্ববাদী ভারতকেই নির্দেশ করছে। (এই ব্যাপারে আরও বিস্তারিত পরে আসছে ইন শা আল্লাহ)
.
[২] দ্বন্দ্বের শুরু ও শেষ
.
২০২৪-এর জানুয়ারিতে বাংলাদেশে আরেকবার গণতন্ত্রের নামে নির্বাচন নাটক অনুষ্ঠিত হয়ে আওয়ামী লীগ যখন আবার ক্ষমতায় আসে, এরপর থেকে এখানে ভারতীয় পণ্য বয়কটের আন্দোলন জনপ্রিয় হতে শুরু করে। কিন্তু এইসব অর্থনৈতিক লাভক্ষতির হিসেব ছাড়াও মুমিনরা ভাল করেই জানে যে, গোঁড়া হিন্দু'ত্বব|দী ভারতের সাথে মুসলিমদের মূল দ্বন্দ্ব ঈমানে, আকিদায়, দ্বীনে।
.
পণ্য বয়কট আন্দোলন না হলেও ভারত যে হাসিনা সরকারকে দিয়ে প্রয়োজনে - অপ্রয়োজনে সুযোগ পেলেই এখানকার ইসলামপন্থীদেরকে এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিরোধীদেরকে হত্যায় মেতে উঠে, তা ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহ, ২০১৩ সালের শাপলাচত্বর গণ-হ-ত্যা, ২০২১ সালের মোদিবিরোধী আন্দোলনে ক্র্যাকডাউন – ইত্যাদি ঘটনায় তা স্পষ্ট হয়। এটা ঠিক যে মুসলিমদের ভারতীয় পণ্য বয়কট আন্দোলনের কারণে এবার আমাদের উপর ওদের ক্ষোভটা হয়তো খানিক বেশিই ছিল।
.
মোদির জাতীয় ক্ষমতায়ন শুরুই হয়েছিল গুজরাটে মিথ্যে অযুহাতে মুসলিমদের ওপর স্মরণকালের ভয়াবহতম গণ-হ-ত্যা চালিয়ে। আর কাশ্মিরের বেদনাদায়ক ঘটনা থেকে শুরু করে তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে মুসলিমদের হত্যা, লুন্ঠন, ধর্ষণ এসব তো আমাদের অহরহই দেখতে হয়। ভারতীয় জাতীয়তাবাদী হওয়া সত্ত্বেও স্রেফ ঈমানের কারণে, দ্বীনের কারণে ওরা মুসলিম হত্যায় মেতে উঠতে দ্বিধা করে না। এমনকি বাবরি মসজিদের শাহাদাত, সেখানে রামমন্দির নির্মাণ... তাই এই উপমহাদেশে হিন্দু'ত্বব|দীদের সাথে আমাদের দ্বন্দ্বের শুরু আর শেষ যে একমাত্র ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ – তা আমাদের ভুলে যাওয়া যাবে না। এত জুলুম আর নিষ্পেষণের মাঝেও কাশ্মিরের জন্য ভারতীয় মুসলিম ভাইদের তোলা ‘তেরা মেরা রিশতা কীয়া, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ স্লোগান কিন্তু গুজরাটের কসাইরা সহসা ভুলে যায় না।
.
[৩] সহজ সরল প্রশ্ন ও কিছু যৌক্তিক অনুমান
.
ভারতীয় পণ্য বয়কট আন্দোলনের কথা বললে, এবার এখানকার সাধারণ ছাত্রদের (যাদের অধিকাংশই মুসলিম) আন্দোলনের কারণে ভারতের সবচেয়ে বড় পণ্য ‘শেখ হাসিনা’ বয়কট (আদতে উৎখাত) হওয়ার উপক্রম হয়েছে। আর এই ফেরাউনতূল্য ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা হলো বাংলাদেশের মুসলিমদের ওপর, বাংলাদেশের সম্পদের ওপর ভারতের আধিপত্যের সবচেয়ে বড় গেটওয়ে, ভারতের সবচেয়ে বড় স্ট্র্যাটেজিক অ্যাসেট। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী থেকে সাধারণ মুসলিমদের খুন করার কথা তো আগেই এসেছে। সম্পদের দিক দিয়ে শেষমেশ দেখেছিলাম শেখ হাসিনা ভারতকে রেল ট্রানজিট এবং মংলা বন্দরও দিয়ে দিয়েছে। ভারতীয় মিডিয়াগুলো সেটাকে উপমহাদেশীয় জিওপলিটিক্সে চীনের বিরুদ্ধে ভারতের বিজয় হিসেবে জোরেশোরে প্রচারও করছে।
.
ঠিক এমন মুহুর্তেই যদি সাধারণ ছাত্র – যাদের অধিকাংশই কিনা আবার মুসলিম – তাদের আন্দোলনের কারণে বাংলাদেশে ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্ট্র্যাটেজিক অ্যাসেট, ভারতের সবচেয়ে বড় পণ্য ‘শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ’ পতনের অবস্থা তৈরি হয় তাহলে যে তা মূলত ভারতের জন্যই এক বিশাল পরাজয় হবে তা যেকোনো বিবেকবান, চিন্তাশীল বান্দাই বুঝতে পারবে। শুধু তাই নয়, এই মুহুর্তে ত|গু'ত আওয়ামী লীগের পতন হলে ভারতের অতিসাম্প্রতিক যে রেল ট্রানজিট, মংলা বন্দর ইত্যাদি বিজয়গুলো নিয়ে তারা উল্লাস করছে সেগুলোও মুহুর্তেই ধুলো হয়ে যেতে পারে।
.
তাহলে যে প্রশ্নের উত্তর একেবারে সহজ হয়ে যায় – সাধারণ ছাত্রদের (যাদের অধিকাংশই মুসলিম) আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহে ভারতীয় অ্যাসেট শেখ হাসিনার পতনোন্মুখ অবস্থা তৈরি হলে বরাবরের মত সেখানে গণ-হ-ত্যা আর ক্র্যাকডাউনে কে সাহায্য করতে সবার আগে এগিয়ে আসবে?
উত্তরটা একেবারেই সহজ। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা 'র' পরামর্শ দিয়ে, আন্তর্জাতিক সমর্থন তৈরির প্রচেষ্টা চালিয়ে এবং দেশের ভেতর সিস্টেমেটিক ভাবে তাদের গড়ে তোলা নেটওয়ার্ককে কাজে লাগিয়ে আগের মতই এই গণ-হ-ত্যাকারী সরকারকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করবে।
.
[৪] আন্দোলন, তিনটি তাৎপর্য ও শিক্ষা
.
২০২৪ এর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ যে তিনটি বিষয় ছিল, তার প্রথমটি হলো – এক নতুন প্রজন্ম রক্ত দিতে শিখে গিয়েছে। তারা ফেরাউনতুল্য শাসকের ভয় কাটিয়ে উঠেছে। এটা এমন এক পরীক্ষা যে পরীক্ষায় অনেক রথী মহারথীরাও ফেল করে যায়। সেই পরীক্ষাতেই ছাত্ররা আল্লাহর ইচ্ছায় পাশ করেছে। আন্দোলনের চূড়ান্ত সাফল্য (এখনও) না মিললেও ছাত্ররা তাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ যেটুকু করার ছিল, সেটুকু করতে পেরেছে আলহামদুলিল্লাহ। সফলতা-বিফলতার মালিক তো আল্লাহ।
.
আর সাধারণ মুসলিম থেকে বিভিন্ন ইসলামি সংগঠনের জন্যও শিক্ষাটা এখানে – রক্ত ছাড়া বিজয় তো দূরের কথা, সেই পথে হাঁটাও যায় না। কতো আন্দোলন শুরুর দিকে মার খেয়ে সমঝোতায় আর চুক্তির ফাঁদে হারিয়ে গিয়েছে।
.
ছাত্রদের এবারের আন্দোলনে দ্বিতীয় যে তাৎপর্যপূর্ণ ও শিক্ষামূলক বিষয় ছিল, সাধারণ থেকে ইসলামি যেকোনো সংগঠনের জন্য, তা হলো – হায়ারার্কি (hierarchy) বেইজড স্ট্রাকচার থেকে বের হয়ে হোলাক্রেসি (holacracy) স্ট্রাকচারে আন্দোলন পরিচালনা করা। হায়ারার্কি বেইজড স্ট্রাকচারে এক কিংবা অল্প কয়েকজনের নির্দেশে কার্যক্রম পরিচালিত হয়, সেটা একটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক সংগঠন বা আন্দোলন যেকোনো কিছুতেই হতে পারে। অন্যদিকে হোলাক্রেসিতে কোনো সেন্ট্রালাইজড নেতৃত্ব থাকে না; অনেকেই নিজস্ব সার্কেলে নেতৃত্ব পর্যায়ের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অনেক বেশি ডিটেইলসে যেতে চাই না। এগুলো একটু সার্চ করলেই উভয় স্ট্রাকচারের সুবিধা-অসুবিধা, প্র্যাক্টিকালিটি সবকিছু পেয়ে যাবেন।
.
কোনো সংগঠন পরিচালনা করতে হায়ারার্কি বেইজড স্ট্রাকচারই বেশি ফলদায়ক এটা যেমন ঠিক, তেমনি আন্দোলন বা অভ্যুত্থানের সময় জালিমের হাতে নেতৃত্বশূন্য না হওয়ার জন্য হোলাক্রেসি স্ট্রাকচারই বেশি যুতসই। ছাত্ররা জেনে কিংবা না জেনে এমনই একটা স্ট্রাকচার দাঁড় করিয়েছে মাশাআল্লাহ, যা তাদের আন্দোলনকে ৬ জন সমন্বয়ক দিয়ে প্রত্যাহার নাটক করিয়েও দমাতে পারেনি। ষাটের বেশি সমন্বয়ক ছাড়াও শেষদিনের খবর পর্যন্ত জেনেছি, “আমি কে? তুমি কে? সমন্বয়ক, সমন্বয়ক” স্লোগান এসেছে।
.
আন্দোলনের ক্ষেত্রে কেন এই ধরনের মডেল বেশি উপযোগী সেটা বোঝার জন্য এই শেখ হাসিনা অধ্যায়েই হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন কিংবা মোদিবিরোধী আন্দোলনের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। যেকোনো আন্দোলন ফুঁসে ওঠা দমানোরই একটা উল্লেখযোগ্য স্ট্র্যাটেজি হলো – মাথা কেটে দেওয়া বা নেতৃত্বশূন্য করে ফেলা। সেটা নেতৃত্বকে বন্দি করে, তাদেরকে ভয়ভীতি দেখিয়ে সমঝোতা বা চুক্তি করে ইত্যাদি বিভিন্নভাবেই হয়। কিন্তু ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা তা হতে দেয়নি।
.
অধিকাংশ (ইসলামি) আন্দোলন বা সংগঠনের ব্যর্থতা এখানেই যে তারা পর্যাপ্ত সংখ্যক যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি না করে একজন কিংবা অল্প কয়েকজনের দিকে চেয়ে থাকে যা তাদেরকে সামান্য নেতৃত্বশূন্য অবস্থাতেই দিশেহারা করে দেয়।
.
তৃতীয় তাৎপর্যপূর্ণ ও শিক্ষামূলক বিষয়টি হলো – অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া। এই ছাত্ররা ২০১৮ সালে, সড়ক আন্দোলনে মার খেয়ে, ঘরে ফিরে গিয়ে আরও বেশি জুলুমের শিকার হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা তাদেরকে ২০২৪ সালে এসে আর আন্দোলন থেকে দমাতে পারছে না। আল্লাহ চাইলে আন্দোলন সফল হবে, না চাইলে হবে না। কিন্তু এতটুকুতেই ছাত্ররা যে অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের আপাদমস্তক প্রস্তুত করতে পেরেছে, তা সত্যিই আওয়ামী দুঃশাসন ভেঙ্গে এক নতুন ইতিহাস গড়ার আশা দেখায়।
.
.
কলেবর বেড়ে যাওয়ায় প্রথম পর্ব এখানেই শেষ করছি ইনশাআল্লাহ। পরের পর্বই শেষ ইনশাআল্লাহ। সেখানে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট আলাপ হবে ইন শা আল্লাহ। সেগুলোর মধ্যে থাকবে – বিভিন্ন দিক থেকে আন্দোলনের সেক্যুলারাইজেশনের ষঢ়যন্ত্র এবং ইসলামপন্থীদের দায়, ইসলাম এবং শত্রুর প্রকৃত পরিচয়, ছাত্র ভাইদের প্রতি নাসীহা ও আমাদের করণীয়, তিরস্কার এবং সূরাহ মায়েদার আয়াত ইত্যাদি। আল্লাহই তাওফিকদাতা।
.
আপনাদের ভাই আবু উবাইদাহ আল হিন্দি
২৩ মুহাররম, ১৪৪৬ হিজরি
মন্তব্য: ০