Alapon

বন্দি জীবনে আত্মগঠন ও ব্যক্তিগঠন

বন্দি জীবনে আত্মগঠন ও ব্যক্তিগঠনঃ

এটি এমন সময় যখন পৃথিবীর সকল আপনজনের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখা যায় না। নিজের জীবনের সকল প্রয়োজনীয় উপাদান থেকে বঞ্চিত থাকতে হয়। একটি কঠোর ও শৃঙ্খলিত এবং অমানবিক জীবনকে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। এ অবস্থায় কারাবন্দি হয়েও জীবনকে আরও সুন্দর করে গঠন করতে কিছু পরামর্শ রাখছি
১। যারা ছাত্র তাদের কারাকর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে প্রয়োজনে কোর্টের নির্দেশে পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষাসামগ্রী সংগ্রহ করে নিতে হবে। সাথিদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করা, ছাত্র হিসেবে পরীক্ষার প্রস্তুতিতে বেশি সময় ব্যয় করা।
২। ভুলে যেতে হবে এটি জেলখানা, এটিকে খাপখাইয়ে নিয়ে সময় কাটাতে হবে। মনে রাখতে হবে, হায়াত এক এক দিন করে শেষ হয়ে যাচ্ছে। একটি দিন অনেক দামি ও মূল্যবান। একটি রুটিন ঠিক করে নিতে হবে। কারণ এখানে কঠিন নিয়ম চলছে। কখন খাওয়া, কখন গোসল, কোন দিন চুল কাটা, কখন তালা খুলে দেবে, সবকিছু নিয়মে বাঁধা।
৩। কয়েকজন সমমনা এৎড়ঁঢ় করে নিলে একে অপরকে সহযোগিতা করতে সহজ হয়। একটি কারাগারে চলমান আছে।
৪। স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নেওয়া। এটি গুরুত্ব¡পূর্ণ বিষয়। বিছানাপত্র পরিচ্ছন্ন রাখা, মাঝে মধ্যে রোদে দেওয়া, খাওয়াদাওয়াতে নিয়ম মেনে চলা, বিশুদ্ধ পানি পান করা, কম আহার করা, বিকেলে কারার মাঠে নিয়মিত ব্যায়াম করা।
৫। অসুস্থ হলে চিকিৎসা নেওয়া কারাগারে ডাক্তার জরুরি চিকিৎসা দিয়ে থাকে।
৬। মক্তবে নিজের নাম লিখিয়ে ছাত্র হয়ে যাওয়া। দুই ঘণ্টা কুরআন তালিমে নিয়মিত অংশ নেওয়া। কয়েদিদের মধ্যে অনেক আলেম থাকেন তারাই মোটামুটি শিক্ষকতার কাজ করে থাকেন।
৭। এতদিন কুরআন তিলাওয়াতে যে দুর্বলতা ছিল, তা এখানে সংশোধন করে নেওয়ার সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।
৮। আগেই বলছি জেলখানাতে লাইব্রেরি রয়েছে। সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে বই আনা যায়। বইপুস্তক সংগ্রহ করে পড়তে হবে। এখানে ব্যাপক অধ্যয়নের সুযোগ যা খুব কম লোক কাজে লাগায়।
৯। আড্ডাবাজি ও গল্পগুজবে কয়েদিদের সময় কাটে। কিন্তু না, মুমিনেরা হায়াত অপচয় করতে পারে না। যেকোনোভাবে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে নিতে হবে।
১০। আগেই বলেছি, ছাত্রদের জন্য জেলখানায় মূল অধ্যয়নের বিষয় দুটি এক. পাঠ্যপুস্তক; দুই. আল কুরআন।
১১। তাই কুরআনকে জেলখানায় লেখাপড়ার মূল বিষয়ে বানাতে হবে।
ক) কুরআনের তাজবিদ শিক্ষা মক্তবে।
খ) অর্থসহ কুরআন পাঠ : সারা কুরআন ‘বাকারা হতে নাছ’ পর্যন্ত অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন শুরু করতে হবে। কারাকক্ষে কুরআন অধ্যয়নে বেশি মজা পেয়েছিলাম।
গ) কাগজে ঘড়ঃব করা। ছাত্রদের জন্য কাগজ কলম বৈধ। আমি ছাত্রদের থেকে নিয়েছিলাম ও হাজার খানিক আয়াত বিশেষভাবে পড়ার ও শেখার জন্য ঘড়ঃব করেছিলাম।
ঘ) কুরআনের আয়াত, সূরা মুখস্থ করার সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। জেলখানাতে কুরআন পুরাই হেফ্জ করেছে এমন নজির বহু আছে।
১২। সালাত আদায় করতে হবে নিয়মিত ও জামাত কায়েম করতে হবে। প্রত্যেক ওয়ার্ডে ১৫. জন কয়েদির মধ্যে ৫. জন কমপক্ষে নামাজি থাকে।
১৩। সালাতের দাওয়াত ও নামাজি বাড়ানোর কাজটি এখানে মূল দাওয়াতি কাজ। তবে বুঝতে হবে এখানে ভয়ংকর অপরাধী, নেশাখোর, হত্যাকারী ও সন্ত্রাসীদের আবাসস্থল।
১৪। ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও আলাপের মধ্যেমে ধীরে ধীরে গড়ঃরাধঃব করতে হবে। বন্ধুসুলভ আচরণ ও হাদিয়া প্রদান, নিজের জন্য বাইর থেকে যা আসে, তাতে ঝযধৎব করা হচ্ছে সম্পর্ক সৃষ্টির উপাদান।
১৫। কারাগারে অনেকে গোয়েন্দার দায়িত্ব পালন করে। সব বিষয়ে নিজেকে সাবধানে ও বুদ্ধিমত্তার সাথে চলতে হয়।
১৬। ঝগড়াঝাঁটি, রাজনৈতিক বিতর্ক, সরকারের সমালোচনা ইত্যাদি অপ্রয়োজনীয় কাজ থেকে দূরে থাকতে হবে।
১৭। সর্বদা নিজেকে ত্যাগ করার মানসিকতা গ্রহণ করতে হবে। পাশের ভাইটি, রুমের অসুস্থ ব্যক্তিটির প্রতি সেবাদান একটি দাওয়াতি কাজ বুঝতে হবে।
১৮। দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ যারা সারাক্ষণ কিছু পেতে চায়। অন্তত কিছু দিতে না পারলেও সুসম্পর্ক রাখা প্রয়োজন। কেউ হয়তো একই থানার বা জেলার হিসাবে কাছে টানা যায়। এরা অনেক কাজে আসে।
১৯। সকালে, দুপুরে ও খড়পশঁঢ়-এর পর গুনতিতে বিরক্তি প্রদর্শনকরা ঠিক নয়। এটিকে জেল জীবনে স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করবে। ফাইলে শৃঙ্খলার সাথে বসতে হবে।
২০। জেলজীবনে বিদ্রোহী আচরণকে কঠিনভাবে নেওয়া হয়, শান্তিও কঠিন। তাই সংযত ও নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে অভ্যস্তÍ হতে হবে।
২১। সকাল থেকে ১২টা, খাওয়ার পর আবার সন্ধ্যা পর্যন্ত, কিছুটা উন্মুক্ত পরিবেশে বাইরে অন্য ওয়ার্ডের কয়েদিদের সাথে দেখা-সাক্ষাতের সুযোগ থাকে।
২২। তখন সমমনা অন্যদের সাথে পরিকল্পিতভাবে মাঠে হাঁটা, ঘাসের ওপর বসে দ্বীনি আলাপ সংযতভাবে করার সুযোগ আছে। দাঈদের বুঝতে হবে তাদের সর্বাবস্থায় দাঈ থাকতে হবে।
২৩। অনেক দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক ও দাওয়াতের কারণে আশু পরিবর্তন হতে দেখেছি। একবার যদি তাদের জীবনে কোনো অনুভূতি আসে সেটি এ নিঃসঙ্গ জীবনে দাগ কাটে ও পরিবর্তনের সূচনা করে

২৪। এ অপরাধীরাও তো মানুষ। এদের মধ্যে অনেকে আছে মিথ্যা মামলায় কারাবাস করছে, তারা জানে না কেন তারা জেল খাটছে। এদের সাথে মিশলে ও সঙ্গ দিলে এরাও ভালো মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে।
২৫। এখানে সপ্তাহে দুদিন বৃহস্পতিবার ও সোমবার সিয়াম পালন করার অভ্যাস করা উচিত। পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন জীবন সিয়ামকে বেশি ফলপসূ ও আত্মগঠনের উপায় মনে হয়েছে।
২৬। সন্ধ্যার খাবার রেখে দিয়ে রাতে খাওয়া যায়।
২৭। শেষ রাতের সালাত, তাহাজ্জুদ কারাজীবনে বেশি গুরুত্ব¡পূর্ণ। এখানে আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন ও চোখের পানি স্বাভাবিক জীবনের চেয়ে বেশি ক্রিয়াশীল। অবস্থার কারণে এ সময়ে আল্লাহর কাছে বেশি ধর্ণা দেওয়া ও নৈকট্য লাভের উপায় হিসেবে বেশি ইবাদত করার সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।
২৮। কারা জীবনে মানুষ নিজেকে সংযত ও পরিমিত হতে বাধ্য হয়। অনেক কিছু চাইলে পাওয়া যায় না, খাওয়া যায় না, ইচ্ছামতো যাওয়া যায় না, জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করার এ তারবিয়তকে জীবনের জন্য শেখা উচিত।
২৯। একদিন আপনজনদের ছেড়ে যেতে হবে এটি যেন তার প্রশিক্ষণ’ সে হিসেবে গ্রহণ করলে মৃত্যুর শিক্ষা আমাদের জীবনকে বদলে দিতে হবে।
৩০। সাক্ষাতে যারা আসেন, তাদের শুধু এটা চাই, ওটা প্রয়োজন ইত্যাদি কম বলে হিদায়াতের, সালাতের ও কুরআন অধ্যয়নের কথা উপদেশ দিলে তাদেরও পরিবর্তন হয়।
৩১। জেল জীবনে সবর ও ধৈর্যের কোনো বিকল্প নেই, প্রতিটি মুহূর্তে সবরের সাথে থাকতে হবে। অধৈর্য ও অস্থিরতা এখানে বেদনাকে আরও দুর্বহ করো তোলে।

‘দাওয়াতে দ্বীন’ বই থেকে খানিক অংশ
লিখেছেন : অধ্যাপক মফিজুর রহমান

পঠিত : ২৭ বার

মন্তব্য: ০