Alapon

শুধু আবেগ নয়, বুদ্ধি ও বিবেক দিয়ে প্রতিবাদ হোক—ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও ফিলিস্তিনের প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা:

একজন মুসলমানের হৃদয়ে ফিলিস্তিনের জন্য ব্যথা থাকবে—এটাই স্বাভাবিক। যারা আল-আকসা মসজিদের ইতিহাস জানেন, যারা জানেন নবীজির (সা.) মেরাজের প্রথম ধাপ এই পবিত্র ভূমিতে, তাদের হৃদয় ব্যথায় মোচড় দিবে, যখনই এই মাটিতে রক্ত ঝরে, শিশুর কান্না ওঠে, মায়ের বুক খালি হয়।

ইজরায়েলের বর্বর আগ্রাসনে ফিলিস্তিন যেন প্রতিদিন এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই ব্যথা আমরা কীভাবে ধারণ করছি? কিভাবে তা প্রকাশ করছি? এই অনুভূতিকে আমরা কি জ্ঞানের আলোয় রূপ দিচ্ছি, নাকি? শুধু আবেগের ঢেউয়ে ভেসে গিয়ে নিজের দেশের ক্ষতি করছি?

হামাসের হাতে বন্দী ইজরায়েলি নাগরিকদের সাথে আমাদের ভাইয়ের কেমন আচরণ করছে!

সম্প্রতি বিশ্ববাসী বিস্ময়ে দেখেছে—হামাস যখন কিছু ইজরায়েলি নাগরিককে বন্দী করেছিল, তখন তাদের সঙ্গে কেমন আচরণ করা হয়েছে। ভিডিওতে দেখা গেছে, বন্দীদের খাওয়ানো হচ্ছে, ওষুধ দেওয়া হচ্ছে, এমনকি মানসিক প্রশান্তিও দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ইসলামের যে শিক্ষা—"দুশমনের সাথেউ উত্তম আচরণ দিয়ে প্রতিবাদ করা", তা যেন বাস্তবে রূপ নিয়েছে এই দৃশ্যে।

এই আচরণ ছিল একটা বার্তা—আমরা মুসলমান, আমরা ন্যায়বিচার চাই, প্রতিশোধ নিতে চাই কিন্তু রাসুলের দেওয়া উত্তম পদ্ধতিতে। ফিলিস্তিনের ভাইদের এমন এই প্রতিরোধ কেবল বন্দুকের নয়, এটি এক মানবিক চেতনাও বহন করে।

বাংলাদেশে কিছু দৃশ্য: হতাশাজনক ও বেদনাদায়ক

এই দৃশ্যের ঠিক বিপরীতে আমরা বাংলাদেশে কী দেখছি? ইসলামের নামে, ফিলিস্তিনের প্রতি সংবেদনার নামে আমরা নিজের দেশেই লুটপাট করছি, দোকানে আগুন দিচ্ছি, সাধারণ মানুষকে ভয় দেখাচ্ছি। কে সেই দোকানের মালিক—সে মুসলিম না অমুসলিম, সে গরিব না মধ্যবিত্ত—সেটা দেখার প্রয়োজন মনে করছি না। এমনকি আবার সেই হামলার ক্লান্তি কাটাতে কিনছি সেই কোম্পানির কোমল পানীয়, যার বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে এসেছি।

বাসায় ফিরে সেই বিদেশি কোম্পানির টুথপেস্ট, সাবান, শ্যাম্পু দিয়েই পরিষ্কার হচ্ছি—এ কেমন প্রতিবাদ? এ তো আত্মপ্রবঞ্চনা। এ তো নিজের বিবেককে সান্ত্বনার মোড়কে ঢেকে রাখা।

এমন আবেগ নয়, ইসলাম চায় প্রজ্ঞার প্রতিবাদ

ইসলাম আমাদের শিখিয়েছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে দৃঢ়ভাবে, কিন্তু সেই অবস্থান যেন ন্যায় ও বিবেকবোধের আলোয় পরিচালিত হয়। রাসূল (সা.) বলেছেন,
"তোমাদের মধ্যে উত্তম সেই, যে অন্যের ক্ষতি করে না; যার হাত ও জবান থেকে মানুষ নিরাপদ থাকে।"

তাহলে ফিলিস্তিনের প্রতি ভালোবাসা যদি কাউকে নিজের প্রতিবেশীর দোকান ভাঙতে শেখায়, তবে সেটি কীভাবে ইসলামসম্মত হয়?

ফিলিস্তিনের প্রতি ভালোবাসা—দেশের প্রতি দায়িত্ব

ফিলিস্তিনের জন্য কান্না, দোয়া, দান, বয়কট ও সম্ভব হলে যুদ্ধের ময়দানে উপুস্তি হওয়া—সবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার পাশাপাশি এটাও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা কীভাবে নিজেদের সমাজে, রাষ্ট্রে এমন একটি শক্তিশালী ভিত্তি গড়ে তুলতে পারি, যাতে আমাদের প্রতিবাদ হবে গ্রহণযোগ্য, প্রভাবশালী এবং স্থায়ী।

আপনি যদি সত্যিই ফিলিস্তিনের জন্য কিছু করতে চান—তবে এই মুহূর্তে আপনার সবচেয়ে বড় করণীয় হলো:

সচেতনতা তৈরি করুন।
মানুষকে জানাতে হবে, কীভাবে মিডিয়া ফিলিস্তিন ইস্যুকে বিকৃত করে, কিভাবে পুঁজিবাদী কর্পোরেট সংস্থাগুলো ইজরায়েলের যুদ্ধযন্ত্রে অর্থ জোগায়। তথ্য দিন, যুক্তি দিন, সাধারণ মানুষকে বোঝান সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলুন।

দেশীয় পণ্য বেছে নিন
শুধু বয়কট বললেই হবে না। তার বিকল্প তুলে ধরুন। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের পণ্যের গুণাগুণ প্রচার করুন। দেশীয় উৎপাদনের প্রতি ভালোবাসা ছড়িয়ে দিন।

শান্তিপূর্ণ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ প্রতিবাদ করুন
রাস্তার প্রতিবাদ, মানববন্ধন, মিছিল—সবই শক্তিশালী অস্ত্র, যদি তা হয় সুসংগঠিত ও নিয়মতান্ত্রিক। ভাঙচুর করে কখনোই আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা যায় না, বরং আদর্শকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়।

যাকাত-সদকা ফিলিস্তিনে পৌঁছানোর পথ খুঁজুন
বিশ্বস্ত সংস্থার মাধ্যমে সাহায্য পাঠান। ফিলিস্তিনের মানুষের জন্য অর্থ-ঔষধ সংগ্রহে অংশ নিন।

ইসলাম কখনো উগ্রতা শেখায় না

রাসূল (সা.) যখন তায়েফে গিয়ে শিশুদের হাতে পাথর খেয়েছিলেন, তখন জিবরাইল (আ.) এসে বলেছিলেন, “চাইলেই আমি এই জনপদ দুটো পাহাড় দিয়ে চাপা দিতে পারি।” কিন্তু নবীজি কী বলেছিলেন?
"না, বরং আমি চাই, এদের বংশধরদের মধ্যে কেউ যেন ঈমানদার হয়।"

এই হলেন প্রকৃত মুসলমান—যিনি শুধু প্রতিশোধে নয়, ভবিষ্যতের কল্যাণে বিশ্বাস করেন।

বিবেকের আলো জ্বালাই

আমরা আজ যদি নিজের দেশের ক্ষতি করি, তবে কাল আমরাই দুর্বল হবো। দুর্বল জাতির কণ্ঠ কখনো বিশ্ব দরবারে শোনা যায় না। ফিলিস্তিনের জন্য সবচেয়ে বড় সহানুভূতি হবে—নিজ দেশকে সবদিক থেকে এতটা শক্তিশালী করে তোলা, যেন বিশ্ব আমাদের কথায় কান দেয়, আমাদের প্রতিবাদে কাঁপে।

আসুন ভাই, আমরা এমন আবেগ আর ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের খোলস ছেড়ে বের হই। বুদ্ধি, যুক্তি, প্রজ্ঞা ও ভালোবাসার আলোয় পথ চলি।
আসুন, আমরা প্রকৃত মুসলমান হই—যিনি শুধু হাত দিয়ে নয়, হাতের সাথে হৃদয় দিয়ে জিহাদ করেন; যিনি আগুন দিয়ে নয়, আলো দিয়ে পথ দেখান।

মো. আশরাফুল ইসলাম

পঠিত : ৭০ বার

মন্তব্য: ০