“মকবুল আহমদ (রহি.): নীরব নেতৃত্বের আলো”
তারিখঃ ১৪ এপ্রিল, ২০২৫, ০২:৩৭
আলো-আড়ালের যুগল পরিবেশে গড়ে ওঠা কোনো কোনো মানুষ থাকেন, যাঁদের জীবনের স্বর সুরের চেয়ে স্থিরতায় সমৃদ্ধ। তাঁদের না থাকে তুমুল জনপ্রিয়তা, না থাকে নন্দনের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু সময় যখন ক্ষয়ে যেতে থাকে, ইতিহাস যখন ধুলোমলিন হয়ে পড়ে, তখন হঠাৎ দেখা যায়— এইসব নীরব মানুষগুলোই রেখে গেছেন সবচেয়ে বেশি প্রভাব, সবচেয়ে গভীর আলো।
মকবুল আহমদ (রহি.) ছিলেন তেমনই একজন মানুষ। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর তৃতীয় আমীর। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এমন এক সময়ে, যখন ‘জামায়াত’ শব্দটি জনপ্রিয়তা কিংবা ক্ষমতার অংশীদারত্বের নয়, বরং ঘৃণা, ষড়যন্ত্র ও অপরাধের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। মিডিয়া, ক্ষমতা ও সামাজিক ভাষ্য একসুরে গাইছিল— জামায়াত মানে যুদ্ধাপরাধ, শিবির মানে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ।
এই প্রোপাগান্ডার মাঝখানে দাঁড়িয়ে, হাজারো মামলা-মোকদ্দমার মধ্যে, নেতাকর্মীদের অনিশ্চয়তা আর গণহারে গ্রেফতারের ভয়াবহ বাস্তবতায়— দলের দায়িত্ব পালন ছিল সহজ কোনো কাজ নয়।
কিন্তু এমনই এক অন্ধকারের মধ্য দিয়ে, একজন ক্ষীণ অথচ স্বচ্ছ আলোর রেখার মতো তিনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
যখন একে একে দলের শীর্ষ নেতাদের কারাবরণ ও ফাঁসি ঘটছে, যখন রাজপথে নয় বরং আদালতের করিডোরে মৃত্যুর সিল ওঠে আসছে— তখন এই মানুষটিই ছিলেন সংগঠনের অভ্যন্তরে স্থিরতা ও আত্মবিশ্বাসের অনুপম উৎস।
মূলত, ২০১০ সালে মাওলানা নিজামী (রহি.) যখন ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় কারাবন্দি হলেন, তখন দায়িত্ব এসে পড়ে মকবুল আহমদের কাঁধে। প্রথমে ভারপ্রাপ্ত আমীর হিসেবে, পরে রুকনদের প্রত্যক্ষ ভোটে পূর্ণ আমীর নির্বাচিত হয়ে নেতৃত্ব দেন তিনি।
২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত এবং ২০১৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত পূর্ণ আমীর হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন।
এই সময়কালে একের পর এক শীর্ষ নেতাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এমনই এক ভয়াবহ অবস্থা ছিল তখন— রাস্তাঘাটে, ক্যাম্পাসে-মার্কেটে জামায়াত-শিবির পরিচয় লুকিয়ে রাখতে হত। কোনো দলীয় অফিস খোলা রাখা কঠিন ছিল। এমনকি চায়ের দোকানে জামায়াতের পক্ষে কথা বলাও হয়ে দাঁড়িয়েছিল অপরাধ। এই অন্ধকার সময়েই তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যেন কেউ অন্তরালে না পড়ে যায়। ইকামাতে দ্বীনের আন্দোলন নিস্তব্ধ হয়ে না যায়।
তিনি ছিলেন না জনপ্রিয় বক্তা। ছিল না তাঁর কথায় অলংকারের চমক। কিন্তু যা ছিল, তা হলো এক অবিচল ইখলাস, এক গভীর ইয়াকিন, এক বিনীত অথচ দৃঢ় আত্মা।
তিনি ছিলেন না ক্যামেরার সামনে, ছিলেন না টকশোর আলোঝলমলে বিতর্কে। ক্যামেরার সামনে, টকশোর আলোঝলমলে বিতর্কে না থাকা এই মুখটিই সংগঠনকে ভেঙে পড়তে দেননি। কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে দেননি।
স্মরণ করুন— এই মানুষটি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি-চর্চাকেন্দ্র থেকে ওঠে আসেননি। ফেনির এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম নেওয়া এই মানুষটি স্থানীয়ভাবে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবিরে (ততকালীন ছাত্রসংঘ) যোগ দিয়েছিলেন।
তারপর এক যুগান্তকারী সময় পেরিয়ে হয়েছেন বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা আমীর। বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা আমীরও তিনি এমন এক সময় হয়েছিলেন, যখন পাকিস্তান ভেঙে যাচ্ছে। যখন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ চলছিল।
এরপর উক্ত দায়িত্ব পালন করা শেষে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, সহকারী সেক্রেটারি, নায়েবে আমীর এবং শেষে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের আসনে সমাসীন হন।
তাঁর চলাফেরায় ছিল অনাড়ম্বরতা, কথাবার্তায় ছিল সারল্যের মায়া— এমনকি টিসি-টিএসের বক্তৃতায়ও তাঁর সারল্য যেন উপচে উপচে পড়ত। তাঁর প্রতিটি বাক্যে, প্রতিটি দৃষ্টিতে, এমনকি নীরব উপস্থিতিতেও একধরনের স্নিগ্ধতা থাকত। আর সিদ্ধান্তে থাকত বিচক্ষণতা। তাঁর কাছে দায়িত্ব ছিল ‘আমানত’, নিজের নয়— উম্মাহর, দ্বীনকে বিজয়ী করার তাড়নার।
তিনি আমীর ছিলেন, কিন্তু নিজেকে রেখে গেছেন রুকনের মতো সাদামাটা। তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, কিন্তু নেতার মতো করে নয়— একজন খোদাভীরু বড়ো ভাইয়ের মতো, একজন নির্লোভ অভিভাবকের মতো।
২০১৯ সালে অসুস্থতাজনিত কারণে দায়িত্ব থেকে সরে যান। তারপর ২০২১ সালের আজকের এই দিনে, মাহে রমাদানের প্রথম দিনে, কোভিডে আক্রান্ত হয়ে ইবনে সিনা হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে নীরবেই দুনিয়া ছেড়ে চলে যান— যেমনটি তিনি বেঁচে ছিলেন।
কিন্তু সত্যিকারের মানুষ কখনও পুরোপুরি চলে যান না। তাঁরা থেকে যান— স্মৃতিতে নয়, চরিত্রে।
তাঁর রেখে যাওয়া ইখলাসের ছাপ, বিনয়ের নমুনা, দৃষ্টিভঙ্গির শুদ্ধতা— এসবই এখন আমাদের পথচলার মাইলফলক হতে পারে।
এই যুগে যেখানে জনপ্রিয়তা-ভিত্তিক নেতৃত্বের জয়জয়কার, সেখানে মকবুল আহমদের মতো মানুষ আমাদের মনে করিয়ে দেন— নেতৃত্ব মানে আত্মপ্রচার নয়, আত্মত্যাগ। ক্ষমতা মানে জয় নয়, বরং জবাবদিহিতা। আর রাজনীতি যদি নবী-রাসূলদের মিরাস হয়, তবে সেই পথে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ধৈর্য, সাহস, তাওয়াককুল আর নির্মল ইখলাস।
আগেই বলেছিলাম— তিনি ছিলেন না হেডলাইনে, ছিলেন না টকশোর আলো ঝলমলে বিতর্কে। কিন্তু ছিলেন— আমাদের ভেতরের এক অন্তরালে গড়া বিশ্বাসের মতো। নীরব, কিন্তু উপস্থিত। অখ্যাত, কিন্তু অপরিহার্য।
আজ তাঁর স্মৃতিতে মাথা নিচু হয়— এই নয় যে, তিনি একজন নেতা ছিলেন, বরং এজন্য যে, তিনি আমাদের সময়ের একজন দুর্দান্ত সৎ ও সরল মানুষ ছিলেন। অবারিত ইখলাসে ভরপুর এক অনাবিল আলো ছিলেন। এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি দায়িত্ব পালনে ছিলেন মুজাহিদ, আচরণে ছিলেন অভিভাবক, হৃদয়ে ছিলেন খোদাভীরু এক দরবেশের মতো।
আল্লাহ বলেন: “যারা মুমিন এবং সৎকাজ করে, তাদের আমি নিশ্চয়ই এই পৃথিবীতে খেলাফত দান করব, যেমন করে দিয়েছিলাম তাদের পূর্ববর্তীদের, আর তাদের জন্য আমি সুসংহত করে দেবো তাদের দ্বীনের অবস্থান, যা আমি তাদের জন্য পছন্দ করেছি, এবং তাদের ভয়-ভীতির পরিবর্তে আমি দান করব নিরাপত্তা।” —সূরা নূর: ৫৫
রাসূল (সা.) বলেন: “তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সেই ব্যক্তি, যার চরিত্র সবচেয়ে উত্তম।” —সহীহ বুখারী
মকবুল আহমদ (রহি.) ছিলেন সেই উত্তম চরিত্রের এক নমুনা। আল্লাহ তাঁর কবুলিয়াত বাড়িয়ে দিন। তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ আমাদের জীবনে প্রতিফলিত হোক।

মন্তব্য: ০