Alapon

ইচ্ছে অনিচ্ছের গল্পটা...

আবার সেই একই স্বপ্ন! তাঁবুর এক কোণে চৌকি পাতা। চারপাশটা ভালমত দেখা যায় না। চৌকির উপর একটা কাপড়ের পুটলি আর ছোট্ট টিনের বালতি। আবছা আলোতে বালতিটা জ্বলজ্বল করছে। সেতুর সারা শরীরে অসম্ভব ক্লান্তি ভর করেছে। খুব ইচ্ছে করছে চৌকিতে গিয়ে শুয়ে পড়তে। যেতে পারছে না।
চারদিকে হইচই হট্টগোল। সেতু চোখ ঘুরিয়ে কিছুই দেখতে পারে না। ওর দৃষ্টিসীমা চৌকি পর্যন্ত।
কিছু স্বপ্নে নিজের মন মত কাজ করতে পারে সেতু। এই স্বপ্নটা অমন ইচ্ছে স্বপ্ন না। প্রায় প্রতিদিনই দেখছে সেই একই দৃশ্য। সেই একই ক্লান্তি, দুই পা অবশ হয়ে যাওয়া কষ্ট। অনেক পথ পাড়ি দিয়ে শরনার্থী শিবিরে পৌছে আর এগোতে পারছে না। সেতু অবশ্য বুঝতে পারে এটা স্বপ্ন, তবে আতংক আর ক্লান্তিটা সত্যি।
একঘেয়ে ধারাবাহিক স্বপ্ন আজ নতুন মোড় নিল। ছাড়াছাড়া স্বপ্ন। সেই চৌকিতে একটা মেয়ে বসে আছে মাথা নিচু করে। রঙ জ্বলে যাওয়া লাল জামা ভিজে চুপচুপে হয়ে গায়ে সেঁটে আছে। সেতু মেয়েটাকে কোথায় যেন দেখেছে। মনে করতে পারছে না। খুব করে চাইছে মেয়েটা মুখ তুলুক। যদি চেনা যায়। কিন্তু এটা তো ইচ্ছে স্বপ্ন না। সেতুর কাজ চুপচাপ দেখে যাওয়া। 
মেয়েটা মুখ তুললো। মুখটা ভীষণ ফোলা, চোখের নিচে কালশিটে পড়ে গেছে। নাহ সেতু ওকে এখনও চিনতে পারছে না।
জানো সেতু? আমি যখন বাইরে যেতাম, মা সবসময় বলত রেবা মাথায় কাপড় দে। ওরনা এভাবে পরছস কেন? ছড়ায়া পর! গায়ের লগে লাইগা থাকা জামা পইরা বাইরে যাস? মাইনষে কী কইব?
মেয়েটা কাঁদছে। চোখ দিয়ে পানির বদলে রক্ত পড়ছে। সেতুর কাছে অদ্ভুত লাগছে না। স্বপ্নে সবকিছু স্বাভাবিক।
চোখ মুছে মেয়েটা আবার বলতে শুরু করল।
আমি বেঁচে থাকতে কোনোদিন এভাবে কারো সামনে যাইনি। কোনোদিন না! আমার মাথায় ওরনা থাকতো। মা সবসময় ঢিলেঢালা জামা বানিয়ে দিত। 
সেতু এবার চিনতে পারলো রেবাকে। ঘাসের উপর পড়ে থাকা নিথর মেয়েটাই রেবা। রেবা এখনও ঢিলেঢালা কামিজই পরে আছে। কিন্তু পানিতে ভিজে যেভাবে গায়ের সাথে লেগে আছে তাতে অবয়ব বুঝতে কষ্ট হয় না।
কামিজের ঝুল ওর দিকে এগিয়ে ধরে রেবা বলল, দেখো সেতু, রঙটা পানিতে ধুয়ে ধুয়ে গোলাপী হয়ে গেছে। তবু রেহাই পেলাম না। এক ক্লিকে দেশের প্রতীক হয়ে গেলাম! অথচ আমি এভাবে সবার সামনে কখনোই আসতে চাই নি! কখনোই না!
রেবা এখন বিলাপ করে কাঁদছে। সেতুর ইচ্ছে হল রেবাকে বলে বিলাপ করে কাঁদতে হয় না। 
কী হাস্যকর! মৃত মানুষ কীভাবে কাঁদছে তাতে কী আসে যায়? জীবিতরা যখন এই মেয়েটার ছবি সবখানে ছড়িয়ে দিয়েছিল তখন সেতু কোনো নীতিকথা বলতে পারেনি। আর এখন মনে হচ্ছে মৃত মানুষের বিলাপে বাধা দেয়া তার ঈমানী দায়িত্ব!

ছাড়াছাড়া স্বপ্ন আরো কিছুদূর এগোলো। ভোরের আলো এখনও ফোটেনি। সেতু এবার টিনের বালতিটা নিয়ে টিউবওয়েলের কাছে লাইন ধরেছে। একদম ঝাঁ চকচকে নতুন টিউবওয়েল। 
সেতু সবসময় বোরকা পরে। নিকাব হাত মোজা পা মোজা কিছুই বাদ যায় না। কিন্তু এখানে কামিজ আর সালোয়ারেই বাইরে চলে এসেছে। ভেতরে ভেতরে ভীষণ অস্বস্তি। বোরকা কোথায়? পালিয়ে আসার সময় কি বোরকা ছিঁড়ে গেছে? নাকি বোরকা পরার সময় পায়নি? একটা ওরনাও কি ছিল না! কে জানে! স্বপ্নের শুরুই হয় সেই চৌকি থেকে।

প্রচুর লোকজন চারপাশে। একদম টিউবওয়েলের পাশে চলে এসেছে সেতু। হঠাৎ ক্যামেরার ফ্ল্যাশে চোখ ধাঁধিয়ে গেল। 
দারুণ একটা ক্যাপচার। টিউবওয়েল থেকে পানি নিচ্ছে এক লোক, পাশে সেতু অসহায় মুখে দাড়িয়ে আছে। 
আলোকচিত্রীকে পাশেরজন বলছে, টিউবওয়েল তো বসাইছি। ছবিগুলা ফেসবুকে দিয়া দাও।

সেতু খুব করে চাইছে স্বপ্নটা ভেংগে যাক। ফেসবুকে ওর এই ছবি ছড়িয়ে যাওয়ার আগেই ভেংগে যাক! কিন্তু কিছু করার নেই।
এটা তো ইচ্ছে স্বপ্ন না!

পঠিত : ৬৯৭ বার

মন্তব্য: ০