বুক রিভিউঃ আধুনিক যুগে ইসলামী বিপ্লব
তারিখঃ ২৯ জুন, ২০২৫, ১০:২২
আধুনিক যুগে পাল্টে গেছে ইতিহাসের গতিপথ, মানুষের জীবনধারা, ভৌগোলিক সীমানা। পরিবর্তন এসেছে মানুষের চিন্তাচেতনা ও ভাবধারায়। বহু সভ্যতার উত্থান-পতনে মানবজাতি এসে দাঁড়িয়েছে একবিংশ শতাব্দীর তারুণ্যোদ্দীপ্ত অধ্যায়ে।
মানবজাতির সুদীর্ঘ ইতিহাসে অনেক সভ্যতার সাথে পৃথিবীর পরিচয় ঘটেছে। মানুষ পরিচিত হয়েছে সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ, পুঁজিবাদ, ফ্যাসীবাদসহ অসংখ্যা মতবাদ ও জীবনব্যস্থার সাথে। একই সাথে তারা দেখেছে ইসলামের সোনালী যুগের শাসনও। একমাত্র ইসলাম ব্যতীত আর কোনো মতবাদই মানুষের প্রকৃত মুক্তি ও শান্তি নিশ্চিত করতে পারেনি। পারেনি মানবজীবনের পূর্ণাঙ্গ কোনো জীবনবিধান দাঁড় করাতে। পদে পদে ব্যর্থ হয়ে এসব মতবাদ ও সভ্যতা নিজ নিজ জন্মভূমিতেই মৃত্যুবরণ করেছে বা কোনো কোনোটি মৃত্যুর প্রহর গুণছে।
বর্তমান সময়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় মতবাদ গণতন্ত্রও মানুষকে মুক্তি দিতে পারেনি। লেখকের ভাষায়—"১০০ বছরের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে, রাজনৈতিক প্রক্রিয়া হিসেবে গণতন্ত্রের কার্যকারিতা প্রমাণিত হলেও অর্থনীতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। গণতান্ত্রিক সমাজে অবাধ পুঁজিবাদের বিকাশের কারণেই শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মানবতা মুক্তি পায়নি।"
ইসলামের খিলাফত ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়েছে প্রায় ১৪০০ বছর আগে। যদিও পরবর্তীতে লম্বা সময় ধরে মুসলিমরা বিশ্ব শাসন করেছে। আব্বাসীয় খিলাফত, উমাইয়া খিলাফত, উসমানী খিলাফতের মতো তাবৎ তাবৎ সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল। সর্বশেষ ১৯২৪ সালে উসমানী সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে প্রায় এক শতাব্দীকাল ধরে বিশ্বব্যাপী ইসলাম বেশ শোচনীয় অবস্থায় রয়েছে। তাই লেখক মনে করেন, আধুনিক যুগে শুধুমাত্র ইসলামের তত্ত্বগত শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে আলোচনার চাইতে ইসলামের বাস্তবায়ন, রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে ইসলামী ব্যবস্থার বাস্তবায়নের আলোচনা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
অত্যন্ত বাস্তবিক যুক্তি-প্রমাণের দ্বারা তিনি বুঝিয়েছেন, 'নির্বাচনের মাধ্যমেই হোক কিংবা গণজাগরণের মাধ্যমেই হোক জনগণের সচেতনতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া ইসলামী বিপ্লব সম্ভব নয়।'
সহজ-সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় বিপ্লব, বিপ্লবের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন বইটিতে। প্রমাণ করেছেন ইতিহাসের গতিপথ নিয়ন্ত্রণের কারিগর হচ্ছে 'মানুষ বা জনতা'। বলেছেন—রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল শিকড় সমাজ জীবনের গভীর তলদেশে মজবুতভাবে গেঁথে থাকে। কাজেই যতক্ষণ পর্যন্ত সমাজ জীবনের অভ্যন্তরে এর মর্মমূলে কোন পরিবর্তন সূচিত না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোন কৃত্রিম উপায়ে শাসনতন্ত্রে বা শাসনযন্ত্রে অনুরূপ পরিবর্তন সৃষ্টি করা সম্ভব নয়।
লেখকের ভাষায়—"পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণায় প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত একটি জাতি রাষ্ট্রের গায়ে ইসলামী হুকুমত বা ইসলামী রিপাবলিক লেভেল বা সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিলেই ইসলামি বিপ্লব আসবে না।" ইসলামী বিপ্লবের জন্য প্রয়োজন সংগঠনের। আর সেই সংগঠনের মৌলিক উপাদান, গঠন পদ্ধতি ইত্যাদি তুলে ধরেছেন সুনিপুণভাবে। উপস্থাপন করেছেন সেই সংগঠনের নেতৃত্বের স্বরূপ। বলেছেন—ইসলামী নেতৃত্বকে হতে হবে আধ্যাত্বিক শক্তি সম্পন্ন।
ইসলামের মূল দাওয়াত ও এর প্রকৃতি, পদ্ধতি নিয়েও আলোচনা করেছেন বইটিতে। তাওহীদই যে হবে ইসলামী দাওয়াত ও দ্বীনি আন্দোলনের মূল ভিত্তি, সেটা প্রমাণ করেছেন খুব যুক্তিপূর্ণ উপায়ে।
'গণতন্ত্রের শ্লোগান ও ইসলামী বিপ্লব' নামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পয়েন্ট আলোচনা করেছেন। এখানে তিনি গণতন্ত্রের অসারতা এবং ইসলামের সাথে গনতন্ত্রের মৌলিক পার্থক্য তুলে ধরেছেন। গণতন্ত্রকে সাময়িক পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করলেও তিনি ইসলামী আন্দোলনকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেছেন। তিনি বলেন- "গণতন্ত্র বলতে যেহেতু এক ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা বুঝায় সেহেতু ইসলামী আন্দোলনকে এ সম্পর্কে সতর্ক থাকার প্রয়োজন রয়েছে। স্লোগানের অন্তরালে গণতন্ত্রের চাইতে অনেক বেশি উৎকৃষ্ট গণতান্ত্রিক ইসলামের খেলাফতি শাসনব্যবস্থা যেন বিভ্রান্তির শিকার না হয়, সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। নিছক পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামরত একটি দলের সাথে ইসলামের সর্বোৎকৃষ্ট গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিয়োজিত ইসলামী আন্দোলনের সুস্পষ্ট পার্থক্যটা জনগণ যেন বুঝতে পারেন, এর নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। "
তাঁর মতে, ব্যাপারটি যাতে চূড়ান্ত লক্ষ্য বলে বিবেচিত না হয়ে যায় সেদিকটাও গুরুত্বপূর্ণ। লেখকের ভাষায়—''গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া মাধ্যম হতে পারে কিন্তু লক্ষ্য নয়। লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের সার্বিক মুক্তির জন্য ইসলামের ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থাপনার নির্মাণ।''
গুরুত্বপূর্ণ এই বইটিতে লেখক আলোচনা করেছেন ইসলামী আন্দোলনের প্রতিবন্ধকতা সম্বন্ধেও। পাশ্চাত্য জীবনধারা, সাম্রাজ্যবাদী নেটওয়ার্ক, ভোগবাদী সভ্যতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, পুঁজিবাদী শোষণ, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, অনগ্রসর শিক্ষা ব্যবস্থা, সন্ত্রাসবাদের প্রোপাগান্ডা, উগ্রবাদী গোষ্ঠীর তৎপরতা ইত্যাদিকে তিনি ইসলামী আন্দোলনের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বাতলে দিয়েছেন এই প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের উপায়ও। গণ আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি ও ইসলামী বিপ্লবের শর্ত সম্বন্ধে বিস্তারিত আলাপ করেছেন।
সবশেষে বিপ্লবের পাঁচটি প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ১. সশস্ত্র সংগ্রাম; ২. সামরিক অভ্যুত্থান; ৩. ক্ষমতাসীন সরকারের যোগদান; ৪. নির্বাচন; ৫. গণ আন্দোলন।
এরমধ্যে তিনি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন গণ আন্দোলনকে। তবে যেহেতু বর্তমান সময়ে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা গোটা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এবং এটি প্রতিষ্ঠিত একটি ব্যবস্থা, তাই এর বিপরীতে না গিয়ে গণতন্ত্রের সাথে গণআন্দোলনের একটি সমন্বয় কীভাবে তৈরি করা যায় সে ব্যাপারে আলাপ তুলেছেন।
বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্বাচন ব্যবস্থা ও অবাধ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। সর্বশেষ গণ আন্দোলনের জন্য বেশকিছু করণীয় তুলে ধরেছেন।
একবিংশ শতাব্দীর চলমান বাস্তবতায় ইসলামী বিপ্লবের আদ্যোপান্ত জানা ও বিপ্লবের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য বইটি অপরিহার্য বলা চলে। আল্লাহ তায়ালা লেখকের পরিশ্রম কবুল করুন। ইসলামী আন্দোলনের জন্য তাঁর ত্যাগ-কুরবানী কবুল করুন, তাঁকে শহীদের মর্যাদা দান করুন। আমিন।
বই : আধুনিক যুগে ইসলামী বিপ্লব
লেখক : মুহাম্মদ কামারুজ্জামান
রিভিউ : মাসুম বিল্লাহ বিন নূর

মন্তব্য: ০