নাথনপুরে কেউ অতিথি নয়—সবাই কোনো এক রহস্যের অংশমাত্র! পর্ব ৩
তারিখঃ ২৯ জুন, ২০২৫, ১৫:৪৭
অন্ধকারে চা-ওয়ালাটি হঠাৎ যেন বাতাসে বিলীন হয়ে গেল—
এক মুহূর্ত আগেও যার কণ্ঠস্বর ছিল কানের পাশে,
সে এখন নেই।
তার জায়গায় শুরু হলো এক অদ্ভুত তীব্র বাতাস, তারপরই শুরু
হলো তীব্র এক ঝড়ো হাওয়া—পেছনে পাতার কাঁপন, সামনে অজানা শিহরণ।
যেন বাতাস নয়, কারো নিঃশ্বাস আমাকে ঘিরে ধরছে।
ঠিক তখনই বজ্রপাতের আলোতে হঠাৎ চোখে পড়ল—
এক টুকরো কাগজ উড়তে উড়তে আমার দিকে ধেয়ে আসছে,
জলে ভেজা রাতের বাতাসে কাগজের গতিপথ ছিল
অস্বাভাবিকভাবে সোজা—আমার দিকেই।
কাগজটি এসে থামল আমার পায়ের কাছে।
আমি ধীরে তা তুলে নিলাম।
আর তখনই, চোখে পড়ল সেই বাক্যটি—
যা অনেকদিন আগে এক ধুলোমলিন পাতায় পড়েছিলাম,
একবার নয়, বারবার, যেন তা আমার জন্যই লেখা ছিল:
“সব কিছু হারিয়ে গেলেও কিছু ছায়া থেকে যায়…”
এই লাইনই ছিল আমার প্রত্যাবর্তনের শুরু।
এই লাইনটাই যেন ডেকে তুলেছিল আমাকে,
তিন বছর পরে, ফিরে আসতে—নাথনপুরে।
তিন বছর আগে আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম,
লোকের মুখে রটে গিয়েছিল আত্মহত্যা করেছি।
কেউ বলেছিল, পাগল হয়ে পাহাড়ে চলে গেছি।
কিন্তু না—আমি আসলে কোথাও যাইনি।
আমি শুধু সময়ের নিয়ম মানিনি।
আমি আটকে গিয়েছিলাম এক অসময়ের ভেতরে,
যেখানে মানুষ যায় না,
আর ফিরে এলে মানুষ থাকে না।
আর এখন, সেই কাগজের টুকরো, সেই বাতাস, সেই ছায়ার ডাক আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে—
এখানেই আমার মুক্তি।
মুক্তি, নাথনপুরের অভিশপ্ততা থেকে।
লেখাগুলো অয়নের বোধ হয়-উদ্দেশ্য আমি আমোস দি কস্টা
সেই রাতে শুরু হলো তীব্র ঝড় আর বৃষ্টি
আমি ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলাম অন্ধকারে, বিশাল বটবৃক্ষের নিচে—যেন সময়ও থমকে গিয়েছিল।
চারপাশে কেবল বাতাসের গর্জন, পাতা উড়ে যায়, জল ছুঁড়ে পড়ে মুখে, শরীরে।
কখন যে ঠান্ডায় অবচেতন হয়ে পড়েছিলাম, বুঝতেই পারিনি।
চোখ খুলতেই দেখি সকালের হালকা রোদ চারপাশে ছড়িয়ে আছে—
আকাশ ঝকঝকে, কিন্তু মাটিতে ঝড়ের দাগ স্পষ্ট।
আমার জামাকাপড় পুরো ভেজা, শরীর কাঁপছে, মাথা ভার।
তবু মনে অদ্ভুত এক স্থিরতা, এক সিদ্ধান্ত—
এই রহস্যের জট আমাকেই খুলতে হবে।
শেষ না দেখা পর্যন্ত আমি এখান থেকে যাচ্ছি না।
হোটেলে ফিরে একটু ফ্রেশ হই, পোশাক পাল্টাই।
তারপর রওনা হই স্থানীয় পুরনো মন্দিরে—
সেখানে গম্ভীর মুখে বসে ছিলেন এক বৃদ্ধ পুরোহিত, যাঁর চোখে যেন অতীতের ছায়া খেলা করে।
তিনি আমাকে একখণ্ড রক্ষাকবচ দিলেন,
ঝুলন্ত কালো সুতোয় বাঁধা, মাঝে ধাতুর পাতায় উৎকীর্ণ কিছু অদ্ভুত চিহ্ন।
কপালে তিলক দিয়ে কেবল একটাই কথা বললেন—
“নাথনপুর ডাকে যখন, কেউ আর ফিরতে পারে না আগের মতো।”
আমি আর এক মুহূর্তও দেরি করলাম না।
রক্ষাকবচ বুকের পকেটে রেখে আবার রওনা হলাম—
লক্ষ্য: সেই রহস্যময় নাথনপুর।
সকালে এক শিশুদৌড়ে এসে একটা নীল খামে মোড়ানো নোটবুক আমাকে দিয়ে যায়- নোট বুকের দিকে লক্ষ্য করে সামনে তাকিয়ে দেখি শিশুটি কোথাও নাই---লেখা
অয়ন চক্রবর্তী | নাথনপুর | পাঠাগার। কুঠুরি। জমিদার বাড়ি। পুরোহিত!!!!
আমি একগুঁয়ে হয়ে এগিয়ে যেতে থাকি গ্রামের পাঠাগারের দিকে।আকষ্মিক সেই পাঞ্জাবী পড়া লোকটি আমার পথ আগলে দাঁড়ায়, সাহস জাগানীয়া ঢং এ বলে ফিরে এসো - একটি নতুন দিনের অপেক্ষায়।
নাথনপুরের প্রাচীন পাঠাগারটায় কেউ আর যায় না।
কাঠের সিঁড়িগুলো পোকায় খাওয়া, দেয়ালের প্লাস্টার খসে পড়ছে, আর বইয়ের তাকগুলো যেন নিজেরাই ক্লান্ত হয়ে হেলে পড়েছে।
তবুও, আমি ঠিক জানতাম—
এই জায়গায় এখনো কিছু ঘুমিয়ে আছে।
আমি গুটি গুটি পায়ে সেই পুরনো অংশটায় পৌঁছালাম, যেটা বহু বছর আগে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল—“অনিরাপদ কাঠামো” বলে বোর্ড টাঙানো ছিল। দরজার নিচে ভেঙে যাওয়া একটি পাতলা ফাঁক দিয়ে বাতাস আসছিল।
কিন্তু সেই বাতাসে ছিল নিশ্বাস,অজানা আগমনের শিস।
আর আমার হাতে ছিল টর্চ, আর পকেটে অয়নেরনোটবুক।
গোপন কুঠুরি:
নোটবুকের একটি পাতায় আঁকা ছিল একটা হাতের ছাপ, আর তার নিচে লেখা ছিল:
ডানদিকে দ্বিতীয় তাকের নিচে।”
আমি দাঁড়িয়ে তাকালাম সেই তাকটার দিকে।
পুরনো ইংরেজি সাহিত্যের বইয়ের স্তূপ—কিন্তু তার নিচে সত্যিই একটা আলগা মেঝে ছিল।
টেনে তুলতেই হালকা ধাতব শব্দ… আর একটা সিঁড়ি, নিচে নেমে গেছে অন্ধকারে।
আমি সেই সিঁড়িতে পা রাখলাম।
প্রতি ধাপে, আমার নোটবুক কাঁপছিল—বা আমি কাঁপছিলাম, বলতে পারি না।
নিচে নেমেই আমি শুনলাম ফিসফিসানি, যেন শত শত কণ্ঠ একই সময় বলছে—অয়নের কন্ঠে
“ মুক্তি দাও"
ছায়ামানব:
কুঠুরি আসলে একটা গোলাকার কক্ষ, যার মাঝখানে এক প্রাচীন আয়না বসানো। আয়নায় আমি দেখলাম নিজেকে—না, শুধু নিজেকে না।
পাশে দাঁড়িয়ে আছে একজন মানুষ। না, সে মানুষ না—তার শরীর আছে, কিন্তু মুখ নেই। শুধু কালো ছায়া, যেন রোদে পোড়া কাচ। সেই ছায়ায় ঝাপসা আলোতে দেখিতে পাই চঞ্চল -আমার -চা ওয়ালা- পাঠাগারের লোক-চৌকিদার -জমিদার বাড়ী -পুরোহিত আরো অচেনা অনেকের মুখ।
সে কিছু বলে না। শুধু আমার দিকে হাত বাড়ায়।
আমার চোখ পড়ে দেয়ালের এক শিলালিপিতে:
“ছায়ামানব একসময় ছিল আলো।
আমার মাথা ঘুরে যায়। আমি হঠাৎ বুঝি—এই ছায়ামানব আসলে আমাদের সবার একটি রূপ, যা আমি এই নাথনপুরে এসে ,,,
অদৃশ্য আওয়াজ ভেসে আসে -আদিম রিপু" আদিম রিপু" আদিম রিপু___
আমি আবার নোটবুক খুললাম।
শেষের এক পাতায় লেখা
“আমি ফিরে এসেছি।
কারণ আমি একা নই। ছায়াগুলো শুধু ভয় নয়—ওগুলো ইতিহাস ওগুলো স্মৃতি।
আমি আজ শেষবার লিখছি কারণ আমিও হয়তো ছায়াদের অংশ হয়ে যাব।
যদি কেউ পড়ে এই নোটবুক—সে যেন মনে রাখে, সে যেনো সবাইকে মুক্ত করে।
সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে উঠে এলাম উপরের ঘরে।
ঘরের চারপাশে থমথমে নিরবতা—
বাতাসে যেন আটকে থাকা ধুলোর গন্ধ, আর অতীতের নিঃশ্বাস।
তবু আমার মনে এক দৃঢ় বিশ্বাস: এই ঘরেই আছে সেই রহস্যের সূত্র,
যা আমাকে টেনে এনেছে ফিরে, বারবার।
আলমারি, পুরনো কাঠের বুকসেলফ, মাকড়সার জাল,
সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি।
হঠাৎ এক কোণে চোখে পড়ে এক বই—
মলাটবিহীন, ধুলোয় ঢেকে থাকা, যেন শতাব্দীর ঘুম ভেঙে জেগে উঠতে চাইছে।
বইটি হাতে নিয়েই আমি কেঁপে উঠি।
এই কাগজ… ঠিক সেই রকম,
যেমনটি ঝড়ের রাতে উড়ে এসেছিল আমার কাছে—
পাতলা, সাদা নয়, খানিকটা ছাইরঙা, স্পর্শ করলেই ঠাণ্ডা হয়ে ওঠে আঙুল।
তবে বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো খালি—
একটি বাক্য, একটি শব্দ পর্যন্ত লেখা নেই।
কিন্তু, পাতাগুলোর মাঝে হাতে আঁকা কিছু ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে—
একটি পুরোনো জমিদারবাড়ি,
একটা ছোট মন্দির যার চূড়ায় ত্রিশূল আঁকা,
আর সেই ভয়াল বটগাছ, যার নিচে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম সেই রাতে।
ছবিগুলো যেন জীবন্ত—
পেন্সিলের রেখায় থেমে থাকা নয়,
বরং এক ধরনের চেতনাবোধে বাঁধা।
এই বই আমার সঙ্গে কীভাবে যুক্ত?
আর কেনো এই ছবিগুলোর মধ্যে নেই কোনো মানুষ—
শুধু স্থান, ছায়া আর নীরবতা?
পাঠাগার থেকে বেরিয়ে দেখি, বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা।
আকাশে ম্লান লালচে আভা, বাতাসে শুকনো পাতার গন্ধ।
বুকের গভীরে জমে থাকা ভয়কে চাপা দিয়ে আমি এগিয়ে চললাম—
তিন রাস্তার সেই রহস্যময় মিলনস্থলের দিকে,
যেখানে দাঁড়িয়ে থাকা সেই জমিদারবাড়ি
বারবার আমাকে টেনে নিয়েছে নিজের দিকে।
রাস্তার মোড়ে পা পড়তেই আলো নিভে যেতে শুরু করল,
এক অজানা ছায়া যেন ধীরে ধীরে ঘিরে ধরল পরিবেশটাকে।
জমিদারবাড়ির সামনে এসে থামলাম।
সময়ের গতি যেন সেখানে এসে স্থবির।
দূরে শিয়াল ডাকা শোনা যায়।
আমি পকেট থেকে তুলে নিলাম সেই মলাটবিহীন বইটি।
হাতের স্পর্শ পড়তেই বইটি খুলে গেল—
আর ঠিক তখনই ঘটে গেল এক অলৌকিক ঘটনা।
বইয়ের পৃষ্ঠা একে একে নিজে থেকেই উল্টাতে লাগল,
হাওয়ার ধাক্কায় নয়, যেন কোনো অদৃশ্য হাত
পাতাগুলোকে সাজিয়ে দিচ্ছে আমার চোখের সামনে।
পাতার ওপর ছবি ফুটে উঠতে লাগল একের পর এক—
তাদের রঙ নেই, কিন্তু গভীরতা আছে।
আমি দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু অনুভব করছি যেন
কোনো গোপন প্রেক্ষাগৃহে বসে আছি,
আর আমার চোখের সামনে
নাথনপুরের ইতিহাসের ছায়া একে একে জীবন্ত হয়ে উঠছে।
আমি দেখতে পেলাম—
একজন যুবক—অয়ন চক্রবর্তী ,
প্রথমবার গ্রামের বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে।
তার চোখে বিস্ময়, আশপাশে ছায়া।
তারপর ফুটে উঠল পুরোহিত—
চোখে লালসা আর গলায় প্রাচীন মন্ত্রের ধ্বনি।
সে কিছু লুকিয়েছে,
কোনো প্রাচীন সত্য, যা যুগের পর যুগ রক্ষা করে এসেছে।
পট পরিবর্তন—
চৌকিদার, যাকে হত্যা করা হয়েছিল,
সে যেন এখনও রাতের প্রহরায় ফিরে আসে।
তার পায়ের ছাপ আজও মাটিতে মিশে।
চা ওয়ালা—
সে আসলে চা বিক্রেতা নয়,
এক যাযাবর আত্মা,
যে খবর দেয়, তারপর মিলিয়ে যায় অন্ধকারে।
সবশেষে দেখা গেল সেই জমিদার।
তার চোখে ঘৃণা, হাতে বন্দুক।
আর তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি ছায়া—
যারা প্রতিশোধ চায়, মুক্তি চায়,
যারা সময়ের গর্ভে আটকে গেছে অয়নেরই মতো।
আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
বইয়ের পাতায় শুধু ছবি নয়—
মনে হচ্ছিল, ছবিগুলো আমার চোখে কথা বলছে।
আর প্রতিটি চিত্রে কোথাও না কোথাও আমি নিজেই আছি।
এখন স্পষ্ট হচ্ছে—
নাথনপুর শুধু এক গ্রাম নয়,
এ এক অদ্ভুত আবর্ত,
যেখানে প্রতিটি সময়, প্রতিটি স্মৃতি,
একটি করে লেখা—
একটি করে ছায়া।
আর সেই লেখাগুলোর ধারক এখন আমিই।
গলায় ঝুলানো মন্দিরের পুরোহিতের দেওয়া রক্ষাকবচটি হাতে তুলে নিলাম।
মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরে, চোখ বন্ধ করে
মনস্থির করলাম—
এই রাতে, এই জমিদারবাড়িতেই আমায় প্রবেশ করতেই হবে।
ভেতর থেকে একটি মন্ত্র ফুঁপিয়ে উঠল ঠোঁটে—
পুরোহিতের শেখানো সেই গোপন স্তোত্র,
যা নাকি ছায়ার প্রহরীদের ঠেকিয়ে রাখে।
মন্ত্রের প্রতিটি শব্দে যেন আমার ভিতরের ভয় জড়সড় হয়ে সরে গেল।
জমিদারবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম—
দরজায় ঝুলছে সেই বিশাল তালা,
যেটি বহু বছর আগে
গ্রামের একাধিক পুরোহিত আর সাধক মিলে
তন্ত্রমন্ত্রের জালে বেঁধে দিয়েছিলেন।
কারণ ছিল একটাই—
এই বাড়ির দেয়ালের আড়ালে ঘুমিয়ে আছে এক অভিশপ্ত শক্তি,
এক ছায়ামানব,
যার উপস্থিতি একসময় গ্রামকে গ্রাস করে নিচ্ছিল নিঃশব্দে।
তার ছায়া পড়লে লোকেরা হারিয়ে যেত দিন রাতের পথে,
শোনা যেত কান্না আর হাহাকার জমিদারবাড়ির জানালায়।
তখনই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়—
এই বাড়িকে বন্ধ করে দেওয়া হবে সময়ের জন্য।
বাঁধা হয়েছিলো এক বিশাল বাউন্ডারির মধ্যে।
দেয়ালে আঁকা হয়েছিল রক্ষার চিহ্ন,
দরজার গায়ে গাঁথা হয়েছিল সীসার তাবিজ,
আর সেই তালাটি—যা শুধু কারও ভিতরের ডাক শুনলেই সাড়া দেয়।
আজ বহু বছর পর,
আমার উপস্থিতিতে যেন বাড়িটি বুঝে গেল—কেউ এসেছে।
চারপাশে বাতাস কেঁপে উঠল।
দূরের বাড়িগুলোর জানালা থেকে কৌতূহলী চোখ উঁকি দিল।
গ্রামের মানুষদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ল নিঃশব্দ গুঞ্জন—
"জমিদারবাড়ির দিকে কেউ একজন গেছে… কেউ আবার সেই তালার সামনে দাঁড়িয়েছে..." এইতো অল্প কিছুদিন আগেও বাড়িটিতে প্রচন্ড বাতাস এবং ভয়ংকর হাসির শব্দ শুনেছে গ্রামের মানুষ
আমি জানতাম—এই মুহূর্তে পেছনে ফেরা মানেই সব শেষ।
যে রহস্য শুরু হয়েছিল বটগাছের নিচে,
যা ধরা দিয়েছিল বইয়ের পাতায়,
আজ তা আমার সামনে দ্বার উন্মুক্ত করে দাঁড়িয়ে।
এবার আমাকে ভেতরে ঢুকতেই হবে।
আমি ধীরে ধীরে খুলে ফেললাম সেই কাপড়ে মোড়ানো সীসার তাবিজ।
কাপড় সরতেই এক তীব্র শীতল বাতাস আমার গায়ে ধাক্কা মারল—
কিন্তু তা শুধু জমিদারবাড়ির সীমানার ভেতরেই।
বাইরে নীরবতা, আর ভিতরে শুরু হয়ে গেল
অদৃশ্য কণ্ঠের বিভীষিকা।
শোনা গেল এক বাচ্চা শিশুর কান্না,
তার সঙ্গে জুড়ে গেল নারীর আর্তনাদ,
পুরুষের ভাঙা স্বর আর
সবচেয়ে ভয়ংকর—এক বিভৎস হাসি,
যা গলা কেটে দেওয়া ক্লাউনকেও হার মানায়।
দরজার সামনে ঝুলে থাকা সেই
মরিচা ধরা বহু বছরের পুরোনো তালা
এখনও আগের মতো শক্তভাবে লটকে আছে।
আমি চারপাশে তাকিয়ে একটা মোটা লাঠি খুঁজে নিলাম।
তারপর বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে
সজোরে তালার ওপর আঘাত করতে থাকলাম।
প্রতিটি আঘাতে
বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে এল নরকসম এক গর্জন—
যেন শত শত আত্মা একসাথে
তাদের বন্দিত্ব ভেঙে মুক্তি চাইছে,
তাদের কণ্ঠে রক্তপিপাসার হিংস্রতা।
এক মুহূর্তের জন্য হাত থামিয়ে
আমি ঈশ্বরকে স্মরণ করলাম।
তারপর নিজের সমস্ত শক্তি নিয়ে
শেষ আঘাতটি হানলাম।
তালাটি ভেঙে পড়ল মাটিতে।
এক প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠল পুরো জমিদারবাড়ি।
দরজার গায়ে হাত দিয়ে সেটাকে ঠেলে দিলাম।
ধীরে ধীরে বিশাল কাষ্ঠদ্বারটি খুলে গেল কঁকিয়ে কঁকিয়ে।
আমি ঢুকে পড়লাম।
প্রবেশের ঠিক পর মুহূর্তেই
বাতাস থেমে গেল।
সেই যেভাবে মঞ্চের পর্দা নামার আগে শেষ আলো নিভে যায়।
চারদিকের গা ছমছমে নীরবতা চেপে ধরল আমার শ্বাস।
আর পেছনে—
জোরে এক শব্দে দরজাটি নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেল।
এই ভৌতিক দৃশ্যের খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে পুরো গ্রামে।
চারদিক থেকে ছুটে আসে মানুষ।
পুরোহিত, বৃদ্ধ, যুবক, নারী—
সবাই এসে জড়ো হয় জমিদারবাড়ির ঠিক বাইরে।
সবার হাতে মশাল জ্বলছে,
চোখে ভয় আর প্রার্থনা।
পুরোহিতদের হাতে রক্ষাকবচ,
তারা মন্ত্র জপছে—
এক অজানা শত্রুর বিরুদ্ধে,
এক ভুলে যাওয়া ইতিহাসের সামনে।
আর আমি—
আমি দাঁড়িয়ে আছি অভিশপ্ত সেই প্রাসাদের উঠোনে,
যেখানে শুরু হতে যাচ্ছে সত্য আর ছায়ার চূড়ান্ত দ্বন্দ্ব।
আমি ধীরে ধীরে পা ফেলিয়ে প্রবেশ করলাম অভিশপ্ত জমিদারবাড়ির ভেতরে।
চুপচাপ, স্তব্ধ চারপাশ।
জমাট বাঁধা এক অদৃশ্য আতঙ্ক যেন প্রতিটি বাতাসে মিশে আছে।
একটু সামনে এগিয়ে যেতেই বিশাল এক প্রাচীন বটগাছ চোখে পড়লো—
তার ডালপালা ছড়িয়ে যেন পুরো উঠোন জুড়ে ছায়ার চাদর বিছিয়ে রেখেছে।
বটগাছটিকে ঘিরে থাকা পাথরের ঘাটটি এখনো অক্ষত—
যেখানে বসেই একদিন গ্রামের বিচার, শাস্তি আর সামাজিক সিদ্ধান্ত হতো।
পাথরের ঘাটে ধুলোর স্তর জমলেও
তাতে এখনও শোনা যায় সেই সময়ের গম্ভীর কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি।
এইখানেই বসতেন জমিদার দিগ্বিজয় রায়,
তার পেছনে খাঁড়া হাতে সিপাহী, পাশে পুরোহিত, আর সামনে গ্রামের প্রজারা।
বটগাছের একপাশে চোখে পড়লো একটি ছোট পূজার মন্দির।
তাতে ঝুলছে এক ভারী সীসার তালা,
ঠিক যেভাবে জমিদারবাড়ির মূল ফটক বন্ধ করা ছিলো তন্ত্র-মন্ত্রে।
মন্দিরের গায়ে সূক্ষ্ম কারুকাজ—
যেন দেবতা নিজেই অভিশাপ দিয়ে চুপ করে বসে আছেন ভিতরে।
আর তখনই…
আচমকা,
এক ঝলকে অন্ধকার ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।
চারপাশ ঝলমলিয়ে ওঠে উজ্জ্বল আলোয়।
এক মুহূর্তে সবকিছু পাল্টে যায়।
জমিদারবাড়ি আর সেই ধ্বংসস্তূপ নয়,
বরং ফিরে গেছি দেড় শতক আগের জমকালো অতীতে।
আমি দাঁড়িয়ে আছি, অথচ যেন কেউ আমাকে দেখছে না।
আমার সামনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে এক ইতিহাসের চিত্র।
দেখি—
সাজানো প্রাসাদ, রথগাড়ি, খণ্ড খণ্ড ঘর, দীঘি,
রান্নাঘরে সেঁকা পিঠার গন্ধ,
নারীদের শাড়ি উড়ছে বাতাসে,
জমিদারের ছেলে পালোয়ানদের সঙ্গে দড়ি টানাটানি খেলছে।
আর মূল উঠোনে বসে আছেন জমিদার নিজে—
কামান-তোপের শব্দের মতো তার কথাবার্তা,
কাঁধে জড়ানো রাজসিক চাদর, গলায় সোনার হার, চোখে অমোঘ দৃষ্টি।
এই আমি—আমোস ডি কস্টা
বসে আছি সেই মহা-আড্ডার মাঝখানে,
কিন্তু যেন আমি নেই—
আমি শুধু এক স্মৃতির ভেতরে জেগে ওঠা ছায়া।
চারপাশে তাকিয়ে বুঝি—
এই বাড়ির ইতিহাস আমাকে কিছু বলতে চাইছে,
এই মাটি, এই গাছ, এই মন্দির—
সব কিছুই এক ভয়ংকর গোপন সত্য লুকিয়ে রেখেছে
যা শুধু আমি শুনতে পাচ্ছি, দেখতে পাচ্ছি।
একটা নিঃশব্দে খুলে গেল ইতিহাসের দরজা।
এইসব ঘটনা আর শুধুমাত্র আমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইলো না।
সেই অভিশপ্ত জমিদারবাড়ির ভেতরে যা ঘটছিল—
তা এখন নাথনপুরের প্রতিটি হৃদয়ে কম্পন তুলতে শুরু করেছে।
বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা
পুরোহিত, সাধারণ মানুষ, গ্রামবাসী—
সবাই দেখছে আগুনের মশালের আলোয় আমার প্রবেশ,
শুনছে দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার শব্দ,
আর বাতাসে ছড়িয়ে পড়া অজানা এক ভয়ের গন্ধ।
কে যেন চাপা গলায় বললো,
“আবার শুরু হলো... বহু বছর আগের মতোই…”
আহত স্মৃতির মতো জেগে উঠলো সেই পুরনো ভয়।
চারপাশে ছড়িয়ে পড়লো আতঙ্কের ছায়া।
কারো চোখে উৎকণ্ঠা, কারো মুখে ধরা দুশ্চিন্তা,
আর সবার অন্তরে একটাই প্রশ্ন—
এইবার কি পুরো নাথনপুর মানবশূন্য হয়ে যাবে?
এই গ্রাম তো এক সময়
আলোর মতো শান্ত আর সরল ছিল।
কিন্তু বহু বছর আগে
যখন শুরু হয়েছিল এক গোপন অভিশাপের সূত্রপাত,
তখন থেকেই ধীরে ধীরে নাথনপুর হারাতে থাকে তার প্রাণ।
আজ আবার সেই ইতিহাস ফিরে এসেছে।
অয়ন চক্রবর্তীর ফিরে আসা,
পুরোনো জমিদারবাড়ির তালা ভাঙা,
ছায়ার ঘূর্ণি, বাতাসে কান্না, হাহাকার—
সব যেন পূর্বলিখিত এক নির্মম পুনরাবৃত্তি।
নাথনপুর থমকে গেছে।
বৃদ্ধ পুরোহিত কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন—
“এইবার যে শুরু হয়েছে, শেষ না হওয়া পর্যন্ত থামবে না...”
কেউ সাহস করে এগিয়ে যেতে পারছে না,
কেউ ছুটে যেতে পারছে না—
গ্রামের মানুষ দাঁড়িয়ে আছে ভয়ের ও বিস্ময়ের সংযোগস্থলে।
শুধু একটা কথা সবার মুখে ঘুরপাক খাচ্ছে—
অয়ন কি ফিরতে পারবে?"
ধীরে ধীরে জমিদার বাড়ির অতীতের সেই রাজকীয় চিত্র যেন ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে গেল আমার চোখের সামনে থেকে।
আলো নিভে গেল,
আর সেই পুরোনো নিস্তব্ধতা আবারও নেমে এলো চারপাশে।
চারিদিকে অন্ধকার,
আর তার সঙ্গে বাড়তে লাগল এক অজানা ঠান্ডা বাতাস।
সেই চেনা হিমে ভেজা বাতাস,
যার মধ্যে লুকিয়ে থাকে শূন্যতা, আতঙ্ক আর প্রাচীন কোনো অভিশাপের নিঃশ্বাস।
আমি সতর্কভাবে চারপাশে তাকালাম।
বুকের ভেতরে অজানা শঙ্কার ঢেউ।
ঠিক তখনই—
আমার চোখ আটকে গেল মন্দিরের পেছন দিকে।
দূরে, অন্ধকারে—
কোনো এক আলো ছায়ার ফাঁকে আমি দেখতে পেলাম দুটি পা।
ভয়, কৌতূহল আর দায়িত্ববোধ মিলিয়ে আমি ছুটে গেলাম সেই দিকে।
গিয়ে দেখি—
মাটিতে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে চঞ্চল দাশগুপ্ত!
আমার সহকর্মী।
যে কিনা তিন বছর আগে নিখোঁজ হয়েছিল…
আর যাকে নিয়ে আমি এতদিন ধরে এই রহস্যের ভেতরে হেঁটে চলেছি,
সে আজ পড়ে আছে এই অভিশপ্ত জমিদারবাড়ির পেছনে।
আমি অবাক, হতভম্ব।
চিৎকার করলাম—
“অয়ন! উঠো! আমি মৃদুল! আমি এসেছি!”
তার শরীরটা তুলে ধরে মাথার নিচে হাত রাখলাম,
একটু পানি ছিটিয়ে দিলাম মুখে।
অয়ন , চোখ খুলো... উঠো...”
অনবরত চেষ্টা করতে করতে, অবশেষে তার চোখ কেঁপে উঠলো।
একটা ক্ষীণ দীর্ঘশ্বাস,
আর তারপর সে আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকালো আমার দিকে।
আমি বিস্ময়ে ওর চোখে তাকিয়ে বললাম,
“তুমি এখানে কিভাবে এলে?”
সে চোখ মেলে তাকালেও,
চোখে ছিলো কেবল বিস্ময় আর শূন্যতা।
“আমোস… আমি… আমি কোথায়?”
সে নিজের কপালে হাত দিয়ে দেখলো—
সেখানে হালকা রক্ত আর ধুলোমাখা চিহ্ন।
মাথায় যেন একটা আঘাত লেগেছে।
আমি হাত ধরে তাকে বসালাম।
সে ফিসফিস করে বলল,
“কিছুই মনে করতে পারছি না…”
অয়ন চক্রবর্তী
যে ছিল এই রহস্যের প্রথম অধ্যায়,
আজ দাঁড়িয়ে আছে আবারো এক ভুলে যাওয়া অতীত নিয়ে।
তার ফিরে আসা কি এই রহস্যের জট খুলবে?
নাকি নতুন কোনো ছায়ার দরজা খুলে দেবে?
প্রাসাদের অন্দরে
বাতাস হঠাৎ করে যেন আরও ভারী হয়ে উঠলো।
পুরোনো বটগাছটা দুলতে শুরু করলো
মনে হলো যেন সে কিছু বলতে চাইছে—
কিংবা কাউকে সতর্ক করছে।
তারই ফাঁকে ভেসে এলো
এক অস্পষ্ট শিশুর কান্না—
অত্যন্ত মৃদু, কিন্তু ভয়ংকরভাবে বেদনাবিধুর।
আমাদের শরীর জমে এলো আতঙ্কে,
কিন্তু সেই কান্নার মধ্যেই
আমাদের চেতনা আবার সম্পূর্ণভাবে ফিরে এলো।
আমি অয়নের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বললাম,
“এই অভিশপ্ততা থেকে মুক্তি পেতে হলে
আমাদের ঢুকতেই হবে প্রাসাদের ভেতরে।
জানতেই হবে, এত বছর ধরে
এই মন্দির কেন তালাবদ্ধ হয়ে পড়ে আছে।”
অয়ন কিছু না বলে মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি জানালো।
আমরা দু’জনেই হাতে তুলে নিলাম মশাল।
ঝাঁঝালো ধোঁয়া আর মৃদু আলোয়
অয়নের চোখে ফুটে উঠলো সাহসের ছায়া,
আর আমার হৃদয়ে বেজে উঠলো
প্রাচীন কোনো সত্যের দ্বারে পৌঁছানোর দৃঢ় সংকল্প।
ধীরে ধীরে এগিয়ে চললাম জমিদার প্রাসাদের মূল দরজার দিকে।
ভাঙা পাথরের সিঁড়ি,
ধুলো জমা কারুকাজে ঘেরা দেওয়াল,
আর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা শত বছরের পুরোনো মূর্তিগুলো
আমাদের পদচারণার শব্দে যেন চমকে উঠছিল।
দরজায় হাত রাখতেই
একটা ঠান্ডা, স্বচ্ছ আলোর রেখা
আমাদের শরীর ছুঁয়ে গেলো—
মনে হলো যেন কোন এক অতীন্দ্রিয় শক্তি
আমাদের আগমনের সংবাদ নিচ্ছে।
দরজা ধীরে ধীরে কর্কশ শব্দে খুলে গেলো,
আর আমরা প্রবেশ করলাম সেই অভিশপ্ত অন্দরমহলে।
ভেতরে ঢুকেই আমাদের চোখ ছলকে উঠলো বিস্ময়ে।
বহু বছরের ধুলো জমে গেছে পাথরের মেঝেতে,
ছাদের কোণে কোণে মোটা মাকড়সার জাল।
একটা ভারী, স্থবির নিস্তব্ধতা ঝুলে আছে পুরো প্রাসাদ জুড়ে,
যেন প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি স্তম্ভ
লুকিয়ে রেখেছে কোনো না কোনো অব্যক্ত কান্না বা লুকোনো সত্য।
অয়ন আর আমি একে অপরের দিকে তাকালাম।
কোনো কথা না বলে শুধুই হাঁটতে থাকলাম—
কারণ জানি, এই প্রাসাদের বুকের গভীরে
লুকিয়ে আছে নাথনপুরের সত্য।
আর সেই সত্য জানলেই আমরা পারবো—
এই অভিশাপের গ্রন্থি খুলে
ছায়া থেকে আলোয় ফেরাতে এক পুরো গ্রাম।
জমিদার প্রাসাদের অন্দরমহলটিতে পা রাখতেই যেন এক অলৌকিক ঘটনার সূচনা হলো।
এক সময়ের অন্ধকার, ধুলোয় মোড়া ঘরগুলো একে একে আলোকিত হয়ে উঠলো—
আলো ঠিক যেন কোনো অদৃশ্য হাত দিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে
প্রতিটি করিডোর, প্রতিটি দেয়াল।
আমরা সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকলাম।
প্রথমেই চোখে পড়লো এক বিশাল তেলের রঙে আঁকা ছবি—
দিগ্বিজয় রায় চৌধুরী, নাথনপুরের সেই প্রভাবশালী জমিদার।
তাঁর কঠোর চোখজোড়া, মোটা গোঁফ আর অলংকৃত পোশাক
এখনও যেন রাজশক্তির ছাপ রেখে গেছে এই প্রাসাদের প্রতিটি ইট-পাথরে।
আশ্চর্যের ব্যাপার, এত বছর ধরে পরিত্যক্ত হওয়ার পরেও
এই রাজপ্রাসাদটি অত্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।
না কোথাও ধুলোর স্তূপ, না মাকড়সার জাল,
না কোনো জীর্ণতার ছাপ।
মনে হচ্ছিল, আজও এখানে কেউ বাস করে।
নাকি কেউ অদৃশ্য থেকে দেখছে আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ?
আমি আর অয়ন বিস্ময়ে ভরা চোখে পুরো প্রাসাদটি ঘুরে দেখতে থাকি।
চার তলা বিশিষ্ট এই বাড়িটির প্রতিটি করিডোর, হলঘর, বারান্দা
এক অভিজাত অতীতের নিঃশব্দ সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
তবে এক সময় আমরা লক্ষ্য করলাম—
দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ তলার এক একটি কক্ষ বন্ধ।
কৌতূহল আমাদের কাবু করে ফেললো।
দু’জনে মিলেই একে একে প্রতিটি দরজা খুলতে শুরু করলাম।
আর প্রত্যেকটি দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে
আমাদের শরীরের পাশ দিয়ে কোনো এক ঠান্ডা প্রবাহ যেন বের হয়ে গেল—
নিশ্চুপ, শব্দহীন, অথচ গভীরভাবে অনুভবযোগ্য।
দ্বিতীয় তলার কক্ষে ঢুকতেই চোখে পড়লো
পুরনো কিছু হাতে আঁকা ছবি।
ছবিগুলোয় কেবল প্রাসাদের নয়,
দেখা গেলো মন্দির, বটগাছ, চা-ওয়ালা, পুরোহিত, চৌকিদার—
অর্থাৎ নাথনপুরের প্রতিটি কাহিনির মুখ্য চরিত্র!
অয়ন বিস্ময়ে ফিসফিস করে বললো,
“এগুলো তো ঠিক আমার নোটবুকের গল্পগুলোর মতো…”
তবে তৃতীয় এবং চতুর্থ তলায় যেটা দেখলাম,
তা আমাদের সম্পূর্ণভাবে স্তব্ধ করে দিলো।
তৃতীয় তলার কক্ষ খুলতেই চোখে পড়লো—
মাটিতে আঁকা এক বিশাল তন্ত্র-মণ্ডল।
চারপাশে ছাই, পুড়ানো কাপড়ের টুকরো আর মৃত পাখির পালক।
এখানে কোনো এক সময়
ভয়ংকর তান্ত্রিক সাধনা হয়েছিল,
আর তার শক্তি যেন এখনও আটকে আছে কক্ষের গাঢ় অন্ধকারে।
চতুর্থ তলায় পা রাখতেই
আমরা বুঝে গেলাম, এই প্রাসাদ শুধু ইট-কাঠের নয়,
এ এক অলৌকিক ইতিহাসের রক্তমাখা সিন্দুক।
সেখানে ছিল একটা আয়না—
যার সামনে দাঁড়াতেই আমি দেখলাম,
আমার প্রতিবিম্বের পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে!
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি—কেউ নেই।
অয়ন থেমে গিয়েছিল।
সে কাঁপা গলায় বললো,
“মৃদুল… আমরা ভুল পথে পা বাড়িয়েছি কিনা?”
আমি তার কাঁধে হাত রেখে বললাম,
“না অয়ন। এখন আর ফিরে যাওয়ার পথ নেই।
এই অভিশাপের শেষ দেখেই ফিরতে হবে—নাথনপুরকে মুক্ত করতেই হবে।”
আমি আর অয়ন ধীরে ধীরে একে একে সব বন্ধ কক্ষের দরজাগুলো আবার বন্ধ করে দিই—
মনে হচ্ছিল যেন প্রতিটি দরজা বন্ধ করার মাধ্যমে
আমরা কোনো এক গোপন শক্তিকে আবার শিকল পরিয়ে দিচ্ছি।
প্রাসাদের নিরবতা আরও গভীর হয়ে উঠলো।
সবশেষ দরজাটি বন্ধ করার মুহূর্তেই
এক অদৃশ্য স্নায়ুচাপ ভর করে আমাদের ওপর।
আমরা ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসি,
পায়ের শব্দ যেন পুরো প্রাসাদের স্তব্ধতা ভেঙে ফেলে।
আর নিচে নামার সাথে সাথেই—
জমিদার বাড়িটি এক গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে।
যেন আলো, জীবন, কণ্ঠ—সব টেনে নিয়ে গেল
এক অজানা অতল গহ্বর।
অয়নের দিকে তাকিয়ে দেখি,
তার মুখেও সেই একই প্রশ্ন—
আমরা ঠিক কী দেখলাম? আর কী পেছনে রেখে এলাম?
এই নীরব অন্ধকারে দাঁড়িয়ে,
আমরা টের পেলাম,
নাথনপুর এখনো সব কিছু বলে ফেলে নি।
আমি আর অয়ন দাঁড়িয়ে আছি সেই জমিদারবাড়ির মূল হলঘরে—
যেখানে শূন্যতা ঘন হয়ে ছায়ায় পরিণত হয়েছে।
ঘরের চারপাশে সবকিছু
ধুলোমলিন, নীরব, কিন্তু অনুভব করা যাচ্ছে
এক অদৃশ্য উপস্থিতি—
যা আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে।
আস্তে আস্তে পা ফেলতে ফেলতে এগোই।
মেঝেতে অদ্ভুত এক ছোপ ছোপ দাগ,
যা শুকনো রক্ত না কি পুরনো কালি, বোঝা যাচ্ছে না।
দেয়ালে ঝুলছে ফেটে যাওয়া এক তেলচিত্র—
একজন রাজবেশে পুরুষের ছবি, যার চোখ যেন আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আর ঠিক তখনই…
ঘরের এক কোণ থেকে ভেসে আসে এক ফিসফিস শব্দ—
অয়ন... ফিরে এসেছো...
আমি এক ধাক্কায় পেছনে ফিরে তাকাই।
কেউ নেই।
কিন্তু বাতাসের গতি বদলেছে।
পেছনের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল এক ঠান্ডা, ঘন অন্ধকার—
আর তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে একটি ছায়ামূর্তি।
তার গায়ে মানুষের মতো অবয়ব,
কিন্তু চেহারাহীন, চোখ নেই, মুখ নেই—
শুধু কালো কুয়াশায় গড়া এক চলমান অস্তিত্ব।
আমি পেছাতে চাই, কিন্তু পা জমে গেছে।
ছায়াটি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, আর আমি স্পষ্ট শুনতে পাই—
"তুই হারিয়ে গিয়েছিলি সময়ের নিয়ম ভেঙে,
আমাকে এই অভিশাপ থেকে মুক্ত করার জন্যে।
কিন্তু তুমি…
তুমি পালিয়ে গিয়েছিলে।
ভেবেছিলাম, তুমি আমার হয়ে দাঁড়াবে,
আমার হয়ে প্রতিশোধ নেবে—
তাদের বিরুদ্ধে, যারা আমার অস্তিত্ব মুছে দিয়েছিল।
কিন্তু না…
তুমি নীরব ছিলে, অন্ধকারে আমাকে ফেলে রেখেছিলে।"
তার কণ্ঠে ছিল এক বিষণ্ন অভিমান,
চোখে জমে থাকা শত বছরের অপেক্ষা।
এখন সেই সময়ের ঋণ শোধ কর..."
আজ যখন আবার ফিরেছো…
আমি জানি, তুমি পালাবে না।
এইবার… হয়তো সত্যিই সব শেষ হবে।"**
আর না হয় আমরা সবাই শেষ হবো ---
সে এগিয়ে আসে,
আর আমার রক্ষাকবচ নিজের থেকে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
তেজে ছায়ামূর্তি একটু পেছাতে বাধ্য হয়।
তখনই আমি বুঝি—
এই রক্ষাকবচই একমাত্র রক্ষাকবচ নয়,
আমার স্মৃতি, আমার সত্য জানার ইচ্ছা—
সেটাও এক শক্তি।
ছায়াটি হঠাৎ এক ঝাপটায় মিলিয়ে যায় অন্ধকারে,
আর ঘরের চারপাশে একেকটা দরজা খুলে যেতে থাকে নিজে নিজেই।
প্রতিটি দরজা যেন আমায় ডাকছে
নাথনপুরের হারানো ইতিহাসের আরও গভীরে…
আমি অয়নের দিকে তাকিয়ে গভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করি—
"তোমার সাথে এই ছায়ামানবের সম্পর্কটা আসলে কী, অয়ন?
এই গ্রামে তো অনেক মানুষ আছে…
তবুও কেন সে বারবার তোমাকেই খুঁজছে?
কেন সে তোমার মাধ্যমেই মুক্তি চাইছে?
আমার আর কোনো ধোঁয়াশা ভালো লাগছে না।
প্লিজ… সত্যিটা বলো।"
অয়ন নীরব।
তার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি—
সে কিছু লুকোচ্ছে… অথবা কিছু ভুলে থাকার ভান করছে।
"আমার তো অধিকার আছে জানার," আমি জোর দিয়ে বলি।
"আমরাও তো এখন এই অদৃশ্য জালে জড়িয়ে গেছি।
তুমি চুপ থাকলে, হয়তো আমরা কেউই আর এই নাথনপুর থেকে ফিরতে পারবো না।"
অয়নের চোখের কোণে হালকা কাঁপন।
সে গভীর নিশ্বাস নিয়ে ধীরে বলে—
"সত্যি বলতে… আমি নিজেও জানি না পুরোটা।
তবে হ্যাঁ—ছায়ামানব আমার অতীতের সাথে বাঁধা।
হয়তো আমি-ই একসময় কিছু করেছিলাম,
যার পরিণাম এখন ফিরছে…
অথবা আমি কাউকে ছেড়ে এসেছি, যে আমাকে আজও ভুলতে পারেনি।"
অয়ন কণ্ঠে ছিল অপরাধবোধ আর ভয়ের অদ্ভুত মিশ্রণ।
আমি আর কিছু বলি না।
শুধু নীরবে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকি—
কারণ এখন বুঝতে পারছি,
এই রহস্য শুধু নাথনপুরের নয়…
এটা আমাদের মধ্যেকারও কিছু।
“আপনার কি মনে আছে, মৃদুল সাহেব,
যেদিন আপনি আমাদের অফিসের চাকরি ছেড়ে চলে যান?”
অয়ন নিচু কণ্ঠে প্রশ্ন করলো, যেন স্মৃতির গহ্বর থেকে ভেসে আসছে তার প্রতিটি শব্দ।
“সেই দিনই তো আমাদের পার্টি ছিল।
পার্টির মাঝে হঠাৎ আমার আর আপনার মধ্যে
একটা ছোটখাটো মনোমালিন্য হয়েছিল।
আমি রাগারাগি করে সেখান থেকে বেরিয়ে যাই…
আর আপনি চুপচাপ চেয়ারে বসে ছিলেন।
বাইরে তখন ঝড় শুরু হয়ে গেছে—
বৃষ্টি পড়ছিল অঝোরে।
আমি শহরের এক কোণে, এক বিশাল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে
বৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলাম।
ঠিক তখনই কেউ একজন আমাকে নাম ধরে ডাকলো।
‘অয়ন!’”
সে থেমে গেল এক মুহূর্ত। তারপর বললো—
“আমি তাকালাম চারদিকে…
কিন্তু আশেপাশে কেউ ছিল না।
শুধু অন্ধকার, জল আর ঠান্ডা বাতাস।
সেদিন বাসায় ফিরে দেখি দরজার সামনে পড়ে আছে
একটি ভেজা কাগজ…
যেখানে শুধু একটি ঠিকানা লেখা—
নাথনপুর।”
আমি বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকলাম অয়নের দিকে।
সে আবার বলতে লাগলো—
“সেই রাতেই আমি প্রথম স্বপ্নটা দেখি—
একজন অচেনা কণ্ঠ বলে ওঠে,
‘তোমাকে ফিরতেই হবে… নাথনপুরে।’
তারপর থেকে একের পর এক অদ্ভুত স্বপ্ন
আমার ঘুম কেড়ে নেয়।
স্বপ্নে দেখি পুরোনো মন্দির,
এক বটগাছ, আর ভয়ংকর ছায়া যেন আমাকে অনুসরণ করছে।
আর তখনই মনে হলো—
না, এসব আর সহ্য করা যাচ্ছে না।
যা-ই হোক না কেন,
এই সব কিছুর পেছনের সত্য আমাকে জানতে হবে।
আমি সিদ্ধান্ত নিই, যাবো নাথনপুরে।”
তার কণ্ঠে এক ধরনের অপরাধবোধের গন্ধ।
“আপনি যেসব ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন, আমোস দা,
আমি ঠিক সেসবই দেখেছি আমার চোখে…
শুধু সময় আর প্রেক্ষাপটটা আলাদা।
গ্রামের অনেকেই আমাকে নিষেধ করেছিল ফিরে যেতে।
তবু আমি ফিরে এসেছি… বারবার।
একটা অপরাধবোধ আমাকে ছাড়ে না।
শেষবার আর কোনো দিক না দেখে,
আমি সোজা এই জমিদার বাড়ির দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে পড়ি।
ঠিক তখনই—
কিছু একটা আমার মাথায় জোরে আঘাত করে।
এরপর আর কিছু মনে নেই।”
অয়নের চোখে তখন কুয়াশা।
অতীতের ধোঁয়াশায় সে হারিয়ে গেছে।
আমি শুধু অনুভব করি—
এই গল্প শুধু জমিদার বাড়ির নয়,
এটা অয়নের নিজের মধ্যেও চলা এক অদৃশ্য যুদ্ধ।
অয়নের কথা শুনে, তার চোখের ভেতর সেই অদ্ভুত শূন্যতা দেখে আমি বুঝে যাই—
এই রহস্যের জট খুলবে একমাত্র সে-ই।
অয়ন ছাড়া আর কেউ পারবে না।
তার মনে লুকিয়ে আছে এমন কিছু,
যা পুরো নাথনপুরের অতীত, এই জমিদার বাড়ির ইতিহাস,
এবং সেই রহস্যময় ছায়ামানবের সাথে অদৃশ্য সেতুবন্ধন গড়ে তুলেছে।
আমি ধীরে ধীরে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াই।
তার কাঁধে হাত রেখে বলি—
"অয়ন, এবার আমাকে সত্যটা বলো।
তোমার অতীতে এমন কী আছে, যা তুমি ভুলে থাকতে চাইছো?
এতদিন যা যা ঘটেছে,
সবই কি কেবল কাকতালীয়?
না কি... তুমি জানো,
তোমাকে কেন বেছে নেওয়া হয়েছে?"
অয়ন মুখ নামিয়ে ফেলে।
তার নিঃশ্বাস ভারি হয়ে ওঠে।
তার চোখের পাতা কাঁপে—
আর আমি অনুভব করি তার ভেতরে চলছে এক ভয়ংকর দ্বন্দ্ব।
আমি থেমে যাই না।
বারবার তাকে মনে করাতে থাকি,
যে এই রহস্যের শেষ না হওয়া পর্যন্ত
গ্রামও মুক্তি পাবে না, আমরাও নয়।
একসময়,
অয়ন মাথা তোলে।
তার চোখে তখন আর দ্বিধা নেই—
শুধু তীব্র যন্ত্রণা আর অপরাধবোধ।
সে ধীরে ধীরে বলে ওঠে,
“আমার মনে পড়ে গেছে...
সব কিছু।
যা আমি এতদিন পেছনে ফেলে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম।
আজ আর লুকিয়ে লাভ নেই।
তোমাকে সব বলবো, আমোস দা ।”
সে এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেয়।
আমার সামনে নাথনপুরের ইতিহাসের আসল পর্দা যেন একটুখানি উঁকি দিয়ে গেলো।
অয়ন আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
"আমোস দা তবে শুনো ... এবার সময় হয়েছে সব সত্য বলার।"
তার কণ্ঠে ছিল এক ভয়ানক ভার,
যা হয়তো এতদিন জমে ছিল মনের গহীনে,
আজ সেই নাথনপুরের বাতাসে তা একে একে ঝরে পড়তে লাগলো।
"যেদিন নাথনপুরের জমিদার বাড়ি বন্ধ করে দেওয়া হয়,
সেদিন থেকেই বাড়িটির চারপাশে তিনটি সীমারেখা টানা হয়েছিলো।
গ্রামের কেউই সেই নিষিদ্ধ সীমানায় পা রাখত না—
না কোনো শিশু, না কোনো বৃদ্ধ।
সবাই জানত, একবার ঢুকলেই ফেরার পথ নেই।"
সে থামলো, চোখ মেলে তাকাল দূরের সেই বটগাছের দিকে।
"কিন্তু আমি—
আমি ব্যতিক্রম ছিলাম।
আমার বয়স তখন মাত্র আঠারো।
তুমি তো জানো মৃদুল,
নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি মানুষের একটা অদ্ভুত আকর্ষণ থাকে।
আমার মধ্যেও ছিল সেই একই আকর্ষণ।
একদিন, সাহস করে পার হয়ে যাই সেই নিষিদ্ধ সীমানা।
তখনো বুঝিনি, আমার জীবনের গতিপথ সেদিনই বদলে গেছে।"
তার গলার স্বর ভারী হয়ে আসে। আমি নিঃশব্দে শুনি।
"সেই রাত থেকেই
জমিদার বাড়ির ভিতর থেকে অদ্ভুত সব শব্দ ভেসে আসতে থাকে।
কে যেন আমাকে নাম ধরে ডাকতো।
কে যেন চায়, আমি সেখানে যাই...
জানালা দিয়ে তাকালে দেখতাম—
বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে এক নারী আমাকে হাত নেড়ে ডাকছে।
সেই ইশারা—
আজও চোখে ভাসে।
সে রাতে আমি ভয় পেয়ে দৌড় দিই।
আর তখনই কয়েকজন গ্রামবাসী আমাকে দেখে ফেলে।
তারা ভাবে, আমি জমিদার বাড়ির ‘ছায়া’ ছুঁয়ে এসেছি।”
সে এক দম নিল।
"এরপর থেকে আমার শরীর ভেঙে পড়তে থাকে।
ঘুমে দেখা দিতো দুঃস্বপ্ন—
কখনো জলে ডুবে যাচ্ছি, কখনো গলায় কেউ নিঃশ্বাস ফেলছে।
গ্রামের লোকেরা ধরে নেয়,
আমি সেই অভিশপ্ত শক্তির দ্বারা আক্রান্ত হয়েছি।
তখন গ্রামের পুরোহিত, সাধক—
যারা একসময় জমিদার বাড়ি বন্ধ করেছিল,
তারা আমাকে রক্ষাকবচ দেয়, বাড়ির চারদিকে মন্ত্র দিয়ে সুরক্ষা তৈরি করে।
আমার পরিবার সিদ্ধান্ত নেয়, আমাকে শহরে পাঠিয়ে চিকিৎসা করাবে।
আমি এক সময় সেরে উঠি,
কিন্তু... নাথনপুর আর ফিরিনি।"
তার কণ্ঠ আবারও ভারী হয়, চোখ জলে চিকচিক করে।
"আমোস দাদা, আমি যে দুবার নাথনপুরে এসেছি—
সেই দুইবারের ঘটনাও তোমার জানা।
কিন্তু এর মূল যে শুরু হয়েছিল,
তা ছিল আমার সেই নিষিদ্ধ সীমা অতিক্রম করার দিন থেকেই।
সেদিন... আমি যা খুলে দিয়েছিলাম,
তার দরজা আজও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।
তোমার আগমনে সেই ইতিহাস আবার জেগে উঠেছে..."
আমি স্তব্ধ হয়ে যাই।
অয়নের কথা শেষ হলে,
নাথনপুরের বাতাসে যেন হঠাৎ গা ছমছম করে ওঠে।
জমিদার বাড়ির প্রাসাদের অন্ধকার করিডোর থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এলো একঝাঁক অভিশপ্ত ছায়ামানব। তারা নিঃশব্দে, যেন ধোঁয়ার মতো ভেসে এসে আমাদের ঘিরে ফেলে। প্রত্যেকের মুখ যেন অদৃশ্য—কোনো মুখাবয়ব নেই, শুধু দুটি জ্বলজ্বলে লাল চোখ অন্ধকারে দাউ দাউ করে জ্বলছে। সেই চোখের গভীরে লুকিয়ে আছে অজানা এক রক্তচক্ষু ক্রোধ, আর তাদের ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে এক বিভীষিকাময়, বিকৃত হাসি—যেন শতাব্দী ধরে জমে থাকা প্রতিহিংসা আজই প্রতিফলনের অপেক্ষায়।
আমি আর অয়ন পাথরের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে গেছি। গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না, হাত-পা যেন অবশ। ছায়ামানবরা আমাদের গা ঘেঁষে ঘুরছে—একেকজন যেন হাওয়ায় ভেসে চলেছে, তবুও তাদের উপস্থিতি এত ভারী যে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল।
হঠাৎ, আমাদের মাঝখান দিয়ে এক ছায়ামানব এগিয়ে এসে আমার চোখের সামনে ঝুঁকে পড়ে। তার লাল চোখ আমার চোখের ভেতর ঢুকে যাচ্ছিল—আমি অনুভব করলাম একটা ঠাণ্ডা ছোঁয়া, যেন কেউ আমার আত্মাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। তারপর সে হেসে উঠলো—একটা দীর্ঘ, বিকট, কানে কাঁটা দেওয়া হাসি। সেই হাসির সাথে সাথে আশপাশের বাতাস যেন ভারী হয়ে এল, শীতল হয়ে গেল পুরো দেহ।
ঠিক তখনই অয়ন কাঁপা কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,
“ওদের চোখের দিকে তাকাস না…! ওরা যা দেখায়, তা বাস্তব নয়।”
আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। মনের ভেতর একটা গর্জন—পুরনো স্মৃতি, যেগুলো আমি ভুলে গিয়েছিলাম, হঠাৎ ভেসে উঠছে। এক নারী —তার চোখে জল, সে যেন কিছু বলতে চাইছে...
তবে ঠিক সেই মুহূর্তে, ঘরের এক কোণ থেকে হঠাৎ একটি দীপ্তিময় আলো ঝলসে উঠল। কুয়াশা ছেঁদ করে একটি মানুষী অবয়ব সামনে এসে দাঁড়াল—এক বৃদ্ধ, হাতে এক ধ্বংসপ্রায় দীপশিখা, গলায় প্রাচীন তামার ক্রস ঝুলছে।
তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“তোমরা সেই দুইজন, যাদের নিয়তি এখন নাথনপুরের গোপন ইতিহাস ছুঁয়ে গেছে। আর ফিরে যাওয়ার পথ নেই—তোমাদের পেছনে যারা, তারা অতীত নয়, তারা প্রতিশোধ।”
গীর্জার বৃদ্ধ ফাদারকে সামনে আসতে দেখে ছায়ামানবগুলো হঠাৎ থেমে গেল। তাদের লাল চোখের দহন কিছুটা ম্লান হলো, যেন প্রাচীন কোনো ভয় তাদের বুকেও বাস করে। তবুও, তাদের রক্তাক্ত দৃষ্টিতে ক্রোধ আর প্রতিহিংসার আগুন তখনো জ্বলছিল। ফাদার গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
"তোরা চলে যা, এই রাত এই শিশুদের জন্য নয়।"
কিন্তু ছায়ামানবদের এক দলনেতা ভয়ংকর হুঙ্কার দিয়ে উঠল,
"এই প্রাসাদ আমাদের... আমরা এখান থেকে কোথাও যাবো না! ঐ পাপী, শয়তান দুটোকে শেষ না করে এই মাটি ছাড়বো না! ওদের আমাদের হাতে তুলে দাও, নইলে এই গ্রাম হবে মৃত—মানবহীন, নির্জীব ছায়ামানবদের গ্রাম!"
আমি ফাদারের দিকে তাকিয়ে, শ্বাস রুদ্ধ করে প্রশ্ন করলাম,
"এইসবের পেছনের রহস্য কী, ফাদার? কারা এই দুইজন? কীভাবে মুক্তি মিলবে এই অভিশাপ থেকে? আমরা নিজেরা এবং এই গ্রামটাকে মুক্ত করতে চাই—দয়া করে বলুন আমাদের করণীয় কী?"
ফাদার শান্ত গলায়, তবুও চোখে অদ্ভুত এক দীপ্তি নিয়ে বললেন,
"তোমরা যারা এসেছো, তারা নিছক পথিক নয়। তোমরা তোদের নিয়তিকে পাল্টাতে এসেছো। এই ছায়ারা কেবল প্রতিশোধ চায় না—তারা মুক্তিও চায়।"
তিনি মুখ তুলে ছায়ামানবদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
"ওরা তোদের মুক্ত করতে এসেছে... ওদের ক্ষতি করিস না। আমি তোদের কথা দিচ্ছি—ওরাই তোদের মুক্তি দেবে।"
কিন্তু ছায়ামানবরা তখনো স্থির রইল না। তারা ফুঁসছিল, বিষিয়ে উঠেছিল রাতের বাতাস। তখন ফাদার ধীরে ধীরে পকেট থেকে এক জীর্ণ পবিত্র ক্রস বের করলেন, চোখ বন্ধ করে কোনো প্রাচীন ধর্মীয় মন্ত্র পাঠ করতে লাগলেন। তারপর আকাশের দিকে ক্রসটি তুলে ধরে ছায়াদের দিকে ইশারা করলেন।
সাথে সাথে, যেন এক অদৃশ্য বিস্ফোরণ ঘটে, চারদিক থেকে বাতাস ছুটে এলো। ছায়ামানবগুলো কাতরাতে কাতরাতে পিছু হঠতে লাগল। তারা ছুটতে ছুটতে অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছিল—তবুও সেই ভয়ানক কণ্ঠস্বর বাতাস কাঁপিয়ে বলে যাচ্ছিল...
"এই যাওয়া শেষ যাওয়া নয়... আমরা আবার ফিরে আসবো... ফিরে আসবো... ফিরে আসবো..."
চারদিকে কুয়াশা গাঢ় হয়ে এলো, কিন্তু সেই আওয়াজ অনেকক্ষণ ধরে গুঞ্জন তুলতে থাকল বাতাসে—যেন রাতও জানে, শেষ হয়নি এই অভিশাপের গল্প।
রাতের নিস্তব্ধতা আবারও ধীরে ধীরে গ্রাস করল চারপাশ। ছায়ামানবদের বিকৃত আওয়াজ মিলিয়ে গেল কুয়াশার গর্ভে। ফাদার চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন—চোখে ক্লান্তি, কণ্ঠে চাপা ভয়। আমি আর অয়ন তার দিকে এগিয়ে গিয়ে জোরে বললাম,
"ফাদার, এখন বলুন! কারা সেই দুইজন? আমরা কীভাবে ওদের মুক্তি দিতে পারি? এই গ্রাম আর আমরাও কি বাঁচতে পারব?"
ফাদার ধীরে ধীরে আমাদের গির্জার ভেতরে নিয়ে গেলেন। মোমের আলোয় আলোকিত সেই পুরনো গির্জার এক কোণায় বসে তিনি বলতে শুরু করলেন—এক ইতিহাস, যেটা নাথনপুরের কোনো বইয়ে লেখা নেই।
বিঃ দ্রঃ এই গল্প লেখকের অনুমতিবিহীন কোথাও পোষ্ট করা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গন্য করা হবে

মন্তব্য: ০