Alapon

অধ্যাপক গোলাম আজম (রহ) ; এক কিংবদন্তীর গল্প

"মু’মিনের জন্য নিয়ম হচ্ছে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারবে, কিন্তু তার চেয়ে বেশি কাউকে ভালোবাসতে পারবে না। এটাই আল্লাহর নির্দেশ। আর ভয়, আল্লাহ ছাড়াতো কাউকে ভয় পাওয়া জায়েজই নেই। মু’মিন আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় পেতে পারে না। আমি উদ্বিগ্ন নই। আমি মৃত্যুকে ভয় করি না। মৃত্যুকে ভয় পাবো কেন? মু’মিনতো মৃত্যু কামনা করে। কেননা মৃত্যুর পর আল্লাহর কাছে যাওয়ার সুযোগ পাওয়া যাবে। তাই মৃত্যুকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।" এই কথাগুলো দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন এদেশের ইসলামি পুনর্জাগরণের অন্যতম ব্যক্তিত্ব, ইসলামকে রাষ্ট্রীয়ভাবে কায়েমের চেষ্টার জন্য যার রয়েছে অক্লান্ত পরিশ্রম সেই মহান মনিষী ইসলামী আদর্শের পতাকাবাহি এক বীর সেনাপতি অধ্যাপক গোলাম আযম (রাহিমাহুল্লাহ)। উনাকে যখন জেলে নেয়া হচ্ছিল তখন সাক্ষাৎকারে তিনি এই কথাগুলো বলেছিলেন।

খুনি হাসিনা তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য এ দেশকে ইসলামী নেতৃত্বশূন্য করার জন্য এক ঘৃণা ষড়যন্ত্র শুরু করে। একটি মিথ্যা এবং সাজানো ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে জোরপূর্বক সম্পূর্ণ বেআইনি এবং অন্যায় ভাবে ট্রাইবুনাল সাজিয়ে মিথ্যা রায় দিয়ে এদেশের জাতীয় নেতৃবৃন্দকে শহীদ করেছিল। তাদের মধ্যে অধ্যাপক গোলাম আযম (রহ.) কারাগারেই ইন্তেকাল করেন।

তার ইন্তেকাল এবং মিথ্যা রায় নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়া এবং মহলের বিভিন্ন বিবৃতি গুলো ছিল- গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়, ‘তার বিচার ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত।’ আরব নিউজে বলা হয়েছে, ‘১৯৯০ সালে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর তিনি ‘কিংমেকারের ভূমিকা’ পালন করে বিএনপিকে ক্ষমতায় এনেছিলেন। তবুও তাঁর ইন্তিকালে বিএনপি একটি শোক বাণীও দেয়নি।’ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়, ‘সমালোচকেরা বলে থাকেন যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জামায়াতকে লক্ষ্য করে এবং বিরোধী দলকে দুর্বল করতে ট্রাইব্যুনালকে ব্যবহার করছেন। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম আন্তর্জাতিক মানদন্ড পূরণে ব্যর্থ হয়েছে”। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “যে অন্যায়ভাবে কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করলো, সে যেন গোটা মানব জাতিকে হত্যা করলো।” রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “বিচারক তিন ধরনের , দুই ধরনের জাহান্নামী এক ধরনের জান্নাতী, যে সত্য জেনেও অন্যায় বিচারকার্য করে সে জাহান্নামী, যার বিচারকার্যের জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও বিচারকার্য করল সে জাহান্নামী, আর যে সত্যকে জানলো এবং সে অনুযায়ী বিচারে রায় দিল সে জান্নাতি” (ইবনে মাজাহ)।

২০১৪ সালের ২৩ ই অক্টোবর , রাত ১০টা ১০ মিনিটে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (সাবেক বিএসএমএমইউ) প্রিজন সেলে ইন্তেকাল করেন তিনি (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। এ হাসপাতালের কার্ডিয়াক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অধ্যাপক গোলাম আযমের রক্তচাপ সকালে আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়। দুর্বলতার কারণে কথা বলতে পারছিলেন না তিনি। রক্তচাপ ওইদিন অনেক কমে যাওয়ায় দুর্বল হয়ে পড়েন। পক্ষাঘাতগ্রস্ত (প্যারালাইজড) হওয়ায় তার দেহের নিচের অংশ নড়াচাড়া করতে পারছিলেন না। সন্ধ্যার পর অবস্থার আরো অবনতি হয়। পরে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়। রাত ১০টা ১০ মিনিটে তিনি ইন্তেকাল করেন। রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে এ ঘোষণা দেয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। তাঁর ৬ ছেলে ও স্ত্রীসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রয়েছে। লাখো মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বাবার পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন অধ্যাপক গোলাম আযম। ২০১৪ সালের ২৫ অক্টোবর দুপুরে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে ঐতিহাসিক নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় স্বতঃস্ফূর্ত জনতার উপস্থিতি ছিল অভূতপূর্ব। লাখ লাখ তরুণ আর বয়স্কের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। কিংবদন্তি নেতা অধ্যাপক গোলাম আযমের নামাজে জানাজায় অংশ নিতে সকাল থেকে জনতার ঢল নেমেছিল মসজিদমুখী। পূর্বঘোষণা অনুযায়ী, নামাজে জানাজার জন্য সকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লাখ লাখ জনতা জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম অভিমুখে স্রোতের মতো আসতে শুরু করে। বেলা ১১টায় বায়তুল মোকাররম উত্তর এবং দক্ষিণ গেট ও তার চারপাশ, পল্টন ময়দান, গুলিস্তান, জিপিও, দৈনিক বাংলার মোড় হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত জনসমুদ্রে পরিণত হয়। জানাজার পূর্ব মুহূর্তে জনগণ উচ্চৈঃস্বরে কালেমা পাঠ করতে করতে চারদিক মুখরিত করে তোলেন। জানাজাকে ঘিরে বায়তুল মোকাররম ও এর আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়। সরকার সমর্থক কয়েকটি সংগঠন জানাজা ঠেকানোর ঘোষণা দিলেও তাদের তৎপরতা চোখে পড়েনি। শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবেই জানাজা সম্পন্ন হয়। বাদ জোহর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে মরহুম অধ্যাপক গোলাম আযমের নামাজে জানাজা সম্পন্ন হয়। জানাজায় ইমামতি করেন তার চতুর্থ পুত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুল্লাহিল আমান আল আযমী। জানাজা শেষে মগবাজারের কাজী অফিস লেনস্থ নিজ বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে এ কিংবদন্তি নেতাকে দাফন করা হয়।

এবার একটু এই মহান ব্যক্তির ছাত্র জীবন এবং পেশাগত জীবন নিয়ে আলোচনা করা যায়। গোলাম আযম ১৯৩৭ সালে জুনিয়ার মাদ্রাসা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে কৃতিত্বেও সাথে উত্তীর্ণ হন। এসএসসি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় গোলাম আযম ত্রয়োদশ স্থান লাভ করেন। ১৯৪৪ সালে ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকেই আইএ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে ঢাকা বোর্ডে দশম স্থান অধিকার করেন। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের কাজে জড়িয়ে পড়ায় গোলাম আযম পরীক্ষা দিতে পারেননি এবং ১৯৪৯ সালে দাঙ্গাজনিত উত্তেজনাকর পরিস্থিতির কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠান সম্ভব হয়নি। ফলে তিনি ১৯৫০ সালে এম. এ পরীক্ষা দেন। ঐ বছর কেউ প্রথম বিভাগ পায়নি। চারজন ছাত্র উচ্চতর দ্বিতীয় বিভাগ লাভ করেন এবং অধ্যাপক গোলাম আযম তাদের মধ্যে একজন। ১৯৫০ সালের ৩রা ডিসেম্বর তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। কর্মজীবনের সূচনা হলো। তিনি ১৯৫০ সালর ৩রা ডিসেম্বর থেকে ১৯৫৫ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের অত্যন্ত জনপ্রিয় শিক্ষক হিসেবে রংপুর কারমাইকেল কলেজে কর্মরত ছিলেন। নিজ বিভাগের ছাত্ররা ছাড়াও তার লেকচারের সময় অন্যান্য ক্লাসের ছাত্ররা তার ক্লাসে যোগদান করতো।

অধ্যাপক গোলাম আযমের জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি ইসলামী আন্দোলন এবং সংগঠন পিছনে ব্যয় করেছিলেন। এর পাশাপাশি এদেশের রাজনীতিতে এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় পরিবর্তনের জন্য কাজ করেছিলেন।
তিনি ছাত্র জীবনে ছিলেন ডাকসুর জিএস। তিনি তখন থেকেই ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং একাধিকবার গ্রেফতার হন। তিনি তমুদ্দিন মজলিসের রংপুর জেলার প্রধান ছিলেন। তিনি ১৯৫৪ সালে জামাত ইসলামীতে যোগদান করেন। ধারাবাহিকভাবে তিনি জামাত ইসলামের রুকন হন। পুর্ব পাকিস্তানের আমির নির্বাচিত হন। ২০০০ সালের ডিসেম্বর মাসে মজলিসে শূরার কাছে বিশেষ আবেদনের প্রেক্ষিতে আমীরে জামায়াত-এর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভ করেন।

এই মহান পুরুষের এদেশের জাতীয় জীবনে রয়েছে অসংখ্য অবদান। স্বৈরাচারী ও একনায়কতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে জামায়াত সর্বদাই সোচ্চার ছিলো। জামায়াতের অন্যতম নেতা হিসেবে এবং বিশেষভাবে রাজনৈতিক দিক থেকে উত্তপ্ত সাবেক পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমীর হিসেবে অধ্যাপক গোলাম আযম বিরোধী দলীয় আন্দোলনে একজন প্রথম সারির নেতার ভূমিকা পালন করেছেন। আইয়ূব খানের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিটি আন্দোলনে অধ্যাপক গোলাম আযম অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৪ সালের ২০শে জুলাই ঢাকায় খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসভবনে মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, আওয়ামী লীগ, নেজামে ইসলাম ও নিষিদ্ধ জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধিবৃন্দ ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য চার দিনব্যাপী বৈঠকে নয় দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে সম্মিলিত বিরোধী দল Combined Oppositeon Partics (COP) গঠন করা হয়। সম্মিলিত বিরোধী দলের তৎপরতা পরিচালনায় অধ্যাপক গোলাম আযম বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৬৭ সালের ৩০ এপ্রিল শাসরুদ্ধকর স্বৈরশাসনের হাত থেকে দেশকে বাঁচানোর জন্য আতাউর রহমান খানের বাসভবনে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের সর্বজনাব নূরুল আমীন, হামিদুল হক চৌধুরী ও আতাউর রহমান খান, কাউন্সিল মুসলিম লীগের মিয়া মমতাজ দৌলতানা, তোফাজ্জল আলী ও সৈয়দ খাজা খায়েরুদ্দিন, জামায়াতে ইসলামীর মিয়া তোফায়েল মুহাম্মদ, মাওলানা আব্দুর রহীম ও অধ্যাপক গোলাম আযম, আওয়ামী লীগের নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান, আব্দুস সালাম খান ও গোলাম মোহাম্মদ খান লুন্দখোর এবং নেজামে ইসলাম পার্টির চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, মৌলভী ফরিদ আহমদ ও এম, আর, খানকে নিয়ে ‘পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট’ গঠিত হয়। পিডিএম আট দফা কর্মসুচি ঘোষণা করে। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের জনাব আব্দুস সালাম খানকে সভাপতি এবং অধ্যাপক গোলাম আযমকে জেনারেল সেক্রেটারি করে পূর্বাঞ্চলীয় পিডিএম কমিটি গঠিত হয়। পিডিএম-এর পূর্বাঞ্চলীয় জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে অধ্যাপক গোলাম আযম দিনরাত পরিশ্রম করেন এবং গণতন্ত্র উদ্ধারের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
১৯৬৯ সালের সরকার বিরোধী আন্দোলন জানুয়ারি মাসে সতুন পর্যায়ে প্রবেশ করায় দেশব্যাপী এক প্রচন্ড গণজাগরণের সূচনা হয়। সমগ্র দেশব্যাপী সুষ্ঠুভাবে গণআন্দেলন পরিচালনার তাগিদে ৭ ও ৮ই জানুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত দুই দিনব্যাপী বৈঠকে (১) ন্যাপ, (২) আওয়ামী লীগ (৬ দফা), (৩) নেজামে ইসলাম পার্টি, (৪) জমিয়তে ই উলামায়ে ইসলাম, (৫) কাউন্সিল মুসলিম লীগ, (৬) জামায়াতে ইসলামী, (৭) এনডিএফ, (৮) আওয়ামী লীগ (৮ দফা পন্থী) এই আটটি দলের নেতৃবৃন্দের স্বাক্ষর ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটি (ডাক) গঠন করা হয়। নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খানকে ডাক-এর আহ্বায়ক নির্বাচিত করা হয়।
গণআন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছলে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান গোল টেবিল বৈঠকে যোগদান করার জন্য ডাক-এর ৮টি অঙ্গদলের দু’জন করে প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানান। যাদের আমন্ত্রণ জানানো হয় তারা হলেন- কাউন্সিল মুসলিম লীগের মমতাজ দৌলতানা এবং খাজা খায়েরুদ্দিন, জামায়াতে ইসলামীর সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী ও অধ্যাপক গোলাম আযম, পাকিস্তান আওয়ামী লীগের (৬ দফা) শেখ মুজিবুর রহমান ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের মুফতি সাহমুদ ও পীর মোহসেন উদ্দিন, পাকিস্তান আওয়ামী লীগের (৮ দফা) নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান ও আব্দুস সালাম খান, নেজামে ইসলামের চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ও মৌলভী ফরিদ আহমদ, ন্যাপের আব্দুল ওয়ালী খান ও অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ। এ ছাড়াও পাকিস্তানের পিপল্স পার্টির জুলফিকার আলী ভুট্টো ও ন্যাপ (ভাসানীর) মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এয়ার মার্শাল আসগর খান, লেঃ জেনারেল মুহম্মদ আযম খান ও প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ বৈঠকে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন।
২৬শে ফেব্রুয়ারি রাওয়ালপিন্ডিতে সকাল সাড়ে দশটায় প্রেসিডেন্ট গেস্ট হাউজে ডাক-এর ষোলজন প্রতিনিধি, প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের নেতৃত্বে ১৫ জন, নির্দলীয় এয়ার মার্শাল আসগর খান, বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ রাজনৈতিক সংকট উত্তরণকল্পে গোল টেবিল বৈঠকে মিলিত হন। ৪০ মিনিট ব্যাপী বৈঠকের পর ঈদুল আযহা উপলক্ষে বৈঠক ১০ মার্চ সকাল ১০ টা পর্যন্ত মূলতবি রাখা হয়। ১০ই মার্চ হতে ১৩ই মার্চ পর্যন্ত রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট গেস্ট হাউজে গোল টেবিল বৈঠকে বসে এবং ১৩ই মার্চ গোল টেবিল বৈঠকের সমাপ্তি অধিবেশনে প্রেসিডেন্ট আইয়ূব খান নিম্নোক্ত দাবী দুটি গ্রহণ করেন, প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচন এবং ফেডারেল পার্লামেন্টারী সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন। অধ্যাপক গোলাম আযম এ বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধিত্ব করেন।
বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অধ্যাপক গোলাম আযম ১৯৮০ সালে সর্বপ্রথম ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফর্মুলা’ উপস্থাপন করেন। ১৯৯৬ সালে তার পূর্বেকার প্রস্তাব মতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার সংবিধানে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফর্মুলা’ সংযোজন করেন। ১৯৯৯ সালে ইসলাম ও জনগণের ইচ্ছার বিরোধী ভারতের তাঁবেদার আওয়ামী লীগ সরকারের উচ্ছেদের লক্ষ্যে গঠিত চারদলীয় জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা ছিলেন তিনি।

উনার জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। এজন্য তিনি তার জীবনের অধিকাংশ সময় ইসলামী আন্দোলনের খেদমতে ব্যয় করেছিলেন। তার লেখা বইগুলো এখন ইসলামী আন্দোলনের জনশক্তিদের জন্য অনুপ্রেরণা এবং ইসলামী আন্দোলনের কাজের ক্ষেত্রে অনেক বড় সহায়ক।উনার লেখা বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মনটাকে কাজ দিন, আল্লাহ তায়ালার সাথে মানুষের সম্পর্ক, জীবন্ত নামাজ, মজবুত ইমান সহ অসংখ্য। তিনি তার জীবনী নিয়ে লেখা একটি বই "জীবনে যা দেখলাম" সর্বমোট ৬ খণ্ড । সেখানে তিনি অনেকগুলো বিষয় বিস্তারিত তুলে ধরেছেন।

উনার সবচেয়ে বড় অবদান ছিল তিনি এদেশে ইসলামী ঐক্যের অনেক চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বর ইসলামী ঐক্য ইসলামী আন্দোলন’ পুস্তিকায় সকল ইসলামী শক্তিকে এক প্লাটফর্মে সমবেত হওয়ার রূপরেখা প্রদান করেন অধ্যাপক গোলাম আযম। ’৮১ সালের ডিসেম্বরে ঐ রূপরেখা অনুযায়ী ‘ইত্তেহাদুল উম্মাহ’ নামক ব্যাপকভিত্তিক ঐক্যমঞ্চ গঠিত হয়। ১৯৯৪ সালে ইসলামী ঐক্যের অগ্রগতি সম্পর্কে ‘ইসলামী ঐক্য প্রচেষ্টা’ শিরোনামে পুস্তিকা রচিত হয়। ১৯৯৪ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকাস্থ আল ফালাহ মিলনায়তনে ওলামা-মাশায়েখ সম্মেলনে ইসলামী ঐক্য গঠনের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী হাটহাজারী ও পটিয়া মাদ্রাসার মুহতামিমদ্বয়ের নিকট প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে মুহতামিমদ্বয় কর্তৃক চারদফা প্রস্তাব পেশ করেন। ১৯৯৬ সালে চারদফা প্রস্তাব গ্রহণ করে পত্রের উত্তর প্রদান। ১৯৯৭ সালে খুলনায় অনুষ্ঠিত ওলামা সম্মেলনে ইসলামী ঐক্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হয়। ১৯৯৮ সালের জানুয়ারি মাসে গওহারডাঙ্গা মাদ্রাসার মুহতামিম, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমীরে শরীয়াত ও মহাসচিবের নিকট পত্র প্রেরণ করা হয়। ১৯৯৮ সালে ১৯৭৮ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত ২০ বছর ধরে ইসলামী ঐক্য প্রচেষ্টার ধারাবাহিক বিবরণ দিয়ে ‘ইসলামী ঐক্যমঞ্চ চাই’ নামক পুস্তিকা রচনা।

এছাড়াও ইসলামের খেদমতে তিনি তুরস্ক, ইংল্যান্ড, আমেরিকা সহ একাধিক দেশের সফর করেন এবং অনেকগুলো কাজ করেন।


যুদ্ধাপরাধ বিচারের নামে ওনাকে হত্যা করার পাঁয়তারার সময় গ্রেপ্তারের প্রাক্কালে সাংবাদিকরা যখন জিজ্ঞাসা করেছিল আপনার ভয় করছে না? তিনি জবাব দিলেন, তিনি জবাব দিলেন,ভয়? ভয় কিসের? ইসলামী আন্দোলনের কর্মী হিসেবে শাহাদাতের কামনা করেছি সারা জীবন…আর অন্যায়ভাবে যদি মৃত্যু দেয়া হয় শহীদ হওয়ার গৌরব পাওয়া যায়… আল্লাহকে ছাড়া কাউকে “ভয় করাতো জায়েজই নাই, আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করার অনুমতি নাই।”

গোলাম আযম হয়তো আজকে নেই কিন্তু তিনি রেখে গেছেন তার অসংখ্য উত্তরসূরী। তারা এদেশে ইসলাম কায়েমের জন্য নিজেদের রক্ত বিন্দু পর্যন্ত বিলিয়ে দিতে দ্বিধা করে না। তার অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে এদেশের ইসলামী আন্দোলনের জনশক্তিরা দুর্বার বেগে এগিয়ে চলছে। তিনি হয়তো আজকে জীবিত নেই কিন্তু তিনি অসংখ্য ইসলামী আন্দোলনের জনশক্তিদের হৃদয়ে জায়গা করে আছে। হে আল্লাহ এই মহান কিংবদন্তি মানুষটিকে তুমি জান্নাতুল ফেরদাউস দান করো এবং তার শাহাদাতকে কবুল কর। আমিন।।


লেখক: মুশিউর রহমান
শিক্ষার্থী এবং সংগঠক।।


পঠিত : ৪৩০ বার

মন্তব্য: ১

২০২৫-১১-০১ ২৩:০৮

User
Tareq Aronnyo

কোন পুন্যের জেরে একজন মানুষের নামের শেষে রহমতুল্লাহি আলাইহি এড করা যায়?

submit