Alapon

ট্রুথ ভেইল ২

সবাই কথা বললেও মার্কেল রবিনো একেবারে নিশ্চুপ ছিল। 
মুসা তারিক তার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে আবার বলতে শুরু করল-:"মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর বান্দাদের জন্য খাবারে হারাম-হালালের কিছু বিধান দিয়েছেন । তিনি আমাদের জন্য মৃত জীব, রক্ত, শূকরের গোশত, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নামে জবেহ কৃত , শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আহত হওয়া, ধাক্কা খেয়ে মারা যাওয়া  জীব খাওয়া নিষিদ্ধ করেছেন।
এখানে একটা কথা বুঝে নিতে হবে যে কোন আহারযোগ্য দ্রব্যাদির মধ্যে শরীয়ত যেগুলোকে হালাল- হারাম ঘোষণা করেছেন সেগুলোর হালাল ও হারাম হবার মূল ভিত্তি তাদের ভেষজ উপকারিতা ও অপকারিতা নয় বরং তাদের নৈতিক লাভ ও ক্ষতিই   এর ভিত্তি। প্রাকৃতিক বিষয় গুলো আল্লাহ মানুষের নিজের প্রচেষ্টা, সাধনা, অনুসন্ধানের উপরে ছেড়ে দিয়েছেন। জীবন ও জড় খাদ্য গুলির মধ্যে কোনটি মানুষের দেহে সুখাদ্যের যোগান দিতে পারে এবং কোন খাদ্যটি তার জন্য ক্ষতিকর ও অনুপকার তা উদ্ভাবন ও নির্ণয় করার দায়িত্ব মানুষের নিজের উপর বর্তায়।
এ দায়িত্ব শরীয়ত নিজের কাঁধে তুলে নেয়নি। এ দায়িত্ব যদি শরীয়ত নিজের কাঁধে তুলে নিতো তাহলে সর্বপ্রথম বিষ হারাম বলে ঘোষণা করত । কিন্তু দেখা যায় কোরআন ও হাদীসের কোথাও এর অথবা মানুষের জন্য ক্ষতিকর অন্য মৌলিক ও যৌগিক পদার্থের আদৌ কোনো উল্লেখ নেই।
শরীয়ত খাদ্যে ব্যাপারে যে বিষয়টির উপর আলোকপাত করে এই যে__কোন খাদ্যটি মানুষের নৈতিকতার উপর কি প্রভাব বিস্তার করে, আত্মার পবিত্রতার জন্য কোন খাদ্যটি কোন পর্যায়েভক্ত এবং খাদ্য সংগ্রহের পদ্ধতি গুলোর মধ্য থেকে কোন পদ্ধতিটি মানব ইমান ও প্রকৃতিগত ভুল বা নির্ভুল? যেহেতু অনুসন্ধান চালাবার সাধ্য মানুষের নেই এবং অনুসন্ধান চালাবার জন্য যে উপায় উপকরণের প্রয়োজন তাও মানুষের আয়ত্বের বাহিরে। আর এর জন্য এসব ব্যাপারে মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুল করে বসেছে।তাই শরীয়ত কেবলমাত্র এইসব বিষয়ে মানুষকে পথ নির্দেশ দেয়।
 শরীয়ত যেগুলোকে হারাম গণ্য করেছে সেগুলোকে সেগুলো হারাম করার কারণ হচ্ছে যে মানুষের নৈতিক বৃত্তের উপর সেগুলোর খারাপ প্রভাব বা সেগুলো পবিত্রতা বিরোধী অথবা কোন খারাপ আকিদার সাথে সেগুলোর সম্পর্ক রয়েছে।
পক্ষান্তরে যে জিনিস গুলো কে হালাল করা হয়েছে সেগুলোর হালাল হবার কারণেই যে উপরল্লিখিত দোষ গুলোর মধ্য থেকে কোন একটা দোষেও সেগুলো দুষ্ট নয়।
এখন তোমরা আমাকে প্রশ্ন করতে পারো যেগুলো হারাম করা হয়েছে তা হারাম হওয়ার কারণ আল্লাহ বুঝিয়ে দেন নি কেন ? কারণ বুঝিয়ে দিলে তো সকলে যথার্থ জ্ঞান লাভ করতে পারতো।
আর এর অর্থ হচ্ছে আমাদের পক্ষে কারণগুলো অনুধাবন করা সম্ভব নয়। যেমন শূকরের গোশত বা মৃত জীব, রক্ত  ইত্যাদি আহার করলে আমাদের নৈতিক ভিত্তিতে কোন ধরনের দোষ , কতটুকু, কি পরিমাণে দেখা দেয় সে সম্পর্কে কোন প্রকার অনুসন্ধান চালাবার কোন ক্ষমতাই আমাদের নেই।
কারণ নৈতিকতা পরিমাণ করার কোন উপকরনই আমাদের আয়ত্তাধীন নয়।মহান আল্লাহর হালাল-হারামের সীমানা মেনে চলা তোমার উপর নির্ভরশীল করে দিয়েছেন । যে ব্যক্তি মেনে নেবে যে কুরাআন আল্লাহর কিতাব , মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল এবং আল্লাহকে সর্বজ্ঞ , সবচেয়ে জ্ঞানী বলে স্বীকার করবে  সে তার নির্ধারিত সীমা না মেনে চলবে। এর কারণ বোধগম্য হোক বা না হোক তার পরওয়া সে করবে না।" 
মুসা তারিক দীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে থামলে আন্না লেনা বলল-:" বাহ , আপনি অনেক ভালো বলতে পারেন।"
তারা সকলে এতক্ষণ নিবিড় মনোযোগের সাথে মুসা তারিকের কথা শুনছিলো।
এই প্রথম মার্কেল কথা বলল-:"অনেক সুন্দর বিধান আছে আপনাদের শরীয়তে।"
এরপর মুসা তারিক বলল-:" আরও আছে।"
"তাই নাকি? ভাইয়া, তাহলে আমাদের তাও বলেন।" আর্থার বলল।
মুসা তারিক আবার বলতে শুরু করলো-:"  শিকার করে পশু-পাখি  খাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু বিধান সংযোজন করা হয়েছে।"
"আসল ইসলাম একটা অসাধারন ধর্ম" আন্না লেনা বলল।
মুসা তারিক একটা মুচকি হাসি আবার বলতে শুরু করল-:"পশু পাখি শিকার করার জন্য যে বন্দুক, তীর অথবা যে অস্ত্রের দ্বারা শিকার করা হয় তা নিক্ষেপ করার পূর্বে আল্লাহর নাম নিয়ে নিক্ষেপ করতে হয়। নতুবা শিকার যদি জবেহ করার পূর্বে মারা যায় তাহলে সে শিকার খাওয়া যাবে না।
আবার অনেকে অনেক সময় নিজেদের পোষা প্রাণী দ্বারা শিকার করে । এ সময় যখন পোষা প্রাণীকে শিকারের পিছনে ছেড়ে দেয়া হয় তখন আল্লাহর নাম নিয়ে ছেড়ে দিতে হয় কারণ পোষা প্রাণী হয়তো ধরার সময় শিকারকে মেরে ফেলবে, তখন মারা যাওয়া পানি দিয়ে খাওয়া যাবে না।"
মুসা তারিক কিছুক্ষণ থেমে আবার বলল-:"আর্থার আমাকে আরেকটা প্রশ্ন করেছিল আমি কেন সালাদ আর সাদা পানি ছাড়া অন্যকোন পানি ও খাবার খেলাম না?আসলে আমি খাবারের সাথে সালাদ খেতে খুবই পছন্দ করি । ছোটবেলা থেকে সালাদ আমার প্রিয় খাবার। কিন্তু এখানে না খাওয়ার কারণ হলো ইউরোপিয়ান রেস্টুরেন্টের সালাদ  একটু বেশি স্বাদ , তাই আমি এটা খাই না।"
 তারা সবাই অবাক হয়ে মুসা তারিকের দিকে তাকিয়েছিল। তারা ভাবলো বেশি স্বাধ হবার কারনে কি কোন মানুষ কোন খাবার বর্জন করে?
মুসা তারিক বলল-:"রেস্টুরেন্টের সালাদের সাথে ব্যাকন ফ্যাট অর্থাৎ লবণযুক্ত শুষ্ক শুকরের চর্বি ব্যবহার করা হয় তা আমাদের জন্য হারাম । তাই আমি এসব খাবার খাইনা।
আর পানীয় খাবারের মধ্যে একমাত্র সাদা পানি ছাড়া অধিকাংশ পানির সাথে অ্যালকোহল মেশানো হয়।
আর সর্বশেষ যে কথাটা হচ্ছে সকল রেস্টুরেন্টের অবস্থা না, তবে ইউরোপের কিছু রেস্টুরেন্ট অবস্থা হল এটা। যা আমি এতক্ষণ বর্ণনা করলাম।"
"ভাইয়া আমরা যখন দুপুরের সময় এখানে এসেছিলাম তখন আপনি বাগানের পিছনে গিয়ে যেটা করেছিলেন সেটা কি করেছিলেন?" বলল আন্ন লেনা।
"এটা ছিল আমাদের প্রার্থনা। যেটাকে আমরা নামাজ বলে থাকি।" মুসা তারিক বলল।
"আসলে আমি অনেক মুসলিম কে দেখেছি যারা নিজেদের অবসর সময়ে গল্পগুজবের মধ্যে কাটায়। আর আপনি এই ভর দুপুরবেলা ঘর্মাক্ত, ক্লান্ত অবস্থাতেও প্রার্থনা করতে ভুলেননি। এটা খুবই অবাক করা বিষয়।" আর্থার বলল।
"দেখো, শুধু আমি নয় সকল ধর্মপ্রাণ মুসলমানই সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে। আর নামাজ এটা আমাদের জন্য ফরয , যা পালন করা আবশ্যক।" এটুকু বলে মুসা তারিক কিছু সময় থেমে আবার বলতে শুরু করল-:"এটা ঠিক আমাদের মুসলমানদের মধ্যে অনেকে আছে  যারা অবসরে বসে থাকলেও নামাজ আদায় করেনা।  এটা তাদের গাফিলতি। এর জন্য তাদের অনুশোচনা করতে হবে।"
হঠাৎ মুসা তারিকদের পাশে দুটি মেয়ে চিৎকার করা শুরু করলো। মুসা তারিকরা দৌড়ে সেখানে উপস্থিত হল এবং জানতে পারল মেয়ে  দুটি রাস্তার পাশে হাঁটছিল হঠাৎ একটা ম্যাক্রো থেকে কিছু ছেলে তাদের ভিন্ন শব্দ করে ডাকছিল। শেষে তাদেরকে মাইক্রোতে উঠতে বলে। এটা নিয়ে তর্ক যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এক পর্যায়ে ছেলেগুলো জোর পূর্বক তুলতে চাইলে মেয়ে দুটি দৌড়ে পালিয়ে আসে।
পাশে পুলিশের একটা টহলরত গাড়ি এসে পড়ায় ছেলে গুলো পালিয়ে যায়।সকল ধরনের অন্যায়, অপরাধ এর বিষয়ে জার্মান সরকার খুবই সচেতন। এই ব্যাপারে তাদের নিরাপত্তা বাহিনীও খুব দায়িত্ব জ্ঞান নিয়ে কাজ করে। এখানেও ঠিক তাই হয়েছে।
পুলিশের গাড়ি এসে পড়ায় মেয়ে দুটি বেঁচে গেল। টহলরত ইউনিটৈর কমান্ডার গাড়ি থেকে নেমে মেয়ে দুটিকে দু'একটা প্রশ্ন করে আবার ডিউটিতে ফিরে গেল।
আন্না লেনা তাদের জিজ্ঞেস করল যে তাদের সাথে কি হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন ভয়ে সম্পূর্ণ কাবু হয়ে গিয়েছে।
অন্যজন বলল-:"আমরা একটু ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। পথে এরা আমাদের ডিস্টার্ব শুরু করে।"
মুসা তারিক তাদের অবস্থা দেখে বুঝে ফেলল যে তারা আসলেই খুব ভয় পেয়েছি। আসলে পশ্চিমা সমাজে ব্যাস্থার মধ্যেই এক ধরনের নোংরা আর বেহায়া অবস্থা বিরাজ করছে।
আমেরিকাতে প্রতি ২৭ সেকেন্ডে একজন করে দর্ষণ হয়‌। যা খুবই লজ্জাজনক। অথচ সকালে আমেরিকাকে বলে সোনার হরিণের দেশ অথচ সেখানেই সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। সবাই বলেন থেকে সভ্যতার দেশ অথচ সেখানে প্রায় ৪৩ শতাংশ হলো জারজ সন্তান। তাইতো আমেরিকার এক বিখ্যাত টিভি বিশ্লেষক আর্তনাদ করে বলেছিলেন-:"আমেরিকা বিধাতা অবশ্যই তোমার বিচার করবেন। আর যদি না করেন তাহলে এর জন্য বিধাতাকে ক্ষমা চাইতে হবে কেননা নৈতিক অপরাধ আর লালসা চরিতার্থ করার জন্য তিনি অনেক জাতিকে ধ্বংস করেছিলেন।"
মুসা তারিক মেয়ে দুটির দিকে তাকিয়ে আনমনে ভাবছিল__ "আজ হয়তো এই মেয়ে দুটির বেঁচে গেছে। কিন্তু আরো অসংখ্য মেয়ে আছে যারা মানুষরূপী পশুদের লালসা আর অত্যাচারের শিকার হয়।"
আন্না লেনা সহ বাকিরা মেয়ে দুটির কথা শুনছিল।ততক্ষণে মুসা তারিক আবার বেঞ্চিতে গিয়ে বসলো। সে আবারও ভাবনার জগতে হারিয়ে গেল । 
সে ভাবতে লাগলো__এই পশ্চিমা সমাজের চাইতেও এশিয়ার প্রাচ্যের সমাজব্যবস্থা সভ্যতা অনেক বেশি রক্ষনশীল , অনেক বেশি সমৃদ্ধ , উন্নত , অনেক আদর্শিক। কিন্তু তার তুলনায় পাশ্চাত্যের সমাজ সভ্যতা অনেক বেশি নোংরা আর বেহায়াপনায় ভরপুর । পাশ্চাত্যের জন্মই হয়েছিল পৃথিবীতে নোংরামি, বেহায়াপনা, অপসংস্কৃতির উদ্ভব আর লুটপাট করে খাওয়ার জন্য। আজকে পাশ্চাত্য সমৃদ্ধ হয়েছে প্রাচ্যে উপনিবেশ স্থাপন করে আর আফ্রিকান দাসদের উপর অমানুষিক সব কাজ করিয়ে। 
আমেরিকার মানুষ যখন গোসল করতে শিখিনি তখন প্রাচ্যের মুসলমানরা বিভিন্ন সুগন্ধিযুক্ত সাবান ব্যবহার করে গোসল করতো। প্রাচ্যের ছেলেমেয়েদের মধ্যে এক ধরনের শিষ্টাচার আছে। তারা বড়দের সম্মান করতে জানে , ছোটদের স্নেহ করতে জানে। কিন্তু পাশ্চাত্যের ছেলেমেয়েদের মধ্যে  এর ছিটেফোঁটাও নেই।
মেয়ে দুটোর সাথে কথা শেষ করে আন্না লেনা, আর্টুর আর্থার, মার্কেল রবিনোরা মুসা তারিকের কাছে আসল।
রবিনো বলল-:"মুসা তারিক ভাই, আপনিতো দেখছি নিরিবিলি বসে আছেন !! অথচ সবাই কত হইচই ।"
"কি করব? এমন এ্যাবনরমাল লোকের দৃশ্যতো পাশ্চাত্যের সমাজ অহরহ দেখা যায়। এখানে ও তার পুনরাবৃত্তি।" মুসা তারিক বলল।
মুসা তারিকের কথা শেষ হলে আর্টুর আর্থার বলল-:"ঠিক তাই, এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে।"
মুসা তারিক বলল-:" এই যে তোমার দেখতে চাও পাশ্চাত্যের সমাজে এ্যাবনরমাল লোকের সংখ্যা অনেক বেশি। এখানে কয়েকদিন পরপর শুনতে পাবে নানা বিচিত্র সব ঘটনা।
তোমরা মাঝে মাঝে শুনতে পাবে যে পাশ্চাত্যের কোথাও বিদ্যালয় ক্লাস চলছে আর হঠাৎ কিছু লোক সেখানে ঢুকে কয়েক জনকে গুলি করে, এক পর্যায়ে নিজেকে নিজে গুলি করে হত্যা করে। এই যে এরকম পাগল পাশ্চাত্যে বেশি দেখতে পাও কিন্তু কেন জানো?"
আন্না লেনা বলল-:" আমাদের চাইতে আপনার উত্তরটা অনেক বেশি অসাধারণা  আর তথ্যবহুল হবে। তাই আপনি বলুন।"
মুসা তারিক বলতে শুরু করল-:"এক্ষেত্রে আমার বক্তব্য হচ্ছে এটি প্রধানত দুই কারণে ঘটে। প্রথমটি হচ্ছে ভঙ্গনশীল পরিবার ব্যবস্থা। তোমরা দেখতে পাবে পাশ্চাত্যের অধিকাংশ পরিবারই ভঙ্গনশীল পরিবার। তারা ছোটবেলা থেকে এক ধরনের একাকিত্বের সঙ্গে বসবাস করে আসছে। তাদের কারো বাবা নেই, কারো মা নেই, কারো বাবা মা দুজনের একজনও নেই।এখানে মারা যাওয়ার বেঁচে থেকেও কাছে এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে আর এই দিকটা তাদেরকে ছোট বেলা থেকে হৃদয়বিদারক যন্ত্রণা দেয়। যার ফলে তারা মানসিকভাবে আনফিট হয়ে যায়।আমার এই কথার সাথে পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীরা একমত পোষণ করেন।
মুসা তারিক খানিক থেমে আবার বলতে শুরু করল-:"এছাড়াও আরেকটি কারণ আছে সেটা হল ধর্মহীনতা।পাশ্চাত্যের সমাজে ধর্ম চর্চা নেই বললেই চলে। তাছাড়া পৃথিবীর চারটা বড় ধর্ম ইসলাম , খ্রীষ্টিয়, বৌদ্ধ, হিন্দু এই চারটিরই জন্মস্থান প্রাচ্যে। যদিও অনেকে খ্রিস্টান ধর্ম কে পাশ্চাত্যের বলে দাবি করে কিন্তু এটি শুরু হয় বেথেলহামে যা প্রাচ্যের নগরী।
আর প্রাচ্যের মানুষের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি অনেক বেশি কাজ করে। আর এই ধর্মীয় চেতনার কারণে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমাজের মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য রয়েছে । পাশ্চাত্য সমাজে কোন ধরনের ধর্মীয় চেতনা নেই ফলে তা পশুর সমাজে পরিণত হয়েছে।"
মুসা তারিকের কথা শেষ হলে আর্থার বলল-:" ভাই আপনার কথা পুরোপুরি সত্য।"
"আপনি তো দেখছি একজন দার্শনিক।" মার্কেল রবিনো মুসা তারিককে বলল।
"এটুকু জ্ঞানার্জনের জন্য দার্শনিক হবার প্রয়োজন নেই।" মুসা তারিক বলল।
আন্না লেনা চুপচাপ বসে সকালের কথা শুনছিল। এবার সে বলল-:"মুসা তারিক ভাই, আপনার সাথে একদিনের সাক্ষাতে ইসলাম সম্পর্কে দীর্ঘদিনের কৌতুহলী অনেকটা পূরণ হয়ে গেছে। এখন আমার অনুরোধ হচ্ছে আমি ইসলাম সম্পর্কে আরো বেশি জানতে চাই। আপনি আমাকে কিছু বইয়ের নাম বলেন আমি তা সংগ্রহ করে পড়বো।"
"হ্যাঁ, অবশ্যই তোমার ইচ্ছাকে আমি সমর্থন করি। তোমাদের এখানে কি কোনো ভালো লাইব্রেরী আছে?"মুসা তারিক বলল।
"হ্যাঁ আছে , সেখানে অনেক ইসলামী বইও পাওয়া যায়।" আন্না লেনা বলল ।
"তাহলে তো ভালো। তুমি সেখান থেকে পড়তে পারো। এক্ষেত্রে কোন ধর্ম সম্পর্কে জানতে হলে সর্বপ্রথম সে ধর্মের ধর্মগ্রন্থ পড়তে হবে এবং সাথে সাথে তোমাকে সেই ধর্মের বার্তাবাহকদের জীবনী সম্পর্কে পড়তে হবে অর্থাৎ যাদেরকে আমরা নবী রাসুল বলে থাকি। আর ইচ্ছে করলে তুমি পাশাপাশি কিছু বই পড়তে পারে যেগুলো ইসলামের শরিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা আছে।"। মুসা তারিক বলল।
"হুম আমিও অনেকটা এরকম ধারণা করেছিলাম।"
আর্থার বলল।
"তোমরা চাইলে ইংরেজিতে অনূদিত তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন অথবা তাফহীমুল কুরআন পড়তে পারো। সেখানে আজ সমূহের ব্যাখ্যাসহ রয়েছে। আমি নিজেও সেখান থেকে অধ্যায়ন করি।"
মুসা তারিক বলল।
মুসা তারিকের কথা শেষ হলে আন্না লেনা বলল-:"আমি আপনাদের ধর্মীয় বার্তা বাহক অর্থাৎ রাসুল সাঃ এর জীবনীর উপর লেখা বই পড়েছিলাম। আমি আসলেই মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমি এখন আরো পড়তে চাই।"
"আচ্ছা, তুমি প্রথমত কোরআন টা একটু পড়ো। যেমন সূরা নূর, সূরা হুজুরাত , সূরা নিসা ইত্যাদি। এছাড়াও তুমি শেষ অংশ অর্থাৎ ২৯/৩০ নং পারা পড়তে পারো। তবে কোরআন শরীফ এর পুরোটাই আল্লাহর নিয়ামত। তুমি চাইলে সম্পূর্ণ অংশ পড়তে পারো।"মুসা তারিক , আন্না লেনাকে বলল‌
"আচ্ছা আজ আমি আর আর্থার লাইব্রেরীতে গিয়ে কোরআন শরীফের একটা তাফসির সংগ্রহ করবো।"আন্না লেনা বলল।
এরপর মুসা তারিক রবিনোর দিকে তাকিয়ে বলল-:"চল, রবিনো তুমি আজ আমাকে জার্মানীর বড় মসজিদ নিয়ে যাবে ।সেখানে আসরের নামাজ পড়বো।"
মুসা তারিকের কথা শেষ হলে আর্থার বলল-:"ঠিক আছে, তাহলে আপনারা সেদিকে যান । আমি আর আন্না লেনা লাইব্রেরীতে যাব।"
যাওয়ার সময় আন্না লেনা মুসা তারিককে বলল-:"ভাইয়া আগামীকাল দেখা হবে।"
"আচ্ছা ঠিক আছে।"মুসা তারিক বলল।
কিছুক্ষণের মধ্যে যে যার গন্তব্যে চলে গেল।
মার্কেল রবিনো গাড়ি ড্রাইভ করছিল। মাঝে মাঝে দু'একটা কথা বলছিল। এক পর্যায়ে রবিনো মুসা তারিককে বলল-:"আমি এতদিন অনেকটাই ধর্মবিমুখ ছিলাম। মনে করতাম গাছগাছালি যেমন জন্মায় আর মরে যাই ঠিক আমাদেরও তাই হবে। কিন্তু এখন বুঝেছি আসলে আমি ভুলভ্রান্তির মধ্যে বসবাস করেছিলাম।"
মুসা তারিক বলল-:"আসলে গাছগাছালি আর আমাদের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। গাছ-গাছালিরা জন্মায় আর মরে, এটুকুতে শেষ। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ।মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত।"
মার্কেল রবিনো মুসা তারিককে জিজ্ঞেস করল-:"গাছপালা আর মানুষের মধ্যে এই পার্থক্য কেন?"
"এই যে গাছপালার দেখার জন্য চোখ নেই , শোনার জন্য কান নেই , চিন্তা করার জন্য মাথা নেই , অনুভব করার মন নেই, আমাদের মত পরিবার নেই, সমাজে নেই, রাষ্ট্র নেই‌।কিন্তু মানুষের সবকিছু আছে সুতরাং আমাদের একটা ভবিষ্যৎ আছে। আর বর্তমানের কাজের উপর সে ভবিষ্যৎ নির্ভর করে।" মুসা তারিক বলল।
"ভাই, আপনি একজন ধর্ম প্রচারক হলে অনেক ভালো মানাতো। আপনার উপস্থাপনা অতি চমৎকার।" রবিনো মুসা তারিককে লক্ষ্য করে বলল।


ফজর নামাজ শেষে মুসা তারিক তার প্রতিদিনের রুটিন অনুযায়ী কুরআন অধ্যয়ন করে একটু ব্যায়াম করতে বের হলো।
মুসা তারিক হোটেলের পাশের বাগানটিতে হালকা গতিতে দৌড়াচ্ছিল। হঠাৎ তার দৃষ্টি পড়লো আমাদেওসের উপর। সেও বাগানের এক কোণে ব্যায়াম করছিল।
 আমাদেওসের সাথে মুসা তারিকের দেখা হয়েছিল গতকাল রাতে। সে থাকে মিউনিখ শহরে কিন্তু অফিসের একটা জরুরী কাজে তাকে বার্লিনে আসতে হলো।
মুসা তারিক যখন রাতে ডিনার করতে নিচে নামল তখন আমাদেওসও এসেছিল খাবার খাওয়ার জন্য। সেখানে তাদের পরিচয় হয়। অল্প সময়ে এই মুহূর্তে তারিক আমাদেওসের সাথে একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলে। আর এটা সম্ভব হয় মুসা তারিকের অমায়িক আর মার্জিত ব্যবহারের মাধ্যমে।
মুসা তারিক তার কাছে এসে বলল-:"হাই!!আমাদেওস।"
আমাদেওসও তাকে দেখে বলল-:"কি খবর ? মুসা তারিক।"
"এইতো একটু হাঁটতে বের হলাম।" মুসা তারিক বলল।
"চল আমরা বাগানের দোলনায় গিয়ে বসি।"  আমাদেওস বলল।
মুসা তারিকও তাকে বলল-:"চলো যাই।"
দোলনায় বসে আমাদেওস একজনকে ডেকে কিছু কোমল পানীয়  আনার জন্য বলল।
 বাগানে হোটেলের কর্মচারীরা থাকে যারা হোটেলে অবস্থানরত লোকদের বিভিন্ন সেবা দিয়ে থাকে।
আমাদেওস মুসা তারিকের দিকে তাকিয়ে বলল-:"খুব গরম লাগছে। আশা করি আপনি কোমল পানীয় খেতে পছন্দ করবেন।"
"না , আসলে আমি কোন কোমল পানীয় খেতে পছন্দ করি না । শুধু হাতে তৈরি করা ফলের জুস ছাড়া।" মুসা তারিক আমাদেওসকে বলল।
"আচ্ছা আমি তাহলে ফলের জুস অর্ডার করছি।"এটা বলে আমাদেওস দুই গ্লাস আমের জুস অর্ডার করলো।
তারপর আমাদেওস মুসা তারিককের দিকে তাকিয়ে বলল-:"কি ব্যাপার , আপনি কোমলপানীয় কে পছন্দ করেন না কেন? প্রায় সবাই এটাকে পছন্দ করে। কিন্তু আপনি কেন এর ব্যতিক্রম? নাকি এতে আগে থেকে অভ্যস্ত নন?"
"আসলে তেমন কিছু না। মূলত কিছু শারীরিক ও ক্ষতিকর দিক থাকায় এটাকে পছন্দ করি না। অবশ্য আমি এক সময় এটাকে খুব পছন্দ করতাম । বিশেষ করে ছোটবেলা প্রচুর পরিমাণ জুস খেতাম ।কিন্তু এখন আর খাই না।"মুসা তারিক আমাদেওসকে বলল।
"তাই নাকি। আচ্ছা আপনি যে শারীরিক ক্ষতির দিক এর কথা বলেছেন এ ব্যাপারে একটু বিস্তারিত বললে ভাল হতো।" আমাদেওস বলল।
ততক্ষণে ছেলেটি দুই পট আমের জুস নিয়ে এলো। তারা দুজনে দুই পাট নিয়ে নিলো এবং খেতে শুরু করল।
এরপর মুসা তারিক আবার বলতে শুরু করল-;" এই যে, দোকানে যে সকল কোমল পানীয় বিক্রি হয় বলতে গেলে তার অধিকাংশই এমনকি সম্পূর্ণটাই আমাদের জন্য অর্থাৎ মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। কোমল পানীয় পানের মাধ্যমে আমরা নিজের অজান্তেই নিজেদের ক্ষতি সাধন করছি। সাধারণত  বাজারে যে সকল কোমল পানীয় পাওয়া যায় তা সকলের কাছে খুবই ভালো লাগে কারণ এতে ক্যাফেইন , এলকোহল , এপিয়েট ইত্যাদি যোগ করা হয়।ফলে এই সকল উপাদান আমাদের মস্তিষ্ক উত্তেজিত করে আর তাই এটা আমাদের দেহে এক ধরনের অনুভূতি সৃষ্টি করে ।আসলে এটি সাময়িক ভালো লাগলেও আমাদের জীবনের জন্য এক হুমকি স্বরূপ।"
একটু থেমে মুসা তারিক আবার বলতে শুরু করল-: "এই কোমল পানীয়তে ক্যারামেল কালার ব্যবহার করা হয় যা কারসিনোজেন হিসেবে কাজ করে। আর কারসিনোজেন হলো ক্যান্সার সৃষ্টিকারী পদার্থ। অর্থাৎ কোমল পানীয় ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়াও কোমল পানীয়তে রয়েছে প্রক্রিয়াজাত চিনি যা ডায়াবেটিস ও স্থূলতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। আর এই প্রক্রিয়াজাত চিনি মুখের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ভেঙ্গে এসিড তৈরি করে যা দাঁত ক্ষয় এর মূল কারণ।'মেটাবলিক সিনড্রোম' বা বিপাকীয় প্রক্রিয়ার বিভিন্ন সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়। যা হৃদরোগের কারণ। যারা নিয়মিত কোমল পানি খায় তাদের হৃদরোগের ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি। এছাড়াও কোমল পানীয়তে আরো অনেক ক্ষতিকর দিক রয়েছে । যেমন কোমল পানীয়তে রয়েছে ফসফরিক অ্যাসিড যা ক্যালসিয়াম মেটাবলিজমে বাধা দেয় এবং হাড় ক্ষয়  ত্বরান্বিত করে। এছাড়াও ফসফোরিক এসিড় মূত্রনালীর বিভিন্ন সমস্যা তৈরি এবং কিডনি রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।"
মুসা তারিকের কথা শেষ হলে আমাদেওস দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল-:" হুম, আসলে এটা আমাদের জন্য অনেক ক্ষতিকর। আমাদের উচিত এ কোমল পানীয় পরিহার করা।"
এরপর মুসা তারিক তাকে আবার বলল-:" সম্প্রতি একটি গবেষণায় আরও একটা আশঙ্কাজনক তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।"
"তাই নাকি, কি সেটা?"আমাদের সমস্যা তারিককে বলল।
"সেই গবেষণায় জানা গেছে, প্রচলিত কোমল পানীয়তে প্রচুর পরিমাণ কীটনাশক পাওয়া গেছে। যা আমাদেরকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছে ।আর সেই কীটনাশকের পরিমাণ তারা উল্লেখ করেছে__ সেভেন আপ-১২.৫% মিরিন্ডা -২০.৭% কোক-৯.৮%পেপসি-১০.৯% থামস আপ৭.২% মোজো-১৯.৩ %স্প্রাইট - ৫.৩% ফ্রুটো-২৪.৫%।এছাড়াও কোকাকোলা এবং পেপসি  কোলাতে পাওয়া গেছে সীসা ও ক্যাডমিয়াম এর মত বিষাক্ত ধাতু, যা ক্যান্সারের জন্য দায়ী । স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা পানীয় হচ্ছে লেবুর জুস, আখের রস, ডালিমের রস , টমেটোর জুস ইত্যাদি।"‌ দীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে থামল মুসা তারিক।
"ধন্যবাদ আপনাকে। অল্প সময়ে আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু জানার সুযোগ হয়েছে। আপনার অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় কথা বলছেন।"আমাদেওস মুসা তারিককে বলল।
"আপনাকেও ধন্যবাদ। কথা বলে ভালো লাগলো। আবার দেখা হবে। আমি এখন উঠছি" মুসা তারিক বলল।
"আচ্ছা ঠিক আছে।" আমাদেওস বলল।
মুসা তারিক রুমে এসে স্পোর্টস ড্রেস খুলে ফ্রেশ হয়ে বসল। বসে বসে কফি তৈরি করছিল। হঠাৎ তার রুমের দুই রুম পরের রুমের সামনে হইচই শুরু হলো। 
মুসা তারিক রুম থেকে বেরিয়ে দেখলো একজন  লোক উচ্চস্বরে একজন হোটেলবয় কে শ্বাসাচ্ছিল।
মুসা তারিক দেখল আন্না লেনা ও আর্টুর আর্থার এসেছে। তারাও দাঁড়িয়ে দেখছিলাম লোকটির কান্ড। তখন হোটেল ম্যানেজার এসে দুজনকে বুঝিয়ে কোনমতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করল।
মুসা তারিক আর্টুর আর্থার আর আন্না লেনা তিনজনেই মুসা তারিকের রুমের সামনের বেলকনি গিয়ে বসলো।
মুসা তারিক বসে আবার উঠে রুমে গিয়ে তিনজনের জন্য তিন কাপ কফি আনলো।
কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে মুসা তারিক জিজ্ঞেস করল-:" এখানে মূলত কি হয়েছে ? আমি শেষে এসেছিলাম তাই তেমন কিছু বুঝতে পারলাম না।"


( চলবে ).........
( বি. দ্র. : এই লেখাটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। এর সাথে বাস্তবের কোন ব্যক্তি, স্থান বা কারো সম্পৃক্ততা কিংবা মিল নেই। - লেখক )

লেখক - মুশিউর রহমান
শিক্ষার্থী এবং সংগঠক।।

পঠিত : ১৯৬ বার

মন্তব্য: ০