Alapon

ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা: একটি পর্যালোচনা



সাইয়েদ কুতুব শহীদ রচিত "ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা" সমকালীন ইসলামী চিন্তাধারায় এক প্রভাবশালী গ্রন্থ। বইটি শুধু তাত্ত্বিক আলোচনা করেনা, বরং মুসলিম বিশ্ব ও পশ্চিমা সমাজের সম্পর্ককে প্রভাবিতকারী এক সুদূরপ্রসারী কর্মপরিকল্পনার রূপরেখাও প্রদান করে। লেখকের লেখার শৈলি , প্রখর যুক্তি এবং একটি আদর্শ ইসলামী সমাজের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা পাঠককে আলোড়িত করবে।

গ্রন্থটির সমকালীন জাহেলিয়াতের (ইসলাম-পূর্ব অজ্ঞতার যুগের মতো অবস্থা) ধারণা এবং এর বিপরীতে একটি বিপ্লবী ইসলামী সমাজের অপরিহার্যতাদিক তুলে ধরে। সাইয়েদ কুতুব মনে করেন, বিংশ শতাব্দীর আধুনিক সমাজ তার বস্তুগত উন্নতি সত্ত্বেও আধ্যাত্মিক ও নৈতিক দিক থেকে গভীর সংকটে নিমজ্জিত। পশ্চিমা সেক্যুলারিজম, জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতন্ত্রের মতো মতাবাদ গুলো মানুষের মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে ব্যর্থ হয়েছে এবং ফলস্বরূপ সমাজে শোষণ, অবিচার ও নৈতিক অবক্ষয় বিস্তার লাভ করেছে।

এই প্রেক্ষাপটে, সাইয়েদ কুতুবের প্রস্তাব হলো একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, যা কেবল ব্যক্তিগত ইবাদতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং সমাজের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোকেও ইসলামী নীতি ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে ঢেলে সাজাবে। তিনি মনে করেন, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব (হাকিমিয়্যাহ) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই ন্যায়বিচার, সাম্য ও শান্তি নিশ্চিত করা সম্ভব। এই লক্ষ্যে একটি সচেতন ও বিপ্লবী মুসলিম জামাতের আত্মপ্রকাশ জরুরি, যারা জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক ও কার্যত সংগ্রাম পরিচালনা করবে।



"ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা" বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত:

কোরআন ও সুন্নাহর বিপ্লবী ব্যাখ্যা: সাইয়েদ কুতুব কোরআন ও সুন্নাহর একটি বিপ্লবী ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তিনি কেবল ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আয়াত ও হাদিস পাঠের পরিবর্তে সমকালীন সমাজের সমস্যা সমাধানে এর অন্তর্নিহিত বিপ্লবী চেতনাকে তুলে ধরেন। জিহাদ, হিজরত ও শাহাদাতের মতো ধারণাগুলোকে তিনি বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পুনর্সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন।

জাহেলিয়াতের ধারণা: সাইয়েদ কুতুবের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হলো "জাহেলিয়াত"। তিনি কেবল ইসলাম-পূর্ব আরব সমাজকেই জাহেলিয়াত হিসেবে দেখেন না, বরং আধুনিক পশ্চিমা বিশ্ব এবং মুসলিম বিশ্বের অনেক অংশকেও এই ধারণার অন্তর্ভুক্ত করেন। তার মতে, যেখানে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত নয় এবং মানুষের তৈরি আইন ও রীতিনীতি অনুসরণ করা হয়, সেটাই জাহেলিয়াত।

হাকিমিয়্যাহ (আল্লাহর সার্বভৌমত্ব): সাইয়েদ কুতুবের চিন্তাধারার কেন্দ্রবিন্দু হলো আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ধারণা। তিনি মনে করেন, আইন প্রণয়নের একমাত্র অধিকার আল্লাহর এবং মানুষের কাজ হলো সেই আইনের আনুগত্য করা। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নিজস্ব আইন প্রণয়নের অধিকার নেই।

একটি বিপ্লবী জামাতের প্রয়োজনীয়তা: সাইয়েদ কুতুব একটি বিপ্লবী মুসলিম জামাতের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন, যারা সমাজের নেতৃত্ব গ্রহণ করে ইসলামী বিপ্লবকে সফল করবে। এই জামাত হবে আদর্শবান, ত্যাগী এবং আল্লাহর পথে সংগ্রামকারী।

জিহাদের তাৎপর্য: সাইয়েদ কুতুব জিহাদকে কেবল আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ হিসেবে দেখেন না, বরং আল্লাহর পথে সার্বিক সংগ্রাম হিসেবে ব্যাখ্যা করেন, যার মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক ও প্রয়োজনে সশস্ত্র সংগ্রামও অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।

শক্তিশালী দিক:"ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা" বেশ কিছু শক্তিশালী দিকের জন্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য:
১।সমকালীন সমাজের তীক্ষ্ণ সমালোচনা: সাইয়েদ কুতুব আধুনিক সমাজের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সংকট এবং পশ্চিমা মতাদর্শগুলোর ব্যর্থতা অত্যন্ত জোরালোভাবে তুলে ধরেছেন।

২।ইসলামের একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে উপস্থাপন: গ্রন্থটি ইসলামকে কেবল কিছু আচার-অনুষ্ঠানের সমষ্টি হিসেবে না দেখে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হিসেবে উপস্থাপন করে, যা মানুষের জীবনের সকল দিককে নির্দেশনা দিতে সক্ষম।

৩।বিপ্লবী চেতনার উন্মোচন: সাইয়েদ কুতুবের লেখায় একটি শক্তিশালী বিপ্লবী চেতনা বিদ্যমান যা একটি ইসলামি সমাজ বিনির্মাণের জন্য উপযুক্ত মানুষ তৈরি এবং বিপ্লবী কর্মপন্হা নির্ণয়ে সহায়ক।


"ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা" নিঃসন্দেহে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী চিন্তামূলক গ্রন্থ। এটি মুসলিম বিশ্বে ইসলামী পুনর্জাগরণ এবং রাজনৈতিক ইসলামের উত্থানে একটি significant ভূমিকা/আবেদন রেখে চলেছে। বইটি একই ভাবে তার প্রাসঙ্গিকতা বজায় রেখে চলেছে যেভাবে তার শুরুর দিনে ছিল। সাইয়েদ কুতুবের ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে উপস্থাপন এবং তার বিপ্লবী চেতনা মুসলিম বর্তমান পথভোলা মুসলিম যুবক দের একটি নতুন পথের সন্ধান দিচ্ছে।

পরিশেষে বলা যায়, "ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা" সমকালীন ইসলামী চিন্তাধারাকে বুঝতে এবং একটি আদর্শ ইসলামী সমাজের স্বপ্ন দিয়ে যারা কাজ করেন তাদের জন্য বইটি একটি আলোকবর্তিকা। এই গ্রন্থটি এই উম্মুাকে আদর্শের প্রতি দৃঢ় হতে অনুপ্রাণিত করতে যাচ্ছে।


সাইয়েদ কুতুবের "ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা" গ্রন্থটি একটি গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক কাজ, যা আধুনিক ইসলামী চিন্তাধারাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।

লেখকের সম্পর্কে:
সাইয়েদ কুতুব (১৯০৬-১৯৬৬) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর একজন প্রভাবশালী মিশরীয় ইসলামী চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক কর্মী। তিনি প্রথমে একজন প্রগতিশীল সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে ইসলামী আন্দোলনের দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের একজন গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক নেতায় পরিণত হন। তার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ১৯৫০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ, যা পশ্চিমা সমাজের বস্তুবাদিতা ও আধ্যাত্মিক শূন্যতা সম্পর্কে তার ধারণাকে আরও দৃঢ় করে। জামাল আবদেল নাসেরের শাসনামলে মুসলিম ব্রাদারহুডের উপর দমন-পীড়ন এবং তার নিজের কারাবন্দী জীবন তার চিন্তাভাবনাকে আরও বিপ্লবী ও কঠোর করে তোলে। "ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা" মূলত এই প্রেক্ষাপটেই রচিত, যেখানে তিনি একটি নিপীড়িত মুসলিম জনগোষ্ঠীর মুক্তির দিশা এবং একটি আদর্শ ইসলামী সমাজের blueprint তৈরি করতে চেয়েছিলেন।

বই:ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা
_সাইয়েদ কুতুব শহীদ
_আফনান খান সিয়াম

পঠিত : ৬৯ বার

মন্তব্য: ০