Alapon

আমি চোর, ডাকাত আর কখনোবা সিঁদেল চোর!

রাত তখন ৯টা! সন্ধ্যায় এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। আর যেদিন বৃষ্টি হয় সেইদিন এই শহরের রিক্সাওয়ালারা কেমন জানি ভিনগ্রহের প্রাণী হয়ে যায়!

গুনে গুনে পনেরোটা রিক্সাওয়ালাকে বললাম, যাবেন?
বিরক্ত মাখা উত্তর, নাহ!
তার উত্তর দেবার ভঙ্গিমায় কেন যেন মনে হল, কোনো এক কালে আমি তার পাকা ধানে মই দিয়েছিলাম!

যাগ গে! যখন হতাশ হয়ে ভগ্ন মন নিয়ে এগারো নাম্বার গাড়ি অর্থাৎ পা দুখানি দিয়ে গন্তব্যের পানে হাঁটা শুরু করতে যাবো তখনই পিছন থেকে এক রিক্সাওয়ালা ভাই বললেন- যাইবেন কই?

ভাড়া ১০ টাকা বেশি চাইলেও আপত্তি করলাম না! বৃষ্টিমুখর রাতে এভাবে রিক্সা পাওয়া যে কতোটা ভাগ্যের ব্যাপার তা এই শহরের প্রায় প্রতিটি মানুষই জানে!

রিক্সায় উঠলেই কেন জানি গুনগুনিয়ে গান গাইতে ইচ্ছে করে। বরাবরের মতই গান গাচ্ছিলাম আর কিছুটা নির্জন শহরের সৌন্দর্য খাচ্ছিলাম। রিক্সাওয়ালা ভাই বললেন- ভাইজানের মনটা মনে হয় খুবই ভালো। বিরাট আনন্দে আছেন মনে হচ্ছে!
গান গাওয়া বন্ধ করে বললাম- নাগো ভাই! মনটা ভীষণ খারাপ। ইদানিং কিছু লিখতে পারি না। মাথা থেকে লেখা-টেখা বেরোয় না। তাই মনখারাপের চোটে গান গাইতেছি।

তিনি আবারও পাল্টা প্রশ্ন করলেন- লেখা-টেখা বেরোয় না কেন?
বললাম- পাপ! পাপ বেশি হয়ে গেছে। তাই মাথায় খালি ‍দুষ্টামো ঘোরে, সাহিত্য ঘোরে না। সাহিত্য মাথা থেকে পলাইগেছে!

খানিকটা পথ আসার পর মাঝপথে দেখলাম, এক ডাব বিক্রেতা ল্যাম্পপোষ্টের নিচে বিরশ মনে ভ্যান ভর্তি ডাব নিয়ে বসে আছে। বৃষ্টিটা না হলে তাকে নিশ্চয়ই এমন বিরশ মনে বসে থাকতে হতো না। ডাব কাটায় ব্যস্ত থাকতে হতো। কেন জানি না, তাকে কিছুটা ব্যস্ত করতে ইচ্ছে হল।
রিক্সাওয়ালাকে বললাম- ডাবওয়ালার ওখানে গিয়ে দাঁড়ান ।

ডাবওয়ালাকে বললাম- একটা বিরাট নারিকেলওয়ালা ডাব কাটেন তো। পানি সবটুকু আমিই খেলাম। তারপর ডাব দুভাগ করে একভাগ রিক্সাওয়ালাকে দিলাম। অর্থেক ডাবটা হাতে নিতে নিতে তার দুচোখ কেমন জানি চকচক করে উঠল। আমি প্রায়শ খেয়াল করেছি, মানুষের চোখ চকচক করে দুই সময়ে। এক, যখন বিরাট দুঃখ পায়। দুই, যখন অপ্রত্যাশিত ভাবে বিরাট খুশির সংবাদ পায়। ডাব খাওয়াটা তার জন্য হয়তো বিরাট আনন্দেরই ব্যাপার ছিল।

ডাবের নারিকেল খাওয়া শেষ করে ফুলে যাওয়া পেটটাতে হাত বুলাতে বুলাতে বললাম- ডাবের অর্থেক খাওয়ালাম বলে আবার আমাকে ফেরেশতা ভাববেন না। আমি ফেরেশতা নাহ! আমি ইবলিশ শয়তানের সাক্ষাৎ ছোট ভাই। আমার মত বদ এবং শয়তান স্বয়ং ইবলিশ ছাড়া দ্বিতীয়টা দেখি নাই। অতএব মামলা ডিশমিশ। 
বাড়িতে গিয়া খবরদ্দার বউ, বাচ্চা, দ্বারাপরিবারের কাছে ডাব খাওয়ার গল্প করবেন না!

সে খানিকটা হতভম্বের চাহুনিতে আমার দিকে চেয়ে রইল! তারপর অনেকক্ষন ধরে রিক্সাওয়ালা বেশ চুপচাপ। এরই মাঝে আমি দুইটা গানের ভুলভাল রিলিক দিয়ে সঙ্গিত চর্চা মোটামুটি সমাপ্ত করেছি।

এরপর রিক্সাওয়ালা ভাই বললেন- আপনি করেন কী?
বললাম- ছিনতাই করি! মাঝে মাঝে ডাকাতিও করি। তবে সিঁদেল চোর কইলেও আপত্তি করব না।

সে এবার পুরোটাই স্টপ হয়ে গেল!

প্রশ্ন করলাম, বাড়িতে আছে কে? ছেলেমেয়ে কয়জন?
বললেন- বউ আছে। আর এক মেয়ে আছে। বড় দুই মেয়ের বিবাহ হয়ে গেছে। 
মেয়ে কিসে পড়ে?
বললেন- ক্লাস টেনে পড়ে। এইবার এস.এস.সি দিবে। দোয়া কইরেন।

রিক্সা থেকে যখন নামলাম তখন তার হাতে ভাড়ার টাকার সাথে সাথে নিমাই ভট্টাচার্যের ‘মেমসাহেব’ বইখানি ধরিয়ে দিলাম। তারপর বললাম- আপনার মেয়েকে এই বইটা আমার পক্ষ থেকে উপহার দিলাম। অবশ্যই পড়তে বলবেন। আর দোয়া দিলাম, সে যেন কোন পুরুষের জীবনের সত্যিকারের মেমসাহেব হতে পারে!

ফিরে আসার জন্য পথ ধরেছি। রিক্সাওয়ালার দিকে ফিরে দেখি সে বইখানির দিকে ভয় মাখানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ফিরে গিয়ে বললাম- বললাম না আমি ছিনতাকারী, ডাকাত এবং সিঁদেল চোর!

আমি কাউকে কাউকে প্রশ্ন করতে করতে ত্যক্ত বিরক্ত করে ফেলি! কারণ, তার জ্ঞানগুলো আমি ছিনতাই করতে চাই।

আমি কারও কাছ থেকে বই পড়তে নিলে, তা সহজে আর ফেরত দেই না। ফেরত দেবার অভ্যাস কম। তাই আমি ডাকাত।

আর সিঁদেল চোর! মানুষের সঙ্গে কথা বলিই চুরি করার জন্য! জ্ঞান চুরি করার জন্য। আপনার কাছ থেকেও কিছু জ্ঞান চুরি করে মনের আনন্দে এখন বাড়ি ফিরছি!

আজ আসছি। আমার ভাগ্য ভালো হলে আর আপনার ভাগ্য খারাপ হলে আবারো আমাদের দেখা হবে, ইনশা আল্লাহ! সেদিনও কিন্তু আপনার জ্ঞাস চুরি করব। জ্ঞান চুরির অপেক্ষায়...


পঠিত : ৯০৯ বার

মন্তব্য: ০