Alapon

চিত্তাকর্ষণ

সুবিত্রা লক্ষ্মীর বড় ছেলেটা অ-নে-ক-দি-ন কোন খোঁজ নিচ্ছেনা।মেয়েটারও বিয়ে হয়েছে বছরখানেক।স্বামীর পেনশনের টাকা থেকে বড় ছেলেকে ডাক্তার বাবু হতে অধিকাংশটাই খরচ হয়ে গেছে।মেয়েটাকে বিয়ে দেয়ার জন্য যে অল্প আধটু জমিয়ে রেখেছিলেন তা সে সময়ই শেষ।আর এখন যে যুগ(!) ছেলে-সন্তানের বিয়ে মানেই অঢেল টাকার জোর।আর যদি শ্বশুরঘর নির্দয় হয় তাহলেতো পুরো জীবনই বেয়ে বেড়াতে হয় আধুনিক পাশবিকতার আহ্লাদী আপ্যায়ন।সুবিত্রা লক্ষ্মীর মেয়েটারও একই দশা হয়েছে।বিয়ের পর থেকে জামাই বাবুর আবদারে এটা না ওটা দিতেই হয়।এইতো কয়দিন আগেই মেয়েটাকে মেরে ঘর থেকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে।-বলে দিয়েছে ও ঘরে থাকতে হলে ২০হাজার টাকা নিয়েই ঘরে ফিরতে হবে।সুবিত্রা'র দুধাল গাভীটি তখন বিক্রি করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিলনা।এই গাভীর দুধ আর বাড়ির আঙিনায় রোপন করা পেঁপে গাছ থেকে পেঁপে বিক্রি করেই চলছিলেন এ দিনগুলো।মেয়ের সুখের জন্য তা'ই করলেন। ২০ হাজার টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে কপালে একটা আদরের চুম্বন এঁকে দিয়ে বিদায় দিলেন।

শান্তিনগর গ্রাম।দেশ বিভাগের পর খুব অল্প হিন্দু পরিবার এ গ্রামে বসবাস করে।তারমধ্যে হিরো বাবু'র পরিবার অন্যতম।হিরো বাবু'র বাবা শ্যামল বাবু হোমিওপ্যাথী ডাক্তার হিসেবে আশেপাশের গ্রামগুলোতে বেশ খ্যাতি পেয়েছিলেন। সাথে মানুষের সাথেও বেশ সখ্যতা ছিল তাঁর।তিনি মারা যাবার পর তাঁর ছেলে হিরো বাবু শান্তি নগর স্কুলের গণিতের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান।হিরো বাবু'র এক ছেলে এক মেয়ে।সুভ্রত আর সুষমা।বড় ছেলেকে আইএ পাশ করানোর পর পরই হার্টএটাকে মারা যান তিনি।এরপর থেকে সুভ্রত ও সুষমাকে নিয়ে জীবন সংগ্রাম শুরু করেন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী সুবিত্রা লক্ষ্মী।সুবিত্রা স্বামীর আদর্শে প্রভাবিত।খুব আত্মসম্মানবোধ সম্পূন্ন মহিলা।শত দুঃখ কষ্টেও কাউকে কিছু বলতেন না।আর তাদের আশেপাশে সকল মুসলিম পরিবার হওয়াতে কোন কিছু কারও সাথে শেয়ার করতেও সংকোচবোধ করতেন।যদিও তাঁর মধ্যে মুসলমানদের জন্য বেশ আন্তরিকতা,
মন থেকে কি একটা টান অনুভব করেন তিনি। তাঁর স্বামীর কাছ থেকেও এ জাতির ব্যাপারে সব সময় ভাল কথাই শুনতেন।এই যে, এত এত বছর ধরে তারা একটা পরিবার'ই এ গ্রামে আছে তাদের সাথে কেউ কখনো খারাপ আচরণ করেনি।কষ্ট দেয়নি।তাদের মেয়ে-ছেলে মুসলিম ছেলে-মেয়েদের সাথে মিশেই বড় হয়েছে।সুষমা'র সবচেয়ে কাছের বান্ধবী সুমাইয়া।গ্রামের মাতব্বরের মেয়ে।সুভ্রত'র বাবা মারা যাবার পর সুমাইয়া অনেক দিক থেকেই তাদের সসহযোগিতা করে।সুমাইয়ার মাঝে তাদের ধর্মের অনেক ভাল ভাল গল্পও শোনত সু্ষমা।পাকঘর থেকে অনেক সময় সুবিত্রাও কান পেতে শুনতেন এসব।এইতো ক'দিন আগে সুষমাকে তাঁর শ্বশুর বাড়ি থেকে পাঠিয়ে দিয়েছে শুনে সুমাইয়া খুব তটস্থ ছিল।সুবিত্রা লক্ষ্মী ও সুষমাকেও শান্তনা দিয়েছে।বলেছে-"আল্লাহ যা করেন ভাল'র জন্যই করেন।হয়ত এতেও আপনাদের জন্য ভাল আছে।"সুবিত্রা প্রায়ই সুমাইয়ার এমন ইশ্বর বিশ্বাসে আশ্চর্য হন।যদিও তাঁর স্বামীও বিপদে পড়লে ইশ্বরের ওপর বেশ বিশ্বাস রাখতেন।

তহুর আলী মাতব্বরের বাড়িতে মসজিদের হুজুরকে ডাকা হয়েছে।কয়দিন পরই রোজার মাস। এর আগেই যাকাতের সকল টাকা বন্টনের বিষয়টি শেষ করতে চান মাতব্বর সাহেব।হুজুর সকালের খাবার খেয়ে চাটাইয়ে বসে মাতব্বর সাহেবের সাথে যাকাতের খাতগুলো নিয়ে কথা বলছিলেন।মাতব্বুর সাহেব মুখের বাম দিকে আয়েশ করে পানের খিলিটি ভরে দিয়ে পাশে রাখা হুক্কায় একটা টান দিয়ে জিজ্ঞেস করলেনঃ
মৌলভী সাব,আপনার এতিম-মিসকিন এগুলো বুঝলাম,কিন্তু এইযে চিত্তাকর্ষণ করার জন্য যাকাত দেয়ার বিষয়টি বুঝলাম না।এবার মসজিদের হুজুর একটু নড়ে বসলেন।হালকা আওয়াজে গলাখাকারী দিয়ে কথা শুরু করলেনঃমাতব্বর সাবঃআমাদের সমাজে কিছু বিধর্মী পরিবার আছে।যারা ইসলামের ব্যাপারে দুর্বল।তাদের ছেলে-মেয়েকে বিবাহ দিতে পারেনা অর্থের কারণে। আবার আত্মসম্মানের কারণে কারও কাছে হাতও পাতে না।এমন কিছু পরিবারকে যাকাতের টাকা দেয়া যায়। যার ফলে সেই পরিবার ইসলামের প্রতি খুশি হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে ফেলতেও পারে।মাতব্বর সাহেব আর হুজুর যখন কথা বলছিলেন তখন সুমাইয়া পর্দার আড়াল থেকে তাদের কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল।কারণ সেই মূলত দাদা তহুর আলীকে যাকাত দেয়ার জন্য প্রতিবার আলাদা একটা মানসিক চাপে রাখে।সে যাকাতের হাকীকতসহ কিছু বই পড়েছে যেখানে ইসলামের মৌলিক ও অন্যতম এ বিধান নিয়ে বেশ শক্ত কথাই লিখা।তাই সে তার দাদাকে জাহান্নামের ভয় দেখিয়ে যাকাত দিতে উৎসাহিত করেছে।মাতব্বর সাব মৌলভী সাহেবের কাছ থেকে আরও কিছু বিধান জেনে নিলেন।যেমন বন্দি মুক্তি, জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ বলতে কি বুঝানো হয়েছে।এখন যারা সমাজে ইসলামের জন্য কাজ করেন তারা জিহাদ ফি সাবিলল্লাহ'র মধ্যে পড়বে কিনা?এখনতো দাস কিবা ইসলামের জন্য যুদ্ধ হয়না তাহলে বন্দি মুক্তির টাকা কাকে দেয়া হবে?হুজুর সংক্ষেপে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিলেন।মাতব্বর সাহেব মনে মনে বললেনঃএর জন্যই তাহলে আমার নাতনী প্রতিবার আমাকে যাকাতের জন্য এই খাতগুলোতে এত বেশি চাপাচাপি করে! হুজুরের কথার শেষ দিকে সুমাইয়া ভিতর থেকে ডেকে উঠে দাদু ভাই।আম্মু আপনাকে ডাকেন। তহুর মাতব্বরের একমাত্র ছেলে জহুর আলীর একটি মাত্র মেয়ে সন্তান সুমাইয়া।জহুর সৌদি আরব থাকে প্রায় কুড়িবছর।নাতনীটাকে নিজের চেয়েও বেশি ভালবাসেন তিনি।হুজুরকে বিদায় দিয়ে হুক্কার নলটি পাশে রেখে লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ান তহুর আলী মাতব্বর।

সুবিত্রা লক্ষ্মী তুলসী গাছে পানি দিচ্ছিলিনে।পিছন থেকে সুমাইয়ার কন্ঠে মাসি ডাক শুনে ঘুরে দাঁড়ান। সুমাইয়া সুবিত্রা লক্ষ্মীকে অনেকটা জড়িয়ে ধরে ঘরের ভিতর নিয়ে আসে।তারপর অনেকটা উত্তেজিত আর হৃদয়জড়ানো কথোপকতনে ইসলামে যাকাত।তাঁর দাদু ভাইকে বোঝিয়ে রাজি করানোসহ আরও কিছু বিষয় বলে।সুমাইয়ার মধ্যে যেন তখন এক মহা আনন্দ বিরাজ করছে।এই আনন্দ প্রিয় বান্ধবীকে সহযোগিতার।তাঁর পরিবারের ভরণ-পোষণের।মনের মধ্যে লুকানো মানবিকতার।যার শিক্ষা তাঁর রাসূল সাঃ তাঁদের দিয়েছেন।সুমাইয়া ভ্যানিটিব্যাগ থেকে অর্ধ লক্ষ টাকার একটা চেক বের করে সুবিত্রালক্ষ্মীর হাতে ধরিয়ে দেয়।সুবিত্রা এতক্ষণে সুমাইয়ার পাগলামি বোঝতে পারেন।বয়স, পরিশ্রম,একাকীত্ব আর ছেলে-মেয়ের চিন্তায় দুর্বল হয়ে পড়া সুবিত্রার চোখ গড়িয়ে কান্নার ঢেউ উঠে।সুমাইয়াকে জড়িয়ে ধরেন তিনি।সুমাইয়া সুবিত্রালক্ষ্মীকে শান্তনা দেয় আর বলে দাদু ভাই বলেছেন এই টাকা দিয়ে আরেকটা ভাল দেখে দুধের গাভী কিনে নিতে।আর আমাদের জন্য প্রার্থনা করতে।সুবিত্রা এবার নিজেকে শক্ত করে নেন।সুমাইয়াকে ছেড়ে দিয়ে ভিতরের ঘরে যান।সুমাইয়াকে বসতে বলে কলেরঘরে গিয়ে গোসল করে আসেন।টপটপ করে চুল থেকে গড়িয়ে পড়া পানিগুলো দেখে সুমাইয়া তখনও বোঝেনা কি করতে চাচ্ছেন সুবিত্রা মাসি।তবে সুমাইয়া দেখে সুবিত্রা মাসির মুখের মধ্যে একটু আগের সেই দুশ্চিন্তার ছাপ নেই।কি এক পবিত্র ছায়া যেন পুরো ঘরকে আচ্ছাদিত করে ফেলেছে। সুবিত্রা মাসির চেহারা থেকে উদ্ভাসিত হচ্ছে শ্বাশ্বত আলোকরশ্মিগুচ্ছ। আর তিনি মুচকী হেসে এগিয়ে আসছেন সুমাইয়ার দিকে....।

অনুগল্প
০১.০৫.১৮
চট্টগ্রাম

পঠিত : ৯২২ বার

মন্তব্য: ০