Alapon

শিক্ষকতার একাল-সেকাল


শিক্ষকতার একাল-সেকাল
একটা সময় ছিল যখন শিক্ষকতা পেশাটা মহান পেশা হিসেবে পরিগণিত হতো । তাই বলে এখন যে মহান পেশা নয়; আসলে তা না। মূলত শিক্ষকদের পাঠদান, ছাত্রদের জন্য আত্মত্যাগ ও উদার মানসিকতা, আন্তরিকতাসহ অনেক ঘাটতি এবং একাল-সেকালের শিক্ষকদের মাঝে যে বিস্তর ফারেক সৃষ্টি হয়েছে, আমি সে দিকেই ইঙ্গিত করছি। মূলত শিক্ষকতার বর্তমান রূপ-রস এবং অতীতের রূপ-রস নিয়ে কিছু অব্যক্ত কথা ব্যক্ত করার নিরিখেই এই লেখাটির অবতারণা । পড়া শেষে বর্তমান অবস্থার সাথে মিলিয়ে দেখবেন । 

১.

 দেখতে দেখতে ৮টি বছর কীভাবে যে, পেছনে ফেলে এসেছি অথচ একটিবার জন্যেও টের পাইনি এতটা বছর অতিবাহিত করেছি। কিন্তু বিদ্যালয়ের স্মৃতিগুলো আজও যে, মনের ভেতর স্বচ্ছ আয়নার মতো চকচক করছে। স্মৃতির পাতা ঘেঁটে বারংবার সেই স্মৃতিটি  বের করে আনতে মন চাইছে । যে স্মৃতিটি রবে অম্লান । স্মৃতিটা হলো আমার সেই সব শিক্ষকদের যারা কর্তব্য মনে করে রাতের আঁধারে অজপাড়া গায়ের মেঠো পথ মাড়িয়ে ছাত্রদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখতেন, ছাত্রটি কি পড়ার টেবিলে আছে নাকি ঘুমিয়ে গেছে অথবা পড়া রেখে অন্য কোথায়ও  আড্ডা দিচ্ছে । ভাবতে পারেন, একজন  শিক্ষক কতটা বড় মনের অধিকারী হলে উনার পক্ষে এমন কঠিন কাজ সহজভাবে করা সম্ভব । এমন শিক্ষকরা যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যান তখন ছাত্ররা ২০০ গজ দূরে থাকতেই সাইকেল কিংবা রিক্সা অথবা হুন্ডা থেকে নেমে শিক্ষককে সম্মান দেখাতে কুণ্ঠাবোধ করে না। করবেইবা কেন? যে শিক্ষক তার/তাদের জন্য এতটা আত্মত্যাগ করতে পারে উনার জন্য এই সম্মান তো কেবলই যৎসামান্য । পারলে তো ছাত্ররা জীবন দিতেও সদাতৎপর । 

হাল আমলে এমন শিক্ষক পাওয়া যেমন দুষ্কর , শিক্ষককে উপর্যুক্ত সম্মান প্রদর্শন করার ছাত্রও রীতিমতো দুষ্কর ।

 

২.

 ক্লাসে আমার মতো যারা মোটা মাথার অধিকারী ছাত্র আছে, তারা ছাত্রবর্তী ক্লাসে শিক্ষকের পাঠদান বুঝা মানে মঙ্গল্গ্রহ জয় করার সমান । মূলত ছাত্রবর্তী ক্লাসে শিক্ষকের মুখনিঃসৃত পড়া চিকন মাথাওয়ালা ছাত্রদের কাছ থেকে ঘুরে আসতে আসতে মোটা মাথাওয়ালা ছাত্ররা আর তা বুঝ উঠতে পারে না। তাই ক্লাস শেষে অসম্পূর্ণ  পাঠ সম্পূর্ণ করার জন্য বাধ্য হয়েই  শিক্ষকদের শরণাপন্ন হতে হয় ।  শিক্ষকও সেক্ষেত্রে  দ্বিধাদ্বন্দ্বে পতিত না হয়ে বিষয়টা আন্তরিকতার সহিত নিয়ে উনার বাসায় ছাত্রদের অসম্পূর্ণ পাঠ সম্পূর্ণ করাতেন । এমনও দিন গত হয়েছে, যখন শিক্ষক বিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরছেন খাবার খাওয়া ও বিশ্রাম নেওয়ার জন্য । কিন্তু তখনও কোনো-না-কোনো ছাত্র গিয়ে উনার বাসায় হাজির হয়েছেন এই মর্মে যে, স্যার, আজকের পড়াটি ক্লাসে ঠিকমতো বুঝিনি । তাই অনুগ্রহপূর্বক আমাকে যদি  এখন পড়াটি বুঝিয়ে দিতেন খুবই উপকৃত হতাম। শিক্ষকও সকল ক্লান্তি আর ক্ষুধা ভুলে গিয়ে হাসি মুখে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেন । এই যখন ছিল অবস্থা, তখন এটা সকলের কাছে সহজেই অনুমেয় যে, সে সময়ের শিক্ষকদের এই অনুপম দৃষ্টান্ত আজকের শিক্ষকদের মাঝে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যেও খুঁজে পাওয়া মুশকিল । 

 ৩.

সে সময়ে অবশ্যই আজকের মতো এত অধিক ছাত্র-ছাত্রী ছিল না।  আবার একেবারে কমও ছিল না । শিক্ষক ক্লাসে হাজিরা ডাকার সময় যখন দেখতেন, অমুক ছাত্র-ছাত্রীটি ক্লাসে দুদিন যবত অনুপুস্থিত সঙ্গে সঙ্গে তিনি দুজন ছাত্রকে উক্ত ছাত্র-ছাত্রীর বাড়িতে পাঠিয়ে খবর নিতে তার/তাদের  কি কোনো অসুখ-বিসুখ হয়েছে কিনা? ছাত্রদের রিপোর্টে যদি তাদের অসুস্থতার খবর আসত। তাহলে বিদ্যালয়ের ছুটির পর শিক্ষক সেই বাড়িগুলোতে গিয়ে তাদের খোজ-খবর নিত এবং অভিভাবকদেরকে তাদের ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে  আসত। আর ছাত্রদের রিপোর্টে যদি উক্ত ছাত্র-ছাত্রীর এমনি ক্লাসে না আসার খবর পেত। তাহলে পরের দিন শিক্ষক ক্লাসে এসে দুজন ছাত্রকে পাঠাত ওদের ধরে আনার জন্য ।  এভাবেই শিক্ষকগণ ছাত্রদের পড়ার জন্য যত পদ্ধতি অবলম্বন করার দরকার তা করতেন । অবশ্যই এইকথাগুলো বর্তমান প্রজন্মের কাছে সেফ রূপকথার গল্পের মতোই লাগবে । 

৪.

সকল বোর্ড পরীক্ষা যখন নিকটবর্তী তখন শিক্ষকগণ পেরেশান হয়ে যেতেন কীভাবে উনাদের ছাত্র-ছাত্রীদের রেজাল্ট ভালো করা যায় । তাই পড়াশোনা এবং পরীক্ষা ভালো করার ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের তাগিদ দেওয়ার পাশাপাশি অভিভাবকদেকেও বিদ্যালয়ে এনে শক্তভাবে তাগিদ দিতেন । আজকাল তো শিক্ষকরা পেরেশান হয়ে যান কোচিং বা প্রাইভেট পড়িয়ে কত টাকা আয় করবেন, তা নিয়ে ।

 

৫.

ইদানীংকালে এও শুনতে পেলাম যে, কোনো ছাত্র-ছাত্রী যদি অমুক-তমুক শিক্ষকের কাছে কোচিং বা প্রাইভেট না পড়ে তাহলে পরীক্ষায় তাকে ফেল করিয়ে দিবে  বা পরীক্ষার হলে তাকে কোনো প্রকার হেল্প করা হবে না । 

অথচ সেকালে এমন ছিল যে, একজন শিক্ষক ৫জন ছাত্র-ছাত্রীর তদারকি করবেন। আরেকজন শিক্ষক ৩জন ছাত্র-ছাত্রীর তদারকি করবেন। এভাবে ক্লাসের যত ছাত্র-ছাত্রী ছিল সবাইকে তদারকির জন্য শ্রেণি শিক্ষকদের মাঝে বণ্টন করে দেওয়া হতো । উনারা খুঁত-খুঁতিয়ে দেখতেন কোন ছাত্রের বা ছাত্রীর কোথায় বা কোন বিষয়ে সমস্যা রয়েছে। সে অনুযায়ী সে বিষয়ের ওপর জোর দিতেন । অর্থাৎ প্রতিটি শিক্ষকই তখন একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের ভূমিকা পালন করত ।  এই বিষয়টিও অনেকের কাছে হয়তো প্রগোতিহাসিক যুগের কোনো ব্যাপার বলে মনে হবে। 

৬.

সেকালে শিক্ষক এবং ছাত্র-ছাত্রীর সম্পর্ক ছিল পিতা-পুত্র-কন্যার সম্পর্কের মতো । তাই যেকোনো অভিভাবক তার ছেলে-মেয়েকে বিদ্যালয় কিংবা কোচিং-এ পাঠিয়ে নিশ্চিত থাকতে পারতেন । আর আজকাল কিছু শিক্ষকরূপী অমানুষদের জন্য  ছাত্র-ছাত্রীদের পাশাপাশি অভিভাভকগণও দুশ্চিন্তায় রয়েছে । তাই মা আজ তার মেয়েকে বিদ্যালয় বা কোচিং-এ শুধু পাঠায় না; বরং তিনি মেয়ের সাথে বিদ্যালয় বা কোচিং গিয়ে  সংসার পেলে সারাটি কাটিয়ে দেন ।  এ চিত্রটি গ্রামে কম লক্ষ করা গেলেও শহরগুলোতে খুবই কমন। 

পরিশেষে বলতে চাই, একালের কিছু শিক্ষক যেমন পরিমল গংদের মতো আছে, ঠিক তেমনিভাবে নাসির স্যারের মতোও অনেক স্যার আছেন। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আমরা নাসির স্যারের মতো স্যারদের মূল্যায়ন করতে না পারার কারণেই দিনের পর দিন পরিমলের মতো পশুরূপী শিক্ষকদের জন্ম হচ্ছে। ফলে এই ভণ্ড শিক্ষকদের কাছে থেকে কথিত শিক্ষা নিয়ে জাতি আদতে মেরুদণ্ডহীন জাতিতেই পরিণত হচ্ছে । নাসির স্যারদের জন্য শুভ কামনা ও ফুলের তুড়ি এবং পরিমল গংদের জন্য নিন্দা ও ঘৃণার ঝুড়ি ।  

পঠিত : ১৩৭৯ বার

মন্তব্য: ০