Alapon

আহমদ ছফাঃ একজন ঠোঁটকাটা মানুষের উপাখ্যান

‘অবিন্যস্ত কেশরাশি, সাধারণ বেশভূষা, সাধারণ বাস, এমনকি কথাবার্তাতেও অতি সাধারণভাবে কঠোর সত্যের উচ্চারণকারী একজন মানুষ আহমদ ছফা’।
‘আহমদ ছফা প্রথাগত মানুষ ছিলেন না, তিনি বরং প্রথাকে অস্বীকার করেই চলতেন। নিজের জীবনেও বিশেষ শৃঙ্খলা ছিল না তার। কিন্তু যখন তার লেখায় ফুল, বৃক্ষ, পাখি, প্রকৃতির বর্ণনা করেছেন তখন তার মধ্যে যে অপার শৃঙ্খলা তাকে তিনি তুলে নিয়ে এসেছেন নিপুণভাবে তার লেখায়। প্রকৃতির এই শৃঙ্খলা তাকে মুগ্ধ করেছে। তিনি ঐ প্রকৃতির বর্ণ, গন্ধ, স্পর্শের মধ্য দিয়ে জীবনকে আস্বাদন করতে পেরেছেন।’ 

আজ এমনই একজন গুণী মানুষের জন্মদিন। তাকে আমি ঠোঁটকাটা মানুষ হিসেবেই চিনে। তাই আজ সে ঠোঁটকাটা মানুষটির জীবনের কিছু ঘটনা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।

১.
খালেদা জিয়ার সঙ্গে ছফার একবার ফোনালাপ হয়েছিল। উপলক্ষ ছিল এনজিও ব্যুরো থেকে ‘বাংলা-জার্মান সম্পীতি’র রেজিস্ট্রেশনের ব্যাপারে। ছফা ই বেগম জিয়াকে ফোন করেছিলেন। ফোনটি ধরেছিলেন তাঁর পিএস। ছফা বিনয়ের সঙ্গে পিএসকে বলেছিলেন, ম্যাডামকে কি একটু দেয়া যাবে? আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই।

পিএস সাহেব জানতে চাইলেন, আপনি কে? ছফার জবাব, আমি আহমদ ছফা। পিএস সাহেব ফের জানতে চাইলেন, কোন আহমদ ছফা? পিএস-এর কথায় ছফা কচ ভয়ানক রকম খেপে গিয়েছিলেন। তিনি রাগলে সচরাচর যে গালটি তাঁর মুখ দিয়ে বা’র হত সেটি বেরিয়ে গিয়েছিল। তারপর তিনি কোন রকম ভূমিকা না করে বললেন, বাংলাদেশে আহমদ ছফা দু’জন আছে নাকি? ছফা কথা না বাড়িয়ে রিসিভারটি ধপাস করে রেখে দিয়েছিলেন।

পিএস সাহেব ছফার এ অশোভন আচরণের কথা বেগম জিয়াকে জানিয়েছিলেন কিনা জানা যায়নি। কিছুক্ষণ পরে বেগম জিয়া ফোন করেছিলেন। ছফা র কথার ঝাল তখনও থেকে গিয়েছিল। ফোন পেয়ে তিনি বেগম জিয়াকে বিরক্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ম্যাডাম, কী সব অশিক্ষিত পিএস টিএস রাখেন আহমদ ছফার নাম জানে না। ছফা র কথায় বেগম জিয়া হেসে জবাব দিয়েছিলেন, আমি নিজে অশিক্ষিত; শিক্ষিত মানুষ পাব কোথায়। আপনারা কেউ তো এগিয়ে আসছেন না?

‘বাংলা-জার্মান সম্প্রীতি’ থেকে বাসায় লোকজন এলে বেগম জিয়ার সঙ্গে কথোপকথনের বিষয়টি সবিস্তারে বয়ান করেছিলেন। তিনি বেগম জিয়ার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে বারবার বলে যাচ্ছিলেন, ভদ্রমহিলার তারিফ না করে পারা যায় না। তিনি আশ্চর্য রকম বিনয়ী

আনুপূর্বিক তসলিমা এবং অন্যান্য স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ বইটি পড়ে খালেদা জিয়া আহমদ ছফা সম্পর্কে জেনেছিলেন এবং তাঁকে ফোন করে দাওয়াতও করেছিলেন। তবে ছফা যাননি। তিনি বেগম জিয়াকে বলেছিলেন, যেতে পারি এক শর্তে। আমাকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতে হবে। শেখ হাসিনার কাছে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে রান্না করে খাইয়েছিলেন। খালেদা জিয়ার রান্না করার সময়ও হয়নি, ছফা ও যেতে পারেননি। 

২.
“একবার দুই মেরুর দুই ‘জাতি’কে অর্থাৎ বুদ্ধিজীবী ও আলেমসমাজকে একটি প্ল্যাটফর্মে দাঁড় করাবার উদ্দেশ্যে ‘ইনসানিয়াত সেন্টার বাংলাদেশে’র ব্যানারে তাঁর উদ্যোগে শিশু একাডেমিতে দুই বিপরীত সত্তার ব্যক্তিবর্গকে আলোচক হিসেবে উপস্থিত রেখে একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন হাফেজ্জী হুজুর।

‘সাম্রাজ্যবাদ ও মুসলিম বিশ্ব’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন লিবিয়ান রাষ্ট্রদূত জনাব হাসান আল আইব, বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি জনাব কে. এম. সা’দউদ্দীন, প্রফেসর এমাজউদ্দীন ও ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা কমিউনিস্ট লীগের আবদুল মতিন সাহেব।

কমিউনিস্ট আবদুল মতিন সাহেবকে কেন দাওয়াত করা হবে এ বিষয় নিয়ে লিবিয়ান রাষ্ট্রদূত আপত্তি করলে পর ছফা ভাই ভীষণ খেপে যান এবং বলেন, আমাদের সমাজ বিপ্লব কাকে নিয়ে কীভাবে করতে হবে তা আমরাই ভাল জানি, আপনি নন। আমাদের কাছে পয়সা নেই বলে আপনাদের মুসলমান ভাইদের পয়সা দিয়ে কাজগুলো করতে চাই। তাই বলে এ ব্যাপারে পলিসি আপনাদের হবে না, হবে আমাদের। রাষ্ট্রদূত ক্ষমা চেয়ে তখন থেমে যান।” (ছফা, স্মা., পৃ. ১৯০ ইসহাক ওবায়দী) 

৩.                                                    
শেখ মুজিবের সঙ্গে যখন তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল তিনি তাঁকে ‘স্যার’ সম্বোধন করেছিলেন। শেখ মুজিব নাকি তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ছফা, তুমি আমাকে ভাই বলে ডেকো। ওইদিন ছফা কে শেখ মুজিবুর রহমান একটি কম্বল উপহার দিয়েছিলেন। কম্বলটি ছিল কমলা রঙের এবং খুব হালকা। মাপলে এক কেজিও হবে না। ছফা যতদিন বেঁচেছিলেন ওটি জড়িয়ে ঘুমোতেন।। তিনি একই কাপড়-চোপড় বেশিদিন ব্যবহার করতেন না। কিন্তু কম্বলটি হাতছাড়া হবার ভয়ে শীতের শেষে লন্ড্রি থেকে ধোলাই করে এনে তালা বদ্ধ করে রাখতেন।

"শেখ মুজিবর রহমান প্রথমে আমাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, রাষ্ট্রদূত হওয়ার জন্য। কিন্ত তিনি যখন বললেন, শর্ত আছে। আমি (ছফা) বলেছিলাম, শর্ত ছফার জন্য নয়, আপনি অন্য কাউকে দেখুন। শেখ মুজিবর রহমান আমার উপর প্রচন্ড রুষ্ট হয়েছিলেন। কিন্ত জেলে দেয়ার সাহস পাননি। পরে শেখ মুজিবর রহমান আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, শিক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা হওয়ার জন্য জন্য।
আমি (ছফা): বলেছিলাম সম্ভব নয়। আমাকে ধারণ করার মতো শক্তি আপনার সরকার বা আপনার প্রশাসনের নেই।

এরপর আবুল ফজলকে এই অফার দিলে তিনি আনন্দের সঙ্গে রাজি হন। আবুল ফজল শেখ সাহেবের কেনা গোলাম হয়ে যান। উপদেষ্টা হওয়ার পর শেখ সাহেবকে খুশী করা ছাড়া তাঁর আর কোন পথ অবশিষ্ট ছিল না। আমীন জানতে চান: আচ্ছা, আপনি শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু বলেন না কেন? ছফা: আমি তোমার বাবাকে বাবা ডাকতে যাব কোন দুঃখে? তোমার বাবাকে পৃথিবীর সমস্ত লোক বাবা ডাকলেও আমি ডাকবো না, তাঁকে অনেকে জাতির পিতা বলে থাকেন, আমি বলি না, একই কারণ। মুক্তিযুদ্ধ আমার মা।

আমীন: তা হলে পিতা কে?
ছফা: সময়। সময়ের দাবি এবং পাকিস্তানীদের কার্যকলাপ। ৪৭ এর পর হতে দেশের উদরে জন্ম যন্ত্রণা শুরু হয়েছে, যা ১৯৭১ এর মার্চে প্রসব বেদনায় প্রদীপ্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটিয়েছে।"
{ 'আহমদ ছফার চোখে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী', লেখক: মোহাম্মদ আমীন }                                       
৪.
বাংলা একাডেমীর একুশে বইমেলায় কলকাতার বই আসত। আহমদ ছফা এর বিরোধীতায় নামেন। তার বিরোধীতার ফলে কলকাতার বই আসা বন্ধ হয়। ছফা কাজটা করেছিলেন দেশের লেখকদের কল্যানের জন্য কিন্তু এদশেরই লেখক শওকত ওসমান তাকে বাজে লোক  বলে মন্তব্য করেন। ছফা তাকে নিয়ে নিউমার্কেটের বইয়ের দোকানে দোকানে নিয়ে যান।গিয়ে জিজ্ঞেস করেন শওকত ওসমানের কোন বই আছে কিনা।কেউ লেখক কেই চিনতে পারল না।তখন কলকাতার একজন সাধারন মানের লেখকের নাম বলতেই অনেকগুলো বই বের করে দিল। আহমদ ছফা তখন শওকত ওসমানকে জিজ্ঞেস করলেন, 
"দেশটা আমরা বাল ছেঁড়ার জন্যে স্বাধীন করেছি?""

৫.
১৯৯৬ সালে এক রাতে পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আশীষ খন্দকার, ব্রাত্য রাইসু, শাহ্‌রীয়ার রাসেল আহমদ ছফার একটি সাক্ষাৎকারটি নেয়, সাক্ষাৎকারটির কিছু অংশ তুলে ধরছি।

রাইসু: যৌনতা এই ঈশ্বরত্বকে নষ্ট করে না?
ছফা: যৌনতা দিয়ে মানুষ একটা কাজই করে, বংশবিস্তার করে।
রাইসু: না।
ছফা: না, আমাকে বলতে দাও। মানুষের আরো ফ্যাকাল্টি আছে, সমস্ত ফ্যাকাল্টিগুলি যৌনতার অধীন নয়। ইয়ুং এই জায়গায়ই ডিফার করে ফ্রয়েডের সঙ্গে। মানুষের জীবন হচ্ছে সাইকো সোমাটিক ফোর্স। শারীরিক, মনোদৈহিক একটা ব্যাপার। আশীষ: ইলেক্ট্রনিক বায়োলজিক্যাল সাইকো ফিজিক্যাল ফোর্স। ছফা: এবং এরই মধ্যে যেগুলি আছে, যেমন রিলিজিয়াস এক্সপিরিয়েন্স, আধ্যাত্মিক এক্সপিরিয়েন্স এগুলি এক ধরনের…যেমন বাউলরা প্রেমভাজা খায়, প্রেমভাজা মানে দুইজনের পায়খানা খায়। ফরহাদ তো এগুলি বলে না। এগুলিকে তারা বলে আধ্যাত্মিক এক্সপিরিয়েন্স। কিন্তু এখন বাস্তব জীবনে যেটা দেখা যায়, ফিজিক্সে যদি যাও, তো বস্তু আর ভাবের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব পাবে না। হায়ার ফিজিক্সে। বাউলরা যে জীবন যাপন করে, জীবনযাপনটা তারা একটা ধর্ম মনে করে।

রাইসু: আমার মনে হয় ছফা ভাই, এইখানে বাউলরা হইছে সবচেয়ে বড় এলিট।
ছফা: এলিটিজম হচ্ছে একটা জিনিস, যখন একটা অংশে নিজেদের আইডেনটিটি এসার্ট করতে করতে তারা মনে করে যে দে আর স্টে ফর সামথিং। বাউলদের এই যে সেকল্যুড মানসিকতা, এইটা আমি খুব অপছন্দ করি। দেখো, জৈনরা মনে করে সমস্ত বস্তুসত্তার মধ্যে প্রাণ আছে। এই কাঠটার মধ্যেও প্রাণ আছে। প্রাণের যে ভেরিয়েশন, সেটা হচ্ছে ডিগ্রি এবং স্টেজের। সেজন্য উর্দুতে একটা শের আছে : “সে মুক্তাতেও নেই, সে পাথরেও নেই, সে নানা বর্ণে দীপ্ত।”

রাইসু: এটারই উল্টা করে রবীন্দ্রনাথ বলতেছেন, তোমারই স্পর্শে পান্না হলো সবুজ। ছফা: রবীন্দ্রনাথ এটা গ্যেটের সেকেন্ড পার্ট থেকে চুরি করেছে।
রাইসু: রবীন্দ্রনাথ তো তাইলে তো অত বড় মাপের কিছু ছিল না।
ছফা: এগজাক্টলি, এই যে বিভিন্ন জায়গা থেকে নিয়ে, তালি দেওয়ার যে ক্ষমতা এটাই মানুষকে বড় করে।
রাইসু: এইটা তো দামি কথা বললেন, ছফা ভাই।
ছফা: দামি কথা তো বলি, কিন্তু কারো মাথায় তো সান্ধায় না। আমরা একটা গিভেন পয়েন্ট অফ টাইমে বাস করছি। আজকে যে মানুষের জীবন, পাঁচ হাজার বছর আগের কোনো ইতিহাস নেই। পাঁচ হাজার বছর পরেও কোনো ইতিহাস থাকবে না। {সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: আশীষ খন্দকার, ব্রাত্য রাইসু, শাহ্‌রীয়ার রাসেল}

আহমদ ছফার লেখা পড়া অত্যন্ত জরুরী। বিশেষ করে তার রাজনৈতিক প্রবন্ধ গুলো অসাধারন। যেমনঃ বাঙ্গালী মুসলমানের মন,মুজিব হত্যার নীল নক্সাঃ আমি যতটুকু জানি,ফারাক্কা ষড়যন্ত্রের নানা মাত্রা,মাদ্রাসা শিক্ষার কথা,বাংলাদেশের হিন্দু ও ইত্যাকার প্রসঙ্গ,শতবর্ষের ফেরারিঃ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ইত্যাদি।
তার লেখা পুষ্প বৃক্ষ বিহঙ্গ পুরাণ, যদ্যপি আমার গুরু,গাভী বিত্তান্ত,ওঙ্কার ইত্যাদি প্রায় তিরিশের অধিক।গ্যোতের ফাউস্ট কাব্যনাট্যের অনুবাদ তার অমর কীর্তি।

এই মহামানব ২০০১ সালের ২৮ শে জুলাই এই মহান ব্যাক্তিত্ব ঢাকায় মৃত্যুবরন করেন। তার জন্ম ৩০ শে জুন ১৯৪৩ চট্টগ্রামে। ছফা পরপারে চলে গেছেন কিন্তু নতুন সাহিত্যিকদের এক অনুসরনীয় দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। আহমদ ছফার ব্যাপারে সবার আরো জানা উচিত। এরকম মানুষ বছরে বছরে জন্মায় না। হয়ত শত সহস্র বছর অপেক্ষা করতে হয় এক এক জন আহমদ ছফার জন্য।

পঠিত : ২২৬১ বার

মন্তব্য: ০