Alapon

পৃথিবীর ভয়ংকর বন্দীশিবিরে উইঘুর মুসলিমরা

চীনের শিনজিয়াং প্রদেশে উইগুর মুসলিমদের 'সংশোধনের' (?) জন্য পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ বন্দীশিবির গড়ে তুলেছে কর্তৃপক্ষ ।

উপগ্রহ চিত্র বিশ্লেষণ করে তৈরি করা এক রিপোর্টে বলা হয়, আঞ্চলিক রাজধানী উরুমচির কাছেই দাবাংচেং-এ এরকম একটি শিবিরে সম্প্রতি ব্যাপক সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এই শিবিরটিতে কমপক্ষে এগারো হাজার বন্দীকে রাখা যাবে।

অস্ট্রেলিয়া-ভিত্তিক একটি স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান এ কথা জানিয়েছে, তবে এর প্রকৃত ধারণক্ষমতা এক লক্ষেরও বেশি হতে পারে।

চীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ: তারা পশ্চিম শিনজিয়াং অঞ্চলে বিনাবিচারে লক্ষ লক্ষ মুসলিমকে আটকে রেখেছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, এসব শিবিরে লোকজনকে জোর করে আটকে রাখা হচ্ছে, কিন্তু চীনের বক্তব্য - এখানে উইগুরদের শিক্ষা এবং বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দেয়ার মধ্যে দিয়ে সন্ত্রাসবাদ ও ধর্মীয় উগ্রপন্থা দমন করা হয়।

দাবাংচেং-এ যে শিবিরটি গড়ে তোলা হয়েছে - তা ২০১৫ সালেও ছিল একটা ফাঁকা জায়গা। কিন্তু তিন বছর পরে একই জায়গার উপগ্রহ চিত্রে দেখা যাচ্ছে সেখানে এক বিশাল দেয়াল-ঘেরা স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। এর চারদিকে দু কিলোমিটার দীর্ঘ দেয়াল, রক্ষীদের জন্য তৈরি হয়েছে ১৬টি চৌকি। ভেতরে গড়ে উঠছে অনেকগুলো বিশাল বিশাল চারতলা ভবন।

এসব শিবিরের চার পাশে থাকে কড়া প্রহরাছবির কপিরাইট.
Image captionএসব শিবিরের চার পাশে থাকে কড়া প্রহরা

শিনজিয়াংএ এরকম অনেকগুলো কারাগারের মতো স্থাপনা তৈরি হয়েছে গত কয়েক বছরে। এখানে সাংবাদিকদের পক্ষে কারো সাথে কথা বলা প্রায় অসম্ভব। শিনজিয়াংএ ফোন করে সাধারণ লোকের সাথে কথা বললে ব্যাপারটা কি তার একটা আন্দাজ পাওয়া যায়।

কাশগরে একটি বন্ধ মসজিদ, ওপরে উড়ছে চীনা পতাকাছবির কপিরাইট.
Image captionকাশগরে একটি বন্ধ মসজিদ, ওপরে উড়ছে চীনা পতাকা

সাংবাদিক জন সাডওয়ার্থ একটি হোটেলের মালিককে প্রশ্ন করেছিলেন, ১৬টি প্রহরী-চৌকি ওয়ালা ওই স্থাপনাটা কি? তিনি জবাব দিলেন, "এটা একটা সংশোধনমুলক স্কুল। সেখানে হাজার হাজার লোক আছে। তাদের চিন্তা-ভাবনায় কিছু সমস্যা আছে।"

চীন সবসময়ই বিনাবিচারে মুসলিমদের আটকে রাখার কথা অস্বীকার করে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় টিভিতে এসব স্কুলের 'ছাত্রদের' সাক্ষাতকার প্রচার হয়। কিন্তু এরা কি জরিপের জন্য নির্বাচিত হয়েছে, কতদিন ধরে এসব 'কোর্স' চলবে তার কোন উল্লেখ থাকে না। তবে এদের কথাবার্তা থেকে একটা কিছু আন্দাজ করা যায়। এদের সাক্ষাৎকারগুলো অনেকটা স্বীকারোক্তির মতো।

আবলেত তুরসুন তোহতিছবির কপিরাইট.
Image captionআবলেত তুরসুন তোহতি

একজন বলছে, "আমি আমার ভুলগুলো গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি। আমি বাড়ি ফিরে যাবার পর একজন ভালো নাগরিক হয়ে উঠবো।"

আমরা জানতে পারছি এসব স্থাপনার উদ্দেশ্য উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে লড়াই করা - যাতে আইনি তত্ব, কর্মদক্ষতা, এবং চীনা ভাষা ইত্যাদি শিক্ষা দেয়া হয়। এগুলো শুধুই এ প্রদেশের মুসলিম সংখ্যালঘুদের জন্য - যাদের মাতৃভাষা চীনা নয় - তারা একধরণের তুর্কিক ভাষা বলে।

শিনজিয়াংএ উইগুরদের সংখ্যা ১ কোটিরও বেশি। তাদের সাথে মধ্য এশিয়ার জনগোষ্ঠীরই মিল বেশি, চীনের সংখ্যাগরিষ্ঠ হ্যান জনগোষ্ঠীর সাথে তাদের সংস্কৃতির অনেক তফাৎ। এসব সংশোধনী স্কুলের নিজস্ব পোশাক আছে। ছাত্রীদের কারো মাথায় হিজাব নেই।

গত এক দশকে শিনজিয়াং-এ দাঙ্গা, আন্ত-সম্প্রদায় সহিংসতা, আক্রমণ এবং পুলিশী ব্যবস্থার কারণে এখানে শত শত লোক নিহত হয়েছে। বেজিংএর তিয়ানআনমেন স্কোয়ারে একটি আক্রমণের ঘটনায় দু'জন এবং কুনমিংএর উইগুরদের ছুরিকাঘাতে ৩১ জন নিহত হবার দুটি ঘটনা চীনের শাসকশ্রেণীকে উদ্বিগ্ন করে তোলে।

তিয়ানআনমেন স্কোয়ারে গাড়ি নিয়ে চালানো এই আক্রমণে দু'জন নিহত হয়ছবির কপিরাইট.
Image captionতিয়ানআনমেন স্কোয়ারে গাড়ি নিয়ে চালানো এই আক্রমণে দু'জন নিহত হয়

এর পর শিনজিয়াংএর নানা রকম বিধিনিষেধ জারি হয়েছে। ইসলামী রীতিনীতি পালন - যেমন পুরুষদের দাড়ি রাখা, মহিলাদের হিজাব পরা, শিশুদের ধর্মশিক্ষা, বা ইসলামী শোনায় এমন নাম রাখা - এগুলো সীমিত করতে নানা আইনী পদক্ষেপ বলবৎ হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের রোজা রাখা বা মসজিদে যাওয়া নিষিদ্ধ।

এখান থেকে শত শত লোক সিরিয়ায় জঙ্গী গ্রুপগুলোর হয়ে যুদ্ধ করতে গেছে এমন বিশ্বাসযোগ্য খবরের পর উইগুররা কর্তৃপক্ষের সন্দেহের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। তাদের ওপর জারি হয়েছে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা।

হোতানে একটি বন্দীশিবিরে ছিলেন ২৯ বছর বয়স্ক আবলেত তুরসুন তোহতি। তাদের সকালে উঠিয়ে দৌড় করানো হতো। জোরে না ছুটতে পারলে পেটানো হতো।

শিনজিয়াংএর একটি পোস্টার : 'স্থিতিশীলতাই আশীর্বাদ'ছবির কপিরাইট.
Image captionশিনজিয়াংএর একটি পোস্টার : 'স্থিতিশীলতাই আশীর্বাদ'

তিনি বলছেন, তাদের কমিউনিস্ট পার্টির প্রশংসাসূচক গান গাইতে হতো, আইন মুখস্থ করতে হতো। আবৃত্তি করতে ভুল হলে পেটানো হতো। এসব ক্যাম্পের সাবেক বাসিন্দাদের সবার মধ্যেই দেখা গেছে ব্যাপক ক্ষোভ।

এসব সংশোধন শিবিরে কোন অভিযোগ ছাড়াই আটক থাকা লোকদের কোন আইনী প্রক্রিয়ার শরণাপন্ন হবার সুযোগ নেই। চীন দাবি করে যে তাদের এসব কর্মসূচি সফল হয়েছে। কিন্তু এসব প্রকল্প নিয়ে ইতিহাসে উদ্বেগজনক দৃষ্টান্তের কোন অভাব নেই।

প্রতিবেদনে ব্যবহৃত ছবি: অ্যালামি/গেটি ইমেজেস/ রয়টার্স/ গাইমার বেইলি আর্কিটেক্টস/জিএমভি

পঠিত : ৬৪১ বার

মন্তব্য: ০