Alapon

মুসলিমরা গরু গোশত খাওয়া শিখল কীভাবে...?


সম্প্রতি ভারতে গোরক্ষার নামে যেভাবে মুসলমান হত্যা চলছে তা আধুনিক জগতে চরম নিন্দনীয় ও অকল্পনীয়। গোধূলিলগ্নে চারণভূমি থেকে গরু নিয়ে ফেরার সময় গোহত্যার অভিপ্রায়ের অজুহাতে মুসলিম রাখাল বালক হত্যা, বাড়িতে গোমাংস রাখার অভিযোগে পুরো মুসলমান পরিবারকে পুড়িয়ে মারার কর্মকান্ডে সারা পৃথিবী বিস্মিত, স্তম্ভিত ও চিন্তিত।
প্রাচীন ভারতে গোহত্যা ছিল ব্রাহ্মণ-সেবার অবিচ্ছেদ্য অংশ : প্রাচীনকাল থেকে ভারতে গোহত্যা ও গোমাংস আহারের ব্যাপক প্রচলন ছিল উচ্চ ও নিম্নবর্ণের হিন্দুর বাড়িতে, সব ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, ব্রাহ্মণ-তুষ্টিতে এবং বিভিন্ন রাজকীয় ও ধর্মীয় গোমেধে। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দের সব ভারতীয় ধর্মীয় গ্রন্থ ও লোকসাহিত্যে উৎসব করে ভারতে গোমাংস আহারের প্রমাণ পাওয়া যায় জন্মানুষ্ঠান, মহাব্রত, শ্রাদ্ধ ও ব্রাহ্মণ-সেবায়।

কামসংহিতায় উল্লেখ আছে, তান্ত্রিক ব্রাহ্মণদের শারদীয় সেবা করতে হতো ১৭টি অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর বয়সী খর্বকায় ষাঁড় এবং তিন বছরের কম বয়সী গোশাবক হত্যা করে। অবশ্য নিম্নবর্ণের দরিদ্র হিন্দুদের কালেভদ্রে গোমাংস আহারের সৌভাগ্য হতো।

বৈদিক ও বৈদিক-পরবর্তী যুগে ভারতীয়রা গোমাংস কেবল আহার করত তাই নয়, তাদের বিশ্বাস ছিল পিতা-মাতার শবদেহ দাহনের সময় একই সঙ্গে হৃষ্টপুষ্ট ষাঁড় পোড়ালে মৃত ব্যক্তি ষাঁড়ে আরোহণ করে স্বর্গে প্রবেশ করতে পারবেন। এরূপ ঘটনার উল্লেখ আছে অথর্বেদের বর্ণনায়।

খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ সাল থেকে কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তুরস্ক ও পূর্ব ইউরোপের পোল্যান্ড, রুমানিয়া, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, নরওয়ে প্রভৃতি দেশ থেকে আর্যরা ভাগ্যের অন্বেষণে স্থলপথে কয়েক হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে ভারতে পৌঁছে। যাযাবর জীবনের পরিসমাপ্তিতে আর্যরা পরিচিত হয় সহজলভ্য খাদ্য হিসেবে গোমাংসের সঙ্গে। বৃহৎ জনবসতির কারণে ভারতে বনজপ্রাণীর সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পেয়েছিল, তবে গৃহপালিত ষাঁড়, মহিষ, গরু ও ছাগলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল দ্রুতগতিতে। ব্রিটিশ প্রশাসক উইলিয়াম ক্রুক ১৮৯৪ সালে প্রকাশিত তার ব্যাপক গবেষণাগ্রন্থ The Veneration of the cow in India- তে দেখিয়েছেন যে, আর্যরা কেবল গোমাংসভোগী ছিলেন তাই নয়, তাদের গোমাংসে বিশেষ আকর্ষণ ছিল।

মহাভারত ও রামায়ণ-চরিত্রদের গোমাংসপ্রীতি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। দ্রৌপদী দেবতাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, পঞ্চপা-বের বনবাসের অবসান হলে যুধিষ্ঠির সহস্র ষাঁড় ও গরু বলিদান করে দেবতাদের তুষ্ট করবেন। পঞ্চপা-ব তাদের বনবাসকালে সহজলভ্য গৃহপালিত গরুর মাংস সংগ্রহ করতেন এবং গোমাংস আহারে তাদের শক্তি সঞ্চিত হতো। গোবর ও গোমূত্রের ব্যবহারও ছিল তাদের জীবনযাত্রায়। মহাভারতে আরও উল্লেখ আছে, রাজা রতিরত্নদেব প্রতিদিন সহস্র গরু জবাই করে ব্রাহ্মণদের মধ্যে বিলি করে পুণ্য অর্জন করতেন।

ভাগ্যের অন্বেষণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ইসলাম ধর্মাবলম্বী রাজা ও দলপতিরা ভারত বিজয় করেছেন বিভিন্ন শতাব্দীতে। এদের কেউ এসেছেন ইরান থেকে, কেউ আফগানিস্তান থেকে, কেউ তুরস্ক থেকে, কেউ মধ্যপ্রাচ্য, কেউ বা রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। তাদের দীর্ঘ পথযাত্রায় খাদ্যের জোগান এসেছে বনজপ্রাণী, হরিণ, ঘোড়া, উট, দুম্বা, গন্ডার ও মহিষ থেকে। রোদে শুকিয়ে এসব প্রাণীর মাংস দীর্ঘদিন রেখে খাওয়া যায়। গোমাংস কখনো এদের যাত্রাপথের সামগ্রী হিসেবে বিবেচিত হতো না। ধাই মাতার সঙ্গে আরবদের দীর্ঘ বন্ধন ছিল। তাই দুধদানকারী প্রাণী হত্যায় তাদের মানসিক অস্বস্তিবোধ ছিল। চারণভূমির স্বল্পতার কারণে গৃহপালিত গরুর সঙ্গে তাদের পরিচয় ছিল সীমিত। মরুভূমির দেশ আরবে চারণভূমির অভাব সর্বজনজ্ঞাত।

ভারতে পৌঁছে ভাগ্যান্বেষণকারী বিজয়ী মুসলমানরা কৃষিকাজে ব্যাপকসংখ্যক গরুর ব্যবহার এবং একই সঙ্গে ভারতীয়দের গরু বধ করে গোমাংস আহার ও ধর্মীয় কাজে ব্যাপক গোমাংস বিতরণ দেখে বিস্মিত হন। তারা লক্ষ্য করেন, গরুর দুধের বিবিধ ব্যবহার- সরাসরি দুগ্ধপান, দই, মাখন, ছানা ও ঘি উৎপাদনে। ভারতীয়দের গোবরভক্তিতে মুসলমানরা আশ্চর্যান্বিত হয়েছেন। গোবর ব্যবহৃত হতো মন্দিরের বেদি পরিষ্কার করার কাজে এবং গোবর খাইয়ে ভক্তের পাপমোচনে। নিম্নবর্ণের হিন্দুরা গোবর শুকিয়ে ব্যবহার করত জ্বালানি হিসেবে। গরুর লেজের ঝোল ও গোমূত্রের ওষুধ হিসেবে ব্যবহারে মুসলমানরা হতবাক হয়ে পড়ে। ভারতে বনজপ্রাণীর স্বল্পতার কারণে অন্য দেশ থেকে আগত মুসলমানরা ক্রমে গোমাংস আহারে অনুরক্ত হয়ে পড়েন এবং একেক দেশের মুসলমানরা একেক রকমের মসলা, চর্বি ও তেলসংযোগে গোমাংস রান্নায় বৈচিত্র্য আনেন। অল্পবয়সী গোশাবক মাংসে ব্রাহ্মণদের আসক্তির কারণে গাই-গরুর সংখ্যা কমতে থাকলে কৃষিতে সমস্যা দেখা দেয় এবং দুধেরও অভাব সৃষ্টি হয়। গরুর দুধের স্বল্পতায় শিশু ও বয়োবৃদ্ধরা স্বাস্থ্য সংকটে পড়ে। চাষাবাদের ক্ষতি রোধ করার লক্ষ্যে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর ও আওরঙ্গজেব গোহত্যা সীমিত করেন, গোবধের আগে কাজীর অনুমতি নেওয়ার বিধানও চালু করেন। এতে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীরা খুশি হলেও ব্রাহ্মণরা অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হন। তাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনে বিঘ্নসৃষ্টি ও হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে বলে প্রচারণা চালিয়ে ব্রাহ্মণরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। স্মরণযোগ্য যে, সম্রাট আকবরই প্রথম সতীদাহ প্রথা বন্ধের চেষ্টা করেছিলেন।

মুসলমানরা ভারতে গোহত্যা আরম্ভ করেননি, গোমাংস আহারের প্রচলনও করেননি। বরং মুসলমান শাসকরা গোহত্যা সীমিত করার উদ্যোগ নিয়েছেন কৃষিকাজের উন্নয়ন ও শিশুস্বাস্থ্য রক্ষার নিমিত্ত।

সম্রাট অশোকের আমলে (খ্রিস্টপূর্ব ২৬৮ থেকে ২৩২) মূলত বৌদ্ধধর্মের সুবিধার্থে ও হিন্দুধর্মের সঙ্গে দৃশ্যমান পার্থক্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সম্রাট অশোকসৃষ্ট ৮৪ হাজার স্তূপের মধ্যে মুষ্টিমেয় কয়েকটি স্তূপে গোবধ রোধের প্রস্তাব লিপিবদ্ধ রয়েছে।

মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের কাছে একাধিকবার পরাজিত মহারাষ্ট্রের ছত্রপতি শিবাজী ভোঁসলে (১৬৩০-১৬৮০) বিজয়পুর গুহায় আত্মগোপন করেন। পরাজয়ের গ্লানিতে তার সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে তিনি শঠতা ও ছলনার আশ্রয় নিয়ে নিজেকে ভগবানের পুনর্জীবনপ্রাপ্ত অবতার ঘোষণা দিয়ে হিন্দুদের উজ্জীবিত করেন এবং গোহত্যা নিষিদ্ধ করেন। এতে হিন্দুদের পাশাপাশি বৌদ্ধ ও জৈনরা খুশি হয় এবং তারা ভারত রক্ষার সংগ্রামে যুক্ত হয় অবতার ভগবান শিবাজীর নেতৃত্বে। রায়ঘর দুর্গে অবস্থানরত ছত্রপতি শিবাজী ভোঁসলের মৃত্যু হয় ৩ এপ্রিল, ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে রক্ত আমাশয়ে এবং পতন হয় মারাঠা রাজ্যের। তবে গোরক্ষা আন্দোলন নিঃশেষ হয় না।

১৮৭০ সাল থেকে পাঞ্জাবে গোরক্ষা রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয়, দয়ানন্দ সারাভাস্তি ১৮৮২ সালে প্রথম গোরক্ষা সভা অনুষ্ঠান করেন যা ক্রমে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় পরিণত হয়। উত্তর-পশ্চিম ভারতের হাই কোর্ট ১৮৮৮ সালে গরু পবিত্র প্রাণী নয় বলে রায় দেওয়ার পরও আজমগড়ে ব্যাপক দাঙ্গা হয় ১৮৯৩ সালে এবং শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। অযোধ্যায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার পুনরাবৃত্তি ঘটে ১৯১২-১৩, ১৯১৭ সালে এবং সাম্প্রতিকালেও একাধিকবার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে গোমাংস ভক্ষণ করলেও স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬০-১৯০২) পরবর্তীতে ভারতে ফিরে গোরক্ষার প্রবক্তা হন।

গোরক্ষার স্রোতের বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে একমাত্র রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) গোমাংস ভক্ষণের অধিকার নিশ্চিতকরণের জন্য ক্রমাগত ব্যাপক প্রচার চালিয়েছেন। আধুনিক যুগে রক্ষণশীলতা পরিহার করে নির্বিবাদে গোবরের জ্বালানি ও ঔষধি হিসেবে ব্যবহার এবং গোমাংস ভক্ষণের অধিকার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ হচ্ছে- Hindu Authorities in favor of slaying the cows and eating its flesh. রাজা রামমোহন রায় হিন্দুধর্মের বিভাজনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।

১৯১৫ সালে মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে ফিরে ভারতীয় রাজনীতিতে তার প্রবেশ সহজ করার লক্ষ্যে বেছে নেন গোরক্ষা আন্দোলন এবং প্রকাশ করলেন পবিত্র গাভীতথ্য। মহাত্মা গান্ধীর পবিত্র গাভীতথ্য রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার খোরাক সৃষ্টি করে এবং গোরক্ষা আন্দোলন জোরদার হয়। গান্ধী লিখলেন, ‘মা এবং দুগ্ধদানকারী গাভী উভয় অতীব প্রয়োজনীয়। তবে গাভীর অবদান বেশি। সন্তান জন্মের প্রথম কয়েক বছর স্তন্যদান করেন এবং প্রত্যাশা করেন যে পরবর্তীতে সন্তানরা মাকে দেখাশোনা করবে, অসুস্থ হলে তার সেবাযত্ন করবে। গাভী কস্মিনকালে রোগাক্রান্ত হয়। মা মারা গেলে ব্যাপক অর্থব্যয় করে কবরস্থ বা শবদাহ করতে হয়। অপর পক্ষে মৃত গাভীর চামড়া থেকে শুরু করে প্রতিটি অঙ্গ আমাদের অর্থের জোগান দেয়।’ গান্ধীর বক্তব্যে ভর করে রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ (আরএসএস), বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দল গোরক্ষা আবেদন তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করে। এ-জাতীয় প্রচারণার কারণে সংশ্লিষ্ট ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলো গোহত্যা নিষিদ্ধ করে গোরক্ষার ধারা ভারতীয় সংবিধানে যুক্ত করার দাবিতে ১৯৬৬ সালে ভারতীয় পার্লামেন্টের সামনে ব্যাপক বিক্ষোভ করে। বজরং দল গোহত্যা নিষিদ্ধ করার জন্য ৩০ লাখ কর্মী সমাবেশ করে ২০০২ সালে।

গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী কেশুভাই প্যাটেল গোরক্ষার জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেন। গান্ধীবাদী আচার্য বিনোবা ভাবে ১৯৭৯ সালের এপ্রিলে দীর্ঘমেয়াদি অনশন পালন করে প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইকে বাধ্য করেন গোহত্যা নিষিদ্ধ করে গোরক্ষা আইন প্রণয়নে।
লেখক: ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা

পঠিত : ১৭৬৩ বার

মন্তব্য: ০