Alapon

"তোমায় ভালোবাসি হে প্রিয়তমা"।

১.
ফুলশয্যার রাত।
আমি যে মেয়েটির সামনে প্রবল অস্বস্তি নিয়ে বসে আছি তার সঙ্গে আমার কয়েক ঘন্টা আগে বিয়ে হয়েছে।আমি আগ্রহ এবং অনাগ্রহের মাঝামাঝি কোনো দৃষ্টি নিয়ে ফুলশয্যার ঘরের নিস্পন্দ ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে আছি।আমার সামনে লাল শাড়ীর ঘোমটা দিয়ে মেয়েটি বসা।এই শ্যাম বর্ণের মেয়েটির সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বাবা মায়ের পছন্দে।ছোট বেলা থেকেই আমার শখ ছিলো চিত্রনায়িকা পূর্ণিমার মতো ফর্সা,রূপবতী একটা মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে হবে।তার হাতে মেহেদীর রং থাকবে।চাঁদনী রাতে আমরা পাশাপাশি রাস্তা হাঁটবো।সে হঠাৎ বলবে,"তোমার হাতটা একটু ধরতে পারি?"আমি বিব্রত কণ্ঠে বলবো,"হুম পারো।"অথবা কোনো জ্যোৎস্না রাতে ছোট নদীটার বুকে তাকে নিয়ে নৌকা ভাসাবো।ব্যাক ভিউতে গান বাজবে,"....নদীর জ্বলে চাঁদ পড়েছে,চাঁদ পড়েছে বন্ধুর গায়..."
তা না!বিয়ে হলো কিনা একটা আস্ত কাকের সঙ্গে!!সবই আমার কপাল!!!!
আমার কাকবধূর কথায় ভাবনায় ছেদ পড়লো।"আমি জানি,আমাকে আপনার পছন্দ হয় নি।কিন্তু আমার গায়ের রংয়ের জন্য তো আমি দায়ী নই।যিনি আমাকে বানিয়েছেন তাঁর মর্জি।"আমি মনে মনে বললাম,"দুনিয়াময় এতো ছেলে থাকতে আমার গলায়ই তোর ঝুলতে হলো।আবার আপনি আপনি করছে!!যত্তসব ক্ষ্যাত!!!"ইচ্ছে করছে কষে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেই।কিন্তু ফুলশয্যার রাতে নববধূকে থাপ্পড় দিয়ে বসলে কেলেংকারী হয়ে যাবে ভেবে আমি ক্ষান্ত দিলাম।
২.
ইদানিং আমি ইচ্ছে করেই রাত করে বাসায় ফিরি।আমার কর্পোরেট জীবন এমনিতেই খুব ব্যস্ততায় কাটে।তবুও অফিস ছুটির পর পথে পথে ঘুরি।শাহবাগের ওভারব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে গাড়ি চলাচল দেখি।তারপর যখন বাসায় ফিরি তখনও দেখি আমার নববধূ ঘুম ঘুম চোখে আমার জন্য রাতের খাবার নিয়ে বসে আছে।আমার মায়া হয় না।আমি নিষ্ঠুর কণ্ঠে বলি,"এসব ন্যাকামি বন্ধ করবা।আমার জন্য কারো মায়া দেখাতে হবে না।যত্তসব!!"
সে কিছু বলে না।আস্তে মাথা নাড়ে এবং পরের দিন আবার খাবার নিয়ে ওয়েট করে।রাতে ঘুমানোর সময় বুঝতে পারি,সে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।বিড় বিড় করে বলছে,"কিচ্ছু চাই না গো।শুধু তোমার পাশে একটু ঠাঁই দিও।"আমি না শোনার ভান করে শুয়ে থাকি।আমার হৃদয় বিগলিত হয় না।তীব্র আবেগে কণ্ঠ ধরে আসে না।যেন ভালোবাসার হরমোন "অক্সিটোসিন" এর নিদারুণ অভাব আমার মধ্যে।
৩.
ফজরের আজান তখনো হয়নি।নববধূর ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো।বললো,"ওঠো না!একসঙ্গে তাহাজ্জুদ পড়বো।"আমি নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়ি না।বিয়ের আগে মাঝে মাঝে পড়তাম।ওজু করে এসে একসঙ্গে নামাজে দাঁড়ালাম।নামাজ শেষ হতেই সে আমাকে সূরা বাকারার ২১৬ নাম্বার আয়াত পড়তে দিলো।আমি পড়লাম,"এমনও তো হতে পারে যে বিষয়টি তোমাদের ভালো লাগে না,তাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর।"
আমার মধ্যে এক ধরণের ভাবান্তর এলো বলে মনে হলো।সে আমার আরেকটু কাছে ঘেঁষে বসলো।তারপর বললো,"হয়তো আমার মধ্যেই তোমার জন্য আল্লাহ কল্যাণ রেখেছেন।কোনো ফর্সা,রূপবতী মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হলে হয়তো কোনো অকল্যাণ হতো।তা না হলে তোমার পাঁজর থেকে আল্লাহ আমাকে বানাবেন কেন?"
শেষ কথাটা আমাকে টাচ করে গেলো।আমি ভুল বুঝতে পারলাম এবং এই প্রথম বারের মতো তার জন্য আমি এক বুক মায়া অনুভব করলাম।
৪.
জ্যোৎস্না রাত।আমি আমার প্রিয়তমা বধূর হাত ধরে হাঁটছি।চাঁদের উজ্জল আলোয় এই শ্যাম বর্ণের মেয়েটিকে অপ্সরীর মতো লাগছে আজ।কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লা নাকি টাকার অভাবে অনেক দুপুর একটা সিঙ্গাড়া খেয়ে কাটিয়ে দিতেন।বিয়ের পর এটা শুনে তসলিমা নাসরিন কেঁদে ফেলেছিলেন।আমার মনে হলো,এই মেয়ের যদি আমার জন্য মায়া লাগে তাহলে জীবনের বাকি দুপুর আমি একটা সিঙ্গাড়া খেয়ে কাটিয়ে দিতে পারবো।

পঠিত : ১১০৪৬ বার

মন্তব্য: ০