Alapon

কম্পিউটারের আধুনিকায়ন

খ্রিষ্টপূর্ব ২৪০০ সালে ব্যাবিলনে আবিষ্কৃত অ্যাবাকাস (Abacus)নামক একটি প্রাচীন গণনাযন্ত্রকেই কম্পিউটার ইতিহাসে প্রথম যন্ত্র হিসেবে ধরা হয়। অ্যাবাকাস ছিলো ফ্রেমে সাজানো গুটির স্থান পরিবর্তন করে গণনা করার যন্ত্র।

১৬১৬ সালে স্কটল্যান্ডের গণিতবিদ জন নেপিয়ার গণনার কাজে ছাপা বা দাগ কাটাকাটি অথবা দন্ড ব্যবহার করেন। এসব দন্ড জন নেপিয়ার (John Napier) এর অস্থি নামে পরিচিত। ১৬৪২ সালে ১৯ বছর বয়স্ক ফরাসি বিজ্ঞানী ব্লেইজ প্যাসকেল সর্বপ্রথম যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর আবিষ্কার করেন। তিনি দাঁতযুক্ত চাকা বা গিয়ারের সাহায্যে যোগ-বিয়োগ করার পদ্ধতি চালু করেন।

১৬৭১ সালের জার্মান গণিতবিদ গটফ্রাইড ভন লিবনিজ প্যাসকেলের যন্ত্রের ভিত্তিতে চাকা ও দন্ড ব্যবহার করে গুণ ও ভাগের ক্ষমতাস¤পন্ন আরো উন্নত যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর তৈরি করেন। তিনি যন্ত্রটির নাম দেন রিকোনিং যন্ত্র (Reckoning Machine)। পরে ১৮২০ সালে টমাসডি কোমার রিকোনিং যন্ত্রের পরিমার্জন করে লিবনিজের যন্ত্রকে জনপ্রিয় করে তোলেন।

উনিশ শতকের শুরুর দিকে আধুনিক একটি যন্ত্রের নির্মাণ ও ব্যবহারের ধারণা (যা কেবলমাত্র যান্ত্রিকভাবে, মানে যেকোনো রকম বুদ্ধিমত্তা ব্যতিরেকে, গাণিতিক হিসাব করতে পারে) প্রথম সোচ্চারভাবে প্রচার করেন চার্লস ব্যাবেজ। তিনি এটির নাম দেন ডিফারেন্স ইঞ্জিন (Difference Engine)। এই ডিফারেন্স ইঞ্জিন নিয়ে কাজ করার সময় (১৮৩৩ সালে) তিনি অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন নামে আরও উন্নত ও সর্বজনীন একটি যন্ত্রে ধারণা লাভ করেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় যন্ত্র ও অর্থের অভাবে কোনোটির কাজই তিনি শেষ করতে পারেননি।

কম্পিউটার বিজ্ঞানের সত্যিকার সূচনা হয় অ্যালান টুরিং-এর প্রথমে তাত্ত্বিক ও পরে ব্যবহারিক গবেষণার মাধ্যমে। বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে আধুনিক কম্পিউটার  বিকাশ ঘটতে শুরু করে। ১৯৪৬ সালের মাঝামাঝি পেনসিলভেনিয়া ইউনিভার্সিটির জন মশলি ও প্রেসপার একার্ট নামে দুই প্রতিভাবান ইঞ্জিনিয়ার ‘এনিয়াক’ নামে প্রথম ইলেক্ট্রনিকস ডিজিটাল কম্পিউটার তৈরি করেন। তখন এনিয়াক কম্পিউটার  রাখার জন্য দরকার পড়তো ৯ মিটার প্রস্থ ও ১৫ মিটার দৈর্ঘ্যরে একটি ঘর। আর এর ওজন ছিল প্রায় ১৫ টন। এটা চালানোর জন্য লাগতো ১৫০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ।

১৯৪৬ সালের শেষ দিকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার হাওয়ার্ড এইকিন নামের একজন প্রতিভাবান বিজ্ঞানী তৈরি করে ফেললেন এনিয়াকের চেয়ে কিছুটা ছোট এবং আরেকটু ক্ষমতাস¤পন্ন ইলেক্ট্রনিকস কম্পিউটার  ‘মার্কওয়ান’। তবে ছোট হলেও এই কম্পিউটারটি ছিল ১৫ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৬ মিটার প্রস্থ বিশিষ্ট। এর উচ্চতা ছিল ২.৪ মিটার। এতে ব্যবহৃত বিদ্যুতের তারের দৈর্ঘ্য ছিল ৮০০ কিলোমিটার। আর এটা তৈরি করতে যে খরচ পড়তো সেই খরচ দিয়ে বর্তমান সময়ের পুরো একটা কম্পিউটার কোম্পানি বানিয়ে ফেলা যাবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টেল কর্পোরেশন ১৯৭১ সালে মাইক্রোপ্রসেসর উদ্ভাবন করার পর থেকে বাজারে আসতে শুরু করে মাইক্রোপ্রসেসরভিত্তিক কম্পিউটার। তখন থেকে কম্পিউটারের আকৃতি ও কার্যক্ষমতায় এক বিরাট বিপ্লব সাধিত হয়। ১৯৮১ সালে বাজারে আসে আই.বি.এম কো¤পানির পার্সোনাল কম্পিউটার বা পিসি। এর পর একের পর এক উদ্ভাবিত হতে থাকে উচ্চক্ষমতাস¤পন্ন মাইক্রোপ্রসেসর এবং তৈরি হতে থাকে শক্তিশালী পিসি।

১৯৭১ সালে ব্যক্তিগত কম্পিউটারের সম্ভাবনার সাথে সাথে বহনযোগ্য ব্যক্তিগত কম্পিউটারের চাহিদার সম্ভাবনাও তৈরি হয়। এলান কে ১৯৬৮ সালে জেরক্স পার্কে একটি ‘ব্যক্তিগত, বহনযোগ্য, নিজের কাজে তথ্য ব্যবহার করা যায়’ এমন যন্ত্র হিসেবে কল্পনা করেন এবং তার গবেষণাপত্র ‘ডায়নাবুকে’ ১৯৭২ সালে বর্ণনা করেন। আইবিএমের বিশেষ এপিএল মেশিন পোর্টেবল (এসসিএএমপি) কম্পিউটারটি দেখানো হয় ১৯৭৩ সালে। এই পরীক্ষামূলক যন্ত্রটি আইবিএমের পালম প্রসেসরের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত। আইবিএম ৫১০০, প্রথম বাণিজ্যিক বহনযোগ্য কম্পিউটার। এটি বাজারে আসে ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এর ভিত্তি ছিল এসসিএএমপি পরীক্ষামূলক যন্ত্রটি।
১৯৮০ দশকের শুরুর দিকে প্রথম ভাঁজ করা যায় এমন ল্যাপটপ দেখা যায়। ১৯৮৩ সালের পর নতুন ইনপুট ব্যবস্থা আবিষ্কৃত হয়, যার মধ্যে ল্যাপটপেরও ইনপুট যন্ত্রাংশ ছিল, যেমন টাচপ্যাড (গ্যাভিলানএসসি)। এ সময় কিছু সিপিইউ এমনভাবে বানানো হয় যাতে এগুলো কম বিদ্যুৎশক্তি ব্যবহার করে, ফলে ব্যাটারির স্থায়িত্ব বেড়ে যায়। ২০০০ দশকের শুরু থেকেই অপটিক্যাল ড্রাইভগুলোর ব্যবহার হতে থাকে যেমন সিডিরম, রাইটেবল সিডি রম, পরে ডিভিডি রম, রাইটেবল ডিভিডি রম, তারপরে ব্লু-রেড্রাইভ। এরপরেও বিবর্তন চলতে থাকে এবং আজকের এই অবস্থায় পৌঁছে।

সেই ল্যাপটপেরও দিন শেষ হয়ে এলো। সহজে বহনযোগ্যতার যে ধারণা থেকে ল্যাপটপের উদ্ভাবন, সেই একই ধারণা থেকে এবার তৈরি হবে রোলটপ। রোলটপ হলো নমনীয় নোটবুক ককম্পিউটার  যেটাকে কাগজের মত রোল করা ও ভাঁজ করা যাবে। ফলে একজন ব্যবহারকারী এটিকে সর্বোচ্চ স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে বহন করতে পারবে এবং অপ্রতুল স্থানে রেখেও দিতে পারবে।

নোট বুকটি একটি রোলের উপর পেঁচানো থাকবে। এটি ব্যবহার করতে চাইলে প্রথমে রোল থেকে প্যাঁচ ছাড়িয়ে নিতে হবে। এরপর রোলের দুই মাথায় থাকা প্লাগগুলো লাগিয়ে নিতে হবে। বেশ, হয়ে গেল। এরপর ব্যবহার শেষে যখন ব্যবহারকারী এটিকে ভাঁজ করবেন তখন এটি পানির বোতলের আকারের হয়ে যাবে যেটি সহজে কাঁধে বহন করা যাবে।

এতে থাকবে মাল্টি-টাচ সুবিধা যা আইফোনের সুবিধা ও কার্যকারিতা দিবে। টাচ-স্ক্রিন নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি এতে প্রচলিত নোটবুকের মত কি-বোর্ডও থাকবে, ফলে স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে টাইপ করা যাবে। ওয়েব-ক্যাম, ব্লু-টুথ, ওয়াই-ফাইসহ প্রচলিত নোটবুকের সব সুবিধাই এতে থাকবে। এভাবেই আমাদের ব্যবহৃত কম্পিউটার নামের যন্ত্রটির ক্রমাগত আধুনিকায়ন হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে হয়তো আরও অনেক কিছুই অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।

ছবি ও তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, Tuvie

পঠিত : ১২২১ বার

মন্তব্য: ০