Alapon

খেলার সাথে রাজনীতি মেশাবেন নাঃ পুরোটাই ভাওতাবাজি

পেরুর সাবেক সিনেটর জেনারো লিডেসমা '৭৮ ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ নিয়া বলতেছিলেন, সে সময় আর্জেন্টিনার স্বৈরশাসক জেনারেল জর্জ ভিদেলার বিশ্বকাপ জিতাটা অত্যন্ত জরুরী ছিল। যেকোন মূল্যে আর্জেন্টিনার ওয়ার্ল্ড কাপ চাই-ই চাই। জেনারেল ভিদেলা নিজ দেশে যেইভাবে মানবাধিকার লংঘন করে চলতেছিলেন, অব্যাহত জুলুম আর দুর্নীতিতে দেশের মানুষের নাভিশ্বাস উঠতেছিল, সেই সময় আর্জেন্টিনারে বিশ্বকাপ জিতায়া দিতে পারলে এক ঢিলে অনেকগুলা পাখি মরে। ক্রুইফ আর পল ব্রিটনারের মত তারকারা সেই বিশ্বকাপ বর্জন করছিল মানবাধিকার লংঘনের কারণ দেখাইয়া।

ভিদেলা আদি ও আসল চালটাই দিছিলেন। স্পোর্টস ন্যাশনালিজমের পতাকার তলে দেশপ্রেম মারানের নামে মানুষ ভাত আর কাপড়ের কথা ভুইলা ফুটবল খাইতে থাকবো, যতটুক কাপড় পড়া আছে,জয়ের আনন্দের ঠ্যালায় ঐটাও খুইলা নাচতে থাকবো। পাশাপাশি প্রায় ত্রিশ হাজার ছেলেমেয়ে গুম হওয়ার প্রতিবাদে প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেলে মহিলারা " মাদার'স প্লাজা ডি মায়ো'তে কালো পোশাক পড়ে যেই প্রতিবাদ জানান, যেইটা আন্তর্জাতিক অঙ্গণে ইতোমধ্যে মানবাধিকারের পুনরুদ্ধারের প্রতীক হইয়া উঠছিলো, তার থেইকাও দৃষ্টি ফেরানো যাইবো। 

হইছিলোও তাই। আর্জেন্টিনার আয়োজনে '৭৮ এর ফুটবল বিশ্বকাপ বিজয় ছিল স্পোর্টস ন্যাশনালিজমের কাঁধে ভর কইরা ডিক্টেটরদের সেই প্রাগৈতিহাসিক গ্ল্যাডিয়েটর ফাইটের সবচেয়ে ক্ল্যাসিক্যাল এক্সাম্পল। 

গ্রুপ পর্বে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, পেরু আর পোল্যান্ড ছিল এক গ্রুপে। ব্রাজিল পোল্যান্ডরে ৩-১ গোলে হারায় আর পেরুরে ৩-০ গোলে হারায়। আর্জেন্টিনা পোল্যান্ডরে হারায় ২-০ গোলে। আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল ম্যাচ গোলশূন্য ড্র হয়। আর্জেন্টিনার তখন ফাইনালে কোয়ালিফাই করার জন্য পেরুরে ৪-০ গোলে হারানোর দরকার পড়ে। 

পেরুতেও তখন সামরিক জান্তা। আর্জেন্টিনার সরকারের সাথে পেরুর হাই অফিসিয়াল চুক্তি হয়। পেরুর ১৩ জন রাজনৈতিক বন্দীকে আর্জেন্টিনায় পাচার করা হয় গুপ্তহত্যার জন্য। যার মধ্যে দুইজন এডমিরাল, একজন সাংবাদিক আর দশজন বামনেতা ছিল। চুক্তি হয় বিনিময়ে পেরু আর্জেন্টিনার কাছে ৪-০ গোলে হারবে। 

আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী দলের স্ট্রাইকার লেওপলদো লুকুই নিজেও পরবর্তীতে বলছেন, আমি এখন যেইটা জানি, আমি তাতে বলতে পারি না যে, আমি সেই বিজয় নিয়া গর্বিত। আমি ব্যাপারটা তখন বুঝি নাই, আমাদের বেশিরভাগই বুঝে নাই যে, আমরা রাজনৈতিক গুটিবাজিতে পড়ে গেছি। আমরা শুধু ফুটবল খেলতেছিলাম। 

পেরুর ক্যাপ্টেন হেক্টর চাম্পিতেয সেইদিনের কথা মনে করে বলতেছিলেন, আমাদের ড্রেসিং রুমে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট জেনারেল ভিদেলা আর হেনরি কিসিঞ্জার আসলেন। আমরা বলাবলি করতেছিলাম, উনারা আর্জেন্টিনার ড্রেসিংরুমে না গিয়া আমাদের এইখানে কেন? হাফটাইমের পরেই যখন দলের প্রধান স্ট্রাইকার জোসে ভ্যালাসকুয়েজরে কোচ উঠায়া নেন, তখনই বুঝেন ঝামেলা আছে।

পরবর্তীতে হেক্টর খোলামেলাই বলেন, সরকার থেকে ম্যানেজারের উপর চাপ ছিল, আর ম্যানেজার থেকে কোচ আর খেলোয়াড়দের উপর চাপ ছিল যাতে কমপক্ষে ৪-০ গোলে আর্জেন্টিনার কাছে পেরু হারে। তাই হইছে। পেরু ৬-০ গোলে হেরে যাওয়ায় আর্জেন্টিনা ফাইনালে উঠে। এবং বিশ্বকাপও জিতে। এইটা নিয়া পরে কিসিঞ্জাররে জিজ্ঞেস করলে সে বলে, পেরুর ড্রেসিংরুমে গেছিলেন কিনা মনে করতে পারতেছেন না। 

'৮৬ এর বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যারাডোনার সেই বিখ্যাত 'হ্যান্ড অফ গড'ও তাই যতটা না শৈল্পিক তারচেয়ে বেশি রাজনৈতিক। '৮২ এর এপ্রিলে ফকল্যাণ্ডের দখল নিয়ে ইংল্যান্ডের সাথে আর্জেন্টিনার ৭৪ দিনের যুদ্ধের পরাজয়ের স্মৃতি তখন তাজা আছে। স্পোর্টস ন্যাশনালিজমের কাঁধে ভর কইরা আর্জেন্টিনার দেশপ্রেম তখন টগবগ টগবগ ফুটতাছে।  খুব স্বাভাবিক কারণেই ম্যারাডোনার হাত দিয়া গোল করার এই শৈল্পিক চৌর্যবৃত্তিরে গ্লোরিফাই করতে 'ঈশ্বরের হাত' তত্ত্ব আর্জেন্টাইনরা খুব খাইছে। 

কারণ এর মাধ্যমে তারা যুদ্ধে পরাজয়ের পরে নিজস্ব ফোস্কাতে হাত বুলায়া আরাম পাইছে। ম্যারাডোনাও এই দেশপ্রেমের ফায়দা নিছে 'ঈশ্বরের হাত' রেটোরিকের মধ্য দিয়া নিজের উপরে আলগা খোদায়ী আরোপ কইরা। ইংল্যান্ডের সাথে জয়ের পর ম্যারাডোনা নিজের মুখেই কইছেন, যদিও খেলার সাথে রাজনীতির কোন হিস্যা নাই। কিন্তু আমাদের ছেলেদের ওরা পাখির মতো গুলি কইরা মারছে। এই জয় তার প্রতিশোধ। 

তার মানে আমরা যতই চিক্কুর দিতে থাকি, রাজনীতির সাথে খেলা মিশাইবেন না। এইটা আসলে একটা ভাওতা। খেলা রাজনীতির একটা অংশ। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ। এই গুরুত্বের কারণেই মেসি কিংবা রোনালদোরে ইসরাঈল তার মাঠে আমন্ত্রণ জানায়। ঠিক যেই কারণে নেতানিয়াহু বলিউডে আইসা বচ্চন আর করণ জোহরগো লগে সেলফি তুলে, একেবারে সেইম কারণেই মেসিরে জেরুজালেমে নিয়া ইহুদি উপাসনালয়ে ইবাদত বন্দেগি করায়।

স্পোর্টস ন্যাশনালিজমের কাঁধে ভর কইরা স্পোর্টস পলিটিক্স। 
'১৪ সালে ব্রাজিল ওয়ার্ল্ডকাপও যেমন ব্রাজিলরে নাঙ্গা কইরা দিছে। খালি সময়টা '৭৮ সাল না বইলা কিংবা ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ভিদেলার মতো  হয়তো অতোটা স্মার্ট না বইলা ব্রাজিলরে জার্মানির কাছে

মাস্ট উইন ওয়ার্ল্ডকাপে আইসা সেভেন আপ খাইতে হয়। 
আমাদের দেশের ইউ নো হু'র মতো ভিদেলাও '৭৮ সালে আর্জেন্টিনার প্রত্যেকটা ম্যাচে গ্যালারিতে দেখা দিতো। সবাইরে এক পতাকার তলে দেশপ্রেমের টানে ঐক্যবদ্ধ হইতে কইতো। আর ত্রিশ হাজার মানুষরে গুম করতো।

স্পোর্টস ন্যাশনালিজমের কাঁধে ভর কইরা ডেক্টেটরশিপ। আর একদল বেতনভুক্ত রামছাগল আর আরেকদল ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা ঐসময় চেঁচাইতে থাকতো, দেশপ্রেম, দেশপ্রেম। খেলার সাথে রাজনীতি মেশাবেন না।

লিখেছেনঃ আরেফিন

পঠিত : ১২৫৩ বার

মন্তব্য: ০