Alapon

ইউসুফ জুলেখা সমাচার এবং চেপে রাখা ইতিহাস...

“সম্মানিত মুসল্লিয়ানেকরাম

আজকে পবিত্র কুরআনের ১৩ তম পারা দিয়ে আমরা তারাবীহ নামাজ আদায় করব ইনশাআল্লাহ।

এতে আমরা সুরা ইউসুফের অধিকাংশ অংশ পেয়ে যাব। সেই সাথে পাব সুরা রাদ ও সুরা ইবরাহীম।

সুরা ইউসুফ অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন একটি সুরা। 
পবিত্র কুরআনে এটি একমাত্র সুরা যাতে আল্লাহ ধারাবাহিকভাবে কোন নবীর ঘটনা বর্ননা করেছেন।

তবে এটি ইউসুফ জোলেখার কাহিনী নয়।

অনেকে নামাজের শেষে এসে প্রশ্ন করেন “হুজুর! আজ সুরা ইউসুফ তিলাওয়াত করেছেন। কিন্ত কই, জুলায়খার কোন কথাতো কানে এল না!”

‘জুলায়খা’ নামটি কুরআনে নেই। জুলায়খার কাহিনী কল্প কাহিনী কিংবা ইতিহাসের গল্পে আছে। এই নাম ও কাহিনী নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে”

মাসজিদে তারাবীহের আগে ইমাম সাহেব যখন কথাগুলো বলছিলেন, তখন বেশ হাসি পাচ্ছিল। অনেক কষ্টে হাসি চাপতে হল।

পরে ভাবলাম, আমার হাসি পেলেও এই বক্তব্য অনেক গুরুত্বপুর্ন। 
অনেক মানুষই ইউসুফ নামের সাথে জোলায়খার নাম জুড়ে দেন।

রাস্তার ধারে ইউসুফ জোলায়খার প্রেম কাহিনী সম্বলিত রসাত্মক অনেক বই পাওয়া যায়। সে সব বই পড়লে ইউসুফকে কোন নবী মনে হয় না। 
মনে হয় রুপকথা কিংবা মেগা সিরিয়ালের হিরো। যেখানে নায়িকা জুলেখা তার প্রেমে পাগলপারা। শেষে দুজনের মধুর মিলনের মধ্য দিয়ে কাহিনীর সমাপ্তি ঘটে।

আল্লাহ শিখাতে চাইলেন কি আর মানুষ শিখছে কি?

একটা গল্প মনে পড়ে গেল।

এক হিন্দু ভদ্রলোক খুব ধার্মিক। কিন্ত তার স্ত্রীর স্বভাব চরিত্র ভাল নয়। তিনি খানিকটা আঁচ করতে পারেন, পরকিয়ার দিকে স্ত্রীর কিছুটা ঝোক আছে। তিনি ভাবলেন, স্ত্রীকে ধর্ম শিক্ষা দেয়া দরকার। ধর্মের শিক্ষা পেলে হয়তো তার চরিত্রে পরিবর্তন আসবে।

তিনি স্ত্রীকে পাঠালেন এক ধর্ম গুরুর কাছে। কিছু দিন পরে তিনি অবাক হয়ে খেয়াল করলেন, স্ত্রী খুব আগ্রহ নিয়ে শাস্ত্রের পাঠ নিচ্ছে। মনে মনে তিনি তো মহা খুশি! যাক ঔষধে কাজ হয়েছে।

একদিন তিনি কৌতুহল বশেই স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন “আচ্ছা! শাস্ত্রের পাঠ তোমার কেমন লাগছে”

স্ত্রী উত্তর দিল “ খুব ভাল”

তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন “শাস্ত্রের কোন অংশটা তোমার বেশি ভাল লেগেছে?"

সপ্রতিভ স্ত্রী উত্তর দিল “দ্রৌপদি আর পঞ্চ পান্ডবের কাহিনী”

স্বামী বেচারা তখনই জ্ঞান হারালেন।

ভাল কথা। আপনাদের কি পঞ্চ পান্ডব ও দ্রৌপদির কাহিনী জানা আছে?

তবে সংক্ষেপেই বলি। হিন্দুদের কাছে অন্যতম গুরুত্বপুর্ন ধর্মগ্রন্থ হল মহাভারত। একই পুরুষের বংশধর পান্ডব আর কৌরবদের বিবাদ নিয়েই মহাভারতের কাহিনী।

পান্ডবরা পাঁচ ভাই। যুধিষ্ঠির, অর্জুন, ভীম, নকুল আর সহদেব। ভাইয়ে ভাইয়ে দারুন মিল। যে কোন সিদ্ধান্ত সবাই মিলেমিশে নেয়। কোন কিছু খেতে গেলেও পাঁচ ভাই সমান ভাগ করে খায়। তাদের মাতৃভক্তিও অসাধারন। জীবন দিয়ে হলেও মায়ের আদেশ, মায়ের আজ্ঞা পালন করতে সবাই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

দ্রৌপদি ছিল এক রাজ্যের রাজকন্যা। এক স্বয়ম্বর সভায় অর্জুন দ্রৌপদিকে জিতে নেন। বাড়ি ফিরে অর্জুন মা কুন্তির সাথে দেখা করতে আসেন।

অর্জুন মাকে ডেকে বলেন“মা দেখ, তোমার জন্য কি এনেছি?”

কুন্তি তখন প্রার্থনায় মশগুল ছিল। কুন্তি ভেবেছিলেন, হয়তো বন থেকে কোন খাবার কিংবা শিকার নিয়ে এসেছে। ছেলের দিকে না তাকিয়ে তিনি বললেন “যা এনেছ পাঁচ ভাই মিলে ভাগ করে খাও”

মাতৃ আজ্ঞা শিরোধার্য।

দ্রৌপদির সাথে পাঁচ ভাইয়েরই বিয়ে হয়ে গেল। এক নারীর স্বামী হল পাঁচ জন।

এবার বুঝলেন তো, স্ত্রীর উত্তর শুনে কেন ধার্মিক স্বামীটি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন।

অনেকেই হয়তো ভাবছেন, ইউসুফ জোলায়খা ছেড়ে কোন মহাভারতে চলে এলাম!

চলুন ইউসুফ জোলায়খার কাহিনীতে ফিরে যাই।

কুরানের বাইরে ইউসুফ আলাইহিস সালাম সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। দু একটা হাদিসে ইউসুফ আলাইহিস সালামের দৈহিক সৌন্দর্যের বর্ননা আছে। এছাড়া কুরানের বাইরে নির্ভরযোগ্য সুত্রে তেমন কিছু কিছু নেই।

কুরানে আল্লাহ অনেক কাহিনী বর্ননা করেছেন। কিন্ত শুধু গল্পের খাতিরে কাহিনী বলেন নি। ততটুকুই বলেছেন, যার মধ্যে আমাদের জন্য শিক্ষা আছে। 
এর বাইরে অতি রসাত্মক বর্ননাভংগি কুরান পুরো এড়িয়ে গেছে। এদিক দিয়ে কুরান অন্যান্য ধর্মালম্বীদের ধর্মগ্রন্থ থেকে সম্পুর্ন ব্যতিক্রম, গুনে মানে অনন্য।

কুরানে জুলায়খা নামটি নেই। বলা হয়েছে আজীজের স্ত্রী। কোন কোন তাফসিরকারক আজীজের স্ত্রির নাম দিয়েছে জুলেখা। কেউ কেউ তাকে অন্য নামে অভিহিত করেছেন।

ইউসুফের কাহিনীর অন্যতম শিক্ষা হল ইউসুফের সৎ চরিত্র।

আজীজের স্ত্রী ইউসুফের রুপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ ছিল। সে ইউসুফকে বদ্ধ ঘরে খারাপ কাজের আহবান জানায়। কিন্ত আল্লাহভীরু ইউসুফ তার এই আহবান থেকে নিজেকে মুক্ত রাখেন। নিজের চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষার স্বার্থে জেল জীবনকে বেছে নেন।

এখানে ঈমানদারদের জন্য বিশাল শিক্ষা আছে। সত্যের জন্য, আল্লাহ্‌র হুকুম মানার জন্য, এভাবেই যুগে যুগে ঈমানদারদের নানা পরিক্ষার সম্মুখিন হতে হয়। 
সত্যিকারের ঈমানদারেরা হাসিমুখে যে কোন বিপদ আপদ মাথা পেতে নেন। ধৈর্য্য ধারণ করেন। তবু আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্য থেকে পিছু হটেন না।

কুরানে জুলেখাকে কেন্দ্র করে কাহিনী বলতে গেলে এটুকুই। একটা জমজমাট প্রেমের গল্প হতে হতেও হয়নি। কোথায় যেন তাল কেটে গেল। অনেকের তাই এটুকুতে মন ভরে নি।

কল্পনার রং মিশিয়ে তাই ইউসুফ জুলেখার ঘটনাকে কেন্দ্র করে নানা রসাত্মক কাহিনী ফাঁদা হয়েছে। সেখানে ইউসুফের সৎ চরিত্র, তার থেকে নেয়া শিক্ষা গুরুত্বহীন। দুজন নারী পুরুষের মধ্যে রসাত্মক love story টাই মুখ্য।

ইহুদী খৃষ্টানদের মুল ধর্মগ্রন্থগুলো এভাবেই বিকৃত হয়েছে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে, চটকদার ও রসালো করতে গিয়ে তারা তাদের গ্রন্থগুলোকে বিকৃত করে ফেলেছে। সেই সব গ্রন্থ হারিয়েছে মৌলিকত্ব।

তাই খোলা মন নিয়ে কেউ সেই সব গ্রন্থ পড়তে গেলে বারেবারে হোচট খান, খেই হারিয়ে ফেলে্ন। নিজের মনেই ভাবেন“এটা কি সত্যিই ঈশ্বরের বানী? ইশ্বরের গ্রন্থে কি এই ধরনের কথা থাকতে পারে?”

আলহামদুলিল্লাহ! কুরান এই সমস্ত সকল দোষ ত্রুটি থেকে মুক্ত। কুরানে এমন একটি কথাও নেই যেটি যুক্তি, বুদ্ধি, বিবেকের বিরোধী। এমন একটি আলোচনাও নেই যেটি কোন সজ্জন সুরুচি সম্পন্ন পাঠকের অস্বস্তি তৈরি করতে পারে, তাকে বিব্রত করতে পারে।

নবীগন আল্লাহ্‌র বিধান মোতাবেক পরিচালিত। তারা ছিলেন বেগুনাহ, মাসুম, নিষ্পাপ। আল্লাহ পাক তার বিশেষ রহমত দ্বারা তাদেরকে সকল পাপ থেকে দূরে রেখেছেন।

তাই আসুন আমরা কুরান পড়ি, কুরান নিয়ে গবেষনা করি। নবীদের জীবন কাহিনী কুরান থেকেই জানার চেষ্টা করি। তার থেকে শিক্ষা নেই। নিজের জীবনকে সে আলোয় আলোকিত করি।

তাহলে আমাদেরকে আর বিভ্রান্ত হতে হবে না। রাস্তার ধারের কোন চটি বই থেকে ইউসুফ জোলেখার কাহিনী শিখতে হবে না।

তখন তারাবীহ শেষেও আর কেউ প্রশ্ন করবে না “হুজুর! সুরা ইউসুফ তো পড়লেন। কিন্ত জোলেখার নাম তো খুঁজে পেলাম না”


পঠিত : ৬৫৯৩০ বার

মন্তব্য: ০