Alapon

মুসলিম বিজ্ঞানীদের হত্যার নেপথ্যে মোসাদ

 ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মুসলিম বিশ্বকে হুমকি হিসেবে দেখে আসছে ইসরাইল। রাষ্ট্রটি নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় মুসলিমদের প্রধান বাধা মনে করে। এজন্য প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিশ্বজুড়ে মেধাবী মুসলিমদের গুপ্তহত্যা করে আসছে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। তাদের টার্গেটে প্রথমেই থাকে মুসলিম বিজ্ঞানীরা।



১৯৫২ সালে মিসরীয় পরমাণু বিজ্ঞানী সামিরাহ মুসাকে হত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হয় ইসরাইলের গুপ্তহত্যার এই মিশন। সর্বশেষ চলতি বছরও বেশ কয়েকজন মুসলিম বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে তারা। এরমধ্যে আছে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে কর্মরত ফিলিস্তিনি রকেট বিজ্ঞানী ফাদি মোহাম্মদ আল-বাতস।

১৯৫২ সালে ড. সামিরাহকে যুক্তরাষ্ট্রে এক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে হত্যা করা হয়। এই নারী বিজ্ঞানীকে ইসরাইলের পছন্দ না করার কারণ তিনি মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের ক্রমবর্ধমান পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছিলেন। এছাড়া তিনি ইউরেনিয়ামের চেয়ে কম মূল্যে পরমাণু উপকরণ উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করছিলেন।



১৯৬৭ সালে আরেক মিসরীয় পরমাণু বিজ্ঞানী ড. সামির নাজিবকে হত্যা করে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা। পরমাণু প্রযুক্তির সামরিক প্রয়োগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গবেষণা করছিলেন তিনি। মার্কিন শহর ডেট্রয়টে তাকে হত্যা করা হয়। ১৯৮০ সালের জুনে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে রহস্যজনকভাবে মারা যান ইরাকের পরমাণু প্রকল্পের প্রধান ড. ইয়াহইয়া আমিন আল মুশেদ। ধারণা করা হয়, মোসাদ তাকে হত্যা করেছে। ইরাকি পরমাণু চুল্লিতে ফরাসি সহযোগিতা নিয়ে আলোচনার জন্য প্যারিসে গিয়েছিলেন তিনি। তিনিও মিসরীয় বিজ্ঞানী।

১৯৮৯ সালে অজ্ঞাতপরিচয় কিছু দুর্বৃত্ত মিসরীয় বিজ্ঞানী সাইদ আল-বোদায়েরকে তার নিজের বাসভবনে গুলি করে হত্যা করে। মাইক্রোওয়েভ বিষয়ে কাজ করছিলেন তিনি। ১৯৯১ সালে লেবাননের পদার্থবিজ্ঞানী রামাল হাসান রামাল প্যারিসে রহস্যজনকভাবে খুন হন। তিনিও মোসাদের শিকার বলে মনে করা হয়। ২০০৪ সালে ইরানি পদার্থবিজ্ঞানী মাসুদ আলি মোহাম্মদিকে তেহরানে তার বাড়ির বাইরে হত্যা করা হয়। কণা পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করছিলেন এই বিজ্ঞানী। ওই ঘটনার জন্য ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছে ইরান। তবে ওয়াশিংটন এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করলেও, এ নিয়ে কথা বলেনি ইসরাইল।



গত বছর তিউনেশিয়ায় হত্যা করা হয় দেশটির অ্যাভিয়েশন প্রকৌশলী মোহাম্মদ আল-জাওয়ারিকে। তিনি ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ড্রোন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছিলেন জাওয়ারি। নিজ বাসভবনের বাইরে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

চলতি বছর ফাদি মোহাম্মদ আল-বাতসকে হত্যা করা ছাড়াও বিভিন্ন দেশে মুসলিম মেধাবীদের হত্যা করেছে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ফিলিস্তিনি প্রকৌশলী ও কানাডায় পিএইচডি গবেষক হাসান আলি খাইরুদ্দিনকে হত্যা করে মোসাদ। বিশ্ব অর্থনীতিতে ইহুদি আধিপত্য নিয়ে গবেষণা করছিলেন তিনি। না থামলে মেরে ফেলা হবে- এমন হুমকি আগে থেকেই দেয়া হচ্ছিল ২৩ বছর বয়সী এই গবেষককে। শেষ পর্যন্ত সেন্ট ম্যারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আবাসিক এলাকায় তাকে হত্যা করা হয়।



গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সে হত্যা করা হয় লেবাননের আরেক বিজ্ঞান শিক্ষার্থী হিশাম সালিম মুরাদকে। তিনি জোসেফ ফুরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরমাণু পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন। এই গুপ্তহত্যার পেছনে মোসাদ জড়িত বলে মনে করে নিতহের পরিবার। চলতি বছরের ২৫ মার্চ পশ্চিমতীরে ফিলিস্তিনি রসায়নবিদ ইমান হোসাম আল-রোজাকে হত্যা করে ইসরাইল।

অনেককে হত্যা না করলেও অন্য পন্থায় দমন করে এই ইহুদি রাষ্ট্রটি। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের স্নায়ুবিজ্ঞানী ড. আফিয়া সিদ্দিকি। এমআইটির এই গ্রাজুয়েটকে নামমাত্র এক অভিযোগে ৮৬ বছরের কারাদণ্ড দিয়ে রেখেছে মার্কিন সরকার। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি এক মার্কিন সেনাকে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন।

এভাবে সারা বিশ্বে মুসলিম বিজ্ঞানীদের হত্যা করে নিজের আধিপত্যবাদী ও বর্ণবাদী এজেন্ডা কায়েম রেখেছে ইসরাইল। আরব ও মুসলিম বিশ্ব যাতে বিজ্ঞান, বিশেষ করে পরমাণু প্রযুক্তিতে এগিয়ে যেতে না পারে সেজন্য এই গুপ্তহত্যার পথ বেছে নেয় দেশটি। এ ধরনের ঘটনা যদি উল্টোটা হতো, তবে কী হতো?



কোনো মুসলিম বা আরব দেশের গোয়েন্দা সংস্থা যদি কোনো ইহুদি বিজ্ঞানীকে হত্যা করতো! সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত মুসলিম বিশ্বকে সন্ত্রাসী আখ্যা দেয়া হতো। পশ্চিমা সরকারগুলো আরব দেশগুলোতে কথিত সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান শুরু করতো। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, ইসরাইলি গুপ্তহত্যা থেকে মুসলিম বিজ্ঞানীদের রক্ষা করবে কে?

বিশ্লেষকরা মনে করেন, মুসলিম বিজ্ঞানীদের হত্যার মধ্য দিয়ে ইসরাইল মুসলিম দেশগুলোকে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়। তারা যাতে পরমাণু প্রযুক্তির মালিক হতে না পারে সেজন্য এসব করে যাচ্ছে দেশটি। এ ব্যাপারে তুর্কি রাজনৈতিক ভাষ্যকার মোস্তফা ওজান বলেন, ‘মুসলিমরা এ ধরনের প্রযুক্তির মালিক হবে- একে ইসরাইল বিপজ্জনক মনে করে। তারা চায় না বিজ্ঞানে মুসলিমরা বড় কোনো সাফল্য অর্জন করুক। আর এ কারণেই তারা মিসর, ইরাক, ইরান ও পাকিস্তানের মতো মুসলিম দেশগুলোর বিজ্ঞানীদের টার্গেট করে।’

তিনি আরো বলেন, ‘এসব হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে ইসরাইল কখনো কোনো মন্তব্য করে না যাতে বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনা সৃষ্টি না করে।’



তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন সিরীয় বংশোদ্ভূত সুইডিশ লেখক হাতেম আল-জোয়াবি। তিনি বলেন, ‘মোসাদ মুসলিম বিজ্ঞানীদের হত্যা করার কারণ এসব দেশকে গবেষণা উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত রাখা।’ যেসব মুসলিম তাদের দেশের যেকোনো ক্ষেত্রে দক্ষ ভূমিকা রাখতে পারে- তাদের সবাইকেই ইসরাইল টার্গেটে রাখে বলেও মত দেন এই লেখক।

তথ্যসূত্রঃ
আরটিএনএন

পঠিত : ১৩৬০ বার

মন্তব্য: ০