Alapon

ইস্তাম্বুল যেভাবে আমাদের হলো...

ইস্তাম্বুল আমাদের হয়েছে ১৪৫৩ সালের ২৯ মে। এই দিনে অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতান ফাতিহ মুহাম্মদ এর নেতৃত্বে কনস্টান্টিনোপল বিজয় হয় যার বর্তমান নাম ইস্তাম্বুল! সুলতান ফাতিহ মুহাম্মদের অসাধারণ নৈপুণ্যে সেকালের কনস্টান্টিনোপল বিজয় হয়। মুসলিমরা অধিকার করার পর এর নাম হয় ইস্তাম্বুল বা ইসলামের শহর বা শান্তির শহর। 

ইস্তাম্বুলের ইতিহাস:
ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রাচীন ‘দোরিয়ান’ গোত্র ‘মেগারন’ নামক আরেকটি গোত্রের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে খৃস্টপূর্ব ৬৪০ সনে বর্তমান ইস্তাম্বুল শহরের অন্তর্ভুক্ত খালসেদন এলাকায় এসে বসতি স্থাপন করে। এর দু’দশক পর মেগারন গোত্রও তাদের দলপতি ‘বাইজাসে’র নেতৃত্বে এসে শহরের অপর পাশে সারাবুর্নু এলাকায় বসতি গড়ে তোলে। শোনা যায়, বাইজাস ইস্তান্বুল শহরের গোড়াপত্তন করেন এবং তাঁর নামেই এলাকাটি ‘বাইজেন্টিয়াম’ নামে পরিচিতি লাভ করে। 

পরবর্তীকালে তাঁর নামেই শক্তিশালী বাইজেন্টেনীয় সাম্রাজ্যের সৃষ্টি হয়। বাইজেন্টেনীয় আমলে এখানে ধর্মীয় উপাসনালয় নির্মাণের পাশাপাশি শিল্প-স্থাপত্য-ভাস্কর্য ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে। বাইজেন্টেনীয় আমলের সভ্যতার অনেক নিদর্শন এখনো ইস্তান্বুলের গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ হয়ে আছে। 

এরপর খৃস্টপূর্ব ৫১৩ সনে ইস্তান্বুল পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। সে আমলের প্রভাব এখন তেমন একটা পরিদৃশ্যমান না হলেও প্রত্যেক দখলদার বাহিনীরই কিছু না কিছু প্রভাব প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জনজীবন ও সভ্যতার ধারায় প্রবাহমান থাকে। অতঃপর খৃস্টপূর্ব ৪০৭ সনে ইস্তান্বুল এথেন্সের দখলে চলে যায়। এরপর রোম-সম্রাট সেপ্টিমাস সেভেরা ১৯৬ খৃস্টাব্দে এ শহরকে রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। 

পরবর্তীতে রোম-সম্রাট কন্সস্ট্যান্টিনোপল তাঁর নামানুসারে শহরের নামকরণ করেন কন্সস্ট্যান্টিনোপল।


তিনি ৩৩০ সনের ১১ মে আনুষ্ঠানিকভাবে কন্সস্ট্যান্টিনোপলকে রোমান সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানী বলে ঘোষণা করেন। রোম-সম্রাট প্রথম থিওদোসিয়াসের রাজত্বকালে ৩৯৫ সনে রোমান সাম্রাজ্য পূর্ব ও পশ্চিম-এ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং কন্সস্ট্যান্টিনোপল তখন পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানীতে পরিণত হয়। 

রোমান আমলে এ শহর খৃস্টান জগতের প্রধান ধর্মীয় কেন্দ্র ও খৃস্টান সভ্যতার ব্যাপক প্রচার-প্রসার ও চর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়। বলতে গেলে, ঐ আমলে এ শহর ছিল বিশ্ব-সভ্যতার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। ইস্তান্বুলের বিশ্ব-বিখ্যাত বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনা তার উজ্জ্বল স্বাক্ষর এখনো বহন করে চলেছে।


ক্রসেড চলাকালে এক পর্যায়ে ১২০৪ সনে ইস্তান্বুল ল্যাটিনদের দখলে চলে যায়। অতঃপর ১২৬১ সনে এ শহরটি পালিওলোগস রাজবংশের অধিকারভুক্ত হয়। এরপর মুসলিমগণ প্রথমে ১৩৯০ সনে সেনাপতি বায়োজিদের নেতৃত্বে এবং ১৪২২ সনে সেনাপতি দ্বিতীয় মুরাদের নেতৃত্বে শহর অবরোধ করেন। 

ঐ সময় পার্শ্ববর্তী কিছু এলাকায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারলেও শহর দখল করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। সমুদ্র ও পাহাড়বেষ্টিত স্বাভাবিক প্রাকৃতিকব্যূহ দীর্ঘদিন পর্যন্ত শহরকে বহিরাক্রমণ থেকে রক্ষা করে। অবশেষে সুলতান ফতেহ্ মুহম্মদের দুর্ধর্ষ সাহসিকতা ও অভিনব রণ-কৌশলের কাছে খৃস্টান-শক্তির পরাজয় ঘটে এবং তুর্কি মুসলিমগণ ১৪৫৩ সনে শহর অধিকার করে এর নাম দেন ইস্তাম্বুল। 

ইস্তাম্বুল বিজয়ে মুসলিমদের প্রাণান্তকর চেষ্টা: 
আল্লাহর রাসূল সাঃ কনস্টান্টিনোপল জয় নিয়ে একটি ভবিষ্যতবাণী করেন এবং যারা এই বিজয় অর্জন করবে তাদের জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। সেই থেকে মুসলিমরা এই শহর অধিকার করার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করেছিল।  

রাসূল সাঃ বলেছিলেন: “আমার উম্মতের এক সেনাদল কনস্ট্যান্টিনোপল জয় করবে। কতই না মুবারক সেই দল, কতই না মোবারক সেই সেনাপতি”। তিনি আরো বলেছিলেন, যে সেনাদল প্রথম কনস্ট্যান্টিনোপল জয় করবে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে”। 

এই ঘোষনার সূত্র ধরেই কনস্ট্যান্টিনোপল জয় এর উদ্দেশ্য যারা মার্চ করেছিলেন তাদের মাঝে ছিলেন ৮০ বছর বয়সী হযরত আইয়ুব আল আনসারী রাঃ। কনস্ট্যান্টিনোপল এর কাছে গিয়ে তার মৃত্যু হয়।


রাসূল সাঃ এর ভবিষ্যত সূত্র ধরে সাহাবীরা চেষ্টা চালিয়েছেন একের পর এক। সবগুলো চেষ্টাই ছিল ব্যর্থ। প্রায় দুই লাখ মুসলিম সেনা শেষ হয়ে গিয়েছিল তবু কনস্টান্টিনোপল জয় করা সম্ভব হয়নি। 

১৪৫৩ সালের ৬ এপ্রিল সুলতান মুহাম্মদ এর বাহিনী কনস্ট্যান্টিনোপল অবরোধ করে। এই কনস্ট্যান্টিনোপল হাজার বছর ধরে খ্রীস্টানদের বিজয়ের প্রতীক হিসেবে মাথা উচু করে ছিল। এর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল দুর্ভেদ্য এবং অজেয়। এক মাস ধরে হাজারো উপায়ে চেষ্টা করেও কোন উপায় হচ্ছিল না অথচ উসমানীয় খেলাফতের হাজার হাজার সৈনিক শহীদ হয়ে যাচ্ছিলেন। 

এই জয় নিয়ে একটি ঘটনা ইতিহাসে চালু রয়েছে।


২৪ মে সুলতান মুহাম্মদ এর আধ্যাত্মিক গুরু শাইখুল ইসলাম আঁকা শামসুদ্দিন তার সাথে দেখা করতে এলেন। তিনি বললেনঃ আমি পর পর সাত দিন হযরত আইয়ুব আনসারি রাঃ এর কবর স্বপ্নে দেখছি। বিজয় হবে কি হবে না তা আল্লাহ জানেন আসো আগে আইয়ুব রাঃ এর কবর খুজে বের করি। 

২৫ মে কবর পাওয়া গেলে কফিন খোলা হল। হযরতের হাতে একটা কাগজে লেখা ছিলঃ


“তোমরা যদি কোনদিন কনস্ট্যান্টিনোপল জয় করতে পারো, তাহলে শহরের একটু মাটি আমার হাতে দিও”।
সুলতান কাঁদতে কাঁদতে তাবুতে চলে গেলেন। বের হয়েই ঘোষণা দিলেনঃ হয় বিজয় নয় মৃত্যু এর বিকল্প নেই। 

আল্লাহর রাসূল সা: এর সাহাবী আমাদের কাছে এই শহর বিজয় করে মাটি চেয়েছেন! তার হাতে যদি আমরা মাটি এনে দিতে না পারি তবে কি লাভ বেঁচে থেকে!


উসমানীয় সৈনিকরা ঝাঁকে ঝাঁকে যেন শহীদ হবার প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। এক সৈনিক কনস্টান্টিনোপল এর ওয়াল বেয়ে উপরে উঠে কালিমার পতাকা উড়ানোর চেষ্টা চালালেন। খ্রীস্টান সৈনিকরা তীর আর গুলি চালালো তার উপর কিন্ত একের পর এক তীর আর গুলি তার শরীরে বিদ্ধ হলেও তিনি থামলেন না। 

পতাকা উড়িয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। যখন তার লাশ নামানো হল দেখা গেল শরীরে ২৩ টি তীর বিদ্ধ হয়েছে!


অসংখ্য রক্তের বিনিময়ে অবশেষে এলো অনেক আকাঙ্ক্ষিত বিজয়। সত্য হল রাসূল সাঃ এর ভবিষ্যতবাণী ঠিক তার ইন্তেকালের ৮২১ বছর পর। কনস্ট্যান্টিনোপল এর নাম করা হল ‘ইসলামবুল’ অর্থাৎ ইসলামের শহর।

পঠিত : ১৫৩৩ বার

মন্তব্য: ০