Alapon

নারী মানেই প্রেমিকা নয়...

১.

ক.

সকাল ছিল রোদ ঝলমলে। দুপুর হতে না হতেই মেঘ করে এল। বাইরে ঝিরিঝিরি বাতাস। বৃষ্টি বুঝি এই এল বলে।

কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়েছিলাম। হঠাৎ দরজায় দুম দুম শব্দ।

দরজা খুলে দেখি, আম্মা ফোন কানে দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে সুস্পষ্ট বিরক্তির ভাব।

আমার জিজ্ঞাসু চেহারা দেখে বললেন “মালয়েশিয়া থেকে এক পাগলের ফোন। একটু কথা বলতো”

আমি ফোন কানে হ্যালো হ্যালো করলাম। কোন সাড়া শব্দ নেই। খুট করে একটা শব্দ হল। মনে হয় কেটে দিয়েছে।

ফোন রেখে আম্মাকে জিজ্ঞাসা করলাম “ঘটনা কি?”

আম্মার মুখ থেকে যা শুনলাম, তার সার সংক্ষেপ হল, আমার ছোটবোনের হাসব্যান্ড থাকে মালয়েশিয়া। তিনি সেখানকার এক ছেলের নাম্বার দিয়েছিলেন। 
বলেছিলেন একটা জরুরী প্রয়োজনে তার সাথে কথা বলতে। ছোট বোন আম্মার ফোন থেকে কল দিয়েছিল। কিন্ত কোন একটা ডিজিট ভুল হওয়াতে রং নাম্বারে চলে যায়।

ও প্রান্তের লোকটা একটা মেয়ে কন্ঠের ফোন পেয়ে ব্যাপক রোমাঞ্চিত।

যতই বলা হল, ভাই ভুলে রং নাম্বারে গিয়েছে, সেই লোক নাছোড়বান্দা। আম্মাকে বারবার ফোন করছে। বারবার জিজ্ঞাসা করছে, তিনি কি করেন, কোথায় থাকেন ইত্যাদি ইত্যাদি।

আম্মা বুঝানোর চেষ্টা করলেন “দেখুন আমি বিবাহিত। আমার ছেলে মেয়ে অনেক বড়। তাদেরও বিয়ে হয়ে গেছে। আমার নাতি নাতনী আছে”

আম্মার কথা লোকটার বিশ্বাস হয় নি। সে একের পর এক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেই চলল “আপনার স্বামী আছে? তিনি কি করেন? কবে মারা গেছেন…ইত্যাদি ইত্যাদি”

আম্মা বারবার ফোন কাটছেন। আর এই লোক বারবার ফোন করেই যাচ্ছে।

ছোট বোন কিছুটা অবাক। মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশে কল করতে ভালই খরচ হয়। এই লোক দেখি তবুও ফোন করেই যাচ্ছে, করেই যাচ্ছে!

আমি আম্মাকে বললাম “এক কাজ করবেন। এই লোক আবার ফোন করলে ফোন রিসিভ করবেন। তারপরে ফোনটা কোন কথা ছাড়াই উলটে রেখে দিবেন। দেখা যাক সে কতক্ষন একা একে একা কথা চালাতে পারে? 
এদের সাথে কথা বললেই মুশকিল। আরো উৎসাহ পায়। তার চাইতে এটাই মোক্ষম ঔষধ। টাকাও খরচ হবে, আবার কথা বলতে না পেরে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে”

.
খ.

আগে আগেও এমন ঘটনা ঘটেছিল।

আমি তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। বাসায় গিয়ে শুনি আম্মার এক মোবাইল প্রেমিক জুটেছে। এক লোক রং নাম্বারে আম্মার ফোনে ফোন দিয়েছিল। যখন বুঝল এই মোবাইলের মালিক এক নারী, তখন আর তাকে পায় কে?

আম্মা যতই বলেন, আমি অনেক বয়ষ্ক একজন মানুষ, আমার স্বামী আছে, সন্তান আছে, বড় মেয়ের ঘরে নাতি নাতনী আছে…কে শোনে কার কথা?

সেই লোক কোনভাবেই মানতে নারাজ। যার এত সুন্দর কন্ঠ, তার বয়স ২০\২২ এর বেশি না হয়েই যায় না। তার সুনিশ্চিত ধারনা, আম্মা তাকে ব্লাফ দিচ্ছে।

আম্মা ফোন ধরা বন্ধ করে দেন। নাছোড়বান্দা বিদ্রোহী প্রেমিক একের পর এক মেসেজ দেয়া শুরু করল। খুবই রোমান্টিক সব মেসেজ। দুয়েকটাতে আবেগঘন ভাষায় লেখা I love You

এই প্রসঙ্গ উঠলে আব্বু হাসিতে ফেটে পরতেন। আম্মার মুখেও তখন লাজুক হাসি।

বেশ কিছুদিন পরে বেচারা প্রেমিক হাল ছেড়ে দেন। কিংবা হয়তো ততদিনে রিং নাম্বারে নতুন কাউকে খুজে পেয়েছেন।
.

গ.
মোবাইল চালু হয়েছে বেশি দিন হয় নি।

মাত্রই লোকে মোবাইলে কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। কিছু লোকের কাজই ছিল অপরিচিত নাম্বারে ফোন দেয়া আর নারী কন্ঠ খোঁজা।

একবার পেয়ে গেলেই কেল্লাফতে। বারবার তাকে ফোন দিয়ে প্রেম নিবেদন করা চাই। বলা যায় না, হাজার জনের সাথে চালিয়ে গেলে, দু একজনের সাথে কিছু একটা হয়ে যেতেও পারে।

আপাও তখন নতুন নতুন ফোন ব্যবহার শুরু করেছেন। এক লোক শুরু করল সকাল সন্ধ্যা জ্বালাতন। তখন নাম্বার ব্লক করা যেত না। সকাল বিকাল ফোনের জ্বালায় ত্যক্ত বিরক্ত অবস্থা।

শেষে দুলাভাই একদিন নরম ভাষায় তাকে বুঝিয়ে বললেন “ভাই, আপনি যাকে ফোন করছেন তিনি আমার স্ত্রী। তিনি তিন তিনটি সন্তানের মা”

সহৃদয় লোকটার বিশ্বাস হয় কথাগুলো। পরে আর ফোন করে নি। হয়তো তার প্রত্যায় জন্মেছিল “ইহা মে কুছ হোনেওয়ালা নেহি”
.
ঘ.
খালাম্মার গল্পটাও আম্মার কাছাকাছি।

খালাম্মা বয়সে আম্মার বছরখানেকের বড়।

তাকেও অপরিচিত এক নাম্বার থেকে খুব ডিস্টার্ব করা হত। সেই লোক আবার খুব ষ্ট্রেট ফরোয়ার্ড। আলাপের কয়েক মিনিটের মধ্যেই সরাসরি বলে বসে “আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি”

রসিক খাল্লাম্মা জবাব দিলেন “তাই নাকি? তা তুমি কি জান আমার বয়স কত?”

সেই লোক জানতে চাইল “কত?”

খালাম্মা বললন “আমি তোমার মায়ের বয়সি। আমার মেয়ের ঘরে নাতনী আছে”

“যাহ! তুমি মিথ্যা বলছ” প্রেমিক প্রবরের গলায় অবিশ্বাসের ছাপ “তোমার এত বয়স হতেই পারে না।“

অনেক অনেক পরে লোকটা রনে ভংগ দেয়। হয়তো বুঝে ফেলে এখানে প্রেমের সম্ভাবনা শুন্য।
.
.
২.
নারী কন্ঠ শুনলেই পুরুষদের এমন ‘ছ্যবালামির’ কারন কি?

নারীর প্রতি পুরুষ দুর্দমনীয় আকর্ষন বোধ করে। নারীর রুপ সৌন্দর্য পুরুষকে এক অমোঘ আকর্ষনে টানে। নারীর কন্ঠের মিষ্টি হাসিতে পুরুষ নিজেকে হারিয়ে খুঁজে। নারীর এক অংগুলি হেলনে পুরুষ তার রাজ সিংহাসন হারাতেও পিছ পা হয় না।

নারীর প্রতি পুরুষের এই যে আকর্ষন, এই যে টান, স্রষ্টা প্রদত্ত। কিন্ত অপরিচিত নাম্বারে ফোন করে এই রকম কান্ড কীর্তনের পেছনে একমাত্র এটাই দায়ী নয়। আমাদের সমাজ সামাজিকতা যেভাবে চলছে তারও অনেকখানি দায় আছে।

‘রং নাম্বারে ফোন করে প্রেম হয়েছে’ এ রকম নাটক, সিনেমা গান হয়েছে ভুরে ভুরে। খুব ছোটবেলায় একটা গান খুব বিখ্যাত হয়েছিল “রং নাম্বার টেলিফোনে\নাম না জানা কেউ বলল হ্যালো…লাইনটা হঠাৎ কেটে গেল…হ্যাল্লো, হ্যাল্লো, হ্যাল্লো/লাইনটা কেটে গেল…উ…উ…উ” সারা দেশে ঐ গান তখন ধুন্ধুমার হিট।

অনেক নাটক সিনেমাতেই দেখা যায়, রং নাম্বারে ফোন করে নায়ক নায়িকার পরিচয় হয়। শুরুর দিকে নায়িকা বিরক্ত বিরক্ত একটা ভাব ধরলেও, এক সময় আসক্ত হয়ে যায়। শুধু ফোনে ফোনে আলাপ, কেউ কাউকে দেখেনি…তবুও দুজনের সে কি গভীর প্রেম! এক সময় দেখা হয়। প্রেম গড়ায় পরিনয়ে।

এই সব দেখে দেখে, শুনে শুনে অনেক পুরুষই নারী মাত্রই সম্ভাব্য প্রেমিকা ভাবেন। নিজেকে কল্পনা করেন সেই নায়ক হিসেবে।

কল্প লোকে ভাবতে থাকেন “প্রথমে ফোনে ফোনে কথা হবে। পরে তিনি তার বিরল প্রতিভা দিয়ে সেই মিষ্টি কন্ঠের মানুষকে পটিয়ে ফেলবেন। তারপর দুজনের দেখা হবে। আগ থেকে ঠিক করা কোন এক জায়গায় দুজন মিলিত হবেন। একজনের পরনে থাকবে নীল শাড়ি। অন্যজনের গায়ে আকাশি শার্ট। হাতে থাকবে টকটকে লাল গোলাপ”

সুখস্বপ্নে বিভোর পুরুষটি একের পর এক চেষ্টা চালিয়ে যান। ফোনের ওপ্রান্তে নারীরা বিরক্ত বোধ করেন। ধৈর্য্য হারিয়ে গালাগাল দেন। তবুও তিনি নাছোড় বান্দা। কারন তিনি জানেনে, নারীরা শুরুর দিকে একটু একটু অমন করে। ধৈর্য্য ধরে চালিয়ে গেলে এক সময় ঠিকই নরম হবে। সিনেমায় এমন কত্ত দেখা গেছে!

নাটক, সিনেমা, গান কিংবা গল্পে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারী এক রুপেই আবির্ভুত হয়। গ্লামারাস, ফ্যাশনেবল, রুপের ছটায় আলোকজ্জ্বল। এসব মাধ্যমে বোন, মা কিংবা আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন কোন মানুষ হিসেবে নারীর উল্ল্রেখযোগ্য উপস্থিতি তেমন নেই বললেই চলে।

আগে কোন এক সময় নাটক সিনেমায় মা কিংবা বোনের শক্তিশালী চরিত্র দেখা যেত। এখন সেই সব চরিত্র চলে গেছে জাদুঘরে।

নারীর এখন একটাই রুপ…প্রেমিকা। নারীর একটাই রুপ…নারী মোহনীয়, কমনীয়,আবেদনময়ী। নারী পুরুষের মাঝে একটাই সম্পর্ক- প্রেম।

নারী কোন পুরুষের মা নয়, বোন নয়…শুধুই প্রেমিকা। পুরুষ কোন নারীর ভাই নয়, বাবা নয়…শুধুই প্রেমিক। লোভ, লালসা কিংবা প্রেম…এটাই নারী পুরুষের একমাত্র রসায়ন।

তাইতো ফোন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, হাটে মাঠে ঘাটে...সর্বত্র নারীর বিড়ম্বনা বাড়ছে। বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়, নারীর অবমুল্যায়ন, নিরাপত্তাহিনতা।

শুধু নীতি বাক্য আর তত্ব কথার মোড়কে সমাজ বদলায় না। সমাজ বদলাতে, চিন্তা চেতনায় পরিবর্তন আনতে এই সব কিছুরই বদল চাই।

গ্লামার আর বিনোদন জগতের চাকচিক্যময় ভুবনে নারীর উপস্থিতি কি বদলাবে? বদলাবে কি নারীর ‘শুধুই প্রেমিকা’ রুপ? 
লালসা কিংবা কামনার বলয় থেকে মুক্ত হয়ে নারী কি হয়ে উঠবে আত্মপ্রত্যয়ী একজন? 
আত্মসম্মান বোধ সম্পন্ন একজন মানুষ হিসেবে কি দর্শকের চোখে ধরা দিবে ?

উত্তর জানা নেই। তবু, খুব আশাবাদী হতে ইচ্ছে করে...


পঠিত : ১৩৫৬ বার

মন্তব্য: ০