Alapon

'সিঁদল' কাব্য!

উত্তরবঙ্গের বিখ্যাত একটি খাবার সিঁদল। রংপুর,কুড়িগ্রাম,লালমনিরহাট, গাইবান্ধা,দিনাজপুর,ঠাকুরগাঁও,পঞ্চগড়,রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ,এলাকার মানুষের প্রিয় খাবার এটি।

১৯৯৮ সালে আমার বন্ধু দেলোয়ার একবার বাড়ি থেকে সিঁদল নিয়ে এলো কিন্তু হলে পাটা- পুঁতা না থাকার কারণে আমরা সেই সিঁদল খেতে পারলামনা। সিঁদলের গল্প শুনে জিহ্বায় পানি চলে এসেছিলো। ঘটনাক্রমে সিঁদলের কারিগর আজ আমার ঘরে।মাসে একবার তার সিঁদলের ভর্তা বানাতেই হবে এবং দিয়ে ভাত খাওয়ার পর আমার টাক মাথাদিয়ে অঝরে ঘাম ঝরার দৃশ্যটি আমার ছেলেদের কাছে কাছে খুবিই মজার।এটি খাওয়ার জন্য বাড়ি হতে ছোট্ট পাটা-পূঁতা আনিয়েছে। 
এটি বানানোর পর শরিষার তেল দিয়ে মাখানোর দায়িত্বটা আবার আমার। ২০০৭ সালে এটি খাওয়ার সুযোগ পেলাম শ্বশুরবাড়িতে। টেবিলে আমার সামনে সিঁদল দেওয়া হতোনা।আমার সঙ্গিনী জানে আমি ভর্তাজাতীয় বস্তু ভীষণ পছন্দ করি।

প্রথমবার খেয়ে বুঝে গেলাম কেন দেলোয়ার এত কষ্ট করে আরিচা নগরবাড়ি হয়ে তিনদিনে ঢাকায় এসেছিলো।হলের ডাইনিং বন্ধ থাকলে আমরা রুমমেটরা মিলে রান্না করতাম হিটারে।স্যারেরা মাঝে মাঝে হামলা দিলে গরম হিটার নিয়ে দৌঁড়ে বাথরুমে চলে যেতাম।আরো কত মজার কাহিনী করতাম আমরা।বেগুন,আলু,কাঁচকলা,ডিমের ভর্তা ছিলো আমাদের জন্য সহজে তৈরি করার উপযোগী খাবার। ওগুলো বানাতে আমি মোটামুটি এক্সপার্টি ছিলাম বলা যায়।সিঁদল কিভাবে প্রসেস করতে হয় সেটা দেলোয়ারের জানা ছিলোনা হয়ত। নানার বাড়িতে পড়ালেখা করা আদরের নাতি হয়ত বিস্তর সিঁদল ভর্তা,গরমভাত,মাসকলাইয়ের ডালদিয়ে খেয়েছে কিন্তু ভর্তা প্রসেস করার সিস্টেম না জানার কারণে তার সিঁদল ঢাকা ঘুরে আবার পঞ্চগড় চলে গেলো। পু্ঁটি,ঢেলা মাছ রোদে শুকিয়ে ঝনঝনা করে সামগাইন বা ঢেঁকিতে মিহি করে কুটতে হয় প্রথম।তারপর এরবসাথে কালো কচুর কচি ডাইগ্যা কুচি কুচি করে কেটে সামগাইনে কুটতে হয়। এরপর কাপড়ে করে পেঁচিয়ে কয়েকদিন ঝুলিয়ে রেখে পানি বের করে ফেলতে হয় যাকে বলে একদিন পঁচানী অর্থাৎ ভয়াবহ গন্ধ উঠাতে হবে।

এরপর পরেরদিন আবার সামগাইনে কুটে সামান্য সরিষার তেল,হলুদ হাতের তালুতে নিয়ে গোল গোল বল বানিয়ে রোদে শুকালেই হয়েগেলো সিঁদল। রোদে শুকানোর পর আর সেই ভয়াবহ গন্ধ থাকেনা।এবার সীল পাটায় বেটে রসুন,লাল মরিচ মিশিয়ে বানাতে হবে ভর্তা।এর সাথে লাফা শাকের ঝোল বা মাসকালাইয়ের ডাল দিয়ে খেলে আত্মার শান্তি!টাক মাথা যাদের তাদের অবস্থাটা তাড়াতাড়ি বোঝা যায়। একদিকে টাক বেয়ে ঘাম আরেকদিকে স্বাদ! যারা বেশি ঝাল খেতে পারেন তাদের জন্য সোনায় সোহাগা।আর যারা ঝালে দূর্বল তারাও খেয়ে চিনি খাবেন বা হুশহাস করতে থাকবেন! 

একবার ২০০৩ সালে গাজীপুরের কাপাসিয়ায় সোহেল তাজ ভাইয়ের এলাকায় বেড়াতে গিয়েছিলাম আমার ছোটভাই শফিকের বাড়িতে। আমি ফয়সাল সেখানে চারদিন ছিলাম। প্রতিবেলা চ্যাঁপা শুটকির ভর্তা দিয়ে পাল্লা করে ভাত খেতাম আমরা।আহা কি যে গন্ধ আর ভয়াবহ স্বাদ!শফিকের ভাবি কত্ত আইটেম রান্না করতো কিন্তু আমরা ঐ চ্যাঁপাতেই পড়ে থাকতাম। ভাবি বলতেন: এগুলোতো আমাদের কামলাদের খাবার,তোমরা খেয়ে কি মজা পাও?আমরা কোন জবাব দিতে পারলামনা।শুধু চ্যাঁপার ভর্তা দিয়ে প্লেটের পর প্লেট খেয়ে চললাম। ভাবিকে প্রতিবলা ভর্তা বানাতে হতো।মাছ,মাংস আমরা তেমন খেলামইনা।এরপর ২০০৪ এ গেলাম নরসিংদীর মনোহরদী ছোটভাই ফয়সালের ভাইয়ের বিয়েতে। বিয়েটা হওয়ার একদিন পরই আমরা পাগল হলাম চ্যাঁপা খাওয়ার জন্য।সে কি এলাহী কান্ড।নতুন ভাবি হেঁসে খুন।কে শুনে কার কথা।

আমরা আসার দিনও চ্যাঁপা দিয়ে পেটপুরে খেয়ে আসলাম। আমার ফরিদপুরতো ঝাল খাওয়ার ওস্তাদ!চিংড়ী, কুমড়োর বিচি,কালজিরা,রসুন,ধনিয়া পাতা,মেথি,বড়কচুর ভর্তা আমাদের রসনার প্রাণ।বৃহত্তর সিলেটের বাহারী চাটনির কথা কি আর বলবো।নোয়াখালী, কুমিল্লা,চিটাগাং,ময়মনসিংহ সবজায়গায় ভর্তারই জয়জয়কার। যশোর,কুস্টিয়া এলাকার মানুষের প্রিয় খাবার ছিটরুটির সাথে ভূনা গোশত। ভর্তা শুটকিতে তারা আবার পিছিয়ে। খুলনা সাতক্ষীরা,বাগেরহাটে সবকিছুতেই চিংড়ীর ছোঁয়া আপনার খাওয়াকে আরো মধুময় করবে।ঢাকার কথা কিআর বলবো।এখানে সব কিছুই খাওয়া হয়।আমাদের সময়ে আমরা মাসে অন্তত একবার পুরান ঢাকার 'নীরব হোটেলে'খেতে যেতাম।বাহারী ভর্তা আর নানান জাতের মুখরোচক খাবার খেয়ে আমরা মনকে তৃপ্ত করতাম। আমাদের এই দেশের প্রতিটি জেলারই এমন স্পেশাল কিছু খাবার আছে যা ঐ এলকার ধনী গরীব সব মানুষের প্রিয় খাবার।এই কারণেই আমরা ভোজন রসিক বাঙালী।

পঠিত : ৬৮৫ বার

মন্তব্য: ০