Alapon

এরদোগান কেন আবার ক্ষমতায় আসবে?

গত ১৬ বছরে শাসনামলে এবারই প্রথম এরদোগানের মোকাবেলায় শক্তিশালী বিরোধী জোট গঠিত হয়েছে। ১৯২৪ সালে আধুনিক তুরস্কের যাত্রার পর হতে এরদোগানের দল একেপি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে তুরস্ককে শাসন করে যাচ্ছে।

আগামী ২৪ জুন তুরস্কে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সংসদ ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। গণভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থায় প্রবেশের পর এটাই তুরস্কের প্রথম প্রেসিডেন্ট ও সংসদ নির্বাচন।

২০০২ সালে এরদোগান ক্ষমতায় আসার আগে ‘ইউরোপের রুগ্ণ দেশ’ হিসেবে পরিচিত কট্টর ধর্মহীন সেক্যুলার রাষ্ট্র তুরস্কের ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি জনগণকে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও আইনের শাসন প্রদানের মাধ্যমে অধিকাংশ জনগণের সমর্থন আদায়ে সক্ষম হয়।

একই সঙ্গে সেনা ক্যু এবং অভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যা সমাধান করে জনমুখী উন্নয়নের মাধ্যমে পুনরায় ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা থাকলেও বিদেশি শক্তিগুলোর ষড়যন্ত্রে সম্প্রতি তুরস্কের অর্থনীতিতে ১২ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি, ইউরোপে এরদোগানের প্রচারণায় নিষেধাজ্ঞা, সিরিয়ান রিফিউজি ইস্যু এবং বিরোধী দলগুলোর প্রথমবারের মতো জোটবদ্ধ লড়াইয়ের কারণে সংসদীয় নির্বাচনে ৬০০ আসনের মধ্য ৩০০ এর অধিক আসনে বিজয়ী হওয়া অনেকটা চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ালেও এরদোগানকে এই মুহূর্তে পরাজিত করাটা অনেক কঠিন।

বিরোধীজোটের কৌশলগত প্রার্থী প্রদান সংসদ নির্বাচনে বড় একটা হুমকি। এরদোগানের আসনগুলো দখল করলে বিরোধীজোট বিভিন্ন স্থানে অত্যন্ত কৌশলে নিজেদের প্রতীক এবং দল পরিবর্তন করে প্রার্থী দিয়েছে। ইতিমধ্যে ইসলামপন্থী দল সাদাত পার্টির ৬ জন প্রার্থী আতার্তুকের সিএইচপি থেকে প্রার্থী হয়েছে।

কোনিয়া প্রদেশে সিএইচপির ২নং প্রার্থী হিসেবে সাদাত পার্টির যুব শাখার ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুল কাদির কারাদুমান, কায়সেরি প্রদেশে ২নং প্রার্থী হিসেবে আহমেদ ইলদিস, ইস্তানবুল প্রদেশে ৯নং প্রার্থী হিসেবে সিভাস প্রাদেশিক যুব শাখার সভাপতি নাজির জাহাঙ্গীর, ইস্তানবুল ১১নং প্রার্থী হিসেবে হুসাইন এমরে, সামসুন প্রদেশে ৩নং প্রার্থী হুসাইন শাহীন, ট্রাবজোন প্রদেশে সাদাত পার্টির প্রাদেশিক ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুল কাদির চেলেবি সিএইচপি থেকে প্রার্থী হয়েছে।

এছাড়াও ইস্তানবুল প্রদেশে সাদাত পার্টির ১নং প্রার্থী হিসেবে কুর্দিশ জাতিয়তাবাদী দল এইচডিপির সাবেক এমপি আলতান তান প্রার্থী হয়েছে। বিরোধী জোটের কৌশলগত প্রার্থী প্রদানে এরদোগানের ৪০-৫০ আসনে প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বিরোধীদলের সব পরিকল্পনা এরদোগানের ক্যারিশমেটিক নেতৃত্বের কাছে পরাজিত হবার সম্ভাবনাই বেশি।

যেসব কারণে এরদোগান পুনরায় বিজয়ী হবার সম্ভাবনা রয়েছে:

এরদোগানের উন্নয়ন পলিসি

আদর্শিক কারণে যারা এরদোগানকে অপছন্দ করে তারাও এরদোগানের নেতৃত্বে ইউরোপের মতো তুরস্কের উন্নয়ন পলিসিকে পছন্দ করে। শিক্ষা, চিকিৎসাসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে এরদোগান জনগণের হৃদয়ে যে অবস্থান করে নিয়েছে তা এত দ্রুত ভেঙে পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

সাম্প্রতিক সময়ে সফল পররাষ্ট্রনীতি

ইউরোপ এবং আমেরিকার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক না থাকলেও সম্প্রতি বছরগুলোতে ইরান, রাশিয়া এবং চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্কের অনেক উন্নয়ন ঘটেছে। গত তিন মাস আগে সিরিয়ার আফরিনে সফল অভিযান সাধারণ তার্কিশদের মনে এরদোগানের অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়েছে।

পিকেকে বিরোধী অভিযান

গত কয়েক বছরে পিকেকের আত্মঘাতী হামলায় তুরস্কের কয়েক শতাধিক জনগণ নিহত হয়েছে। গত বছরে সরকার বেশ কয়েকটি অভিযানে পিকেকের শক্তিশালী কিছু ঘাঁটি ধ্বংসের পাশাপাশি বড়সংখ্যক সন্ত্রাসীদের সীমান্তের ওপারে পাঠিয়ে দিয়েছে। পিকেকের উপস্থিতিতে পূর্ব তুরস্কে কখনোই শান্তিপূর্ণভাবে জনগণ ভোট দিতে পারত না।

অধিকাংশ সন্ত্রাসীদের অনুপস্থিতিতে কুর্দিশ-অধ্যুষিত পূর্ব তুরস্কের ধার্মিক কুর্দিশদের ভোট অতীতের মতো এরদোগান পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আর যদি কুর্দিশ দল এইচডিপি জাতীয়ভাবে ১০ শতাংশের কম ভোট পায় তাহলে তারা আর কোনো আসন পাবে না। সেক্ষেত্রে এই অঞ্চলের ৯০ শতাংশ আসন ২০০২, ২০০৭ ও ২০১১ এর মতো এরদোগানের একে পার্টির ঘরে চলে আসবে। সেক্ষেত্রে এরদোগানের আসন সংখ্যা ৩৫০ পেরিয়ে যেতে পারে।

বিদেশি ভোটে পুনর্জাগরণ

ইউরোপের দেশগুলো এরদোগানের সব প্রকার প্রচারণায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। একই সঙ্গে পুলিশের সহযোগিতায় বিরোধী দল প্রচারণা চালাচ্ছে। তার্কিশদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণকারী ইউরোপিয়ান শক্তিদের এমন ব্যবহারে সামগ্রিকভাবে এরদোগান ও একে পার্টির জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

জাতীয়তাবাদী দলগুলোর ভোট

তুরস্কের তৃতীয় বৃহত্তম দল ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী (এমএইচপি) এবং ইসলামপন্থী জাতীয়তাবাদী দল বুয়ুক বির্লিক পার্টি এই নির্বাচনে এরদোগানের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছে। গত নির্বাচনে এমএইচপি ১১.৯০ শতাংশ ভোট এবং ৪০টি আসন পেয়েছিল। এই নির্বাচনের আগে তাদের সাবেক নেত্রী মেরাল আকসেনার দলীয়প্রধান না হতে পেরে ৫ জন এমপিসহ দল থেকে পদত্যাগ করে ইয়ি বা গুড পার্টি গঠন করে।

সাধারণ তার্কিশদের মতে ইয়ি পার্টি এমএইচপির ৪-৫ শতাংশ ভোট কাটতে পারে। তারপরেও বাকি ৭-৮ শতাংশ ভোট এমএইচপি পাবে। জোটবদ্ধ হওয়ায় তাদের ৭-৮ শতাংশ ভোটে এরদোগান তথা একে পার্টি যথেষ্ট লাভবান হবার সম্ভাবনা বেশি। অপরদিকে বুয়ুক বির্লিক পার্টি গত নির্বাচনে তাদের অর্জিত ১ শতাংশ ভোট এবার একে পার্টির ঘরে আসবে বলেই ধরা হচ্ছে।

তুরস্কের ধার্মিক এবং নারী ভোট

এমন একসময় ছিল যখন তুরস্কে আজান চালুর কারণে প্রধানমন্ত্রী আদনান মেন্দেরেসকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছিল, ইফতার প্রোগ্রামের কারণে নাজিমুদ্দিন আরবাকানকে পদচ্যুত করা হয়েছিল, দীর্ঘ কয়েক দশক সাধারণ নারীরা বোরকা পরার অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। লিবারাল মুখোশে এরদোগান ধারাবাহিকভাবে তুরস্কের সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অধিকার ফিরে দেয়ার পাশাপাশি তাদের গৌরবের ওসমানী খিলাফতের অনেক কিছুই ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে।

তুরস্কের এই ধার্মিক শ্রেণির মানুষের ভোট অতীতের মতো এবারো এরদোগান পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়াও এরদোগান তুরস্কের নারীদের মধ্যে অসম্ভব রকম জনপ্রিয়। নারীদের এই ভোটগুলো সহজে হাতছাড়া হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

তুরস্কের শহরের ভোটে এরদোগান এবং অন্যান্য দলগুলোর মধ্যে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা আবার কখনো এরদোগান কম ভোট পেলেও সমগ্র তুরস্কের গ্রামীণ ভোটগুলো একচেটিয়া একে পার্টি তথা এরদোগানের ঘরে যায়। এবারো এর ব্যতিক্রম হওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এটা সত্য যে তুরস্কের এলিট শ্রেণির ভোটগুলো সিএইচপির তথা আতার্তুকের দলে গেলেও সবচেয়ে বেশি মধ্যবিত্ত এবং ধার্মিক শ্রেণির মানুষের ভোটগুলো আবারো এরদোগান পাবে বলেই আশা করা হচ্ছে।

সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১ নভেম্বরের নির্বাচনে একে পার্টি ৪৯.৫০ শতাংশ ভোট এবং ৫৫০ আসনের মধ্য ৩১৭টি আসন পেয়েছিল। সেই সঙ্গে জাতীয়তাবাদী দলের ৩০-৩৫টি আসন যোগ হলে এই জোটের আসন সংখ্যা ৩৫০ পেরিয়ে যেতে পারে।

অপরদিকে একেপি ৪৫-৪৯ শতাংশ ভোট এবং জোটের অন্য দুই শরিক দল ৫-৭ শতাংশ ভোট পেলে এরদোগান সহজেই বিজয়ের মালা পড়তে পারবে। আগামী ২৪ জুন উন্নয়ন আর নিও অটোমানিজমের ধর্মীয় চেতনায় উজ্জীবিত জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে পুনরায় তুরস্কের শাসন ক্ষমতায় এরদোগান আসবে এটাই বেশিরভাগ তার্কিশ জনগণের বিশ্বাস।

পঠিত : ৭১৮ বার

মন্তব্য: ০