Alapon

২৩ জুন

আজ ২৩ শে জুন। ঐতিহাসিক পলাশী দিবস।
--------------------------------------------------------
  
২৩ জুন ১৭৫৭ সাল। পলাশী যুদ্ধের দিন। অনেকে বলেন, ওটি হলো পলাশী বিপর্যয়ের দিন। যুদ্ধের দিন নয়। যুদ্ধে পরাজিত হওয়া এক কথা, কিন্তু যুদ্ধ না করে যে পরাজয় বরণ করতে হয়, তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাই কেউ কেউ বলেন, এটি যুদ্ধ ছিল না, ছিল ষড়যন্ত্রের কালো থাবা। তপন মোহন চট্টোপাধ্যায় তাঁর পলাশীর যুদ্ধ গ্রন্থের ১৭৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন : ‘পলাশীর যুদ্ধকে একটা যুদ্ধের মতন যুদ্ধ বলে কেউ স্বীকার করেন না।...কিন্তু সেই যুদ্ধের ফলেই আস্তে আস্তে একমুঠো কারবারি লোক গজকাঠির বদলে রাজদণ্ড হাতে ধরলেন। প্রথম থেকেই তাঁরা রাজত্ব করলেন না বটে, কিন্তু বাংলাদেশের ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে দাঁড়ালেন।’

এ সমাজে সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, কিন্তু নেই ইতিহাসের গতিধারা সম্পর্কে তীক্ষষ্ট সচেতনতা। তাই প্রতিপদে সংগ্রামই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। ইতিহাসের প্রতি বাঁকে হাজারো ধারায় রক্ত ঝরিয়ে তাই আমাদের টিকে থাকতে হয়েছে। ১৭৫৭-এর পলাশীর ষড়যন্ত্রেও এ সমাজের ইতিহাস-চেতনার দীনতা সুস্পষ্ট। মোগল সম্রাট শাহজাহান তাঁর কন্যার চিকিৎসার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ চিকিৎসকের প্রতি ঋণ পরিশোধ করার মানসে কোম্পানিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের ‘সনদপত্র’ বা অনুমতি দিয়েছিলেন।

সতের শতকের ‘ইউরোকেন্দ্রিক সভ্যতা’র (Euro-Centric Civilization) বিকাশ এবং গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে মোগল সম্রাটদের কোনো ধারণাই ছিল না। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলকে ওই সময়ে ব্রিটিশ, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিয়ার্ড, ওলন্দাজ জাতি কীভাবে পদানত করে চলেছে, তার হিসাব তাঁরা রাখবেন না। ভারত আবিষ্কার করতে এসে কলম্বাস পৌঁছে গেলেন আমেরিকায়। পনের, ষোল ও সতের শতকের বিশ্বব্যাপী আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় রত ছিল ইউরোপ। তারা যায়নি কোথায়? উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, সমগ্র আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, পশ্চিম, দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে গড়ে ওঠে ইউরো-কেন্দ্রিক শক্তিগুলোর অপ্রতিহত প্রভুত্ব। সতের শতকে ভারতবর্ষের অবস্থা যে খুব খারাপ ছিল তা নয়, তবে ওই যে বলেছি, যথার্থ ইতিহাস চেতনার অভাবে শক্তিশালী মোগল সম্রাটরাও ব্যর্থ হয়েছেন সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে।
ভারতবর্ষ অতীতকাল থেকেই বিজয়ীর পদভারে কম্পিত হয়েছে। কোনো কোনো বিজয়ী ভারত জয়ের গর্ব নিয়ে ফিরে গেছেন নিজ দেশে; কেউবা ভারতকেই নিজেদের আবাসভূমি হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং ভারতের আশা-আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে বৃহত্তর পরিমণ্ডলে মিশে গেছেন। মোগলরা এ পর্যায়ভুক্ত। ভারত জয় করে ভারতের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে তাঁরা মিশে গেছেন। তাঁদের ধারণা ছিল সনাতন। উত্তর-পশ্চিমের দরজা দিয়েই ভারতে প্রবেশ করতে হয়। তা প্রতিরোধের জন্য শক্তিশালী স্থলবাহিনীই যথেষ্ট। ষোল, সতের শতকে নৌযান নৌপথকে যেভাবে গতিশীল করে, মোগলদের চিন্তাভাবনায় তার বিন্দুমাত্র প্রতিফলন ঘটেনি। তাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শক্তিমত্তা সম্পর্কে তাঁদের সঠিক ধারণা জন্মেনি। সম্রাট শাহজাহান কৃতজ্ঞতাবোধপ্রসূত বদান্যতা প্রদর্শনে তাই বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেননি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সম্রাটের এই উদারতার সুযোগ গ্রহণ করে। ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধার জন্য বিভিন্ন স্থানে কুঠি নির্মাণ করে। কুঠির নিরাপত্তার অজুহাতে নিজস্ব সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলে। সৈন্যবাহিনীকে সহায়তাদানের জন্য, বিশেষ করে, অস্ত্রসম্ভার সরবরাহের জন্য, নৌবাহিনীর বিস্তার ঘটাতে থাকে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মোগলদের শক্তিমত্তা সম্পর্কে সজাগ ছিল। স্থলযুদ্ধকে এ কারণে তারা এড়িয়ে চলেছে অতি সন্তর্পণে। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে স্যার টমাস রো  কোম্পানিকে যে পত্র লিখেছিলেন, তাতেও এর উল্লেখ ছিল। তিনি লিখেছিলেন, ‘যদি লাভজনক বাণিজ্য করতে চান তবে তা শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালনা করুন আর সমুদ্রে আপনাদের কার্যক্রম সীমিত রাখুন। বিতর্ক পরিত্যাগ করে এটা নিয়ম হিসেবে গ্রহণ করাই ভালো যে ভারতে স্থলযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পরিণতি মারাত্মক হতে পারে।’
ব্রিটিশ কোম্পানি টমাস রো-এর এ নির্দেশ ৮০ বছর ধরে পালন করেছিল। ১৬৮১ সালে স্যার জোসিয়া চাইল্ডের (Joshia Child) ইঙ্গিতে কোম্পানি এ নীতি পরিত্যাগ করে ভারতে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে শুরু করে। ১৬৬৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে ছিল মাত্র ১০টি যুদ্ধজাহাজ এবং মাত্র ৬০০ সৈনিক। ১৭৪০ সাল নাগাদও সমগ্র ভারতে কোম্পানির অধিকার ছিল ক্ষুদ্র এক ভূখণ্ড : বোম্বাই দ্বীপ, মাদ্রাজ শহরের অবস্থানে পাঁচ মাইল দীর্ঘ এবং তিন মাইল প্রস্থ এক এলাকা আর কলকাতার অবস্থান ক্ষেত্রে তিনটি গ্রাম। তাছাড়া ছিল চারটিমাত্র দুর্গ—সেন্ট জর্জ দুর্গ, ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ, কুড্ডালোরের সেন্ট ডেভিড দুর্গ এবং বোম্বাই কুঠি।

সম্রাট শাহজাহানের কাছ থেকে বাণিজ্যের সনদ লাভ করেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এতদূর অগ্রসর হতে সাহসী হয়। যতদিন পর্যন্ত নবাব আলীবর্দী খাঁ বেঁচেছিলেন, পূর্ব ভারতে কোম্পানির ক্ষমতা যেমন ছিল সীমিত, তেমনি তার আকাঙ্ক্ষাও ছিল অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। আলীবর্দী খাঁ জানতেন, এ বেনিয়া কোম্পানি সুযোগ পেলে যে কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারে। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও তাই তিনি তাঁর দৌহিত্র সিরাজকে এই বেনিয়া কোম্পানি সম্পর্কে সাবধান থাকতে বলেছিলেন। তরুণ সিরাজউদ্দৌলা ক্ষমতাসীন হওয়ার পর প্রথম আঘাত অবশ্য সঠিকভাবে সঠিক স্থানেই হেনেছিলেন। কলকাতা দখল করে কোম্পানির কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের কাছে সঠিক খোঁজ নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর দুর্ভাগ্য এবং দুর্ভাগ্য এ সমাজের যে, সবকিছু সংহত করার পূর্বেই বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরের নেতৃত্বে এবং অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীর সহায়তায় পলাশীর দুরপনেয় কলঙ্কের তিলক অঙ্কিত হয় এ জনপদের জনসমষ্টির ললাটে।
সামাজিক পরিবেশও ছিল ষড়যন্ত্রের উপযোগী।
 তপন মোহন চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘পশ্চিমবঙ্গে তখন বীরভূম ছাড়া আর সব বড় বড় জায়গাতেই হিন্দু জমিদার...। প্রকাশ্যে না হলেও ভিতরে ভিতরে প্রায় সব জমিদারই এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে প্রধান নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। বর্ধমানের রাজার পরই ধনে মানে কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নাম। বাংলাদেশের মহাজনদের মাথা জগেশঠদের বাড়ির কর্তা মহাতাব চাঁদ। জগেশঠরা জৈন সম্প্রদায়ের লোক হলেও অনেকদিন ধরে বাংলাদেশে পুরুষানুক্রমে থাকায় তাঁরা হিন্দু সমাজেই অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। কর্মচারীদের পাণ্ডা হলেন রায় দুর্লভ রাম।...হুগলিতে রইলেন নন্দকুমার। উমিচাঁদ ইংরেজদের হয়ে তাঁকে অনেক টাকার লোভ দেখিয়ে রেখেছিলেন।’ জগেশঠ এবং উমিচাঁদের আশ্রিত ইয়ার লতিফ খাঁ আর একজন ষড়যন্ত্রকারী। সবার শীর্ষে ছিলেন আলীবর্দী খাঁর এক বৈমাত্রেয় ভগ্নীর স্বামী মীর জাফর আলী খাঁ। নবাব হওয়ার বাসনা তার অনেক দিনের। বর্গীর হাঙ্গামার সময় আলীবর্দী খাঁকে হত্যা করিয়ে বাংলার নবাবী গ্রহণের আকাঙ্ক্ষা তাঁর ছিল। শেষ পর্যন্ত সে চেষ্টা ফলবতী হয়নি। সিরাজউদ্দৌলা নবাব হলে শওকত জঙ্গের সঙ্গে মিলে ষড়যন্ত্রের আর এক গ্রন্থি রচনা করেন। তা কার্যকর হয়নি। এবারে জগেশঠ, ইয়ার লতিফ খাঁ, উমিচাঁদের সহযোগী হিসেবে মাঠে নামেন। সিরাজের সমর্থকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সেনানায়ক মোহন লাল এবং মীর মদন বা মীর মর্দান। ২৩ জুনের পূর্বে বাংলার ‘মুক্তির চুক্তি’ নামে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় মীর জাফর এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে। 
অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় রচিত ''মীর কাসিম গ্রন্থের'' ২২৩-২৪ পৃষ্ঠায় ১১ দফার এই চুক্তির বিবরণ রয়েছে।

 মীর জাফরের স্বাক্ষরে চুক্তিতে বলা হয় : ‘আমি আল্লাহ্র নামে ও আল্লাহ্র রসূলের নামে প্রতিজ্ঞা করছি যে, আমার জীবনকালে আমি এই চুক্তিপত্রের শর্তাবলী মানিয়া চলিব।’

বাংলার ‘মুক্তির চুক্তি’ তিনি মেনে চলেছেন। পলাশীর আম্রকাননে যুদ্ধের যে প্রহসন হয়, তাতে প্রধান সেনাপতির সাজে সজ্জিত হয়ে মীর জাফর সত্যি দাঁড়িয়েছিলেন এবং তাঁর চোখের সামনেই বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার জনগণও পরাজয়ের শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত হয়। ২৯ জুন ১৭৫৭ সালে মীর জাফরের প্রথম দরবারে মীর জাফরের আবদারক্রমেই ক্লাইভ মীর জাফরের হাত ধরে তাঁকে নবাবী মসনদে বসিয়ে দিলেন সত্য, কিন্তু মসনদের কর্তৃত্ব যে তখন বাংলার বাইরে চলে গেছে, তিনি তা টের পেলেন অনেক পরে। তাঁর আত্মীয় মীর কাসিম প্রাণ দিয়ে তা অনুভব করেছেন। অনুভব করেছেন এ জনপদের সমগ্র জনসমষ্টি দীর্ঘ দু’শো বছর ধরে। কাকে দোষ দেবেন, মীর জাফরকে? লোভী, বিশ্বাসঘাতক, অপদার্থ মীর জাফর এদেশের ইতিহাসের এক ঘৃণ্য চরিত্র, একটি ক্লীব, একটি ক্লেদ, একটি অপাঙক্তেয় নাম। কিন্তু উমিচাঁদ, জগেশঠ, মহাতাব চাঁদ, ইয়ার লুত্ফ, রায়দুর্লভ রাম ওই প্রহসনের শুধু কি পার্শ্বচরিত্র?

তরুণ সিরাজ হয়তো ছিলেন অহঙ্কারী, সম্ভবত দাম্ভিক, অপরিণামদর্শী, অর্বাচীন, অথবা অন্যকিছু, কিন্তু তৃতীয় শক্তি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য নিজের ঘরের সব দরজা খুলে দেয়ার হীনবীর্য হীনমন্যতার অনেক ঊর্ধ্বে ছিলেন। তাই তিনি স্বাধীনতার প্রতীক, স্বাতন্ত্র্যের পতাকাবাহী। আর যারা বাংলার মসনদকে বেচাকেনার জন্য বানিয়ে নিজেদের আর্থিক ও রাজনৈতিক অবস্থানকে সুদৃঢ় করতে চেয়েছেন এবং নিজেদের সিন্দুকের চাবি পরের হাতে তুলে দেয়ার দুর্বিনীত হীনমন্যতার শিকার হয়েছেন, তারা আজও সীমাহীন ধিক্কারের পাত্র।

 ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল পলাশীর আম্রকাননের পাশেই মুজিবনগরে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে যন্ত্রণায় ছটফট করা অসংখ্য কালরাত্রির পরে। ইতিহাসের গতিধারা সম্পর্কে কতটুকু সচেতন হয়েছি জানি না। তবে সবার মনে এখনও মীর জাফরের প্রতি পুঞ্জীভূত ঘৃণার ডালা রয়েছে সাজানো। উমিচাঁদ, জগেশঠ, রায় দুর্লভ, ইয়ার লুত্ফদের প্রতি ক্ষোভের পাত্র এখনও রয়েছে পূর্ণ। মোহন লাল এবং মীর মদনদের শাণিত তরবারি এখনও রয়েছে উন্মুক্ত। জাতীয় স্বার্থকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের জন্য তৃতীয় শক্তির ওপর নির্ভরশীল হওয়ার নতজানু বশংবদ মানসিকতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সবসময় চরম ঘৃণার সঙ্গে ধিকৃত হতে থাকবে। মোহন লাল, মীর মদনরা আর কোনো সময়ে মীর জাফর, উমিচাঁদ, জগেশঠ, রায় দুর্লভদের ক্ষমা করবে না।

তারপরেও এদেশের মেরুদণ্ডহীন শাসক-প্রশাসকদের একাংশের নতজানু মন-মানসিকতা, অপরের ওপর নির্ভরশীলতার সেই পুরনো অভ্যাস, নিজেদের কিছুটা সুবিধার জন্য জাতীয় পর্যায়ে বিরাট বিপর্যয় টেনে আনার হীনমন্যতাকে এই জাতি শুধু ঘৃণাই করে না, অতীতের মীর জাফর, উমিচাঁদ ও জগেশঠদের জঘন্য ভূমিকার কথা মনে করিয়ে দেয়। তাই ২৩ জুনকে স্মরণ করে ঘৃণাভরে স্মরণ করতে বাধ্য হচ্ছি বাংলাদেশের সেইসব শাসক-প্রশাসকদের, যারা জনগণের রক্ত দিয়ে কেনা স্বাধীনতাকে তুলে দিতে চায় অন্যের হাতে, শুধু ব্যক্তিগত ছোট্ট সুযোগ-সুবিধার জন্য। ক্ষমতার লোভে।

সেই বিশ্বাসঘাতকদের পরিণামঃ
------------------------------
ইংরেজদের ষড়যন্ত্র ও সেনাপতি মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন নবাব সিরাজউদ্দৌলা মসনদচ্যুত হন। নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে যারা ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন, তাদের করুণ পরিণতি বরণ করতে হয়। মীরজাফর খ্যাত হতে চেয়েছিলেন ‘মহবত্ জং’ নামে। কিন্তু তার পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে ‘ক্লাইভের গাধা’ হিসেবে। রাজকার্যে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ভাং সেবন করে তিনি টাল হয়ে থাকতেন। মসনদচ্যুত হওয়ার পর মীরজাফর মারা যান কুষ্ঠরোগের শিকার হয়ে। লর্ড ক্লাইভ নিজের হাতে ক্ষুর চালিয়ে আত্মহত্যা করেন। বুড়িগঙ্গার পানিতে চুবিয়ে হত্যা করা হয়েছিল ঘসেটি বেগমকে। মীরজাফরের ছেলে মীরনের মৃত্যু হয়েছিল বজ্রাঘাতে।
পলাশী ষড়যন্ত্রের যাহারা নেতৃত্ব দিয়াছিল; পরবর্তীকালে তাহাদের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ হইয়াছিল। প্রায় সকলেরই মৃত্যু হইয়াছিল মর্মান্তিকভাবে। কাউকে নির্মমভাবে হত্যা করা হইয়াছে, কেহ দীর্ঘদিন কুষ্ঠ রোগে ভুগিয়া মারা গিয়াছে, কাউকে ফাঁসিতে ঝুলাইয়া মারা হইয়াছে, কাউকে নদীতে ডুবাইয়া মারা হইয়াছে, কেহ নিজের গলায় নিজেই ছুরি বসাইয়াছে। অস্বাভাবিক পন্থায় এবং অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে আলিঙ্গন করিতে হইয়াছে মৃত্যুকে। তাহাদের সকলের উপরেই পড়েছিলো স্রষ্টার  লানত।

মিরনঃ
-------
মিরন পলাশী ষড়যন্ত্রের প্রধানতম নায়ক ছিল। তাহার পুরো নাম মীর মহম্মদ সাদেক আলি খান। সে মীর জাফরের জ্যেষ্ঠ পুত্র। আলীবর্দী খানের ভগ্নী শাহ খানমের গর্ভে তাহার জন্ম হইয়াছিল। এই সূত্রে মিরন ছিল আলিবর্দীর বোনপো। মিরন যে অত্যন্ত দুর্বৃত্ত, নৃশংস ও হীনচেতা ছিল, সে ব্যাপারে কাহারও কোনো সন্দেহ নাই। সিরাজ হত্যাকাণ্ডের মূল নায়ক মিরন। আমিনা বেগম, ঘষেটি বেগম হত্যার নায়কও তিনি। লুত্ফুন্নিসার
লাঞ্ছনার কারণও মিরন। মির্জা মেহেদীকেও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করিয়াছিল মিরন। মীর জাফরের সকল অপকর্মের হোতা ছিল সে। মিরনের প্ররোচনাতেই মীরজাফর চলিতেন।
ইংরেজদের নির্দেশে এই মিরনকে হত্যা করিয়াছে মেজর ওয়ালস। তবে তাহার এই মৃত্যুর ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ইংরেজরা মিথ্যা গল্প বানাইয়াছিল। তাহারা বলিয়াছে, মিরন বিহারে শাহজাদা আলি গওহারের (পরে বাদশা শাহ আলম) সঙ্গে যুদ্ধ করিতে গিয়া পথের মধ্যে বজ্রাঘাতে নিহত হন। ইংরেজদের অর্থপুষ্ট মুতাক্ষরীনকার লিখিয়াছেন, মিরনের আদেশে সিরাজের মাতা আমিনা ও মাতৃস্বসা ঘষেটি বেগম জলমগ্ন হওয়ায়, তাহার মৃত্যুকালে মিরনকে বজ্রাঘাতে প্রাণপরিত্যাগের জন্য অভিসম্পাত করিয়া যান। এই জন্য অনুমান করা হয় যে, বজ্রাঘাতেই মিরনের মৃত্যু হইয়াছিল। ইংরেজরা বলিয়াছে, বজ্রপাতের ফলে তাঁবুতে আগুন ধরিয়া যায় এবং তাহাতেই তিনি নিহত হন। ফরাসী সেনাপতি লরিস্টনের Jean- এই ঘটনাকে অস্বীকার করিয়াছেন। বরং এই মত পোষণ করেন যে, মিরনকে আততায়ীর দ্বারা হত্যা করা হইয়াছিল। প্রচণ্ড ঝড় আর ঘন ঘন বজ্রপাতের সময় তাহার তাঁবুতে আগুন লাগাইয়া দেওয়া হয় এবং তাহাকে হত্যা করা হয়। এহা আর কিছুই নহে, আসলে ঘটনাকে চাপা দেওয়ার একটা কৌশল মাত্র। (অক্সফোর্ড হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া, ভিনসেন্ট এ, স্মিথ।)
নিখিলনাথ রায় তাহার ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনী’ গ্রন্থে উল্লেখ করিয়াছেন, ‘মিরনের মনে স্বাধীনতার ইচ্ছা বলবর্তী হওয়ার পুণ্যশ্লোক ব্রিটিশ পুঙ্গবদের মীর কাসিমের সাহায্যে তাহাকে না-কি কৌশলপূর্বক নিহত করিয়াছিলেন। পরে বজ্রাঘাতে মৃত্যু বলিয়া প্রকাশ করা হয়।’
ভিনসেন্ট এ, স্মিথ তাহার অক্সফোর্ড হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া ও Meadows Taylor তাহার A students Manual of the History of India গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে পরিষ্কার বক্তব্য উপস্থাপন করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন যে, মিরনের মৃত্যুর জন্য ইংরেজ এবং মীর কাসিম উভয়কেই সন্দেহ করা হয়। আসলেই মিরনকে হত্যা করা হইয়াছিল। মেজর ওয়ালস ছিলেন এই হত্যাকাণ্ডের নায়ক। মীরজাফর ইংরেজদের সাজানো গল্পটি বিশ্বাস করেন নাই। তিনি জানিতেন, মিরনকে ইংরেজরা হত্যা করিয়াছে। কিন্তু কাপুরুষ মীরজাফরের ক্রন্দন ছাড়া আর কিছু করিবার ছিল না। এ নিয়া বাড়াবাড়ি করিলে তিনি জানিতেন তাহার নিজের নবাবী ও জীবনটাও চলিয়া যাইতে পারে।

মুহাম্মদী বেগঃ
-------------
মুহাম্মদী বেগ ৩ জুলাই বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নির্মমভাবে হত্যা করিয়াছিল। নবাব সিরাজ এ সময় তাহার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাহেন নাই। তিনি কেবল তাহার কাছ থেকে দুই রাকাত নামাজ পড়িবার অনুমতি চাহিয়াছিলেন। কিন্তু কুখ্যাত মুহাম্মদী বেগ সেই সুযোগ প্রত্যাখ্যান করিবার পরপরই নবাব সিরাজকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
পরবর্তী পর্যায়ে মুহাম্মদী বেগ মাথা গড়গড় অবস্থায় বিনা কারণে কূপে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া মৃত্যুবরণ করিয়াছিল। এই মুহাম্মদী বেগ সিরাজউদ্দৌলার পিতা ও মাতামহীর অন্নে প্রতিপালিত হয়। আলীবর্দীর বেগম একটি অনাথ কুমারীর সহিত তাহার বিবাহ দিয়াছিলেন। 

মীর জাফরঃ
-----------
পলাশী ষড়যন্ত্রের অন্যতম প্রধান নায়ক ছিলেন মীরজাফর আলি খান। তিনি পবিত্র কোরআন মাথায় রাখিয়া নবাব সিরাজের সামনে তাহার পাশে থাকিবেন বলিয়া অঙ্গীকার করিবার পর পরই বেঈমানী করিয়াছিলেন। তিনি ছিলেন সকল ষড়যন্ত্রের মূলে।
মীর জাফর অত্যন্ত হীনাবস্থায় প্রথমত আলীবর্দী খাঁর সংসারে প্রতিপালিত হন। আলীবর্দী খান তাহাকে অত্যন্ত কাছে টানিয়া নিয়াছিলেন। পরে নবাব নিজে বৈমাত্রেয় ভাগিনী শাহ খানমের সহিত মীর জাফরের বিয়ে দেন। নবাব তাহার কার্যদক্ষতায় সন্তুষ্ট হইয়া তাহাকে সেনাপতি পদ প্রদান করেন। নিখিলনাথ রায় লিখিয়াছেন, ‘মীরজাফর মহারাষ্ট্রীয় যুদ্ধের সময়ে অসামান্য বীর্যবত্তা দেখাইয়া আপনার সুনাম প্রচার করিয়াছিলেন কিন্তু আলীবর্দীর ভ্রাতৃজামাতা আতাউল্লা খাঁর সহিত পরামর্শ করিয়া বঙ্গরাজ্য বিভাগ করিয়া লইবার ইচ্ছা করায়, আলীবর্দী খাঁর অনুরোধে তাহাকে পুনর্বার সেনাপতি পদে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। তাহার পর সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের নেতা হইয়া মীরজাফর ইংরেজদের সহিত যোগদানপূর্বক সিরাজের সর্বনাশ সাধনের পর মুর্শিদাবাদের মসনদে উপবিষ্ট হন।’ মীরজাফর সম্পর্কে অনেকে বলিয়াছেন, ‘আর বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর? সর্বস্বীকৃতভাবে তিনি ছিলেন পুরোপুরিভাবেই একজন বিশ্বাসঘাতক। সকল দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি ছিলেন একজন মহাবোকা, রাজনীতি জ্ঞানবিহীন একজন সেনাপতিমাত্র।
মীরজাফরের মৃত্যু হয় অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে। তিনি দুরারোগ্য কুষ্ঠব্যাধিতে আক্রান্ত হইয়া মৃত্যুবরণ করেন। নিখিলনাথ রায় লিখিয়াছেন, ক্রমে অন্তিম সময় উপস্থিত হইলে, হিজরি ১১৭৮ অব্দের ১৪ শাবান (১৭৬৫ খ্রি. অব্দের জানুয়ারি মাসে) বৃহস্পতিবার তিনি কুষ্ঠরোগে ৭৪ বছর বয়সে পরলোকগত হন। তাহার মৃত্যুর পূর্বে নন্দকুমার কিরিটেশ্বরীর চরণামৃত আনাইয়া তাহার মুখে প্রদান করাইয়াছিলেন এবং তাহাই তাহার শেষ জলপান।

জগেশঠ মহাতপচাঁদ এবং মহারাজা স্বরূপচাঁদ
--------------------------------------------
পলাশী ষড়যন্ত্রের পিছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখিয়াছিল জগেশঠ পরিবার, প্রথমত তাহারা ইংরেজদের সহিত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং পরে মীরজাফর ও অন্যদের ইহাতে যুক্ত করেন।
জগেশঠদের পূর্বপুরুষ মানিকচাঁদের সঙ্গে মুর্শিদকুলী খাঁর বংশের ভালো সম্পর্ক ছিল। মানিকচাঁদ ১৭১৫ সালে বাদশাহ ফরখ শেরের কাছ হইতে শেঠ উপাধি লাভ করেন। ১৭২২ সালে মানিকচাঁদ পরলোকগমন করেন। তিনি অপুত্রদকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করিয়া যান। ১৭৪৪ সালে ফতেচাঁদের মৃত্যু হয়। আনন্দচাঁদ, দয়াচাঁদ, মায়াচাঁদ নামে তাহার তিন ছেলে ছিল। পিতার জীবদ্দশাতেই আনন্দচাঁদ ও দয়াচাঁদের মৃত্যু ঘটে। তখন আনন্দচাঁদের পুত্র স্বরূপচাঁদ শেঠ পরিবারের উত্তরাধিকারী মনোনীত হন। নিখিলনাথ রায় লিখিয়াছেন, বাদশাহের নিকট হইতে মহাতপচাঁদ জগেশঠ’ ও স্বরূপচাঁদ মহারাজ উপাধি লাভ করেন। এই সময়ে শেঠদিগের গদীতে অনবরত ১০ কোটি টাকার কারবার চলিত। জমিদার মহাজন ও অন্যান্য ব্যবসায়ী সকলেই অর্থের জন্য শেঠদিগের নিকট উপস্থিত হইতেন। ইংরেজ, ফরাসী প্রভৃতি বৈদেশিক বণিকগণ তাহাদের নিকট হইতে টাকা কর্জ লইতেন। ফতেচাঁদের মৃত্যুর পর নবাব আলীবর্দী ও খাঁ জগেশঠ মহাতপচাঁদকে যথেষ্ট সম্মান করিতেন এবং ফতেচাঁদের ন্যায় তাহারও পরামর্শ গ্রহণ করিতে ত্রুটি করিতেন না।’
আলীবর্দী খাঁর শাসনামলেই জগেশঠের সহিত ইংরেজদের সম্পর্ক অতি গভীর ছিল। নবাব সিরাজ ক্ষমতায় আসিলে এই গভীরতা বৃদ্ধি পাইল এবং তাহা ষড়যন্ত্রে রূপ নিল। পলাশী বিপর্যয়ের পর জগেশঠ রাজকোষ লুণ্ঠনে অংশগ্রহণ করেন।
১৭৬০ সালে মীরজাফর সিংহাসনচ্যুত হইলে তাহার জামাতা কাসেম আলি খাঁ (মীর কাসেম) ক্ষমতায় বসেন। এ সময় বিভিন্ন বিষয় লইয়া ইংরেজদের সহিত তাহার বিরোধ বাধে। জগেশঠ ইংরেজদের পক্ষ অবলম্বন করেন এবং তিনি ইংরেজ ও মীরজাফরের কাছে মীর কাসেমের বিরুদ্ধে কয়েকটি পত্র প্রদান করেন। পত্রগুলি কৌশলে মীর কাসেমের হস্তগত হয়। এই জন্য মীর কাসেম জগেশঠ মহাতপচাঁদকে বন্দী করিয়া মুঙ্গেরে পাঠাইবার জন্য বীরভূমের ফৌজদার মহাম্মদ তকী খাঁর প্রতি আদেশ পাঠান। তকী খাঁ তাহাদেরকে হীরাঝিলের প্রাসাদে বন্দি করিয়া রাখেন। পরে নবাবের সেনাপতি আর্মেনীয় মার্কার নবাবের আদেশে সসৈন্যে তাহাদের নিয়া উপস্থিত হইলে তকী খাঁ তাহাদের মার্কারের হস্তে সমর্পণ করেন। এ সময়ে মীর কাসেম মুঙ্গেরে ছিলেন। মার্কার তাহাদের নিয়া মুঙ্গেরে উপস্থিত হন। তাহাদের সেখানে আটক রাখা হয়। ইংরেজ গভর্নর ২৪ এপ্রিল ১৭৬৩ নবাবকে লিখিয়া পাঠাইলেন, ‘আমি এইমাত্র আমিয়টের পত্রে অবগত হইলাম যে, মহম্মদ তকী খাঁ রজনীতে জগেশঠ ও স্বরূপচাঁদের বাটীতে প্রবেশ করিয়া, তাহাদিগকে বন্দী অবস্থায় হীরাঝিলে আনিয়ে রাখিয়াছে। এই ঘটনায় আমি অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হইয়াছি। যখন আপনি শাসন কার্যের ভার গ্রহণ করেন, তখন আপনি, জগেশঠ ও আমি সমবেত হইয়া, এইরূপ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়াছিলাম যে, শেঠেরা, বংশমর্যাদায় দেশের মধ্যে সর্বপ্রধান, অতএব শাসনকার্যের বন্দোবস্তে আপনাকে তাহাদিগের সাহায্য গ্রহণ করিতে হইবে এবং তাহাদিগের কোনোরূপ অনিষ্ট না করিতে আপনি স্বীকৃত হন। মুঙ্গেরে আপনার সহিত সাক্ষাত্কালে আমি শেঠদিগের কথা আপনাকে বলিয়াছিলাম এবং আপনিও তাহাদিগের কোনো ক্ষতি করিবেন না বলিয়া আমাকে নিশ্চিত করেন। তাহাদিগের তত্পরোনাস্তি অবমাননা করা হইয়াছে। আপনার এ সুনামে কলঙ্ক পড়িয়াছে। ভূতপূর্ব কোনো নাজিম তাহাদিগের এরূপ গৃহ হইতে আনয়ন করা অত্যন্ত অন্যায় হইয়াছে; ইহাতে তাহাদিগের প্রতি এরূপ ব্যবহার করেন নাই। সুতরাং আপনি সৈয়দ মহম্মদ খাঁ বাহাদুরকে (মুর্শিবাদের ফৌজদার) তাহাদিগের মুক্তির জন্য লিখিয়া পাঠাইবেন।’
নিখিলনাথ রায় লিখিয়াছেন ‘ইহার পর ক্রমে ইংরেজদিগের সহিত মীর কাসেমের বিবাদ গুরুতর হইয়া উঠিলে, নবাব কাটোয়া, গিরিয়া, উদয়ানালা প্রভৃতি স্থানে পরাজিত হইয়া মুঙ্গেরে জগেশঠ ও অন্যান্য বন্দী কর্মচারী এবং রাজা ও জমিদারদিগের বিনাশ সাধন করেন। জগেশঠ মহাতপচাঁদকে অত্যুচ্চ দুর্গশিখর হইতে গঙ্গারগর্ভে নিক্ষেপ করা হয়। মহারাজ স্বরূপচাঁদও ঐ সাথে ইহজীবনের লীলা শেষ করিতে বাধ্য। মুতাক্ষরীণের অনুবাদক লিখিয়াছেন, ‘চুনী নামক জগেশঠের জনৈক ভৃত্য প্রভুর সহিত একত্রবদ্ধ হইয়া জলমগ্ন হইতে অথবা তাহার পূর্বে প্রাণ বিসর্জন করিবার জন্য অশেষ প্রকার অনুনয় বিনয় করিতে থাকে। কিন্তু তাহার প্রার্থনা পূর্ণ করা হয় নাই। অবশেষে সে নিজেই দুর্গশিখর হইতে পতিত হয়। জগেশঠ তাহাকে নিরস্ত হইবার জন্য অতিশয় অনুনয় বিনয় করিয়াছিলেন; কিন্তু তিনি তাহার কথায় মনোযোগ দেন নাই।’ জানা যায়, অনুবাদক বাবুরাম নামে চুনীর জনৈক আত্মীয়ের কাছ থেকে এই সংবাদ অবগত হন।

রবার্ট ক্লাইভঃ
------------
নবাব সিরাজবিরোধী ষড়যন্ত্রের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন রবার্ট ক্লাইভ। ক্লাইভ খুব অল্প বয়সে ভারতে আসেন। প্রথমে তিনি একটি ইংরেজ বাণিজ্য কেন্দ্রে গুদামের দায়িত্বে নিযুক্ত হন। এই কাজটি ছিল অত্যন্ত পরিশ্রমের ও বিরক্তিকর। এই কাজটিতে ক্লাইভ মোটেও সন্তুষ্ট ছিলেন না। এ সময় জীবনের প্রতি তাহার বিতৃষ্ণা ও হতাশা জন্মে। তিনি আত্মহত্যা করিবার চেষ্টা করেন। তিনি রিভলবার দিয়া নিজের কপালের দিকে লক্ষ্য করিয়া পর পর তিনটি গুলি ছোঁড়েন। কিন্তু গুলি থাকা অবস্থাতেইও গুলি রিভলবার হইতে বাহির হয় নাই। পরে তিনি ভাবিলেন ঈশ্বর হয়ত তাহাকে দিয়া বড় কোনো কাজ সম্পাদন করিবেন বলিয়াই এইভাবে তাহাকে বাঁচাইলেন। পরবর্তীতে দ্রুত তিনি ক্ষমতার শিখরে উঠিতে শুরু করেন। পরিশেষে পলাশী ষড়যন্ত্রে নেতৃত্ব দিয়া তিনি কোটি টাকার মালিক হন। ইংরেজরা তাহাকে ‘প্লাসি হিরো’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি দেশে ফিরিয়া গিয়া একদিন বিনা কারণে বাথরুমে ঢুকিয়া নিজের গলায় নিজের হাতেই ক্ষুর চালাইয়া মৃত্যুমুখে পতিত হন।

ইয়ার লতিফ খানঃ
-----------------
পলাশী ষড়যন্ত্রের শুরুতে ষড়যন্ত্রকারীরা ইয়ার লতিফ খানকে ক্ষমতার মসনদে বসাইতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু পরে এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করিয়া এক্ষেত্রে মীরজাফরের নাম উচ্চারিত হয়। ইয়ার লতিফ খান ছিলেন নবাব সিরাজের একজন সেনাপতি। তিনি এই ষড়যন্ত্রের সহিত গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন এবং যুদ্ধের মাঠে তাহার বাহিনী মীরজাফর, রায় দুর্লভের বাহিনীর ন্যায় ছবির মতো দাঁড়াইয়াছিল। তাহার সম্পর্কে জানা যায়, তিনি যুদ্ধের পর অকস্মাত্ নিরুদ্দিষ্ট হইয়া যান। অনেকের ধারণা, তাহাকে কে বা কাহারা গোপনে হত্যা করিয়াছিল। (মুসলিম আমলে বাংলার শাসনকর্তা, আসকার ইবনে শাইখ, পরিশিষ্ট)।

মহারাজা নন্দকুমারঃ
-------------------
মহারাজা নন্দকুমার এই ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করিয়াছিলেন। মুর্শিবাদাবাদ কাহিনী গ্রন্থে নিখিলনাথ রায় লিখিয়াছেন নন্দকুমারের অনেক বিবেচনার পর সিরাজের ভবিষ্যত্ বাস্তবিকই ঘোরতর অন্ধকার দেখিয়া, ইংরেজদিগের সহিত বন্ধুত্ব স্থাপনের ইচ্ছা করিলেন। ইংরেজ ঐতিহাসিকগণ বলিয়া থাকেন যে, ইংরেজরা সেই সময়ে আমীরচাঁদকে দিয়া নন্দকুমারকে ১২ হাজার টাকা প্রদান করিয়াছিলেন। পলাশী ষড়যন্ত্রের পর নন্দকুমারকে মীরজাফর স্বীয় দেওয়ান নিযুক্ত করিয়া সব সময় তাহাকে নিজ কাছে রাখিতেন। মীরজাফর তাহার শেষ জীবনে যাবতীয় কাজকর্ম নন্দকুমারের পরামর্শানুসারে করিতেন। তাহার অন্তিম শয্যায় নন্দকুমারই তাহার মুখে কিরীটেশ্বরীর চরণামৃত তুলিয়া দিয়াছিলেন।
তহবিল তছরুপ ও অন্যান্য অভিযোগের বিচারে নন্দকুমারের ফাঁসিকাষ্ঠে মৃত্যু হইয়াছিল। বিচার সম্পর্কে নিখিলনাথ রায় লিখিয়াছেন, ‘প্রধান বিচারপতি জুরীদিগকে চার্জ বুঝাইয়া দেওয়ার পূর্বে মহারাজের কৌঁসুলি ফ্যারার সাহেব জুরিদিগকে লক্ষ্য করিয়া কিছু বলিতে ইচ্ছা করিয়াছিলেন। ইংল্যান্ডীয় আইনে গুরুতর অপরাধীদিগের কৌঁসুলি আইন সংক্রান্ত কোনো কথা ব্যতীত আর কিছু বলিতে পারেন না বলিয়া তাহার আবেদন অগ্রাহ্য করা হয়।... অতঃপর জুরিরা প্রায় একঘণ্টা পরামর্শ করিয়া, মহারাজ নন্দকুমারকে দোষী বলিয়াই প্রকাশ করিলেন। তজ্জন্য তত্কালের নিয়মানুসারে ১৬ই জুন মহারাজ নন্দকুমারের প্রাণদণ্ডের আদেশ প্রদান করা হয়। প্রাণদণ্ডের আদেশ প্রদত্ত মহারাজ নন্দকুমারকে কারাগারের আশ্রয় গ্রহণ করিতে হইল। কারাগারের একটি দ্বিতল গৃহ তাহার আবাসস্থানরূপে নির্দিষ্ট হইয়াছিল। সে গৃহে আর কেহ থাকিত না; তথায় মহারাজ বন্ধুবান্ধবগণের সহিত কথোপকথনে ও শাস্ত্রালাপে মৃত্যু সময় পর্যন্ত অতিবাহিত করিয়াছিলেন।

রায় দুর্লভঃ
-----------
রায় দুর্লভ ছিলেন নবাবের একজন সেনাপতি। তিনিও মীরজাফরদের সহিত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। যুদ্ধকালে তিনি এবং তাহার বাহিনী মীরজাফরদের সহিত যুক্ত হইয়া নীরবে দাঁড়াইয়াছিলেন। যুদ্ধের পর তিনি কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন এবং ভগ্নস্বাস্থ্য লইয়া সেখানেই তাহার মৃত্যু ঘটে।

উমিচাঁদঃ
----------
ক্লাইভ কর্তৃক উমিচাঁদ প্রতারিত হইয়াছিলেন। ইয়ার লতিফ খান ছিলেন উমিচাঁদের মনোনীত প্রার্থী। কিন্তু যখন অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীরা এ ক্ষেত্রে মীরজাফরের নাম ঘোষণা করিলেন, তখন উমিচাঁদ বাঁকিয়া বসিলেন এবং বলিলেন, আপনাদের প্রস্তাব মানিতে পারি এক শর্তে, তাহা হইল যুদ্ধের পর নবাবের রাজকোষের ৫ ভাগ সম্পদ আমাকে দিতে হইবে। ক্লাইভ তাহার প্রস্তাব মানিলেন বটে, কিন্তু যুদ্ধের পরে তাহাকে তাহা দেওয়া হয় নাই। যদিও এই ব্যাপারে একটি মিথ্যা চুক্তি হইয়াছিল। ওয়াটস রমণী সাজিয়া মীরজাফরের বাড়িতে গিয়া লাল ও সাদা কাগজে দুইটি চুক্তিতে তাহার সই করান। লাল কাগজের চুক্তিতে বলা হইয়াছে, নবাবের কোষাগারের পাঁচ শতাংশ উমিচাঁদের প্রাপ্য হইবে। ইহা ছিল নিছক প্রবঞ্চনামাত্র। যাহাতে করিয়া উমিচাঁদের মুখ বন্ধ থাকে। যুদ্ধের পর ক্লাইভ তাহাকে সরাসরি বলেন, আপনাকে কিছু দিতে পারিব না। এ কথা শুনিয়া তিনি মানসিক ভারসাম্য হারাইয়া ফেলিলেন এবং স্মৃতিভ্রংশ উন্মাদ অবস্থায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিতে ঘুরিতেই তাহার মৃত্যু ঘটে।

রাজা রাজবল্লভঃ
----------------
ষড়যন্ত্রকারী রাজা রাজবল্লভের মৃত্যুও মর্মান্তিকভাবে ঘটিয়াছিল। জানা যায়, রাজা রাজবল্লভের কীর্তিনাশ করিয়াই পদ্মা হয় কীর্তিনাশা।

দানিশ শাহ বা দানা শাহঃ
-------------------------
দানিশ শাহ সম্পর্কে বিতর্ক রহিয়াছে। অনেকে বলিয়াছেন, এই দানিশ শাহ নবাব সিরাজকে ধরাইয়া দিয়াছিলেন। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় লিখিয়াছেন, দানা শাহ ফকির মোটেই জীবিত ছিলেন না। আসকার ইবনে শাইখ তাহার ‘মুসলিম আমলে বাংলার শাসনকর্তা’ গ্রন্থে লিখিয়াছেন, বিষাক্ত সর্প দংশনে দানিশ শাহর মৃত্যু ঘটিয়াছিল।

ওয়াটসঃ
----------
ওয়াটস এই ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখিয়াছিলেন। তিনি রমণী সাজিয়া মীরজাফরের বাড়িতে যাইয়া চুক্তিতে মীরজাফরের স্বাক্ষর আনিয়াছিলেন। যুদ্ধের পর কোম্পানির কাজ হইতে বরখাস্ত হইয়া মনের দুঃখে ও অনুশোচনায় বিলাতেই অকস্মাত্ মৃত্যুমুখে পতিত হন।

স্ক্রাফটনঃ
----------
ষড়যন্ত্রের পিছনে স্ক্রাফটনও বিশেষভাবে কাজ করিয়াছিলেন। জানা যায়, বাংলার বিপুল সম্পদ লুণ্ঠন করিয়া বিলেতে যাইবার সময় জাহাজডুবিতে তাহার অকাল মৃত্যু ঘটে।

মীর কাসেমঃ
------------
মীরজাফরের ভাই রাজমহলের ফৌজদার মীর দাউদের নির্দেশে মীর কাসেম নবাব সিরাজের খবর পাইয়া ভগবানগোলাঘাট হইতে বাঁধিয়া আনিয়াছিলেন মুর্শিদাবাদে। পরে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তিনি নবাব হন এবং এ সময় ইংরেজদের সহিত তাহার বিরোধ বাধে ও কয়েকটি যুদ্ধে পরাজিত হন। পরে ইংরেজদের ভয়ে হীনবেশে পলাইয়া যান এবং রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়া বেড়ান। অবশেষে অজ্ঞাতনামা হইয়া দিল্লীতে তাহার করুণ মৃত্যু ঘটে। মৃতের শিয়রে পড়িয়া থাকা একটা পোঁটলায় পাওয়া যায় নবাব মীর কাসেম হিসেবে ব্যবহৃত চাপকান। এ থেকেই জানা যায় মৃত ব্যক্তি বাংলার ভূতপূর্ব নবাব মীর কাসেম আলী খান।

এইভাবেই বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা পলাশী যুদ্ধের কিছুকালের মধ্যেই বিভিন্ন পন্থায় মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হন। পলাশী ষড়যন্ত্রকারীদের উপরে মহান স্রষ্টা বিমুখ হইয়াছিল বলিয়াই অনেকের ধারণা। আসলে এইসব ঘটনা থেকেই আমাদের অনেক কিছু শিখিবার বিষয় রহিয়াছে।

নবাব সিরাজউদ্দৌলার সাড়ে চারশ’ দিনের ঘটনাপ্রবাহঃ
-----------------------------------------------------
৯ এপ্রিল, ১৭৫৬ সাল : 
 নবাব আলীবর্দী খানের মৃত্যু। বাংলার মসনদে নবাব সিরাজউদ্দৌলার আরোহণ।
 সিরাজউদ্দৌলার বয়স তখন মাত্র তেইশ বছর।

১৭৫৬ সালের এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ :
 ইউরোপে সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের অজুহাতে বাংলায় ইংরেজ ও ফরাসিদের দুর্গ নির্মাণ। নবাবের আদেশে ফরাসি দুর্গ নির্মাণ বন্ধ হলেও ইংরেজদের দুর্গ নির্মাণ অব্যাহত।

১৬ মে, ১৭৫৬ সাল : বিদ্রোহী শওকত জঙ্গকে দমনের উদ্দেশে পুর্নিয়ায় নবাব সিরাজউদ্দৌলার সামরিক অভিযান।

২০ মে, ১৭৫৬ সাল : নবাব সিররাজউদ্দৌলা রাজমহল পৌঁছেছেন। গভর্নর ড্রেকের চিঠি হস্তগত। চিঠিতে দুর্গ নির্মাণ বন্ধের কোনো কথা নেই।

১৬ জু

পঠিত : ১৩৬৭ বার

মন্তব্য: ০