Alapon

এরদোয়ান-এর বিজয় এবং বঙ্গীয় ইসলামপন্থীদের প্রাসঙ্গিক ভাবনা-চিন্তা

নতুন সংবিধানের আওতায় গতকাল অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এরদোয়ানের তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচনোত্তর হৈ হুল্লোড়ে আক পার্টির নারী কর্মী-সমর্থকদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশকে অশালীন পোষাকে দলীয় পতাকা হাতে উল্লাস করতে দেখা গেছে। এরদোয়ানের দল নিজেকে ইসলামী হিসাবে দাবী না করলেও দুনিয়াজোড়া সেকুলার ও ইসলামী মহলে ওদের সম্পর্কে এক প্রকার ইজমা হয়েছে, আক পার্টি ইসলামপন্থী দল। ওরা কিন্তু ইসলাম প্রতিষ্ঠার কথা বলে না।

ওসমানী খেলাফতের নামে এক ধরনের সমপ্রসারণবাদের স্বপ্ন দেখায়। জাতীয়তাবাদের প্রতি তাদের কমিটমেন্ট পূণঃ পূণঃ ব্যক্ত করে। জনগণকে, অন্ততপক্ষে নিজ দলীয় অনুসারীদেরকে নামাজের কথা বলে না। তারা যাকাত আদায়ের জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা চালু করে নাই। কী এমন ব্যাপার যার কারণে সবাই তাদেরকে ইসলামী হিসাবে ট্যাগ লাগাচ্ছে? ওরা কীভাবে ইসলামী দল হলো? এমনকি, ওদের ওখানকার মূলধারার ইসলামী দল ওদের বিরোধিতা করে খেয়ে না খেয়ে কোমর বেঁধে।

বাস্তবে এরদোয়ানেরা যা করছেন একাডেমিক পরিভাষায় বিদ্যজনেরা সেটার নাম দিয়েছেন ‘ইসলামিক মর্ডানিজম’। বাংলা কথায়, ইসলামী আধুনিকতাবাদ। তো, এই আধুনিক ইসলাম কতোটুকু ইসলাম সমর্থিত? না, এই উত্তর আমি এখানে দিতে চাচ্ছি না। এ নিয়ে এখানে নতুন করে কোনো আলাপ তুলতে চাচ্ছি না। এ বিষয়ে আগ্রহবোধ করলে ইয়াসির কাদি ২০১৪ সালে লন্ডন শহরে “ইসলামী চিন্তার সংস্কার: বিচ্যুতি, প্রগতি, নাকি সময়ের দাবি?” শিরোনামে যে লম্বা বক্তৃতা দিয়েছেন সেটার সাবলীল অনুবাদটা পড়ে দেখতে পারেন। সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্র তাদের সাইটে প্রশ্ন-উত্তরসহ মোট ৯ পর্বে সেটা ছাপিয়েছে। মাঝখান থেকে একটা লিংক দিচ্ছি: [https://cscsbd.com/1375] ।

বছর কয়েক আগে ইসলামিক মর্ডনিজমের ওপর জিয়াউদ্দীন সর্দার মহোদয়ের করা একটা ডকুমেন্টারি দেখে কয়েকদিন মাথা ঝিম ঝিম করছিলো। হায় আল্লাহ, এই ধরনের মডার্ন ইসলামের সাথে কীভাবে নিজেকে কো-অপ করবো, ভেবে পাচ্ছিলাম না। সেই ডকুমেন্টারিটাতে দেখবেন ইন্দোনেশিয়ার এক নারী নাপিত সর্দার মহোদয়কে সেবা দিচ্ছেন। হেয়ার কাটিং চেয়ারে মাথা হেলান দিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করছেন, আমি একজন পুরুষ। তুমি আমার চুল কাটছো।

তুমি কীভাবে ইসলামিস্ট হইলা? ওই তরুণী বলছে, কেন, অসুবিধা কী? আমি তো নামাজ পড়ি। ডকুমেন্টারিটিতে দেখা গেছে, মেয়েটি কাজ শেষ করে একটা স্কুটিতে করে ওর বাচ্চাটাকে নিয়ে বাসায় এসে জিন্সের প্যান্ট আর টি-শার্টের উপর নামাজের হিজাব পড়ে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়ছে। এবার বুঝেন ...!

জিয়াউদ্দিন সর্দারের ইসলামিক মর্ডানিজম নিয়ে এই মাথাঘোরানো অনুসন্ধান-প্রদর্শন ক্লাইমেক্সে উঠে যখন তিনি পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ নানান দেশ ঘুরে তুরস্কে পৌঁছান। ডকুমেন্টারিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ‘ইসলামপন্থী’ এরদোয়ানের সাক্ষাৎকার আছে। ভিডিওচিত্রটার একপর্যায়ে দেখা যায়, একেবারে খোলামেলা পোষাক পড়া তুরস্কের একজন জনপ্রিয় অভিনেত্রী নিজেকে একজন ইসলামিস্ট দাবী করছে বলছে, দেখো, আমি ঘরে গিয়ে নামাজ পড়ি। গাড়ীর ডেশবোর্ড থেকে সে ওজিফার বই বের করে সে দেখালো। যেটা সে নিয়মিত পড়ে।

২.
প্রচলিত ইসলামী সংগঠনগুলো মানুষের আমল-আখলাক সংশোধনের ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করে। আমি সারাজীবন এ দেশীয় ইসলামী আন্দোলনের মূল ধারাটার সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম। সক্রিয়ভাবে কাজ করেছি। ঘরের গরু কোরবানী করা, পারিবারিক নামাজে ইমামতি করা ইত্যাদির মাধ্যমে ছাত্রজীবন হতেই পারিবারিক ও পরিচিত মহলে একধরনের ‘হুজুর টাইপের’ ইমেজ নিয়ে বড় হয়েছি। প্রচলিত রক্ষণশীল ধারায় সমাজ পরিবর্তন হবে না বুঝতে পেরে এক পর্যায়ে যখন ‘সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্র’ তথা সিএসসিএস-এর বিকল্প প্লাটফর্মে কাজ করা শুরু করলাম, তখন টের পেলাম, ‘আমরা’ কতোটা সমাজবিচ্ছিন্ন ...! ইসলামী রাষ্ট্রের রংগীন স্বপ্নে বিভোর থেকে আমরা সমাজটাকেও দেখেছি ‘সাংগঠনিক’ অতিশুদ্ধতাবাদিতার রংগিন কাঁচের ভিতর দিয়ে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, ইসলাম নিয়ে, বিশেষ করে হাদীস ও সীরাতের ব্যাপক অধ্যয়নের মাধ্যমে ক্রমে ক্রমে জানলাম, যে শুদ্ধতাবাদী ভার্শানকে আমরা সহী ইসলাম হিসাবে এতদিন পর্যন্ত ‘সাংগঠনিকভাবে’ জেনেছি, তা অতিরঞ্জিত। একজাজেরেইটেড। এবং এই অর্থে রং এন্ড ফেইক। আমাদের অতিশুদ্ধতাবাদী ও অতিরক্ষণশীল ‘উচু’ তাকওয়ার স্ট্যান্ডার্ড অনুসারে সাহাবীদের সমাজ বিশেষ করে নারী-পুরুষের সম্পর্কের দিক থেকে অনেকটাই ভিন্ন রকমের। রাসুলের যুগে নারী স্বাধীনতা ছিলো এখনকার মুত্তাকী ইসলামিস্টদের কল্পনাতীত। এ যেন খানিকটা ‘ফ্রি-মিক্সিং’এর পরিবেশ।

তৎকালীন মদিনার সামাজিক পরিবেশ যৌনতার দিক থেকে ছিলো অনেকটাই ‘অবাধ’। যে যার সাথে যেভাবে পারো থাকো। সম্পর্ক করো। অসুবিধা নাই। তবে, যাই করো, জানিয়ে করো, অনুমোদন নিয়ে করো। সীমানা সীমারেখা মেনে চলো। দায়-দায়িত্ব নিয়ে আইনসম্মতভাবে তোমরা স্বাধীন। এ’ধরনের অবদমনমুক্ত অতিসহজ বৈবাহিক ব্যবস্থাকে আমরা এক ধরনের ল’ফুল লিভিং টুগেদার বলতে পারি।

সেক্স নিয়ে কোনো রকমের ট্যাবু সেখানে ছিলো না। এক মহিলা কর্তৃক কাপড়ের কোণা দেখিয়ে রাসুলুল্লাহ সা:এর কাছে দ্বিতীয় স্বামীর কাছ হতে বিচ্ছিন্ন হতে চাওয়ার গল্পটা আজ না থাক। এক মহিলা কর্তৃক প্রকাশ্য মজলিশে রাসুলুল্লাহ (স.)কে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া, চাচা আলী (রা.) সাথে ভাতিজি ফাতেমা (রা.) বিয়ে, তাতে তাদের পারষ্পরিক আগ্রহ থাকা, আবু বকর (রা.) কর্তৃক নিজের অল্প বয়সী কুমারী কন্যা আয়িশা (রা.)কে তিন গুণেরও বেশি বয়সী বরের কাছে বিয়ে দেয়া এবং অসম এ বিয়েতে পাত্র-পাত্রীর মধ্যে রোমান্টিক সম্পর্ক বজায়া থাকা, এখানে আমি মাত্র এই কয়েকটা অতিজানা উদাহরণের কথা আজ বললাম। এ’ ধরনের ভুরি ভুরি উদাহরণ আপনি সীরাত গ্রন্থগুলোতে পাবেন। এ’গুলো পড়ে পড়ে বঙ্গীয় তাকওয়াসম্পন্ন মুসলমানেরা আবেগে ভাসে, কিন্তু এগুলোকে বাস্তব জীবনে মেনে নিতে ও অনুমোদন করতে পারে না।

৩.
ফেইসবুকে ‘মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক’ নামে আমার একটা পেইজ আছে। সেখানে আমি নন-কনসেপ্টচুয়াল তথা পারসনাল বিষয়গুলো সাধারণত শেয়ার করি। কয়েকদিন আগে আমার এক ভাগ্নির সাথে আমার একটা ছবি সেই পেইজে পোস্ট করার পরে এক বঙ্গীয় ইসলামিস্ট আমাকে মিহি সুরে খুব শাসালেন। আমার ওই ভাগ্নি পর্দা করে না। পেশায় ডাক্তার। ওই সিনসিয়ার ইসলামিস্ট মহোদয়ের সাথে আমার আলাপটা এখানে হুবহু কোট করছি:

“প্রশ্নকারী: এই ছবি দিয়ে কি নেকি জমা করতেছেন, নাকি পাপ জমা করতেছেন?

আমার মন্তব্য: যাহা আপনার ধারনা মোতাবেক সঠিক তাহা আপনার জন্য সঠিক। যাহা আমার ধারনা মোতাবেক সঠিক তাহা আমার কাছে সঠিক। লাকুম দিনুকুম ওয়ালিয়া দিন। I am used to to keep warm relation with my relatives, no matter they like to follow me in my ideological concerns, or not. I believe in personal liberty, perhaps you not. That's your business. Not of me.

প্রশ্নকারী: আপনি একজন মুসলিম এবং আপনাকে আমি জ্ঞানী মনে করি। সুতরাং পর্দা সম্পর্কিত জ্ঞান আপনার না থাকার কথা নয়। ‘লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন’ - এই আয়াতটি মুসলিমরা অমুসলিমের সামনে বলবে।

আমার মন্তব্য: আপনি যদি আন্তরিকতা ও ভালবাসার কারণে এই কমেন্ট করে থাকেন তাহলে একটু কষ্ট করে আমার “ইসলামী শরীয়াহ বাস্তবায়নে ক্রমধারার অপরিহার্যতা” [https://cscsbd.com/275] -এই লেখাটা পড়বেন এবং বুঝার চেষ্টা করবেন। আর যদি ফেসবুকীয় হেদায়েত বিতরনের জন্য মন্তব্যটা করে থাকেন তাহলে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নাই।

প্রশ্নকারী: আন্তরিকতার সহিত কমেন্ট করেছি, আপনার কাছে জানতে চাই, আপনি আপনার ভাগ্নিকে নিয়ে যেভাবে ছবি দিয়েছেন এটা কি আপনার দ্বীন সমর্থন করে?

আমার মন্তব্য: হাঁ, করে। খুব সম্ভবত আপনি উপরে রেফারেন্স দেওয়া আর্টিকেলটা পড়েন নাই অথবা ভাল করে পড়েন নাই। কোন এক প্রযুক্তির কল্যাণে যদি মক্কী যুগের কোন সাহাবীকে তার কোনো আত্মীয় মহিলার সাথে দেখা সম্ভব হতো তাহলে খুব সম্ভবত এ রকমই দেখা যেত। ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করেন। I see Islamic shrariah from a bottom-up approach and perhaps you see it from a top-down approach.”

৪.
কথাটা খুব পরিষ্কার। আমাদের এখানকার ইসলামিস্টরা ইসলামকে দেখে টপ-ডাউন এপ্রোচে। তাই তারা এডমিনিস্ট্রেটিভ টপ-ডাউন এপ্রোচের সাথে মতাদর্শগত সোশিও-পলিটিক্যাল বটম-আপ এপ্রোচকে গুলিয়ে ফেলে। বঙ্গীয় ইসলামপন্থীদের সনাতনী ধারার যারা স্টেকহোল্ডার, তাদের যেসব বিগ প্রবলেম, এটি তার অন্যতম।

সনাতনী ইসলামী আন্দোলনপন্থীরাসহ এ’দেশের বৃহত্তর ধর্মপ্রাণ মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান রোগ হলো, নারীদের নিয়ে তাদের ওভারসেন্সিটিভিটি। তাদের লাফ-ধাপ-ঝাপ-দৌড়-নর্তন-কুর্দন দেখে মনে হয়, ইসলাম বুঝিবা কিছু ডুজ এন্ড ডন্টস-এর জন্য এসেছে। নারীদের পর্দা রক্ষা করার বিষয়টা এই সংক্ষিপ্ত করণীয়-বর্জনীয় তালিকার উপরের দিককার একটা কিছু ...!

দুঃখজনক হলেও সত্য, এ’ দেশের ইসলাম, ওভারহোয়েমিংলি পুরুষদের ইসলাম। নারীরা সেখানে অপাংক্তেয়। এমন কি ক্ষণিকের অতিথিও না। পুরুষদের এই মহাদেশীয় ইসলামে নারীরা অবাঞ্ছিত। নারীদের মধ্যে যারা ইসলামিস্ট, প্রাকারান্তরে তারা এই পুরুষতন্ত্রের ডিফেন্ডার। পুরুষরা নারীদের যেভাবে দেখতে চায় সেভাবে নিজেদের সাজিয়ে তারা ভালো মুসলিমা। তারেক রমাদানের ভাষায় এরা হলো মূলত: ‘হালাল ক্যাপিটালিজম’এর অনুসারী। ‘সালাফি ইসলাম’ হলো এই উঠতি ধারার লোকাল পরিচিতি।

সার্বিকভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সমকালীন বাংলাদেশে আমরা যদি মক্কী যুগে অবস্থান করে থাকি তাহলে আমাদের উচিত হবে, নানা ধরনের বিধি-বিধানের চেয়ে ইসলামের বেসিক আন্ডারস্ট্যান্ডিং ও প্রক্লেমেশান নিয়ে ওভারঅল এন্ড প্রফাউন্ডলি এনগেইজ হওয়া। মনে রাখতে হবে, Islam is not a bundle of rules. Instead, it is life-view. Rules are mere supplementary outcomes. But, concepts and understandings are the basics.

দুঃখজনক ব্যাপার হলো, ট্রাডিশনাল ইসলামিক মুভমেন্টের ফরম্যাট হলো, রিক্রুটেড লোকদেরকে যথাসম্ভব রোলমডেল হিসাবে গড়ে তোলা। যাতে তারা সমাজের লোকদের কাছে ‘সত্যের সাক্ষ্য’ হিসাবে দাঁড়াতে পারে। সেজন্য সেই সব লোকদেরকে একটা সিলেবাস, দৈনন্দিন ব্যক্তিগত রিপোর্ট সংরক্ষণ, নিয়মিত সাংগঠনিক জওয়াবদিহিতা ইত্যাদির মধ্যে রাখা হয়। এভাবে ‘ভালো মানুষ’ নির্ণয়ের একটা ‘মান’ বা স্কেল তৈরী করা হয়। এবং সে অনুযায়ী সংগাঠনিক হাইয়ারআরকি সেট করা হয়।

সমস্যা হলো, কিছু প্রদর্শনীমূলক ভালো কাজের মাধ্যমে সত্যিকারের ভালো মানুষ তৈরী করা যায় না। ভালো মানুষ তৈরী হতে হয় অন্তর থেকে ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে। নিছক র্ধ্মীয় আবেগ দিয়ে আখেরাতমুখী লোক তৈরী করা যায়, সমাজে ধর্মীয় আবহ তৈরী করা যায়। যেমনটা করছে বিশ্বব্যাপী বৃহত্তম ইসলামী সংগঠনটি। কিন্তু, যে কাজের জন্য আল্লাহতায়ালা মানুষকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন তা, অর্থাৎ আল্লাহর খলিফা হিসাবে বিশ্ব-জগতে নেতৃত্ব দেয়া, তাওহীদকেন্দ্রিক সভ্যতা গড়ে তোলা, ন্যায় ও সুষম উন্নয়নের ধারায় রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনা করা, এক কথায় সৎকাজের আদেশ দেয়া ও অসৎ কাজ হতে বিরত করার কাজটা করতে হলে মানুষকে কনভিন্স করেই তা করতে হবে। সেজন্য তাদেরকে বাস্তবসম্মতভাবে ও কার্যকর-টেকসই উপায়ে তাদেকে কমিটেড হতে হবে।

অবাস্তব কোনো ‘সাংগঠনিক’ আবহের বুদ বুদের মধ্যে যত লোকই তৈরী হোক না কেন, মনে মনে ‘মন-কলা’ খাওয়ার মতো তাতে ক্ষিধা মিটবে না, পেট ভরবে না। সময় মতো এ’সব সিলেবাসের ভিটামিন খাওয়া লোকেরা বাস্তব ময়দানে টিকে থাকতে পারবে না। রাবার টেনে মাপ দিয়ে ছেড়ে দেয়ার পরে যা হয়, এট দ্যা ভেরি ফার্স্ট চান্স, এরা ভেতরকার স্বভাবে ফিরে যাবে।

যে নৈতিকতা বাস্তবজীবন-সংযুক্ত নয়, তা মূলত: আইন-মান্যতা। আইন মানা আর নৈতিক হওয়া দু’টো ভিন্ন বিষয়। তাই তো দেখা যায়, সারাজীবন সাংগঠনিক আইন মানা ‘মানের’ লোকগুলো পেশাগত জীবনে দড়ি ছেঁড়া গরুর মতো গোগ্রাসে দুনিয়াবি নেয়ামত হাতাতে থাকে। যত বড় দায়িত্বশীল, মুয়ামালাতে বিশেষ করে লেনদেনে ততই বেপরোয়া। ব্যতিক্রম বাদে।

৫.
লম্বা লেখা লিখবো না ভাবি। হায় আল্লাহ, ফেইসবুক-পাঠকদের জন্য এটিও বেশ লম্বা হয়ে গেলো ...! সরি! অবশ্য, আমি লেখালেখি করি আমার একান্ত শুভানুধ্যায়ীদের জন্য। ভবিষ্যতে যারা ইসলামী মতাদর্শভিত্তিক সামাজিক আন্দোলনের কাজ করবেন, এসব লেখা মূলত তাদেরকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সহযোগিতা করার জন্য লেখা। এই ঐতিহাসিক ক্রান্তিকালে যেহেতু ফেইসবুক নামক একটা সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের আছে; এবং কীভাবে যেন mohammad mozammel hoque -এই ফেইসবুক আইডিটার একটা পাঠক মহলও তৈরী হয়ে গেছে, তাই এসব লেখা ফেইসবুকে পোস্ট করা। ফেইসবুক এক্টিভিটি আমার মূল কাজ নয়, অংশমাত্র। তা যারা আমাকে তেমনভাবে জানে না, তারা হয়তো জানেন না। সে যাই হোক।

আমার কাছে ইসলাম সম্পর্কে জানতে, নানা প্রশ্ন নিয়ে লোকজন আসে। এরমধ্যে বোরকা পড়ে না, মাথায় কাপড় দেয় না, এমন ছাত্রীরাও আছে। কোনো কোনো ছাত্র তাদের ছাত্রী বন্ধুদের নিয়ে আসে। কোনো কোনো ছাত্রী তাদের ছাত্র বন্ধু-সহপাঠীদের নিয়ে আসে। আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের সাথে নানা ইসলামিক বিষয় ও ইস্যু নিয়ে খোলামেলা আলাপ-আলোচনা করি। এমনও হয়, আমি নামাজের সময়ে পাশের রুমে নামাজ পড়ে এসে আবার ইসলাম নিয়ে তাদের সাথে আলোচনা চালাতে থাকি। তাদেরকে নাস্তা-পানি খাওয়াই। বিদায়ের সময় পারলে কদ্দুর আগাইয়াও দিয়ে আসি।

বাহ্যিক আমল-আখলাক ও ভিতরের ভাবনা-চিন্তা, দুটাই যদি উন্নতমানের হয়, তাহলে তো খুবই ভালো। অভিজ্ঞতা বলে, সাধারণত এর একটাকে প্রায়োরিটি দিলে অপরটি আনফোকাসড বা ওভারশ্যাডোড হয়ে পড়ে। এ যেন ডিজিটাল ক্যামেরায় ছবি তোলার মতো ব্যাপার। এই দোটানায় পড়ে আমি মানুষের চিন্তা-চেতনা পরিশুদ্ধির পথ বেছে নিয়েছি। আমার ফর্মূলা বা থিওরি হলো, মানুষের মনে আদর্শের বীজটা বুনে দাও। সময়ে তা আপনাতেই বৃক্ষ হয়ে উঠবে। ফল দিবে। রুলস-রিচুয়ালসের চেয়ে কনসেপ্ট-ক্লারিফিকেশন বোধ হয় অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ।

তুরস্কে ইসলামপন্থীদের জয়ে যারা উল্লসিত, তারা সেটা থেকে শিক্ষা নেয়ার জন্য মোটেও প্রস্তুত না। প্রত্যেকে বসে আছে কখন সবাই মিলে একটা কিছু করবে। অথচ আপনি আপনার দুনিয়াবি অর্জন, আয়, উন্নতি, পদোন্নতি ও প্রসারের জন্য সর্বাত্মকভাবে কাজ করছেন, কারো কাছ থেকে সিদ্ধান্ত আসার অপেক্ষা না করেই। সামাজিক দায়িত্বকে যখন আপনি এতই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন, সেটার জন্য কেন আপনি ‘সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের’ অপেক্ষায় বসে আছেন? আল্লাহ তায়ালা কি আপনাকে কোনো সামর্থ্য দেন নাই? আল্লাহর রাসুল (স.) বলেছেন, সাবধান, প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। এবং প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, প্রত্যেক নিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

নিজেকে একটা ত্রিভুজের মাঝে কল্পনা করুন, যার একটা বাহু আদর্শ বা তত্ত্ব যাকে আপনি প্রেফার করেন, একটা বাহু আপনার ইমিডিয়েট পারিপার্শ্বিকতা তথা যে সমাজ ও দেশে আপনি বসবাস করেন সেটা এবং এই ত্রিভুজের অন্য বাহুটা হলো বৃহত্তর জগত তথা সমকালীন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি। এবার নিজের বিবেককে আপনি জিজ্ঞাসা করেন, আপনার করণীয় কী? উত্তর পেয়ে যাবেন। এ’ নিয়ে আমার এই লেখাটা পড়তে পারেন, “আদর্শবাদীদের চিন্তা ও কাজের মডেল” (লিংক- https://mozammelhoque.com/model-of-thinking-process-and-work-procedure-of-the-idealists-ones/)। ভালো থাকেন। এ’ পর্যন্ত যদি পড়ে থাকেন তাহলে আমি নিশ্চিত আপনাকে দিয়ে কিছু একটা হবে। শুরু করেন ...

লিখেছেনঃ Mohammad Mozammel Hoque স্যার

পঠিত : ১৮৬৯ বার

মন্তব্য: ০