Alapon

ঘুরে আসুন ঈশা খাঁর কেল্লা হতে

ঢাকার খুব কাছেই কেল্লাটি। সাধারণত খুব একটা পর্যটক সেখানে যায় না। শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীরে নারায়ণগঞ্জ জেলা শহরের কিল্লারপুলে অবস্থিত ঐতিহাসিক হাজীগঞ্জ দুর্গ। ঈশা খাঁর কেল্লা হিসেবেও অনেকের কাছে এটি পরিচিত। ইশা খাঁ প্রথমে এটি নির্মাণ করলেও মুঘল সুবেদাররা এটিকে ব্যবহার করেছেন ও এর সম্প্রসারণ করেছেন। তাই এর মধ্যে মুঘল স্থাপত্যের ছাপও পাওয়া যায়। 

আবার এটি খিজিরপুর দুর্গ নামেও পরিচিত। বাংলার সম্পদ লুট করতে সুলতানি আমল থেকেই চট্টগ্রামের সমুদ্রতীর থেকে ছিপ নৌকা নিয়ে মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুরা আক্রমণ করত। এদের আক্রমণ প্রতিহত করতে তিনটি জলদুর্গ তৈরি করা হয়। এই তিনটি জলদুর্গের একটি হচ্ছে হাজীগঞ্জ দুর্গ। নদীপথে মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের কবল থেকে এ জনপদকে রক্ষা করার জন্য কেল্লাটি তৈরি করা হয়।


কেল্লার প্রধান ফটক

প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক হাজীগঞ্জ কেল্লা। অধিকাংশ মানুষের মতে এটি ১৬৫০ সালের দিকে নির্মিত হয়েছিল। 
এটি ইট-সুরকির তৈরি চতুর্ভুজাকৃতি দুর্গ। পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা দুর্গটির আয়তন আনুমানিক ২৫০ বাই ২০০ ফুট । দুর্গটি বেশ চওড়া ও প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। উত্তর দেয়ালেই দুর্গের একমাত্র প্রবেশ পথ দুর্গ তোরণ। উঁচু এই দূর্গে ঢুকতে হলে প্রবেশ তোরণের প্রায় ২০টি সিঁড়ি ডিঙ্গাতে হবে। তোরণ থেকে দুর্গ চত্তরে নামতে হবে ৮টি সিঁড়ি।

প্রাচীর ঘেষেই ভেতরে চারদিকে চলাচলের পথ রয়েছে। দুর্গের পূর্ব-দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় দুটি বুরুজ আছে। আরো একটি বুরুজ রয়েছে দক্ষিণ পাশে। তাছাড়া উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম কোনায় ছোট দুটি বুরুজ অংশ আছে, যেখানে এক সাথে কয়েকজন বন্দুক বসিয়ে গুলি চালাতে পারতো। এ বুরুজের অন্যতম কাজ ছিলো কামানের গোলা নিক্ষেপের পাশাপাশি বাইরের অবস্থান পর্যবেক্ষণ। দুর্গের পূর্ব-দক্ষিণ কোনে রয়েছে একটি ওয়াচ টাওয়ার। টাওয়ারে ঢোকার জন্য ছিলো ছোট্ট একটি পূর্বমুখী দরজা। 



ভেতরে ঠিক মাঝখানে একটি মোটা গোল পিলার, পিলারের সাথে গোলাকার সিঁড়ি। আজ পিলারটি টিকে থাকলেও অনেকটুকু সিঁড়িই ভেঙ্গে গেছে। ওয়াচ টাওয়ারটি আজ বিলিন হওয়ার পথে। ইটের তৈরি উঁচু এ মঞ্চটি নদীর দিকে মুখ করা । এ মঞ্চের উপর কামান বসানো হতো। দুর্গে চত্বরের পশ্চিম দিকে আছে বেশ বড় একটি আমগাছ, আর পূর্ব পাশে আছে বড় একটি লিচু গাছ। যা ইতিহাসের সাক্ষী। দুর্গজুড়ে রয়েছে মাটির উঁচু বাঁধ, যার মাঝে রয়েছে ছোট ছোট ফাঁকা জায়গা সেখানে অস্ত্র রেখে মোকাবিলা করা হতো শত্রুদের। 

দুর্গের মাঝে পুরোটাই ফাঁকা মাঠ। ধারণা করা হয়, এখানে অবস্থান নেয়া সৈন্যরা এ মাঠে তাঁবু খাটিয়ে থাকত। সেই সময়ে যেহেতু নদীপথই ছিল যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম তাই নদীপথের আক্রমণ রুখতে নদীর তীরবর্তী জায়গাতেই নির্মাণ করা হয় এ দুর্গটি। এক সময়ের প্রতাপশালী সুবেদার মীর জুমলা খানও অধিকাংশ সময় এ দুর্গে কাটাতেন। বিশেষ করে বর্ষার সময় তিনি এ খিজিরপুর (হাজীগঞ্জ) দুর্গের ভার নিজ হাতে গ্রহণ করতেন। প্রতিহত করতেন নৌপথে অভিযানকারী জলদস্যুদের।

সময়ের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন লোক ব্যবহার করতেন এ দুর্গ নিরাপত্তার জন্য। দুর্গের বাইরের বেশ কয়েকটি নকশা করা পিলার ও নির্মাণ শৈলীও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। খসে পড়েছে দেয়ালের ইট। দুর্গের দেয়ালগুলো বেশ উঁচু প্রায় ২০ ফুট। দুর্গ প্রাচীর লাগানো একটি পায়ে হাটার উপযোগি প্রাচীর রয়েছে। নির্মাণের সময়ে নদীর পাশ দিয়ে বয়ে গেলেও বর্তমানে নদী অনেকটা সরে গেছে।

ঐতিহ্যবাহী হাজীগঞ্জ দুর্গ এখন ধ্বংসের পথে। সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংস হতে যাচ্ছে এই দুর্গ। রয়েছে নজরদারীর অভাব। যার ফলে মাদকসেবীদের আড্ডার স্থল হিসেবে পরিণত হয়েছে এ স্থাপত্য নিদর্শনটি। এতে দিনদিন আগ্রহ হারাচ্ছেন পর্যটকরা। দুর্গটিকে প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর অধিদপ্তরের নিয়মিত তদারকি করা উচিত। পূর্বে বিভিন্ন পর্যায়ে সংস্কার করা হয়েছে। এরপর আর কোন সংস্কারের ছোঁয়া লাগেনি দুর্গটিতে। 


কামান রাখার স্থান

দুঃখজনক ব্যাপার হলো এটা রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য কোন লোক নেই। কর্তৃপক্ষের যথাযথ তদারকি না থাকায় দুর্গের ভেতরে অবাধে চলে মাদকসেবীদের আড্ডা। বছরের পর বছর ক্রমেই ক্ষয়ে পড়ছে এ দুর্গের অভ্যন্তর। ব্যবহৃত হচ্ছে গৃহপালিত পশুর চারণভূমি ও শিশু-কিশোরদের খেলার নির্ভরযোগ্য স্থান হিসেবে। যথাযথভাবে সংরক্ষণ না হলে কিছুদিন পর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে হাজীগঞ্জ দুর্গ রূপকথার গল্পই মনে হবে।
 
এখানে একটি মসজিদ রয়েছে যা বিবি মরিয়ম মসজিদ নামে পরিচিত। ঐতিহাসিকদের মতে, শায়েস্তা খাঁ ১৬৬৪ থেকে ১৬৮৮ সালের মধ্যবর্তী একটি সময়ে এ মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদের কাছে তার কন্যা বিবি মরিয়মের সমাধি রয়েছে বলেই মসজিদটির নাম বিবি মরিয়ম মসজিদ এবং এ নামেই এটি বেশি পরিচিত। মোঘল আমলের নিদর্শন পাওয়া যায় এ সমাধিতে। এখনও দুর্গটি চমৎকার স্থাপত্য নিয়ে মোগলযুগের গৌরবের কথা বলছে।

যেভাবে যাবেনঃ ঢাকার যে কোনো স্থান থেকে আপনাকে প্রথমে যেতে হবে, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী বা কমলাপুর। গুলিস্তান বা যাত্রাবাড়ী থেকে নারায়ণগঞ্জ যেতে পারবেন এসি বা ননএসি বাসে। ভাড়া পড়বে ৩৬ থেকে ৫০ টাকার মধ্যে। আর কমলাপুর থেকে যাবেন ট্রেনে, ভাড়া ১০ টাকার বেশি নয়। কম-বেশি ৪৫ মিনিটে পৌঁছে যাবেন ঢাকা থেকে ২২ কিলোমিটার দূরের নারায়ণগঞ্জে। নারায়ণগঞ্জ বাস  বা ট্রেন স্টেশন থেকে ১৫ থেকে ২০ টাকায় রিকশা ভাড়া নেবে হাজীগঞ্জ কেল্লা। বাসে গেলে নামতে হবে খানপুর মেট্রোহলের মোড়। সেখান থেকে রিকশায় ১০টাকায়  যাওয়া যাবে কেল্লায়।

পঠিত : ২৩৮০ বার

মন্তব্য: ০