Alapon

দারিদ্র্যের জোয়াল ভেঙে আসা রোমেলু লুকাকু বিশ্বকাপের প্রাণভোমরা

ছয় বছর বয়সে মাকে যেদিন লুকিয়ে লুকিয়ে দুধের সাথে পানি মেশাতে দেখেছিলেন সেদিন রোমেলু লুকাকু বুঝেছিলেন আসলেই কতটা গরীব তাঁরা! আরো বুঝলেন, যেদিন রাতে ফিরে দেখলেন বাড়িতে আলো জ্বলছে না। এভাবে দু-তিন সপ্তাহ কেটে যেত বিদ্যুৎ ছাড়া। আরো বুঝলেন, যেদিন স্নানঘরে গরম পানির অভাবে মায়ের গরম করে দেয়া পানি কেটলি থেকে কাপ দিয়ে মাথায় ঢেলে স্নান করতে শুরু করলেন। বুঝলেন, যখন গলির মোড়ের দোকান থেকে পাউরুটি ‘ধার’ করতে শুরু করে দিলেন মা।ভমায়ের অসহায় চেহারা দেখেও নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করতেন ছোট্ট লুকাকু।

লুকাকুর দরিদ্রতার কথা ওর নিজের মুখেই শোনা যাকঃ
ভেঙে যাওয়ার সময়টা খেয়াল আছে আমার। আমাদের ভেঙে যাওয়া, ক্ষয়ে যাওয়া। মা ফ্রিজের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, গোটা দৃশ্যটা আমার পরিস্কার মনে আছে। চোখের সামনে ভাসে।

তখন আমার ছয় বছর বয়স। স্কুল ব্রেকের সময় সাধারনত বাড়িতে খাবার জন্যে ফিরতাম। প্রতিদিন, একদম প্রতিদিন মেন্যুতে একই খাবার, পাউরুটি, দুধ। আসলে ঐ বয়সে খাবার নিয়ে কেউ চিন্তা করেনা। আসেনা মাথায়। মা যা দেয় বাচ্চারা খেয়ে ফেলে। তারপরও…তারপরও আমি জানতাম ওর চাইতে বেশি কিছু আমাদের সামর্থ্যের মধ্যেই ছিলোনা।

তারপর আরকি, সেদিনটা আসলো। প্রতিদিনের মতো দুপুরে বাড়ি ফিরে সোজা ঢুকে গেলাম কিচেনে। দেখি মা রেফ্রিজারেটরের সামনে দাঁড়িয়ে, হাতে এক বক্স দুধ। আমার খুবই পরিচিত দৃশ্য। এই দৃশ্যে অপরিচিত যে অংশটা ছিলো তা হচ্ছে মা দুধে কি যেন মেশাচ্ছিলেন। খুব ভালো করে মেশাচ্ছিলেন, বুঝতে পারছেন তো? ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি কি হচ্ছে ঘটনাটা। ভালোমতো মিশিয়ে টিশিয়ে মা খাবার আমার সামনে এনে রাখলেন, মুখে সেই পরিচিত হাসিটা, যেন কিচ্ছু হয়নি। সবকিছু একেবারে ঠিকঠাক। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম। বুঝে যাচ্ছিলাম আসলে।

আমার মা দুধে জল মেশাচ্ছিলেন। গোটা সপ্তাহ চলার জন্যে আমাদের হাতে টাকা ছিলোনা। আমরা ক্ষয়ে যাচ্ছিলাম, শুধু গরীব না, আমরা মাটিতে মিশে যাচ্ছিলাম।

বাবা ছিলেন পেশাদার ফুটবলার।তবে বয়স হয়ে গেছে, ফুটবল থেকে আয় রোজগার নেমে গেছে শূন্যের কোঠায়।তারপরও ফুটবলারই হতে চাইতেন লুকাকু।তাঁর ভাষায়,বেলজিয়ামের ইতিহাসের সেরা ফুটবলার হতে চাইতাম আমি।ভালো ফুটবলার নয়। বড় ফুটবলার নয়।সবচেয়ে সেরা।’

বুকের মধ্যে ছাঁইচাপা আগুন নিয়ে একেবারেই অল্প বয়সে স্থানীয় লিগে খেলতে শুরু করেন লুকাকু। নিজের বুট ছিল না তাই বাবার বুট পায়ে দিয়েই ১২ বছর বয়সেই ৩৬ খেলায় করে করে ফেলেন ৭৬টি গোল। মায়ের বাবা,মানে নানাভাই ছিলেন লুকাকুর সবচেয়ে আপনজনদের একজন। থাকতেন কঙ্গোতে,যেটি লুকাকুর বাবা-মার আদি বাসস্থান। ৭৬ গোল করার পর একদিন নানাকে ফোন করলেন সুসংবাদটা দেয়ার জন্য। নানা খুশি হলেন। তবে বললেন,আমার জন্য একটা কাজ করতে পারবে রম?’
‘নিশ্চয়ই।’
‘আমার মেয়েটাকে দেখে রেখ।প্লিজ?’
নানার কথাকে সেদিন দুর্বোধ্য ঠেকেছিল লুকাকুর কাছে।তবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাঁর মেয়েকে দেখে রাখবেন। এর ঠিক পাঁচ দিন পর মারা যান লুকাকুর নানা।

এরপর মিউজ আর রাইন নদী দিয়ে বহু জল গড়িয়েছে।আন্ডারলেখট,চেলসি,এভারটন হয়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে থিতু হয়েছেন লুকাকু। নান্দনিক ফুটবলে মন রাঙিয়েছেন সবার, দেশের হয়ে মাথায় পরেছেন গৌরবমুকুট। আর টাকা? রেকর্ড ৯০ মিলিয়ন ইউরো ট্রান্সফার ফি-তে এভারটন থেকে এসেছেন ম্যান ইউতে। তাঁর সাপ্তাহিক বেতন? দুই কোটি টাকা।

অঢেল টাকা আর বিশ্বজোড়া খ্যাতিও লুকাকুকে এখনও সেই ছোট্ট লুকাকুই রেখেছে।‘অর্থ নয়,খ্যাতি নয়, প্রতিপত্তি নয়’–লুকাকুর সবচেয়ে বড় তৃপ্তি তাঁর মাতামহের কাছে দেয়া সেই প্রুতিশ্রুতিটি রাখতে পারা। লুকাকুর ভাষায়,আমার ইচ্ছে করে আর একবার,মাত্র একবার নানাভাইয়ের সাথে ফোনে কথা বলতে। তাঁকে বলতে,দেখেছ?তোমার মেয়েকে আমি সুখে রেখেছি। আমাদের ঘরে আর ইঁদুর ঢোকে না।আমাদের আর মেঝেতে ঘুমাতে হয় না। আর কোনো কষ্ট নেই। আমরা ভালো আছি।...’

দুর্ভাগ্য আর দারিদ্র্যের জোয়াল ভেঙে অনেকেই ধনী হন,বিখ্যাত হন।কিন্তু রোমেলু লুকাকু হতে পারেন ক’জন?

পঠিত : ১৬৭২ বার

মন্তব্য: ০