Alapon

সাইয়েদ নিসার আলী তিতুমীর;অন্ধকারে জ্বলে উঠা আলোক মশাল

চব্বিশ পরগণা জিলার চাঁদপুর গ্রাম। গোবরডাঙ্গা স্টেশন থেকে বারো চৌদ্দ ক্রোশ দূরে। কয়েকমাইল উত্তরে ইতিহাসখ্যাত নারিকেল বাড়িয়া। আর মাত্র দুই ক্রোশ দূরে ইছামতী নদী। এরই মাঝখানের একটি গ্রাম- চাঁদপুর।

১৭৮২ সাল..

দিনটির কথা এখন আর কেউ মনে করতে পারে না। তা না পারুক।

আকাশে সূর্য উঠলে তো সবাই জেনে যায়। তখন চারদিকে কেমন সোনালী আলো। চারদিকে তখন কেবল রোদ্দুরের ঝলকানি। ঠিক তেমনি।

তেমনি অবস্থা হয়েছিল সেদিন। সতেরো শো বিরাশি সালের সেই ঐতিহাসিক দিনটিতে। তাঁর জন্মের মুহূর্তে। ভূমিষ্ট হলেন তিনি।

তিনি মানে- সাইয়েদ নিসার আলী।

বাংলার ইতিহাসের এক আলোকিত পুরুষ।

পলাশীর যুদ্ধ হয়েছিল ১৭৫৭ সালে ২৩ শে জুন। আর নিসার আলীর জন্মগ্রহণ করলেন ১৭৮২ সালে। অর্থাৎ পলাশী যুদ্ধের পঁচিশ বছর পর।

নিসার আলীর পিতার নাম- সাইয়েদ হাসান আলী। আর মায়ের নাম- আবেদা রোকাইয়া খাতুন।

তিনি ভূমিষ্ঠ হলেন চাঁদপুরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তাঁর পূর্বে এই বংশের জন্ম নিয়েছেন বেশ কিছু অলি-দরবেশ। তাঁদের পরিচিতও ছিল অনেক ব্যাপক।

নিসার আলী কোনো অখ্যাত বা মূর্খ পরিবারে জন্ম নেননি। তিনি জন্ম নেননি নাম-নিশানহীন কোনো অজ্ঞাত কৃষক পরিবারেও।

ইংরেজ ঐতিহাসিকরা যে মিথ্যা ইতিহাস তৈরি করেছে তাঁর বংশ সম্পর্কে, তা আদৌ সঠিক নয়। বরং সাইয়েদ নিসার আলীর জন্ম হয়েছিল এমন এক প্রাচীন খান্দানী পরিবারে, যে পরিবারের মান মর্যাদা এবং গৌরব ছিল অনেক-অনেক বেশি।

সাইয়েদ নিসার আলীর সেই ইতিহাসখ্যাত পরিবার এবং বংশের মতো তেমন শ্রেষ্ঠ বংশ আজও আমাদের মধ্যে বিরল।

কিন্তু এতো বড়ো বংশে জন্মগ্রহণ করেও নিসার আলীর মধ্যে এতোটুকু ছিলনা বংশের অহংকার।

শিক্ষাজীবন:-

নিসার আলী যখন জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেই সময়ে মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারে একটি সুন্দর নিয়ম চালু ছিঃল। নিয়মটি হলো- শিশুর বয়স যখন পাঁচ বছর পূর্ণ হতো তখনই তাদেরকে ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া শুরু হয়ে যেত।
সেই প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষা থেকে শুরু করে তিনি অর্জন করেন বিভিন্ন ভাষার উপর অগাধ জ্ঞান, এবং বিভিন্ন বিষয়ে পান্ডিত্য অর্জন করে হয়ে উঠেন সাইয়েদ মীর নিসার আলী।
এছাড়াও তিনি যুদ্ধবিদ্যা সহ নানান শারিরিক কসরত ও খেলাধুলাতেও হয়ে উঠেন পারদর্শী।
তার এই শিক্ষাজীবনে যারা তাঁর পেছনে শ্রম দিয়েছেন তাঁরা হচ্ছেন-মুনশী মুহাম্মদ লাল মিয়া,পণ্ডিত রাম কমল ভট্টাচার্য,হাফেজ নিয়ামতুল্লাহ।

শিক্ষাজীবন শেষ করার পর তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, তাঁর স্ত্রীর নাম- মায়মুনা সিদ্দিকা।

মায়মুনা সিদ্দিকা ছিলেন শাহসুফী মুহাম্মদ আসমত উল্লাহর সিদ্দিকীর পৌত্রী এবং তাঁর সুযোগ্য পুত্র শাহ সুফী ‍মুহাম্মদ রহীমুল্লাহর সিদ্দিকীর আদরের কন্যা।

অসাধারণ এক আল্লাহ প্রেমিকের নাম মির্জা গোলাম আম্বিয়া।মির্জা গোলাম আম্বিয়ার সান্নিধ্যে এসে সম্পূর্ণ বদলে যায় নিসার আলীর ভেতরের সত্তা। বদলে যায় তাঁর আমূল হৃদয়। জেগে ওঠে তাঁর ভেতর ঈমানের আর এক মহান সাগর।

এই সময়ে নিসার আলীর ভেতরের মানুষটি ক্রমাগত ছুটতে থাকে। ছুটতে থাকে দ্রুত গতিতে আলোর খোঁজে।
এরপর তিনি যান মক্কায় হজ্জ করতে।

সেখানে গিয়ে পরিচয় হয় আরেক কিংবদন্তী সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী র সাথে। তিনি নিসার আলী ভেতর জাগিয়ে দেন দেশকে শোষন মুক্ত করার অদম্য শক্তি। সাইয়েদ আহমদ তাঁর প্রিয় শিষ্যের চোখে-মুখে বিশ্বাসের ফুলকী জ্বলে উঠতে দেখলেন। দেখলেন- নিসার আলীর বুকের ভেতর গর্জনমুখর সমুদ্রকে।
তিনি আহ্বান জানালেন তাঁকে জিহাদী ও স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে।

গ্রামে ফিরে এসে তিনি শুরু করলেন তাঁর দাওয়াতী অভিযান।

তিনি সরল সহজ ভাষায় বুঝান সাধারণ মুসলমানকে। বুঝান তাদেরকে সত্য মিথ্যার পার্থক্য।

বুঝান আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের পথ।

তিনি ভাগ্যাহত মুসলমানদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াতেন। তাদের কাছে পৌঁছে দিতেন সত্যের আহ্বান।

নিসার আলীর এই দাওয়াতের মূল কথা ছিল- ইসলামে পরিপূর্ণ আস্থা স্থাপন এবং প্রত্যেকটি কাজকর্মে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা) এর অনুসরণ।
তারপরই নিসার আলী জাগিয়ে তুললেন এক অসামান্য আলোর মিছিল। তাঁর সাথে যুক্ত হলো ধীরে ধীরে হাজার মুক্তিপাগল মানুষ।

যুক্ত হলো তারা নিসার আলীর জীবন জাগানো অবাক মিছিলে।সেই মিছিল কাঁপন ধরিয়ে দিল তৎকালীন শোষক জমিদার, অত্যাচারী নীলকরদের তখতে।
শুরু হল মুক্তি সংগ্রাম, একে একে পরাজিত হতে থাকল জুলুমবাজরা, গড়ে উঠল ঐতিহাসিক বাঁশের কেল্লা।
কম্পন শুরু হয় ইংরেজ দের মসনদে। 
মুখোমুখি হলো কোম্পানী সরকারের সশস্ত্র সৈন্য এবং নিসার আলীর সাথীরা।

সে এক অসম যুদ্ধ!

তবুও একটুও ঘাবড়ালেন না নিসার আলীর সাহসী সৈনিকরা। তাঁরা ক্রমাগত এগিযে গেলেন।

এগিয়ে গেলেন ইংরেজদের কামানের গোলাকে উপেক্ষা করে।

একদিকে ইংরেজদের ভারী কামান, রাইফেল এবং সুশিক্ষিত সৈন্য।

অপরদিকে নিসার আলীর লাঠি, শড়কী ও তীর ধনুকের সজ্জিত একদল জানবাজ দুঃসাহসী বাহিনী।

তারপরও কাঁপলো না মুসলমান বাহিনীর বুক।

তাঁরা তখনো এগিয়ে যাচ্ছেন।

ক্রমাগত সামনে।

এক সময় ইংরেজদের প্রচণ্ড কামানের গোলার মুখে ধ্বংস হয়ে গেল ঐতিহাসিক বাঁশের কেল্লা।

তবুও ভীত সন্ত্রস্ত হলেন না তারা।

আনুগত্য বা আত্মসমর্পণও করলেন না ইংরেজ বাহিনীর কাছে।

নিসার আলী তার সাথীদেরকে জানিয়ে দিলেন, যুদ্ধ চালিয়ে যাও! শাহাদাতই আমাদের সর্বশেষ মঞ্জিল!

নেতার নির্দেশ।

তাঁদের বুকেও ঈমানের সাহসী তুফান।

সেই অশান্ত তুফানে দুলে দুলে উঠছে তাঁদের প্রশস্ত বুক।

তাঁরা ইংরেজ দস্যুদের কামান গোলাকে উপেক্ষা করে সমানে এগিয়ে চলেছেন। এবং তারপর।–

তারপর যুদ্ধ করতে করতে একসময় নিসার আলীসহ অনেকেই ঢলে পড়লেন শাহাদাতের কোমল বিছানায়।

শহীদ হলেন নিসার আলী!

শহীদ হলেন তাঁর পুত্র জওহর আলী ও আন্দোলনের অন্যতম নায়ক ময়েজউদ্দীন।

এভাবে একে একে শহীদ হলেন পঞ্চাশ জন তেজদীপ্ত সৈনিক।

ইংরেজদের হাতে বন্দী হলেন সাড়ে তিনশো বীর মুজাহিদ।এদের মধ্যে প্রধান সেনাপতি- নিসার আলীর ভাগ্নে গোলাম মাসুমকে প্রাণদণ্ড দেয়া হয়েছিল।

এগার জনের যাবজ্জীবন এবং একশো আঠাশ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল।

বিচারকালে চার জনের মৃত্যু হয় এবং তিপ্পান্ন জন খালাস পায়।
নিসার আলীর প্রধান সেনাপতি গোলম মাসুমকে গ্রেফতার করার পর তাঁকে দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে বলা হয়েছিল।

গোলাম মাসুম ইংরেজদের এই প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলেন।

এরপরই কেল্লার পুবপশে গোলাম মাসুমকে ফাঁসি দিয়ে শহীদ করা হয়।

এই যুদ্ধ সম্পর্কে ইংরেজ সেনাপতি মেজর স্টক আফসোসের সাথে মন্তব্য করে বলেছেন:

“যুদ্ধে আমরা জয়ী হয়েছি ঠিকই। কিন্তু এতে প্রাণ দিয়েছেন একজন ধর্মপ্রাণ দেশপ্রেমিক মহাপুরুষ।”

স্কটের এই ছোট্ট মন্তব্যটি অবশ্যই ব্যাপক বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

ইংরেজদের সাথে নিসার আলীর এই সর্বশেষ অসম মহা সংঘর্ষটি বাধে ১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর।
ফজর নামাযের পর।

তিনি বাঁশের কেল্লা তৈরি করে স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে বলেন, “একটু পরেই হয়তো আমরা ইংরেজদের আক্রমণের শিকার হবো। তবে এতে ভয় পেলে চলবে না। এই লড়াই শেষ লড়াই নয়। আমাদের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েই এ দেশের মানুষ একদিন দেশ উদ্ধার করবে। আমরা যে লড়াই শুরু করলাম, এই পথ ধরেই একদিন দেশ স্বাধীন হবে। আজ থেকে প্রায় পৌনে দুশ’ বছর আগে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য তিতুমীর প্রথম যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। বীর তিতুমীর তার বীরত্বের জন্যই ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন। জীবনের বিনিময়ে তিনি সত্যের পথে লড়াই করলেন। তাঁর এই দৃঢ়তা ও অনবদ্য প্রেরণা আজও বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমানকে অনুপ্রাণিত করে, 
শেষ হয়ে যায় একটি সংগ্রামের অধ্যায়, কিন্তু এর অনুপ্রেরণা রচনা করে দিয়ে যায় অজস্র সংগ্রাম ও চূড়ান্ত সফলতার অধ্যায়...

তথ্যসূত্র:-
১.সাইয়েদ নিসার আলী তিতুমীর-মোশাররফ হোসেন খান


পঠিত : ১৭৩৬ বার

মন্তব্য: ০