Alapon

পিরি রইসঃ যিনি সন্ধান দেন নতুন বিশ্বের

পিরি রইস নামে পরিচিত হাজী আহমেদ মহিউদ্দিন পিরি ছিলেন মহান উসমানী সাম্রাজ্যের নৌবাহিনীর এডমিরাল যার অংকিত বিশ্ব মানচিত্রই হচ্ছে তুর্কি এটলাসের সবচেয়ে পুরাতন মানচিত্র যা এক নতুন বিশ্বের সন্ধান দেয়। এই বিশ্ব মানচিত্র এখনো আমেরিকায় পুরাতন মানচিত্র হিসেবে বিদ্যমান।  


ছবিঃ পিরি রইসের অংকিত মানচিত্র

উসমানী আর্কাইভে পিরি রইসের পরিচয়ঃ
তুর্কি আর্কাইভ খুঁজে পাওয়ার আগ পর্যন্ত পিরি রইসের পরিচয় সমন্ধে খুব কম মানুষই জানতো। তুর্কি আর্কাইভের  তথ্যানুসারে জানা যায় পিরি রইসের সম্পূর্ণ নাম হাজী আহমেদ মহিউদ্দিন পিরি। তিনি জন্ম গ্রহণ করেছিলেন  উসমানী সাম্রাজ্যের ইসলামী অংশ গেলিবলুতে অথবা তার পিতার জন্মস্থান মধ্য আনাতুলিয়ার কারামানে। যদিও তার জন্মের সঠিক সময় জানা যায়নি তথাপি ঐতিহাসিকগণ ধারণা করেছেন উনার জন্ম হয়েছে ১৪৬৫-১৪৭০ এর মাঝামাঝি সময়ে।

পদাঙ্ক অনুসরণঃ
পিরি রইসের চাচা কামাল রইস ছিলেন প্রখ্যাত সমুদ্র বিশারদ ও জলদস্যু। তিনি ১৪৯৫ সালে তুর্কি নৌবাহিনীর এডমিরাল হিসেবে নিয়োগ পান। চাচার পদাঙ্ক অনুসরণ করে পিরি রইস ১৪৮১ সালে তুর্কি নৌবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগদান করেন।  তিনি চাচার সাথে ১৪৯৯ সালের জনশিও ও ১৫০০ সালের মডন যুদ্ধে তুরস্কের পক্ষে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৫১১ সালে মিশরে যাওয়ার পথে ঝড়ের কবলে পড়ে ভূমধ্যসাগরে জাহাজ ডুবিতে উনার চাচা কামাল রইসের মৃত্যু হয়। ফলে সব কিছুই খানিক পরিবর্তন হয়ে যায়। এই ঘটনার পর তিনি গুলিবলুতে ফিরে এসে নৌ চালনাবিদ্যা অধ্যয়নে আত্মনিয়োগ করেন।

ক্রিস্টোফার কলম্বাস ও অন্যান্য ম্যাপঃ
গেলিবলুতে ফিরে এসে নেভিগেশনের উপর মনঃসংযোগ করার পর ৯১৯ হিজরীর মহরম মাসে (৯মার্চ- ৭ এপ্রিল, ১৫১৩) তিনি প্রথমবারের মত পৃথিবীর মানচিত্র প্রণয়ন করেন।  প্রথম পৃথিবীর মানচিত্রে সাহারাকে কর্কটক্রান্তিরেখা ও অক্ষাংশের কেন্দ্রবিন্দু বিবেচনা করা হয়। বর্তমানে অরিজিনাল মানচিত্রের এক তৃতীয়াংশ টিকে আছে বাকী অংশ এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। আর্কাইভস থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায় পিরি রইস প্রায় ২০ টি মানচিত্রের সাহায্য নিয়েছিলেন। তার মাঝে ছিল টলেমিক ৮ টি, পর্তুগিজ ৪ টি, ও একটি আরবীয়। এ মানচিত্রের মাঝে ক্রিস্টোফার কলম্বাসেরও একটি ম্যাপ ছিল। এ  ম্যাপটি কামাল পিরি যখন ১৫০১ সালে স্পেনের ভ্যালেন্সীয়ার উপকূলে সাতটি জাহাজে হামলা চালিয়েছিলেন তখন পেয়েছিলেন।


ছবিঃ পিরি রইসের অংকিত মানচিত্র

তার অঙ্কিত প্রথম ম্যাপটি ১৯২৯ সালে জার্মান ধর্মতত্ত্ববিদ গোস্তাভ এডলফ ডায়েসম্যান তুপকাদি প্রাসাদে আবিষ্কার করেন। এই ম্যাপটি ১৫১৭ সালে কায়রোতে ১ম  সুলতান সেলিমের নিকট পাঠানো হয়েছিল। সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হল এটিই ছিল প্রথম উসমানী ম্যাপ যেখানে আমেরিকার অবস্থান ও নতুন পৃথিবীর অবস্থানও দেখানো ছিল। ম্যাপে ইউরোপের কিছু অংশ, পশ্চিম আফ্রিকান উপকূল, পূর্ব, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা, আটলান্টিক দ্বীপপুঞ্জ ও মহাসাগরের বিবরণ  ছিল। ম্যাপে দক্ষিণ আমেরিকার পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা দেওয়া ছিল। ম্যাপটি সে সময়ের চলমান পোর্টোলান চার্ট পদ্ধতিতে অঙ্কিত  হয়েছিল। ম্যাপে অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ রেখা কম্পাস অনুপাতে সাজানো হওয়ায় দিগন্তরেখা খুঁজে পাওয়া সহজ ছিল।


ছবিঃ পিরি রইসের অংকিত মানচিত্র

কিতাব ই বারিয়া, দি বুক অব নেভিগেশনঃ
সম্ভবত আধুনিক পূর্ব এই বিখ্যাত নৌচালনা বিদ্যার বই কিতাব ই বা'রিয়াতে শুধুমাত্র নৌচালনার বিস্তারিত বিবরণীই ছিলোনা এমনকি ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী  নগর ও বন্দরের পরিপূর্ণ বিবরণীও দেওয়া ছিল। ভূমধ্যসাগরে অবস্থিত সকল প্রধান বন্দর, উপসাগর, অন্তরীপ, উপদ্বীপ, প্রণালী ও সুরক্ষিত পোতাশ্রয় সমূহের বিস্তারিত বিবরণ এ বইয়ে বিদ্যমান ছিল। এ ছাড়াও বইটি বিভিন্ন বিষয় যেমন নৌ চালনার দক্ষতা অর্জন ও নৌ চালনার সাথে সম্পর্কিত মহাকাশীয় তথ্যভাণ্ডারে সমৃদ্ধ ছিল।  বইটিতে প্রতিটি শহর ও নগরের জনগণের তথ্য ও তাদের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির নানান তথ্যে ভরপুর ছিল। ধারণা করা হয় মূল কিতাব ইই ববা'রিয়া বইটি লিখা হয়েছিল ১৫১১-১৫২১ সালের মাঝে আর সংশোধিত ও কারুকার্য খচিত তথ্য বিবরণী পরিমার্জিত রূপে ১৫২৪-১৫২৫ সালে বইটি প্রকাশ করা হয়।


ছবিঃ পিরি রইসের অংকিত মানচিত্র

চাচা কামাল রইসের সাথে ভূমধ্যসাগরে ভ্রমণের সময় পিরি রইস এই চার্টগুলো প্রণয়ন করেছিলেন, পরিমার্জিত বইয়ের পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ৪৩৪ যার ২৯০ পৃষ্ঠাই সাজানো হয়েছিল বিভিন্ন মানচিত্র দিয়ে। কিতাব ই বা'রিয়া প্রধানত দুইটি ভাগে বিভক্ত ছিল। প্রথম অংশে বিভিন্ন ঝড়ের প্রকৃতি, কম্পাসের ব্যবহার, বন্দর ও উপকূলের বিবরণ সহ পোর্টোলেন চার্ট, নক্ষত্রের সাহায্যে দিক নির্দেশনার উপায়, প্রধান মহাসাগর ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের প্রকৃতি ইত্যাদির পরিপূর্ণ বিবরণ সন্নিবেশিত ছিল। এ অংশে তিনি ভাস্কো ডা গামা ও ক্রিস্টোফার কলম্বাসের নব আবিষ্কারের কথাও উল্লেখ করেছেন।  দ্বিতীয় অংশে পোর্টোলেন চার্ট ও জাহাজ পরিচালনার বিস্তারিত বর্ণনার সন্নিবেশ ঘটানো হয়েছে। ভালো করে বুঝার জন্য প্রতিটি অধ্যায়ে দ্বীপ ও উপকূল সমুহের বিস্তারিত মানচিত্রাবলি সংযোজিত ছিল।  

মৃত্যুদণ্ড
১৫২৮ সালের পর রহস্যজনকভাবে পিরি রইস নিখোঁজ হন, পরবর্তীতে তিনি সুয়েজ নৌঘাঁটির কমান্ডার হিসেবে আবির্ভূত হন। হরমুজ ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল দখলে ব্যর্থ হওয়ায় সুলতান সুলাইমানের নির্দেশে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কায়রোতে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। যদিও পিরি রইসের বিদেহী আত্মা এ পৃথিবী ছেড়ে গেছে কিন্তু কর্মের মাঝে তিনি অমর হয়ে আছেন।

পঠিত : ৩৪৩৬ বার

মন্তব্য: ০