Alapon

আল-ফারগানিঃ চাঁদের আগ্নেয়গিরি যে মুসলিম বিজ্ঞানীর নাম

আবু আল আব্বাস আহমাদ ইবনে মোহাম্মাদ ইবন কাসির আল-ফারগানি/ফারঘানি (৮০০/৮০৫-৮৭০) যিনি পশ্চিমা বিশ্বে আলফ্রাগানুস নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন একজন আরব অথবা পারস্যের একজন সুন্নি মুসলিম জ্যোতির্বিদ। নবম শতাব্দীতে তিনি ছিলেন বিশ্বের খ্যাতনামা একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী। চাঁদের আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ আলফ্রাগানুস এর নামকরণ তার নামেই করা হয়েছে।

বাগদাদে ৭ম আব্বাসীয় খলিফা আল-মামুন এর পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত পৃথিবীর ব্যাস নির্ণয়ের কাজে নিয়োজিত বিজ্ঞানীদের দলে তিনিও ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি কায়রো চলে যান। ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পুরোনো কায়রোয় গ্রেট নাইলোমিটারের নির্মাণ কাজে আল-ফারগানি তত্ত্বাবধান করেন।

আমরা আজ পৃথিবী নামের যে গ্রহটিতে বসবাস করছি, সে গ্রহ সম্পর্কে আমাদের জানা নানা দিককেন্দ্রিক। কিন্তু এক সময় মানুষ পৃথিবী নামের গ্রহটির ব্যাস কত, তাও জানতো না। প্রথম মানুষ কী করে এর ব্যাস সম্পর্কে জানলো, তা নিয়ে কখনও আমরা কী ভেবে দেখেছি? আর এও কি জানি, একাজটি প্রথম সম্পাদন করেন একজন মুসলিম বিজ্ঞানী। এই বড় মাপের আবিষ্কারটি করেন আবুল আব্বাস আহমেদ ইবনে-মোহাম্মদ ইবনে কাত্তির আর-ফারগানি। তিনি জন্মেছিলেন ট্র্যান্স অক্সিয়ানার ফারগানায়। ফারগানা হচ্ছে তাসখন্দের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি উপত্যকা। তাঁর জন্ম তারিখ জানা যায় নি। তবে ঐতিহাসিক দলিলপত্র ঘেটে জানা যায়, তিনি খলিফা আল-মামুনের অধীনে একজন জ্যোতির্বিদ ছিলেন।

আল ফারগানি জ্যোতির্বিজ্ঞান অধ্যয়নে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত সুদক্ষ প্রকৌশলী। ফারগানি দেখিয়েছিলেন, পৃথিবী নামের গ্রহের ব্যাস ৬৫০০ মাইল। তিনি অন্যান্য গ্রহের ব্যাসও মাপতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি সবচে’ দুরের ইন্টার-প্ল্যানেটারী ডিসটেন্স বা আন্তঃগ্রহের দূরত্ব পরিমাপ করেছিলেন।

সৌর ব্যবস্থায় গ্রহ-উপগ্রহ কীভাবে পরিভ্রমণ করছে, তার ওপর একটি বই লিখে গেছেন তিনি। সেখানে তিনি ছায়াপথ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। এটি এ ক্ষেত্রে একটি অনন্য বই। বইটির নাম ‘জাবামি লিম আল নুজম’। দ্বাদশ শতকে এই বইটি লাতিন ভাষায় অনূদিত হয়। এটি ‘এলিমেন্টস অব স্ট্রোনমি’ নামে সুখ্যাতি অর্জন করে। দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপে এটি ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানের এক অন্যতম প্রধান বই। বলা যায় প্রতিনিধিত্বশীল বই। তার সবচে’ বিখ্যাত বই হচ্ছে জামি বা Jhamee। এর অর্থ elements। তাঁর অন্য দু’টি বিখ্যাত বইয়ের একটি ‘কিতাব আল ফাসুল ইখতিয়ার আল মাজিস্টি’ অথবা ‘The book of Chapreens’।

এটি আল মাজিস্ট-এর সার সংক্ষেপ। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ‘কিতাব আল আইরুখামাত’ অথবা Book on the Construction of Sun-dials। সবগুলো বই-ই লাতিন ভাষায় ভাষান্তর হয়েছে। পরবর্তী সময়ের ইউরোপীয় জ্যোতির্বিদেরা তাঁর এসব অনুবাদিত বইয়ের কাছে ব্যাপকভাবে ঋণী। ৯৬৭ খৃস্টাব্দে আবদুল আজিজ আল কারিমী ফারগানির বই ‘জামি’ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। এর পাণ্ডুলিপি ইস্তাম্বুল জাদুঘরে এখনও পাওয়া যায়। একজন প্রকৌশলী হিসেবে ফারগানি তত্ত্বাবধান করেছিলেন পুরোনো কায়রোর আল ফুসটাট-এর Great Nilometer-এর নির্মাণ কর্ম। এই নিলোমিটার ছিল ট্রাইগ্রিস থেকে পানি আনার একটি খাল খনন পরিকল্পনা।

এ খাল কাটা শেষ হয় ৮৬১ খৃষ্টাব্দে। খলিফা মুতাওয়াক্কুল এ খাল খননের আদেশ দিয়েছিলেন। এটা ছিল অবাক করা এক প্রকৌশল কর্ম। তখন পানি প্রবাহের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের প্রয়োগ ঘটেনি। খলিফা মুতাওয়াক্কুলকে ইতিহাসে অভিহিত করা হয় Niro of the Arabs বা আরবের নিরু। তাকে হত্যা করা হয় ৮৬১ খৃষ্টাব্দে। ফারগানি প্রকৌশল ও প্রযুক্তিকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁকে বলা হয়- Pioneer in Applied Engineering বা ফলিত প্রকৌশলের অগ্রদূত।

এই মহান বিজ্ঞানীর শেষ জীবনের দিনগুলো সম্পর্কে জানা যায়নি। তবে তিনি সাফল্যের সাথে খলিফা মুতাওয়াক্কুলের নির্যাতন মোকাবিলা করেছিলেন। তিনি অদম্যভাবে বরাবর চলে গেলেন জ্ঞানার্জনের পথে।

তথ্যসূত্র: 
1. Science, The Cambridge History of Islam, Vol. 2, ed.
2. Sir Patrick Moore, The Data Book of Astronomy,CRC Press,2000,BG 48ref Henry Corbin, The Voyage and the Messenger: Iran and Philosophy, North Atlantic Books, 1998, pg 44
3. Texts, Documents and Artefacts: Islamic Studies in Honour of D.S. Richards.

পঠিত : ১৪১৩ বার

মন্তব্য: ০